post

তুরস্কের নির্বাচন জানা অজানা কিছু কথা

০৬ জুলাই ২০১৫
এম ফয়সাল পারভেজ# এশিয়া ও ইউরোপ এই দুই মহাদেশে বিস্তৃত প্রভাবশালী মুসলিম রাষ্ট্র তুরস্কের ২৪তম পার্লামেন্ট নির্বাচন সম্পূর্ণ হয়েছে গত ৭ জুন। এবারের নির্বাচনে গত তিনবারের একক ক্ষমতাসীন রিসেপ তাইয়্যেপ এরদুগানের একেপি বৃহত্তম দল হিসেবে আবার আবির্ভূত হলেও, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হয়েছে। তুরস্কের পার্লামেন্টের আসন সংখ্যা ৫৫০। ২৭৬ আসনে বিজয়ী হলে যেকোনো দল এককভাবে সরকার গঠন করতে পারে। ২৫৮ আসন পাওয়া একেপিকে অন্য যেকোনো দলের সাথে কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করতে হবে অথবা সংখ্যালঘু সরকার গঠন করতে হবে। সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হলে  ৪৫ দিনের মধ্য আবারও নতুন পার্লামেন্ট নির্বাচনের আয়োজন হবে। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন (একেপি) ৪০.৯০% ভোট এবং ২৫৮ আসন, মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক এর  ধর্মনিরপেক্ষ ও বামপন্থী সিএইচপি  ২৪.৯৫% ভোট এবং ১৩২ আসন, জাতীয়তাবাদী (এমএইচপি)  ১৬.২৯% ভোট এবং ৮০ আসন, কুর্দিদের স্বাধীনতাকামী (এইচডিপি) ১৩.১২% ভোট এবং ৮০ আসন পেয়েছে। গত ৫৫ বছরে একেপি একমাত্র দল যারা এককভাবে পরপর তিনবার সরকার গঠন করেছিল। আগের নির্বাচনগুলোতে ক্ষমতাসীন দলগুলোর ভোটের পরিমাণ নিম্নে দেয়া হলো : নির্বাচন ২০১১ ক্ষমতাসীন দল : একেপি প্রধানমন্ত্রী : রিসেপ তাইয়্যেপ এরদুগান প্রাপ্ত ভোট ও আসন : একেপি : ভোট ৪৯.৯৮%, আসন ৩২৭ সিএইচপি : ভোট ২৫.৯৮%, আসন ১৩৫ এমএইচপি : ভোট ১৩.০১%, আসন ৫৩ স্বতন্ত্র : ভোট ৬.৫৭%, আসন ৩৫ সাদাত পার্টি :  ভোট ১.২৭%, আসন নেই নির্বাচন ২০০৭ ক্ষমতাসীন দল : একেপি প্রধানমন্ত্রী : রিসেপ তাইয়্যেপ এরদুগান প্রাপ্ত ভোট : ৪৬.৫৮% ও আসন ৩৪১ সিএইচপি : আসন ১১২ এমএইচপি : আসন ৭১ স্বতন্ত্র : আসন ২৬ নির্বাচন ২০০২ ক্ষমতাসীন দল : একেপি প্রধানমন্ত্রী : রিসেপ তাইয়্যেপ এরদুগান প্রাপ্তভোট : ৩৪.২৮% ও আসন ৩৬৩ সিএইচপি : আসন ১৭৮ স্বতন্ত্র : আসন ৯ নির্বাচন ১৯৯৯ প্রধানমন্ত্রী : বুলেন্ট এজেভিত ক্ষমতাসীন দল : ডিএসপি ও এমএইচপি জোট প্রাপ্তভোট : ২২.১৮% ও ১৭.৯৭% আসনসংখ্যা- ডিএসপি : ১৩৬ এমএইচপি : ১২৯ ফজিলত পার্টি : আসন ১১১ (যা বর্তমানে সাদাত পার্টি, তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল) স্বতন্ত্র : ৩ নির্বাচন ১৯৯৭ ক্ষমতাসীন দল : রেফাহ পার্টি এবং তার জোট (রেফাহ পার্টি বর্তমানে সাদাত পার্টি) প্রধানমন্ত্রী : প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন আরবাকান প্রাপ্তভোট : রেফাহ পার্টি ২১.৩৮%  ও আসন ১৫৮ নির্বাচন ১৯৯১ ক্ষমতাসীন দল : ডিওয়াইপি ও আনাপ জোট প্রধানমন্ত্রী : সুলেইমান ডেমিরেল প্রাপ্তভোট : ডিওয়াইপি : ২৭.৩%, আসন ১৭৮ আনাপ : ২৪.১০%, আসন ১১৫t1 ওপরের পরিসংখ্যান থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, এরদুগান অতীতের সরকার প্রধানদের চেয়ে অনেক বেশি জনসমর্থন নিয়ে এককভাবে সরকার গঠন করেছিলেন। তবে  এবারের নির্বাচনের পরে তুলনামূলক কম ভোট পাওয়ায় সকল মহলে কথা উঠেছে তাহলে কি এরদুগানের একেপি যুগের পতন শুরু হয়েছে? নাকি তুরস্ক নতুন কোনো দল কিংবা জোটের অধীনে ক্ষমতাসীন হতে  যাচ্ছে? এবার নির্বাচনে একেপি ভোট কম  পাওয়ার কয়েকটি কারণ হলো : ১.    তুরস্কের জনসংখ্যার ২৩% কুর্দিশ। কুর্দি জনগোষ্ঠী দ্বারা গঠিত  পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এইচডিপি) ৪০ বছর বয়স্ক তরুণ কারিশম্যাটিক নেতা সালাদিন ডেমিরেটাসের নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো ১৩.১২% ভোট ও ৮০টি আসন অর্জন করে। তুরস্কের সংখ্যাগরিষ্ঠ ১২ জেলায় সর্বাধিক ৯০% ভোট এবং এর বাইরের বিচ্ছিন্ন কুর্দি ভোট তারা পায়। ভোটের জন্য তাদের সশস্ত্র সংগঠন পিকেকে এর সহযোগিতা এবং সাধারণ  কুর্দিদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের জেলাগুলোতে এককভাবে ভোট নেয়, যে ভোটগুলো অতীতে একেপিই বেশি পেতো। কুর্দিদের ১২টি জেলায় গত নির্বাচনে ৪৬টি আসন পেয়েছিল এরদুগানের একেপি, যেখানে এই নির্বাচনে মাত্র ১১টি আসন পেয়েছে। তারা অতীতের কয়েকটি নির্বাচনে স্বতন্ত্র হিসেবে ১৯৯৯ এ ৩টি, ২০০২ এ ৯টি, ২০০৭ এ ২৬টি এবং ২০১১তে ৩৫ আসন পেয়েছিল। অতীতে কুর্দিরা বিভিন্ন সরকারের সময় সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে টিকে ছিল, যদিও এরদুগানের ১৩ বছরে তাদের সাথে তেমন বড় ধরনের সমস্যা হয়নি। তারা ইসরাইলের সহযোগিতায় ইরাক, সিরিয়া এবং তুরস্কের কুর্দিস্তানের সমন্বয়ে নতুন কুর্দি রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে বিভোর। ২.    দীর্ঘ ১৩ বছর একটানা  ক্ষমতায় থাকার কারণে অ্যান্টি এস্টাব্লিশমেন্ট একটি চেতনা ভোটারদের মধ্যে কাজ করেছে, যারা কিছুটা হলেও পরিবর্তন চেয়েছিল। ৩.    নিউ ইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান, ইকোনমিস্ট ও খ্যাতনামা বিশ্ব গণমাধ্যমের ভূমিকা দেখে মনে হয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তুরস্কের এ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে। তারা তুরস্কের একেপি শাসনের অবসান ঘটিয়ে আঞ্চলিক অস্থিরতার মতো কোনো ঝুঁকি হয়তো নিতে চাননি। তবে এরদোগানের হাত যাতে অনেক বেশি শক্তিশালী না হয়ে যায় তার জন্য ভূমিকা রেখেছে। সেই সাথে ইরানপন্থী শিয়া মিডিয়াগুলোও এরদুগানের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। ৪.    এরদুগানের প্রস্তাবিত রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থার ব্যাপারে বাম ও জাতীয়তাবাদীদের ব্যাপক নেগেটিভ প্রচারণা কিছুটা হলেও কাজ করেছে। ৫.    প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দাউতুগ্লু স্বল্প সাফল্য এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলের মতো একেপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কিছুটা সাইড লাইনে পড়ে যাওয়ায় বিপর্যয় ঠেকানোর মতো ভূমিকা পালন করার কেউ থাকেনি। ৬.    বিভিন্ন সময়ের ক্ষমতাসীন ডানপন্থী দলগুলোর ভোটের রাজনীতিতে ঐক্য না থাকা আরেকটি কারণ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্ডেজের রাজনৈতিক দলের নাম ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, যারা ১৯৫০-১৯৬০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। এবং আদনান মেন্ডেজকে আরবিতে  আজান চালুর অপরাধে সেনাবাহিনী ফাঁসি দিয়েছিল। তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা  সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজমুদ্দিন আরবাকানের প্রতিষ্ঠিত দলের বর্তমান নাম সাদাত পার্টি, যারা অতীতে দুইবার কোয়ালিশন করে ক্ষমতায় এসেছিল। তাদের দল থেকে বেরিয়ে এসে ২০০১ সালে এরদুগান  একেপি গঠন করেছিলেন। এই কয়েকটি দলের ভোটের রাজনীতিতে ঐক্য থাকলে একেপি তথা ডানপন্থীরা আরও ভাল করতে পারতো। ৭.    সিরিয়া যুদ্ধের পর এরদুগান গত কয়েক বছরে  তুরস্কে আড়াই মিলিয়ন সিরিয়ানকে আশ্রয় দিয়েছেন, যা বামপন্থী এবং জাতিয়তাবাদীরা পছন্দ করেনি। এবং এ ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করে তা ভোটের রাজনীতিতে লাগানোর চেষ্টা করেছে। কি হতে পারে সামনের দিনগুলোতে এটা নিয়ে তুরস্ক এবং আন্তর্জাতিক মহলে চলছে বিভিন্ন রকম আলোচনা ও পর্যালোচনা। তবে সম্ভাব্য যে বিষয়গুলো হতে পারে তা হলো : ১.    একেপি অন্য দলগুলো থেকে ১৮ জনের সমর্থন নিয়ে সংখ্যালঘু সরকার গঠন করতে পারে। একেপির সাথে কোয়ালিশনে না গিয়ে কোনো দল সমর্থন দিলে এ সরকার গঠন হতে পারে। কিন্তু একেপির ব্যাপারে তিন দলেরই নেতিবাচক মনোভাব থাকায় এ ধরনের সমর্থনের সম্ভাবনা কম। ২.    একেপি ও জাতীয়তাবাদী এমএইচপি এর সাথে  কোয়ালিশন সরকার গঠনের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এমএইচপির প্রধান কোয়ালিশনে না যাওয়ার কথা বললেও দ্বিতীয় প্রধান নেতা বলেছেন তারা সম্ভাব্য যেকোনো পথ খোলা রাখবে। ৩.    একেপি ও বামপন্থী সিএইচপি কোয়ালিশন নির্বাচনোত্তর আরেকটি দৃশ্যপট হতে পারে। তবে এ ধরনের সম্ভাবনা খুবুই কম। ৪.    একেপি ব্যতীত অন্যান্য দল সিএইচপি, এমএইচপি ও এইচডিপি কোয়ালিশনের মাধ্যমেও সরকার গঠন সম্ভব। সংসদে অধিক আসনপ্রাপ্ত একেপি কোয়ালিশন বা সংখ্যালঘু সরকার গঠনের মতো সমর্থন না পেলে বাকি দলগুলোর সামনে কোয়ালিশনের পথ প্রশস্ত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে এইচডিপির পক্ষে কুর্দিবিরোধী এমএইচপি ও সিএইচপির সাথে সরকারে থাকা বেশ কঠিন হবে। তবে আন্তর্জাতিক কোনো উদ্যোগ সক্রিয় হলে এটি  অসম্ভব নয়।t2 ৫.    নির্বাচনের সরকারি ফলাফল ঘোষণার ৪৫ দিনের মধ্যে কোনো দল সরকার গঠন করতে না পারলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিতে পারেন। এই সম্ভাবনা বেশ কম হলেও এটি অসম্ভব নয়। একে পার্টি ২০০২ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশটির অভূতপূর্ব উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়। যত দিন তারা এককভাবে সরকার গঠন করতে পেরেছে তত দিন কোনো অস্থিরতা দেখা দেয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর কারণে অস্থিরতা দেখা দিলে তারা ভোটারদের উদ্দেশে স্থিতিশীল সরকার গঠনের জন্য বর্ধিত সমর্থন জনগণের কাছে চাইতে পারেন। আবার বিরোধী পক্ষের সামনেও আরও ভালো ফল করে সরকার গঠন নিশ্চিত করার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। ১৯২৪ সালে ওসমানী খিলাফতের পতনের পর সেনাশাসক মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের হাত দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীন  তুরস্ক প্রজাতন্ত্র গঠনের পর হতে ২০০৮ সালে এরদুগান কর্তৃক গণভোটে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা হ্রাস করার পূর্ব পর্যন্ত কোনো ইসলামপন্থী কিংবা ডানপন্থী দল ভালোভাবে সরকার পরিচালনা করতে পারেনি, যার কারণেই ৩ বার সেনা ক্যু এর মাধ্যমে ইসলামপন্থীদের হটানো হয়েছিল। এরদুগান গত ১৩ বছরে তুরস্কের স্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট, আইনের শাসন, ইসলামী কালচারালের প্রয়োগের রাস্তা প্রশস্তকরণ,  গোটা দুনিয়ার মুসলিম দেশগুলোর পক্ষে শক্ত ভূমিকা এবং বঞ্চিত মুসলমানদের জন্য যতটুকু করেছেন তা সত্যিই অনেক প্রশংসার দাবি রাখে। তবে এরদুগানের এ জনপ্রিয়তাকে ঠেকানোর জন্য গত নির্বাচনে সর্বাত্মক ভূমিকা রেখেছিল তুরস্কের ভেতরের এবং বাইরের শক্তিগুলো। এবং এরাই ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তাসকিম  গেজে পার্কের আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে হটানোর চেষ্টা করেছিল। তুরস্কের এবারের নির্বাচন পুরো মধ্যপ্রাচ্য তথা মুসলিম দুনিয়ার জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রেসিডেন্ট এরদোগান মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ব্রাদারহুড ও অন্যান্য ইসলামি আন্দোলনের একজন কড়া পৃষ্ঠপোষক।  মুরসিকে সমর্থন করায় মিসরের সিসি সরকারের সাথে তুরস্কের শীতল সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে একে পার্টির সাফল্য বা ব্যর্থতা বিশ্বের অন্য দেশের ইসলামি দলগুলোর ওপর বেশ খানিকটা প্রভাব ফেলবে। আর কোনো কারণে একেপি সরকার গঠন না করতে পারলে নিঃসন্দেহে এর প্রভাব হবে আরও মারাত্মক। আর এ কারণেই পশ্চিমা শক্তি, ইউরোপ, ইসরাইল কিংবা ইরানের যে এক অদৃশ্য শক্তি তুরস্কে কাজ করেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কি হতে যাচ্ছে তুরস্কে? এটা দেখার জন্য হয়তোবা আরও কিছুদিন সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে। লেখক : পিএইচডি গবেষক, আংকারা গাজি ইউনিভার্সিটি, তুরস্ক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির