post

ডিজিটাল বিবর্তনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া শেখ মুহাম্মদ এনামুল কবির

১৭ জুলাই ২০২১

বর্তমান বিশ্বের অগ্রগতি এবং উন্নয়নের পিছনে টেকনোলজির অবদান কোনোভাবে অস্বীকার করা যাবে না। এখন গোটা বিশ্বব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে তথ্যপ্রযুুক্তির মাধ্যমে। সংবাদপত্র আবিষ্কারের পর জ্ঞানচর্চায় এক নব দিগন্তের উন্মোচন হয়েছিল। তখন গোটা বিশ^কে বলা হতো গ্লোবাল ভিলেজ। আর এখন তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এ সময়ে বিশ^ব্যবস্থাকে বলা হয় গ্লোবাল হ্যান্ড। কেউ কেউ অগ্রসর হয়ে একে গ্লোবাল ফিঙ্গারও বলে থাকেন কারণ কম্পিউটার বা ল্যাপটপের কি বোর্ডে আঙুলের একচাপে সেকেন্ডেরও কম সময়ে গোটা দুনিয়ার তথ্যভাণ্ডার মানুষের সামনে উন্মোচিত হয়ে যায়। তথ্যপ্রবাহের অবাধ যুগে মাউসের এক ক্লিকেই উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরুর তথ্য চোখের পলকে বেরিয়ে আসে। সময়ের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সবাইকে খাপখাওয়াতে হচ্ছে। আইটি ক্ষেত্রে যারা পারদর্শী তারা বর্তমান সময়ের সাথে খুব দ্রুত এবং যথাযথভাবেই মানিয়ে নিচ্ছে। বিপুল পরিমাণ সাধারণ মানুষ পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুফল পাচ্ছে না তা নয় তারাও কোন না কোনোভাবে মানিয়ে নিচ্ছে তবে এই সাধারণ মানুষ ডিজিটাল পদ্ধতির সত্যিকার ব্যবহার না জানার কারণে সুফলের চেয়ে কুফল ডেকে আনছে বেশি। অর্থাৎ প্রকৃতভাবে নিত্য ব্যবহার্য ডিজিটাল উপকরণগুলো কোন না কোন ভাবে তারা ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু কথা হচ্ছে ডিজিটালের গতির সাথে কি পৃথিবীর সকল মানুষ তাল মিলাতে পারছে? গোটা পৃথিবীর কথা বাদ দিলাম আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার গতি যত বৃদ্ধি পাবে সমাজের সার্বিক শৃঙ্খলার উপরও তার একটা ব্যাপক প্রভাব পড়বে এটাই স্বাভাবিক। একটা সময় আসবে যখন পৃথিবী শুধু ধনীদের জন্য আবাসস্থলে পরিণত হবে। অত্যাধুনিক গতির সাথে নিম্ন আয়ের মানুষ তাল মিলাতে না পেরে সিস্টেমের কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়ে ধুঁকতে ধুঁকতে এমনিতেই একদিন বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। কারণ উন্নত জীবন উপকরণ ও অতি অত্যাধুনিক ডিজিটাল উপকরণ সংগ্রহ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। এর ফলে সামগ্রিক সামাজিক ব্যবস্থাপনার মাঝে বিশৃঙ্খলা তীব্রভাবে পরিলক্ষিত হবে। প্রযুক্তির উন্নতির ফলে কায়িক পরিশ্রম অনেকাংশে কমে গেছে। এর পরিবর্তে মেধার পরিশ্রম বেড়েছে। সমাজের যারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, যারা প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের সুযোগ পায় না। তাহলে তারা কিভাবে শিক্ষিত শ্রেণীর সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকবে? এই শিক্ষিত শ্রেণীরা কায়িক শ্রমিক কম ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন অত্যাধুনিক ডিভাইস তৈরি করছে। এই সমস্ত ডিভাইস অশিক্ষিত লোকেরা না পারছে ক্রয় করতে না পারছে এর ব্যবহার ঠিক মতো করতে এর ফলে শ্রমিক শ্রেণীরা তাদের কায়িক পরিশ্রমের ক্ষেত্র দিন দিন হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়ছে। আবার যারা শিক্ষিত কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান নেই তারাও তাদের অদক্ষতার কারণে কর্ম হারাচ্ছে। বেকার সমস্যা আরো প্রকট হচ্ছে। আমাদের দেশের শিক্ষার হার আগের চেয়ে বাড়লেও পুরোপুরি নিরক্ষতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে আরো সময় লাগবে। যদি নিরক্ষরমুক্ত হয় তারপরও প্রযুক্তির জ্ঞান সবার জন্য উন্মুক্ত না হলে সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা ডিজিটালাইজেশনের সুফল থেকে সবসময় অবহেলিত থেকে যাবে। বর্তমানে নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর সবাই এবং শিক্ষিত মানুষের বিরাট একটা অংশ সঠিকভাবে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার না জানার কারণে অনেক সমস্যার মধ্যে পড়ছে। প্রথমত তারা নিজেরা জানে না কিভাবে অতীব প্রয়োজনীয় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করতে হয়। দ্বিতীয়ত তারা নিজেদের প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে এসমস্ত ডিভাইস ক্রয় করছে কিন্তু সঠিক নিয়ম নীতি না জানার কারণে নিজেদের অজান্তেই এমন কোন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছে, যে তার থেকে পরিত্রাণের জন্য এমন কোন পন্থা বা কাজ করতে হচ্ছে যা তাদের আর্থিক ও মানসিক ক্ষতি টেনে নিয়ে আসছে। অনেক সময় এই ক্ষতি আরো কোন বড় জটিলতা তাদের জীবনে বয়ে নিয়ে আসছে। তৃতীয়ত, অনেক নিরক্ষর বা ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করতে না জানা কোন শিক্ষিত মানুষ শখের বসে কোন ডিজিটাল ডিভাইস যেমন ধরুন স্মার্টফোন ক্রয় করে, তারাও নিজেদের জন্য এক বা একাধিক সিরিজ সমস্যা ডেকে নিয়ে আসছেন। যেমন ধরুন তারা মিয়া একজন সবজি বিক্রেতা। অনেক কষ্ট করে একটি স্মার্টফোন ক্রয় করেছে। কিন্তু বেচারা এর সঠিক ব্যবহার বিধি ভালো জানে না। তারা মিয়া নতুন স্মার্টফোন কিনে পুরা ফুরফুরে মেজাজে আছে। শরীরের মধ্যে এক ধরনের ভাব কাজ করছে। তারা মিয়ার নিজের কাছে নিজেকে এখন অনেক স্মার্ট বলে মনে হয়। একদিন সে মোবাইল হাতে নিয়ে কৌতূহলী হয় এই মোবাইলের অজানা রহস্য উদঘাটনের মিশন উদ্ধারের ভূত চাপে। মোবাইল ওপেন করে সকল ফাংশন একটার পর একটা সমানে টিপতে থাকে। সেটিং ফাংশনেও ঢুকে সেখানে যেটা বন্ধ করা ছিল তা ওপেন, যা ওপেন ছিল তা অফ করে দেয় এরপর সে কি করেছে সে নিজেও জানে না হয়তো। একটু পর সে দেখে মোবাইল বন্ধ হয়ে গেছে। এবার সব বাটন জোরে জোরে চাপ দিয়ে চেষ্টা করে মোবাইল ওপেন করতে কিন্তু কিছুতে কিছুই হয় না। কোনো উপায় না পেয়ে ছুটে যায় কাছের বন্ধু চান্দুর পরামর্শের জন্য। বন্ধুর পরামর্শে পাড়ার কেরামতের মোবাইল সার্ভিসিং এর দোকানে নিয়ে যায় মোবাইল ফোনটি। আর কেরামত কোন মতে মোবাইল সার্ভিসিং শিখে ঐ এলাকার মোবাইল ইঞ্জিনিয়ার সেজে বসে আছে। সে নিজেও ভালো করে জানে না মোবাইলের সব ফাংশন। দেখা গেল অনেক টাকার বিনিময়ে কোন মতে সার্ভিসিং করে মোবাইল ওপেন করে। তারা মিয়া মোবাইল সেরে আবারও মনের আনন্দে টিপতে থাকে। তারা মিয়া কয়েকদিন চালানোর পর আবার মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়। আবারও সে কেরামত আলীর সার্ভিসিংয়ে হাজির। এবার কেরামত আলীর কেরামতিও কাজ করছে না। কেরামত আলী বিজ্ঞ মোবাইল ইঞ্জিনিয়ারের মতো দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দেয় মোবাইল নষ্ট হয়ে গেছে এটা আর চলবে না ফেলে দিতে হবে। তারা মিয়ার তখন আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছাড়া দ্বিতীয় আর কোনো বিকল্প থাকে না। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার না জানা মানুষের মাঝে বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনার একটি কাল্পনিক চিত্র মাত্র। এ ঘটনা কাল্পনিক হলেও আমাদের চারপাশে খুঁজলে এরকমই বাস্তবতার অসংখ্য উদাহরণ পেয়ে যাবো। তারা মিয়ার অনেক পরিশ্রমের টাকা কয়েকদিনের মাঝে শেষ হয়। আবার তার মাঝে নতুন করে জিদ চাপে তাকে আবারো একটি মোবাইল ক্রয় করতেই হবে। আবারো হয়তো আরো কোন ভালো ব্র্যান্ডের স্মার্টফোন ক্রয় করে। কিন্তু তার টানাটানির সংসারে এই ডিজিটাল স্মার্টফোন কোন শান্তি বয়ে নিয়ে আসতে পারেনি। হয়তো ঋণ করে তার শখের চাহিদা পূরণ করেছে। এখন সে ঋণ দিবে না তাদের টানাটানির সংসারে আরো কিছু উপার্জন করে তার স্ত্রী ছেলে-মেয়েদের মুখে দু’ মুঠো ভাত তুলে দিবে? আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের যেখানে শতকরা চল্লিশভাগ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে তাদের জন্য ডিজিটালাইজেশনের বিলাসিতায় গা ভাসানো আর আত্মহত্যা করা একই কথা। তাই আমার প্রশ্ন এই সমস্ত জনগোষ্ঠীকে সঠিকভাবে শিক্ষার আলো না পৌঁছালে এবং তাদের এই পরিবর্তিত আধুনিক যুগের উপযোগী করে গড়ে না তুললে তারা কি পারবে এই ডিজিটালাইজেশনের প্রবল স্রােতে নিজেদের জীবনতরী সঠিক নোঙরে ভিড়াতে বা জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে? ডিজিটাল বিবর্তন আরো বড় একটি ডিজিটাল মুনাফাখোর শ্রেণী তৈরি করেছে। উদাহরণস্বরূপ বহুজাতিক সফটওয়্যার ও মোবাইল কোম্পানিগুলো। পৃথিবীব্যাপী তাদের নেটওয়ার্ক এবং ব্যবসা। বড় বড় শক্তিশালী দেশ তাদের কথায় ওঠে এবং বসে। তারা যেভাবে তাদের ব্যবসায়িক পলিসি নির্ধারণ করে বড় বড় দেশের সরকারও তাদের সেভাবে সহযোগিতা করে করতে বাধ্য হয়। তাদের ব্যবসার এটা এখন একেবারে পৃথিবীব্যাপী ওপেন সিক্রেট বিষয়। আর তা হবেই বা না কেন? এ সমস্ত কোম্পানিগুলোইতো বিভিন্ন প্রভাবশালী সুপার পাওয়ার যাদের আমরা বলি, সে সমস্ত সরকারের বড় ধরনের ডোনার। যাক ওটা আর একটি ভিন্ন আলোচনা মূল কথা হলো এই বহুজাতিক মোবাইল ও সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো সুচতুরভাবে সাধারণ মানুষকে তাদের মুনাফা লাভের একটি বিরাট ক্ষেত্র বানিয়ে তাদের মুনাফা অর্জনের হার হু হু করে বাড়িয়ে নিচ্ছে। সাধারণ মানুষের ঝোঁক প্রবণতা মনস্তাত্ত্বিক চাহিদার উপর ব্যাপক গবেষণা করেছে তারা। তারা জানে কিভাবে সাধারণ মানুষকে তাদের ব্যবসায়িক পণ্যের ভোক্তা বানাতে হয়। তাই এসমস্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সাধারণ মানুষের উপযোগী করে ওয়ান টাইম ব্যবহার উপযোগী, কম টেকসই, কম দামি কিন্তু আকর্ষণীয় ডিজাইনের মোবাইল বা ডিজিটাল ডিভাইস তৈরি করছে। সাধারণ মানুষও দামে কম হওয়ায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে এসমস্ত ডিজিটাল ডিভাইস ক্রয় করতে কারণ তাদের যে কোন একটি স্মার্টফোন হলেই হয় যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য। কে কার খোঁজ নেয় কোথাকার বহুজাতিক কোম্পানি আমাদের কত নিম্নমানের পণ্য ধরিয়ে দিলো না কি তারা এর থেকে মুনাফা করলো ও দিকে তাদের কোনো খেয়াল নেই চিন্তা করার সময়ও নেই। কিন্তু বহুজাতিক মোবাইল বা সফটওয়্যার কোম্পানিগুলির এই ব্যবসায়িক পলিসি গোটা উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মোবাইল কোম্পানিগুলো তাদের বুর্জোয়া মানসিকতার কারণেই টেকসই উন্নতমানের মোবাইল তৈরি না করে স্বল্প টেকসইযুক্ত আকর্ষণীয় এবং লোভনীয় সব ডিভাইস তৈরি করে কম দামে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করছে। সাধারণ শ্রেণীর মানুষেরা বুর্জোয়া মোবাইল কোম্পানির ব্যবসায়িক হীন স্বার্থ হাসিলের নীলনকশা-টকশা এতো কিছু বোঝেনা বা বোঝার চেষ্টাও করেনা। তারা তাদের প্রয়োজনেই ডিজিটাল ডিভাইস ক্রয় করে, ক্রয় করতে বাধ্য হয়। প্রয়োজনের বাইরেও আবার কখনও সমাজের সাথে চলতে গিয়ে শখের বসেও অনেক মানুষ এসমস্ত ডিভাইস ক্রয় করে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসায়িক পলিসির কারণে শুধু জাস্ট ওয়ান টাইম ইউজ করার মতো করে তাদের পণ্য তৈরি করছে এবং এর লংজিবিটিও কম দিচ্ছে যাতে করে ব্যবহারকারীরা দ্রুতই একটি নষ্ট হলে আবার তাদের পণ্য ক্রয় করতে ছুটে যাচ্ছে। এভাবেই ঐ বুর্জোয়া গোষ্ঠীর ব্যবসা চলছে বেশ রমরমা এবং তারা টিকে থাকছে দোর্দণ্ডপ্রতাপে। একদিকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো মুনাফা অর্জন করে সম্পদের পাহাড় বানাচ্ছে অন্যদিকে আমাদের দেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাধারণ মানুষ আজ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে খাপ খাওয়াতে যেয়ে আরো বেশি নিষ্পেষিত হচ্ছে। যাকে আমরা বলতে পারি ডিজিটাল নিষ্পেষণ। আমাদের সামনে অসংখ্য উদাহরণ আছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দরিদ্র মা-বাবা সন্তানের চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে। স্কুলের বন্ধুবান্ধব সকলের হাতে অ্যান্ড্রয়েট সেট, তারা কতো মজা করে গেম খেলে ভিডিও দেখে, চ্যাট করে কিন্তু দরিদ্র মায়ের সন্তানদের শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতে হয়। গরিব মা-বাবার সামর্থ্য নেই সন্তানকে এতো দামি সেট কিনে দেওয়ার। সন্তান বায়না ধরে মোবাইল ক্রয় করার জন্য। সন্তানের কথা চিন্তা করে হয়তো মা-বাবা তাদের একমাত্র উপার্জনের মাধ্যম দুধের গাভীটিকে বিক্রি করে দেয় নয়তোবা অন্যকোন অতীব প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করে সন্তানের চাহিদা পূরণ করছে। তাদের স্বপ্ন একদিন তাদের সন্তান শিক্ষিত হবে মানুষের মত মানুষ হবে তখন তাদের আর দুঃখ থাকবে না। এজন্য তারা অকাতরে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সন্তানের ভালোর জন্য সকল কষ্ট সহ্য করে যায়। মা-বাবা স্বপ্ন দেখে আর এদিকে সন্তান স্মার্টফোন পাওয়ার পর তার আচার আচরণে চেঞ্জ আসে, পড়া লেখায় আগের মতো মন নেই, সারাদিন মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সময় পার করছে। কিন্তু অশিক্ষিত মা-বাবা তো বোঝে না এই ঘরে বসেই তাদের আদরের সন্তান অন্য কোন রঙিন জগতের বাসিন্দা হয়েছে, মজে আছে কোন অনলাইন রূপসী ললনার রূপের ফাঁদে। হয়তো একদিন ছেলেটিকে তার মা-বাবা কোন বখাটে ছেলেদের সাথে আবিষ্কার করে থমকে যায়, তাদের স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে। সাধারণ শ্রেণীর মানুষের উপর ডিজিটালের নগ্ন থাবা সামাজিক জীবনে অভিশাপ বয়ে নিয়ে এসেছে। সমাজের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরাও এই ডিজিটাল খপ্পরে পড়ে দিক ভ্রান্ত। এই দুই শ্রেণীর মানুষেরা ডিজিটাল উপকরণ ব্যবহার করে তাদের বিলাসী জীবনকে আরো উপভোগ্য আরো আরামদায়ক করার জন্য। ধনীর দুলাল দুলালীরা ডিজিটাল উপকরণগুলো ব্যবহার করে তাদের বিলাসী জীবনকে আরো রঙিন করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। হাল জামানার লেটেস্ট দামি স্মার্টফোন অথবা আইপ্যাড বা আইফোন তাদের নিত্য সঙ্গী। কয়দিন পর পর সেটিও চেঞ্জ হয়ে আসে আরো কোন অত্যাধুনিক ডিভাইস। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দ্বারা নিজেদের বিলাসী জীবনের স্থিরচিত্র, ভিডিও ফুটেজ একটার পর একটা আপলোড করে তার বন্ধু-বান্ধবীদের জানান দেয় যে, আমার জীবনটা কত আকর্ষণীয় গ্লামারে পরিপূর্ণ। তার স্থিরচিত্র, ভিডিওতে একটার পর একটা লাইক পড়ে, কমেন্টে বিপরীত লিঙ্গের বন্ধুরা তার রূপের কৃত্রিম প্রশংসায় ভাসিয়ে দেয়। যা তাকে আরো উচ্ছৃঙ্খল আরো উগ্র আরো খোলামেলা হতে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। ডিজিটাল ডিভাইস ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দ্বারা বিভিন্ন চরিত্রবিধ্বংসী সাইট ব্যবহার করে তার মাঝে যে বিকৃত রুচি তৈরি হয় তা বাস্তবে প্রয়োগ করার জন্য ডিজিটাল ফাঁদ পাতে। হয়তো কেউ কেউ শুধু শখের বসে নিজের খোলামেলা ছবি এবং ভিডিও আপলোড করা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে কিন্তু তার এই কর্মকাণ্ড দেখে অনেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আরো বেশি খোলামেলা ছবি এবং ভিডিও আপলোড করে ডিজিটাল ফাঁদ পেতে তার বন্ধু-বান্ধবীদের উপর নিজের বিকৃত মানসিকতার প্রয়োগ করে। এখানেই এই সমস্ত বিকৃত রুচির উঠতি তরুণ-তরুণীরা ক্ষান্ত হয় না- অনেক সময় ভিকটিমকে কামলালসার শিকার বানানোর পর হত্যা পর্যন্ত করতে তাদের হৃদয় কাঁপছে না। বিকৃত রুচির উঠতি তরুণ-তরুণীদের কত ধরনের ফাঁদ আছে এ সমাজে। তাদের পাতা ফাঁদে কাক্সিক্ষত শিকার ধরা পড়লে তাদের আসল রূপ বেরিয়ে আসে। হীন কামনার লালসা পূরণ করার জন্য তারা পাগল হয়ে যায়। যে বন্ধু বা বান্ধবী বর্তমান ডিজিটাল জেনারেশনের আপগ্রেড সম্বোধন বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড সংক্ষেপে বিএফ এবং জিএফকে সে টার্গেট করে সে বিএফ বা জিএফও একই মানসিকতায় পরিপূর্ণ একজন দুর্গন্ধময় আধুনিক ডিজিটাল যুগের বাসিন্দা। সেও মনে মনে এমনই আশা করে বা তারও নিজেরও এমন ফাঁদ থাকে অন্যকে শিকার করার। অবশেষে তারা একে অন্যের শিকারে পরিণত হয়। আদিম বন্যতায় তারা মেতে ওঠে। বিবাহবহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক হয় তাদের নিত্য অভ্যাস। এভাবে ধনাঢ্য পরিবারের উঠতি তরুণ-তরুণীরা নিজেদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ চরিত্রকে এমনভাবে বিলীন করে দিয়ে পাশবিকতাকে নিজেদের ভূষণ হিসেবে গ্রহণ করছে। যার প্রভাবে সমাজজীবনও তাদের পাপাচারের কারণে হচ্ছে কলুষিত। শুধু ধনাঢ্য অভিজাত পরিবারে এই মহামারী ব্যাধি সীমাবদ্ধ নেই গোটা সমাজব্যবস্থা আজ যেন ডিজিটালের বিষবাষ্পে বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। যে যখন সুযোগ পাচ্ছে তারা তাদের ডিজিটালে বুঁদ হওয়া বিকৃত মস্তিষ্কের বিকৃত লালসার শিকার বানাচ্ছে অন্যকোন নারীকে। আমার সোনার বাংলায় যেখানে নারীসমাজ এক সুরক্ষিত বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। যাদেরকে মা হিসেবে, বোন হিসেবে সম্মানের আসনে বসানো ছিল। যে যুবসমাজ মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষায় জীবন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করতো না। এখন এমন অধঃপতন হয়েছে যে, সেই সমাজের তরুণ যুবকদের তারা তাদের কুৎসিত কামনার আগুন নিভাতে নিরীহ মা-বোনদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে হিং¯্র হায়েনার মতো। কখনো একাকী আবার কখনো সংঘবদ্ধভাবে। ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। এইতো কয়দিন আগের দিহান কর্তৃক আনুশকাকে ধর্ষণ করে হত্যার খবরে পুরো দেশবাসী দেখেছে কিভাবে আমাদের নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে ধর্ষক হয়ে। গা শিউরে ওঠার মতো ঘটনা। এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমি দেখেছি অনেকে মন্তব্য করেছেন, কেউ দিহানের বিকৃত মানসিকতা এবং তার এই জঘন্য ঘটনার জন্য তাকে গালি দিচ্ছে ফাঁসি চাচ্ছে আবার কেউ আনুশকাকে দোষ দিচ্ছে কেন সে একজন ছেলের ডাকে একান্তে তার সাথে দেখা করতে গেল এই জন্য। এবং তাদের যুক্তি আনুশকা নিজে থেকেই যেহেতু গিয়েছে তাই তারও দোষ আছে। তাদের কথায় যুক্তি থাকলেও কেউ কি আমরা একটিবারের জন্যও চিন্তা করেছি আনুশকা মারা না গেলে এ ঘটনা আমাদের কারোরই নজরে আসতো না মিডিয়ায় এতো ফলাও করেও প্রচার করতো না। মিডিয়ায় আরো প্রকাশিত হয়েছে, তাকে পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে হিউম্যান অ্যাডল্ট বডির মাধ্যমে। কি বিকৃত মানসিকতা! এগুলো তারা কোথা থেকে শিখলো? ঐ যে ডিজিটাল যুগের ডিজিটাল জেনারেশন ডিজিটাল উপকরণ ইন্টারনেটের অবাধ খোলামেলা জগতের তারা নিয়মিত দর্শক। ওখান থেকেই তারা এক একজন জলজ্যান্ত ধর্ষক হওয়ার দীক্ষা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে মা-বোনদের উপর। এরকম অসংখ্য দিহান আনুশকা আমাদের এই সমাজে আমাদের চোখের সামনে বেড়ে উঠছে, অহরহ ঘটছে এই ধরনের নোংরামি। হত্যার মতো ঘটনা না ঘটার কারণে তা মিডিয়ায়ও ফলাও করে প্রচারও হচ্ছে না বিধায় আমরা চুপচাপ মনে করছি এই সমাজব্যবস্থা ঠিকই আছে। মিউচুয়াল আন্ডারস্টানডিংয়ের নামে অবাধ যৌনাচারের স্বাধীনতার কথা বলে এই জঘন্যতম পাপাচারকে যখন জাস্টিফাই করার চেষ্টা করা হয়, তখন কারো বুঝতে বাকি থাকে না এই সমাজ কতোটা পশুর সমাজে পরিণত হয়ে গেছে। এইতো সাম্প্রতিক সময়ের বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের রক্ষিতা মুনিয়ার হত্যাকাণ্ডের মতো আলোচিত ন্যক্কারজনক ঘটনায় আমরা স্পষ্টতই আমাদের বর্তমান সমাজের প্রকৃত নগ্নরূপ দেখতে পাচ্ছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ঘটনা নিয়েও অনেক মাতামাতি হয়েছে। মূল ধারার মিডিয়াগুলো এটাকে নিছক আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিয়ে মূল হত্যাকারীকে আড়াল করার চেষ্টা করেছে। এছাড়াও তারা দেশের ভূমিদস্যুদের সরদার বসুন্ধরা গ্রুপের টাকা ও ক্ষমতার কাছে নিজেদের বিবেককে বিক্রি করে দিয়ে প্রমাণ করেছে সমাজের পচন কত দ্রুততার সাথে এগিয়ে চলছে! কিভাবে উঠতি বয়সের তরুণী এই ধরনের লম্পটদের কবলে পড়ছে তাও এখন বিভিন্নভাবে বেরিয়ে আসছে। এর পেছনেও রয়েছে ডিজিটাল যুগের গ্লামারপূর্ণ জীবনের হাতছানি। ঐ মুনিয়াকে ব্যবহার করে তার বড় বোন কিভাবে উচ্চাভিলাষী জীবন উপকরণ জোগাড় করতো এরকম কথা একে একে বের হচ্ছে। যাই হোক, যারা এই অবাধ যৌনতার পক্ষে সাফাই গাইছেন তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবন ঘাঁটলে এমন নোংরা কদর্য একটা রূপ আমরা দেখতে পাবো যা হয়তো আমরা কল্পনাতেও চিন্তা করতে পারিনা। এই সমস্ত জ্ঞানপাপীরা নিজেদের চরিত্রকে বিকিয়ে দিয়েছে বিধায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এই নোংরামিতে তাদের কিছুই যায় আসে না বরং তারা ইনিয়ে বিনিয়ে অবাধ যৌনাচারকে শিল্পের পর্যায় উন্নীত করার সকল অপচেষ্টা তারা বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন নামে করে যাচ্ছে। কখনো তারা ক্লোজআপের কাছে আসার গল্পের বাহারি বিজ্ঞাপন দিয়ে কখনো মডেল বানানোর নামে তরুণীদের অর্ধনগ্ন বা পরিপূর্ণ নগ্নতার পথে নিয়ে যাচ্ছে। কোনো উঠতি তরুণীকে দিয়ে অশ্লীল দৃশ্যে অভিনয় করিয়ে তারা এক সঙ্গে তাদের নিয়ন্ত্রিত সকল মিডিয়ায় তার এই ন্যক্কারজনক হীনকাজকে সাহসী কাজ বলে প্রচার করছে অবলীলায়। এইভাবে তাদের উৎসাহে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় আধুনিক যুগের তরুণ-তরুণীরা অশ্লীলতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। তাদের কথা নারীরা উলঙ্গ চলবে কেউ তাদের দিকে তাকালে সেটা নারী স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে তারা হুক্কাহুয়া রব তুলে আকাশ বাতাস ভারী করে তোলে। আপনারা হয়তো বলবেন সমাজের তরুণ-তরুণীদের মূল্যবোধের এই চরম অবক্ষয়কে কেন আমি ডিজিটাল সিস্টেমের কুফল হিসেবে চিত্রায়িত করছি? এর জবাবে বলতে হয় হাল জামানার ডিজিটাল সিস্টেমের ঘাড়ে চড়েইতো যত অপকর্ম ও অশ্লীলতা বেহায়াপনা সমাজব্যবস্থাকে কলুষিত করছে। সোস্যাল ডিজঅর্ডার কী তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আপনারা আরো প্রশ্ন করতে পারেন ডিজিটালাইজেশনের আগেও কি এ ধরনের ঘটনা সমাজে ঘটতো না? হ্যাঁ ঘটতো কিন্তু তা হাতেগোনা কয়েকটা যা সমাজের প্রতিটি মানুষকে নাড়িয়ে দিত এবং সমাজের সবাই মিলে আরো বেশি সচেতন হতো যাতে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার জন্য। কিন্তু বর্তমানে এক একটা জঘন্য ঘটনা আর একটাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে এবং পরিমাণে এতো বেশি ঘটছে যে যা শুনতে শুনতে মানুষের কাছে এগুলো এখন একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সবার মাঝে এমন একটা ভাব কাজ করছে যে, ডিজিটাল যুগতো এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই পারে তাই সবাই সমস্যার সমাধানে না গিয়ে জাস্ট ওভার লুক করে যায়। তারপরও আবারও যখন ভয়াবহ কোনো সামাজিক বিশৃংখলা বা অশ্লীলতার কথা ভাইরাল হয় তখনও সবাই একটু সামাজিক মাধ্যমে এবং মিডিয়ায় কিছু আলোচনা করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করে। চোখ বন্ধ করে থাকার চেষ্টা করে। কেউ গোড়ায় হাত দেয় না বা দেয়ার সামান্যতম সদিচ্ছাটুকু পর্যন্ত দেখায় না। যাই হোক এই পয়েন্টে আমি ডিজিটালাইজেশনের অনেকগুলো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বলেছি এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো নিয়ে যদি এখনই ভাবা না হয় তাহলে সার্বিকভাবে সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই বইয়ে আরো অনেকগুলো দিক পরবর্তীতে আলোচনার মাধ্যমে আমাদের কাছে ডিজিটালাইজেশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হবে এবং এ থেকে পরিত্রাণের পথও হয়তো আমরা খুঁজে নিতে পারবো। আমি আপনাদের আবারও বলছি আমি কখনওই ডিজিটালাইজেশনের বিপক্ষে নই। বরং এর পক্ষে তবে আমার আশঙ্কা হলো সত্যিকার ভাবে যদি ডিজিটালাইজেশনের এই অগ্রগতিকে জাতির মাঝে সুশিক্ষার মাধ্যমে ছড়িয়ে না দেয়া হয় তাহলে সমাজের ভিতরে আমরা যে বিশৃঙ্খলা দেখছি যে অস্থিরতা দেখছি তা আরো বাড়তে থাকবে। তাই একটি সুস্থ এবং পরিশীলিত সমাজগঠনের স্বার্থে আমাদের ডিজিটাল ইকুইপমেন্ট ব্যবহারে সচেতন হতে হবে এবং সচেতন থাকতে হবে।

লেখক : পিএইচডি গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির