post

ডাকসু নির্বাচন ২৮ বছরের দায় শোধ হলো না । তারিক আহমেদ

০২ এপ্রিল ২০১৯

ডাকসু নির্বাচন ২৮ বছরের দায় শোধ হলো না । তারিক আহমেদ২৮ বছরে জমে ছিল অনেক দেনা, অনেক পাওনা। বুক ভরা আশা শিক্ষার্থীদের ডাকসু নির্বাচন হবে। এই ডাকসু তাদের কথা বলবে। শত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২৮ বছর পর এলো সেই দিন। কিন্তু কি হলো সে দিন? বুক ভরা আশা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে। প্রহসনের নির্বাচনে কেমন নেতৃত্ব গড়ে ওঠে? প্রশ্ন রয়ে গেলো অনেক। হয়তো উত্তরও আমরা জানি। কিন্তু এমন কেন হলো। তাইতো ২৮ বছরের দায় এই নির্বাচনে শোধ হলো না। অনেকের মনেই প্রশ্ন ‘ডাকসু মানে কী?’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ সংক্ষেপে (ডাকসু) বলা হয়। ইংরেজিতে বলা হয় Dhaka University Central Students Union (DUCSU) ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে। ১৯২২ সালের ১লা ডিসেম্বর কার্জন হলে অনুষ্ঠিত শিক্ষকদের একটি সভায় ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ’ নামে একটি ছাত্র সংসদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯২৩ সালের ১৯ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন নির্বাহী পরিষদ পূর্বোল্লিখিত শিক্ষক সভার সিদ্ধান্তকে অনুমোদন দেয়। ১৯২৫ সালের ৩০ অক্টোবর সংসদের সাধারণ সভায় খসড়া গঠনতন্ত্র অনুমোদন করা হয়। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পরিষদ অনুমোদন করলে তা কার্যকর হয়। প্রথমবার ১৯২৪-২৫ সালে সম্পাদক ছিলেন যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, পরের বছর অবনীভূষণ রুদ্র। পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে পূর্বনাম পরিবর্তন করে বর্তমান নাম ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ’ গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ডাকসুর সহসভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন থেকে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মাহবুব জামান। সর্বশেষ ১৯৯০-৯১ সেশনের জন্য সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে যথাক্রমে নির্বাচিত হন ছাত্রদলের আমানউল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৩৭ বার নির্বাচন হয়েছে। লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রথম আলো পত্রিকায় ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে ছাত্র সংসদ হলো’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। তিনি সেখানে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদগুলোর ইতিহাস অতি গৌরবের। উপমহাদেশে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ ছিল সবচেয়ে সুসংগঠিত। সেটি গঠনের পেছনে যার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি, তিনি সেখানকার ইতিহাসে তরুণ শিক্ষক আহমদ ফজলুর রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি ইতিহাসের রিডার হিসেবে যোগ দেন এবং নিযুক্ত হন মুসলিম হলের প্রভোস্ট। তাকে উপাচার্য ফিলিপ জে হার্টগ ভেবে দেখতে অনুরোধ করেন আলীগড়ের মতো ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকায় গঠন করা যায় কি না। তিনি দেড় মাসের মধ্যে তার হলের ছাত্র সংসদ গঠনের উদ্যোগ নেন। সেটার নাম দেন তিনি ‘মুসলিম হল ইউনিয়ন সোসাইটি’। এক বছর পর ‘সোসাইটি’ শব্দটি বাদ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্র সংসদটি গঠিত হয়েছিল নিখুঁত গণতান্ত্রিক উপায়ে। প্যানেল ছিল তিনটি। সহসভাপতি (ভিপি) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনজন : আবদুল আজিজ, রহিম উদ্দিন শাহ ও সৈয়দ আলী। সাধারণ সম্পাদক পদে মিজানুর রহমান, নেফাজউদ্দিন খান ও আশরাফ উদ্দিন আহমদ। কারচুপি শব্দটি তখন বাংলা ভাষায় ছিল না। নির্বাচনে বিজয়ী হন ভিপি পদে আবদুল আজিজ এবং সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান। ১৯২১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মুসলিম হল ইউনিয়নের অভিষেক হয়। পূর্ব বাংলার ইতিহাসে সে এক স্মরণীয় ঘটনা। সভাপতিত্ব করেন পদাধিকারবলে ইউনিয়ন সভাপতি এ এফ রহমান এবং প্রধান অতিথি ছিলেন উপাচার্য হার্টগ। সম্পাদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম আনন্দঘন অনুষ্ঠানটি শেষ হতে ‘রাত প্রায় সাড়ে ১০টা’ বেজে যায়। অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেছিলেন হাউজ টিউটর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ইতিহাস বিভাগের প্রধান রমেশচন্দ্র মজুমদার এবং ঢাকা হলের প্রভোস্ট জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ। কালাচাঁদ গন্ধবণিকের দোকানের খাঁটি ছানার সব মিষ্টি অভিষেক অনুষ্ঠানে সদ্ব্যবহার করা হয়। যারা পরাজিত হয়েছিলেন, মিষ্টির ভাগ থেকে তারা বঞ্চিত হননি। কয়েক মাস পরে গঠিত হয় জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের উদ্যোগে ঢাকা হল ইউনিয়ন এবং রমেশচন্দ্র মজুমদার ও নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের উদ্যোগে জগন্নাথ হল ইউনিয়ন। ১৯২২-২৩ সালে মুসলিম হল ইউনিয়নের ভিপি নির্বাচিত হন মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম এবং সাধারণ সম্পাদক আবদুল গফুর। তিনটি হল ইউনিয়ন গঠিত হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন গঠিত হয় একটু দেরিতে। সভাপতি পদাধিকারবলে উপাচার্য হার্টগ। প্রথমবার ১৯২৪-২৫ সালে সম্পাদক ছিলেন জে এন সেনগুপ্ত, পরের বছর অবনীভূষণ রুদ্র। ১৯২৯-৩০ সালে সেক্রেটারি নির্বাচিত হন আতাউর রহমান খান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নামকরণ হয় ১৯৫৩-৫৪ সালে। প্রথম ভিপি ছিলেন এস এ বারি এবং জেনারেল সেক্রেটারি জুলমাত আলী খান। দু’জনই বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন’। সংশোধিত গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ডাকসুতে ২৫টি পদ রয়েছে। এতে উপাচার্য পদাধিকার বলে সভাপতি হবেন। হল সংসদে ১৩টি পদ রয়েছে। সেখানে প্রাধ্যক্ষ পদাধিকারবলে সভাপতি হবেন।

ডাকসুর প্রয়োজনীয়তা ডাকসু হলো শিক্ষার্থীদের কথা বলা, দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য অন্যতম প্লাটফর্ম। বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু শিক্ষকরা নিয়ন্ত্রণ করলে, সেখানে ছাত্রদের অধিকার খর্ব করা হয়। তার প্রমাণ বর্তমান বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অবস্থা। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন হলে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। অথচ বাজেটে আবাসন সংকটে গুরুত্ব না দিয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন দেয়া হয় মোট বাজেটের ৮০%। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে ৫ জন ছাত্র প্রতিনিধি থাকার কথা থাকলেও ডাকসু না হওয়ায় কোনো ছাত্র প্রতিনিধি থাকে না, ফলে ছাত্রদের দাবি উত্থাপন করার কেউ থাকে না। ডাকসুর উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয় ‘সাংস্কৃতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করা।’ ডাকসুর উদ্দেশ্য যাই থাকুক এই ডাকসুর নেতৃবৃন্দ রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছেন বেশি। বাংলাদেশের জন্মের আগে এবং পরে বিভিন্ন সংকটকালে নেতৃত্ব দিয়ে সমাধান করেছে এই ডাকসু। যার প্রমাণ ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১ এবং ১৯৯০-এর মতো জনগণের পাশে ছিল এই ডাকসু। আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯০ সালের পর ডাকসু নির্বাচন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জাতীয় নেতৃত্ব তৈরি হয়নি। পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ কী কাজ করতো এর একটি ধারণা পাওয়া যায় ‘সৈয়দ আবুল মকসুদ’-এর লেখায়। ১ এপ্রিল ২০১৯ সালে প্রথম আলোতে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে ছাত্র সংসদ হলো’ লেখায় তিনি বলেন, ‘প্রথম দুই দশক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ এবং হল ইউনিয়নগুলোর কাজ ছিল জ্ঞানচর্চা, আত্ম-উন্নতির উপায় উদ্ভাবন এবং সমাজসেবামূলক। তারা সান্ধ্য বিদ্যালয় পরিচালনা করেছে। খেলাধুলা ও শরীরচর্চা করেছে। দরিদ্র বস্তিবাসীর মধ্যে সেবামূলক কাজ করেছে। বন্যা, মহামারীর মধ্যে ত্রাণকাজ পরিচালনা করেছে। প্রতি শনিবার হলগুলোতে সন্ধ্যায় আলোচনা সভা হতো। তাতে আলোচনা ও বিতর্ক হতো শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে। জাতীয় রাজনীতির বিষয়ও আলোচনা করা হতো, তবে কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি করতেন না নেতারা, যদিও কোনো দলের প্রতি তাদের সমর্থন থাকত।’

২৮ বছর পরে আবার কিভাবে ডাকসু নির্বাচনের প্রেক্ষাপট তৈরি হলো ১৯৯০ সালের পর বেশ কয়েকবার ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হলেও সরকারের সদিচ্ছার অভাব এবং পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে ক্ষমতাসীনরা বিভিন্ন অজুহাতে এই নির্বাচন আটকে রেখেছিলো। এবার ডাকসু নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করার আগে বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমান অবস্থা ব্যাখ্যা করতে হবে। বলা হয়ে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যার অধীনে থাকবে রাজনীতি তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক এরশাদকে হটায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এই ডাকসু। এরপর যে গণতান্ত্রিক সরকার এসেছে তারা এই ডাকসুকে ভয় পেত। তাদের ধারণা ডাকসু নির্বাচন হেরে গেলে সরকার চালাতে সমস্যা হবে। ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলোর কার্যক্রম দলকেন্দ্রিক হওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে তারা এক হতো না। তাই ক্যাম্পাসে এই ছাত্রসংগঠনগুলো জনপ্রিয় ছিল না। রাজনৈতিক দলগুলো ভোট দেয়ার সাহস করত না। আমরা জানি ১৯৯০ এর পরে এক সরকার দুইবার একটানা ছিল না। একবার বিএনপি আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসতো। কিন্তু ২০০৯ সালের পর এই ধারা পরিবর্তন হয়ে যায়। বিভিন্ন কারণে আওয়ামী লীগ এবার একটানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আছে। সরকার যথেষ্ট শক্তিশালী। তাই ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন করার সুযোগ তৈরি হয়। এ ছাড়াও ২০১২ সালের ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ শিক্ষার্থী ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন। ২০১৭ সালের ৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ডাকসু নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, ডাকসু নির্বাচন অত্যাবশ্যক, তা না হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বশূন্য হয়ে যাবে।’ ২০১৭ সালে ২৫ নভেম্বর থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে অনশন করেন সমাজকল্যাণ অনুষদের ছাত্র ওয়ালিদ আশরাফ। ২০১২ সালের ১১ মার্চ দাখিলকৃত রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের উচ্চ আদালত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ডাকসু নির্বাচনের নির্দেশ দেন। উচ্চ আদালতের আদেশের সাত মাস পেরিয়ে গেলেও নির্বাচনের কোনো আয়োজন দৃশ্যমান না হওয়ায় ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে উকিল নোটিশ পাঠান মনজিল মোরসেদ। জবাব না পেয়ে ১২ সেপ্টেম্বর উপাচার্যসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন তিনি। উচ্চ আদালতের আদেশের প্রেক্ষিতে ২০১৮-এর ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে ঘোষণা দেয় যে ২০১৯ সালের মার্চের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে ডাকসুর নির্বাচন। দীর্ঘ ২৮ বছর পর গত ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। ছাত্রলীগ ছাড়া বাকি সব প্যানেল নির্বাচন বর্জন করে। আগের রাতে সিল মারা, অস্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ভোট প্রদান, নির্ধারিত কক্ষের বাইরে ব্যালট ভর্তি ট্রাঙ্ক উদ্ধার, অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোট দিতে বাধা দেয়া, কৃত্রিম লাইন তৈরি করে শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার প্রয়োগে বাধা দেয়া, প্রার্থীদের ওপর হামলা, প্রশাসনের একচোখা নীতি, ফলাফল প্রকাশে অস্বাভাবিক বিলম্বসহ নানা অভিযোগ এই নির্বাচনে পাওয়া যায়। জাতীয় নির্বাচনে ভোট ডাকাতির পর নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে। জাতীয় নির্বাচন ৩০ ডিসেম্বরে ২০১৮তে ভোট ডাকাতি এমন প্রভাব ফেলে যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে বের হয়নি। একই অবস্থা বিরাজ করেছে উপজেলা নির্বাচনেও। ভোট না দেয়ার এই প্রতিবাদ কী সরকার অনুধাবন করছে কিনা সেটা সময়ই বলে দিবে। তবে এতটুকু সত্য যে, মানুষের ভোটাধিকার হরণের যন্ত্রণা মানুষ এখনো ভুলেনি, যার প্রমাণ ভোট না দিয়ে তার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তবে ডাকসু নির্বাচনে এর বিপরীত ছিল। ভোটার এর উপস্থিতি ছিল অনেক বেশি। কিন্তু ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি ভোটাররা। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আশায় বুক বেঁধেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ছাত্ররাজনীতির নামে ছাত্রদেরকে নির্যাতনের যে নিয়ম তৈরি হয়েছিলো, ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে সেটা ভাঙতে চেয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সেই ডাকসু নির্বাচনেও প্রশ্নবিদ্ধ নেতৃত্ব উঠে আসছে।ডাকসু নির্বাচন ২৮ বছরের দায় শোধ হলো না । তারিক আহমেদ

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় ডাকসু নির্বাচন ১০ মার্চ রাত ১২টার পর ১১ মার্চ শুরু হলো। বিশ্বাস হচ্ছিল না যেই নির্বাচনটা দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে হচ্ছে না, সেই দিন আজ শুরু। একজন ভোটার হিসেবে ভোট প্রদানের উত্তেজনা অনুভব করলাম। সকালেও ঘুম ভাঙলো তাড়াতাড়ি। সকাল ৭টায় দ্রুত ক্যাম্পাসে চলে আসি। ক্যাম্পাসের চারপাশে পুলিশের তল্লাশি চৌকি। পরিচয়পত্র দেখিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করি। এই ক্যাম্পাস যেন স্বপ্নের ক্যাম্পাসের মতোই। কোথাও ভিড় নেই কোনো গাড়ির হর্ন নেই। বহিরাগতদের গাড়ি হনহনিয়ে চলছে না। নির্ধারিত স্টিাকারযুক্ত গাড়ি চলছে। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে নাস্তা করার জন্য মাস্টারদা সূর্যসেন হলে যাই। গিয়ে দেখি ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। ভোট শুরু হবে ৮টায়। এখনি এত দীর্ঘ লাইন। সাথে সাথে হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলে গিয়েও দেখি একই অবস্থা। ভোটারদের দীর্ঘ সারি। এরপর বিজয় একাত্তর হল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে গিয়েও একই অবস্থা। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটায় সময় ৮টা। ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে। আমার আজকে ভোট প্রদানের চেয়ে এই ক্যাম্পাসের ভোট গ্রহণের দৃশ্য দেখার জন্য মন উদগ্রীব ছিল। বিভিন্ন হলে যাচ্ছি ভোটারদের সাথে কথা বলছিলাম। পরিচতজনের সাথে দেখাও হচ্ছিলো। খুবই আনন্দ লাগছিল। এত বছর পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এমন করে সময় যখন ৯টা তখন খবর পেলাম ছাত্রীদের ‘বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী’ হলে ঝামেলা হয়েছে। দেখার আগ্রহ থেকে সেখানে যাওয়ার জন্য হাঁটা শুরু করি। গিয়ে রীতিমতো অবাক। ভাবতেই পারিনি। এ আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যারা জাতিকে পথ দেখাবে তারাই আজকে রাতে সিল মেরেছে। কুয়েত মৈত্রী হলের গেটে কিছু মেয়ে গভীর রাতে সিল মারা অনেকগুলো ব্যালট সাংবাদিকদের দেখাচ্ছেন। ব্যালটের বস্তা তারাই উদ্ধার করেন। তাদের কথা অনুযায়ী বুঝতে পারলাম, নিয়ম অনুযায়ী ভোট গ্রহণ শুরুর আগে প্রার্থীদের ব্যালট বাক্স খুলে দেখাতে হয়। কিন্তু এই হলের প্রাধ্যক্ষ (প্রফেসর শবনম জাহান) সেটি দেখাতে চাননি। তখনি এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তারা ব্যালট বাক্স না দেখালে ভোট দিবে না বলে ঘোষণা দেয়। এরকমভাবে প্রায় ৪৫ মিনিট পর শিক্ষার্থীরা ভোটকেন্দ্রের পাশের রুম থেকে একটি বস্তা উদ্ধার করে। বস্তায় উদ্ধার করা সেই ব্যালটে ছাত্রলীগের প্রার্থীদের ভোট দেয়া হয়েছে। এসময় বিশ্ববিদ্যালয় উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সামাদ তার গাড়ি নিয়ে আসেন। তখন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রাতে সিল মারা ব্যালট তার গাড়ির ওপর ঢেলে দেন। এটা শুনে বুঝার আর বাকি নেই ছাত্রলীগ প্রশাসন মিলে রাতে এই ব্যালটগুলোতে ভোট দিয়েছে। শুধু অবাক হয়েছি কত সংগ্রাম করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন তাঁরা। জাতির সর্বোচ্চ শিক্ষিত তাঁদের ধরা হয়। তাঁরাই আজ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার হরণ করে রাতের বেলা ভোট দিয়েছেন! এত পচন ধরেছে শিক্ষকদের। ছিহ! ঘৃণায় কথা বলতে পারছিলাম না। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি আর ভোট দেবো না। হতাশায়, দুঃখ-কষ্ট বেড়ে গেলো। সর্বশেষ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ঘটনা ঘটলো। ঘৃণায়, লজ্জায় মাথা কাজ করছিল না। তারপর হাঁটতে হাঁটতে নীলক্ষেত মোড়ের পাশে স্যার এ. এফ. রহমান হলের সামনে আসি। ভোটারদের দীর্ঘ লাইন এখানে। রাস্তায় অনেক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করে এক বন্ধুকে পেয়ে বললাম, কখন এসেছিস? উত্তর দিতে গিয়ে মন খারাপ করে সে বললো, ভোট দিতে এসেছি সকাল-সকাল। প্রায় দেড় ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছি। লাইন অল্প একটু এগিয়েছে। এর কারণ জানতে চাইলে সে বললো, সকালেই হলের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের দিয়ে ছাত্রলীগ লাইন পূর্ণ করেছে। এরা এক বুথের ভেতরে গিয়ে ইচ্ছা করে বেশি সময় কাটাচ্ছে। অনেকে একবার ভোট দিয়ে ছাত্রলীগের সহযোগিতায় আবার লাইনে দাঁড়াচ্ছে। যাতে অন্যরা ভোট না দিতে পারে। তা ছাড়া ভোটারদের লাইনগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রশাসনের কেউ নেই। সবই ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ করছে। কথাগুলো শুনে ভাবছিলাম ২৮ বছর পর এই নির্বাচনটা এত খারাপভাবে হতে যাচ্ছে। হলের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখলাম কিছু বড় ভাই লাইন নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্য হলগুলোতে কী অবস্থা জানতে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে যাই। ওইখানে গিয়ে দেখি আরো খারাপ অবস্থা। রাস্তার পাশের গেটেই ছাত্রলীগের নেতারা কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজন অনাবাসিক ভোটারকে ফিরিয়ে দিচ্ছে সেটা দেখলাম। এরপর হাঁটতে হাঁটতে দুপুর ১২টার দিকে গেলাম শহীদুল্লাহ হলের দিকে। গিয়ে দেখি একই অবস্থা। ভোটার লাইন নিয়ন্ত্রণ করছে ছাত্রলীগের নেতারা। বুঝার আর বাকি রইলো না। নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের আরেকটি উদাহরণ হতে যাচ্ছে এই ডাকসু নির্বাচন। সাড়ে ১২টার দিকে রোকেয়া হলের সামনে দেখি মানুষের আনাগোনা বেশি। গেটে কয়েকজন মেয়েকে আইডি কার্ড চেক করে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে। আমিও সাংবাদিকদের সাথে প্রবেশ করায় আমাকে আর আইডি কার্ড চেক করা হয়নি। ভেতরে প্রবেশ করেই আমি অবাক। বিভিন্ন ধরনের শ্লোগান শোনা যাচ্ছে। একেবারে হলের ভেতর বুথের সামনে দেখছি অনেক জোরে শোরগোল হচ্ছে। গিয়ে দেখি ছাত্রলীগের ভিপি প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন, জিএস প্রার্থী গোলাম রাব্বানী, ভিপি প্রার্থী নুরুল হক নুর সাংবাদিকসহ অনেকে শোরগোলের মাঝখানে। একজনকে জিজ্ঞেস করে বুঝতে পারলাম। শিক্ষার্থীদের দাবি একটি রুমে ব্যালট বাক্স রয়েছে। প্রভোস্ট সেই রুমে কাউকে ঢুকতে দিবেন না। হঠাৎ করে দেখলাম ভিপিপ্রার্থী নুরুল হক নুরের ওপর কয়েকজন হামলা করে। আমার সামনেই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলে, তাকে ধরে হাসপাতালে নিয়ে যায় অন্যরা। পরে এক সাংবাদিকদের আলোচনার পাশে দাঁড়িয়ে শুনলাম নুরকে মেরেছে ছাত্রলীগের নেত্রীরা। এ দিকে আন্দোলনকারী ছাত্রীরা আরো ক্ষেপে উঠেছে। একপর্যায়ে দেখি দরজায় দ্রিম দ্রিম আওয়াজ। দরজা ভেঙে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে ছাত্রীরা। কয়েকজন মিলে একটি ট্রাঙ্ক বের করে। একটি হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তালা ভেঙে অনেক-গুলো ব্যালট বের করে। ছাত্রীরা সাংবাদিকদের বলছে ব্যালট থাকার কথা যেখানে ভোট হয় সেখানে, কিন্তু এটি অন্য একটি রুমে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। তখন ভোট বন্ধ ছিল। এরপর টিএসসির ডাচে বসে ছিলাম অনেকক্ষণ। একটা বড় মিছিল দেখলাম। ভোট বর্জনকারীদের মিছিল। বসে বসে ভাবছিলাম, ‘আরেকটি কলঙ্কজনক নির্বাচন হলো।’ এর পরের ঘটনা আমরা সবাই জানি। ডাকসুর ফলাফলে ছাত্রলীগ প্রায় সবগুলোতে নির্বাচিত হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে ২৫টি পদের মধ্যে ২৩টিতে ছাত্রলীগ আসে। বাকি দুইটি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সংগঠন ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’-এর ভিপি (সহ-সভাপতি) পদে নুরুল হক নুর এবং সমাজসেবা পদে আখতার হোসেন নির্বাচিত হয়। ১৮টি হল সংসদের মধ্যে ১২টি হলে ছাত্রলীগ সম্পূর্ণ প্যানেল আসে। ৬টি হলে স্বতন্ত্র এবং ছাত্রলীগ জয়ী হয়। মেয়েদের হলগুলোতে ছাত্রলীগের ভরাডুবি হয়, স্বতন্ত্ররা জয়ী হয়। ‘ডাকসু ইলেকশনে আমরা কী পেলাম?’ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে এই ডাকসু নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি দেখলে বুঝতে পারবো। নতুন নেতৃত্ব তৈরি হয়নি। ছাত্রলীগের নেতারাই আবার জোর করে ডাকসুতে এসেছে। মেধাবী রাজনীতিবিদ তৈরি করার যে প্রক্রিয়া, জোর করার মাধ্যমে তা নষ্ট করে দেয়া হলো। বরং অপরাজনীতি যারা করে তাদের কর্মকাণ্ডের বৈধ একটি প্রক্রিয়া পেয়ে গেলো। একজন ভোটার হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষার্থী হিসেবে ডাকসু নিয়ে প্রত্যাশা অনেক ছিল। ২৮ বছর ধরে একটা নির্বাচন বিভিন্ন রাজনীতির মারপ্যাঁচে অনুষ্ঠিত হয়নি। তাও যা হলো, সেই নির্বাচনের কলঙ্কের দাগ লেগে গেলো। ২৮ বছরের দায় আরো বৃদ্ধি পেলো, দায় শোধ হলো না। তবুও কিছুটা প্রশান্তি ২৮ বছর পর হলেও নির্বাচনের সংস্কৃতি চালু হলো। বিভিন্ন অনিয়ম দূর করার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়াটি চলমান থাকুক।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির