post

জান্নাতের দোলনায় শহীদ এনামুল হক

২৭ জানুয়ারি ২০১৪

মুহাম্মদ তারেক হোসাইন

Shahidশহীদ আব্দুল মালেকের শাহাদাতের খবর শুনে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী রহ: বলিষ্ঠকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আবদুল মালেক এই দেশের প্রথম শহীদ হতে পারে কিন্তু শেষ নয়।’ মাওলানার চিরন্তন সত্য ঘোষণাকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশের যুবকেরা। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া লোহাগাড়ায়ও আওয়ামী বাকশালীদের হাতে বিগত পাঁচ বছরে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেছেন শহীদ হাকিম আলী, শহীদ কামাল উদ্দীন, শহীদ ছালেহ আহমদ, শহীদ আকতার কামাল সাগর, শহীদ মিছবাহ উদ্দীন, শহীদ আবু তাহের, শহীদ ওসমান গণি, শহীদ শহীদুল ইসলাম, শহীদ হারুনর রশিদ, শহীদ মঈনুদ্দীন মুন্না, শহীদ মাহফুজুর রহমান। তাদের পথ ধরেই শাহাদাতে সিক্ত দ্বীনের উর্বর ভূমি লোহাগাড়াতেই শহীদি মিছিলে এগিয়ে এসেছেন অনন্ত জীবনের শান্তির প্রত্যাশায় শহীদ এনামুল হক লালু। শহীদি মিছিলে উজ্জ্বল তারকা শহীদ এনামুল হক শুধুমাত্র একজন ভালো ছাত্রই ছিলেন না বরং তিনি দ্বীনের একজন বলিষ্ঠ মুজাহিদ ছিলেন। ৫ জানুয়ারি বাকশালের নবরূপ প্রহসনের নির্বাচন। সাতকানিয়া লোহাগাড়ার সাধারণ জনগণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে কথিত নির্বাচনকে। বড়হাতিয়া ইউনিয়নের ভবানীপুর স্কুল কেন্দ্রে নির্বাচনী দায়িত্বরত শিক্ষকদের ওপর বিকেল ৩টার দিকে সশস্ত্র আক্রমণে এগিয়ে আসে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। আক্রান্তদের নিরাপত্তায় এগিয়ে যায় স্থানীয় জনগণসহ শিবিরকর্মীরা। আওয়ামী সন্ত্রাসীদের প্রত্যক্ষ মদদে পুলিশ ও বিজিবি হঠাৎ মুহুর্মুহু গুলি বর্ষণ করে শান্তিপূর্ণ অবস্থানরত নিরীহ শিবিরকর্মীদের ওপর। অসংখ্য গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান প্রিয় ভাই এনামুল হক লালু, তার চাচাতো ভাই সদস্য প্রার্থী গিয়াস উদ্দীন, কর্মী ইমরান ভাইয়ের পবিত্র দেহ। সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন প্রিয় এনামুল। বাঁচার জন্য সর্বশেষ আকুতি জানাতে থাকেন। এইবার এজিদের উত্তরসূরি আওয়ামী নরপিশাচরা আক্রমণে এগিয়ে আসে। রক্তাক্ত এনামুলের শরীরে বর্বরোচিত কায়দায় পুলিশ-বিজিবির সামনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা লাঠি ও হকিস্টিক দিয়ে সারা শরীরে এলোপাতাড়ি আঘাত করে স্পটেই মৃত্যু নিশ্চিত করে। এভাবে ফুটফুটে সুন্দর চৌকস লালু ভাইয়ের জীবনটুকু হায়েনারা কেড়ে নেয়। সবার সামনেই ১৭ বছরের এই কিশোর সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চলে যান জান্নাতের পথে। শহীদ এনামুল হক ছিলেন পরিবারের ৪ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। বড়হাতিয়া এশায়াতুল উলুম ফাযিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী এবং হাদুর পাড়া আবাসিক শাখার সভাপতি ছিলেন। বড়ভাই অল্প পড়ালেখা করেই বিদেশে পাড়ি জমান। শহীদ এনামুলকে ঘিরেই পরিবারের ছিল অনেক স্বপ্ন, অনেক আকাক্সক্ষা। কিন্তু নরঘাতকেরা সে স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি। ফুটতে দেয়নি একটি স্বপ্ন গোলাপ। কলিতেই তাকে নিষ্প্রাণ করে দিয়েছে। একটি সম্ভাবনাময় জীবন, একটি লাশ, একঝাঁক শোকাহত বিপ্লবী জনতা, একটি শহীদের মিছিল, সর্বশেষ মায়ের আহাজারি। এতেই কি শহীদ এনামুলের জীবনচক্রের পরিসমাপ্তি? না। বাঁধভাঙা জোয়ারের মত এগিয়ে যাবে শহীদের এই কাফেলার মিছিল নির্দিষ্ট মঞ্জিলে। লোহাগাড়ার মাটিতেই ছাত্রশিবিরের প্রথম শহীদ। রচিত হলো সর্বোচ্চ ত্যাগের ইতিহাস। স্থাপিত হলো বিপ্লবের ভিত্তি। বিগত পাঁচ বছরেই সাতকানিয়া লোহাগাড়ায় ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের ওপর চালানো হয় অবর্ণনীয় ও অমানবিক নির্যাতন। গ্রেফতার করেছে প্রায় সাত শতাধিক নেতাকর্মী। এখনো দুই শ’ জন বন্দী। গ্রেফতার করেছে জেলা ও উপজেলার প্রথম সারির দায়িত্বশীলদের। শহীদের তালিকা হচ্ছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। ১২টি জীবন্ত গোলাপ পাড়ি জমিয়েছে মহান প্রভুর দরবারে। আহতদের সংখ্যাও বর্ণনাতীত। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া, লুটপাট, শতাধিক মিথ্যা মামলা আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। আকাশে বাতাসে কান পাতলেই শুনতে পাই মজলুমের আহাজারির করুণ সুর। তবুও ময়দানের জনশক্তিরা আশাহত হয়নি আজো। এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থেকে মুক্ত হতে সাধারণ মানুষসহ প্রতিটি প্রাণী আল্লাহর কাছে ফরিয়াদরত। জুলুম নির্যাতন আর রক্তের হোলি খেলা থেকে বাঁচতে অসংখ্য মজলুমের গভীর রজনীতে চোখের পানি ও হাজারো আকুতি তার প্রভুর দয়ার সাগরে জোয়ার তুলতে পারেনি? নিশ্চয়ই পেরেছিল! কারণ মুমিনের চেষ্টার সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সহযোগিতা অবশ্যম্ভাবী। প্রশাসনের সমস্ত যন্ত্র এমনকি রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদীয় সন্ত্রাসের মোকাবেলায় এই কাফেলার পক্ষে আল্লাহর সাহায্য ছাড়া এক মুহূর্তের জন্য টিকে থাকা সম্ভব নয়। এখনও প্রতিদিন শুনতে হয় কোথাও আক্রমণ, আহত ও শাহাদাতের সংবাদ। শাহাদাতের মিছিল নিয়মিত দীর্ঘ হচ্ছে। কী অপরাধ নিষ্পাপ ভাইদের? কেন অসংখ্য এনামের মায়ের বুক খালি হচ্ছে? কেন এনামের পিতা হলেন সন্তানহারা। নির্দয় পুলিশ বাহিনী! শহীদ এনামের মায়ের দিকে তাকাও। শুধু তোমাদের জন্যই সন্তানহারা হলেন প্রিয় মা। শ্রদ্ধেয় পিতার পড়–য়া সন্তানকে আদর ¯েœহ দিয়ে বড় করতে দিলে না। নিষ্পাপ ছোট ভাইবোনদের ¯েœহ বঞ্চিত করেছ। পবিত্র কুরআনের সূরা বুরুজে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘তাদের অপরাধ তো একটাই, তারা মহান আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে।’ মূলত ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য শাহাদাত একটা লোভনীয় বিষয়। বর্তমানে পাহাড়সম মুসিবত আসলে মানবীয় সীমাবদ্ধতার সমীকরণে আমাদের মনে হয়, এই আন্দোলন, কাফেলার অগ্রযাত্রা শেষ হচ্ছে, অযোগ্য ব্যক্তিদের চেষ্টায় আর কতদূর যাবে... ইত্যাদি। কিন্তু এই অসত্যের কালো মেঘ কেটে দু’দিন পর আবার যখন সোনালি সূর্যের কিরণ ছড়িয়ে সত্য উদ্ভাসিত হয়। তখন মনে পড়ে ওহুদ, খন্দক যুদ্ধে নিরস্ত্র মানুষগুলোকে যে আল্লাহ সাহায্য করেছিলেন। তিনি তার ওয়াদা আজো পূরণ করে যাচ্ছেন। প্রতিটি মুহূর্তেই বর্ষণ হচ্ছে অপার সাহায্যের অকল্পনীয় ধারা। কারা নির্যাতিত ও জীবন্ত শহীদরা যখন অসুস্থ শরীর নিয়ে নারায়ে তাকবির শ্লোগান দেয়। তখন সকলেরই মাঝে এক নব উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। জানা যায় আগত হাজার হাজার শোকাহত জনতার গগণবিদারী আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে দ্বীন কায়েমের বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে জানাজা শেষ হয়। জানাযায় উপস্থিত হন শিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ সদস্য ও চট্টগ্রাম মহানগরী দক্ষিণের সভাপতি এইচ এম সোহেল, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সভাপতি মুহাম্মদ তারেক হোছাঈন, জেলা সেক্রেটারি আসাদ উল্লাহ আদিলসহ নেতৃবৃন্দ। শহীদ এনামুলের প্রতিটি রক্তের খুন, বাতিলের বুকে ছড়াবে আগুন। এই আগুনের লেলিহান শিখায় দুনিয়া এবং আখেরাতে দাউ দাউ করে জ্বলতে হবে। আর এই রক্তের ফোঁটা বিপ্লবীদের জন্য তৃষ্ণা নিবারক। এইভাবে হত্যা করে শেষ করতে চায় ছাত্রশিবিরের বিশাল কাফেলাকে। কিন্তু শাহাদাত যাদের প্রিয় ঠিকানা তাদেরকে কেউ কখনো পরাস্ত করতে পেরেছে? পারেনি বদরে, পারেনি ওহুদে, পারেনি তাবুকে, পারেনি সিন্ধুতে, তেমনি পারেনি ওরা বাংলার সবুজ জমিতে, পারবে না, ইনশাআল্লাহ। কাফেলা কেবল এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে। আর বেড়েছে ওদের মর্মযাতনা আর গাত্রদাহ। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, চট্টগ্রাম জেলা দক্ষিণ [email protected]

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির