post

তৃতীয়বারের মতো নওয়াজ শরিফের বিজয়

১৬ জুন ২০১৩

মীযানুল করীম পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে মুসলিম লীগ (এন) তৃতীয়বারের জন্য সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। পার্লামেন্ট নির্বাচনের এই ফলাফল পূর্বাভাসের সাথে অনেকটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিভিন্ন মহল বলেছিল নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনার পাশাপাশি ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফও বেশ ভালো ফল করে শক্তিশালী জাতীয় দল হিসেবে আবির্ভূত হবে। এমনকি ইমরান পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে পারেনÑ এ ধরনের আশা প্রকাশ করেছেন অনেকেই। তার দল কিন্তু প্রত্যাশামাফিক ভালো ফল করতে পারেনি। এ দিকে তৃতীয়বারের মতো সরকারের হাল ধরছেন মিয়া মোহাম্মদ নওয়াজ শরিফ। এক দিকে জঙ্গি-তালেবানের তাণ্ডব, অপর দিকে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর ড্রোন হামলায় বিপন্ন-বিপর্যস্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচন হয়েছে ১১ মে। বহুলালোচিত এ নির্বাচনে কেন্দ্রে পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) ৩৪২ আসনের মধ্যে ১৭২ আসন, তথা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে এমন খবর পাওয়া যায় ১২ তারিখ সকালে। তখন টিভিতে জানানো হয়, ‘মধ্য ডানপন্থী’ পিএমএল (নওয়াজ) ১৩০ আসন নিশ্চিত করে জয়ের দৌড়ে সর্বাগ্রে। তেহরিক-ই-ইনসাফ এবং পিপলস পার্টি ওই সময়ে ৩০টির মতো আসন পেয়ে পরস্পর সমপর্যায়ে ছিল। বাস্তবে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, বেসরকারিভাবে নির্বাচনী ফল প্রকাশ করার আগেই নওয়াজ নিজের বিজয় ঘোষণা করতে সক্ষম হয়েছেন। ১১ মে রাতে লাহোরে দলের অফিসে সমাগত বহু সমর্থকের উদ্দেশে বক্তৃতায় নওয়াজ শরিফ আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান মুসলিম লীগকে আবার দেশের সেবার সুযোগ দেয়ায়। তিনি সব দলকে অনুরোধ করেন একই টেবিলে বসার জন্য, যাতে ‘দেশের সমস্যার সুরাহা করা যায়।’ নওয়াজের দলের বিজয়-আনন্দ কিঞ্চিৎ ম্লান হয়ে গেছে। কারণ তার নিজের প্রদেশ পাঞ্জাবে ১৫টি আসন হারালেন ইমরান খানের দলের কাছে। এবারের নির্বাচনে সাবেক সেনাশাসক পারভেজ মোশাররফের গড়া মুসলিম লীগ (কায়েদে আজম) নেই। কারণ আমেরিকা থেকে ফিরে মোশাররফ মামলার কবলে পড়ে গ্রেফতার ও রিমান্ডের পর এখন বন্দী। তার বিরুদ্ধে বেনজির ভুট্টোকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। পাকিস্তানের এটি ছিল চতুর্দশ সাধারণ নির্বাচন। কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টের ৩৪২ আসনের মধ্যে ২৭২টি ‘সাধারণ’ আসন। এর বিন্যাস এরকম : কেন্দ্রীয় রাজধানী-২, কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল (ঋঅঞঅ) ১২, পাঞ্জাব ১৪৮, সিন্ধু ৬১, খাইবার পাখতুন খোয়া (কচক) ৩৫ এবং বালুচিস্তান ১৪। এর বাইরে আছে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৬০ এবং সংখ্যালঘুদের জন্য নির্ধারিত ১০ আসন। দেশটির জনসংখ্যা ১৮ কোটি ২০ লাখ। মোট ভোটার ছিলেন আট কোটি ৬২ লাখের মতো। এর মধ্যে পুরুষ ও মহিলা যথাক্রমে প্রায় চার কোটি ৮৬ লাখ এবং প্রায় তিন কোটি ৭৬ লাখ। প্রাদেশিক পরিষদগুলোর সদস্যসংখ্যা : পাঞ্জাব ৩৭১, সিন্ধু ১৬৮, খাইবার পাখতুন খোয়া ১২৪ এবং বালুচিস্তান ৬৫। এবার কেন্দ্রে সাড়ে চার হাজারের কিছু বেশি এবং প্রদেশগুলোতে মোট প্রায় ১১ হাজার প্রার্থী ছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী বড় দলগুলো হচ্ছে বিদায়ী সরকারে ক্ষমতাসীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), পাকিস্তান মুসলিম লীগ (এন), মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম), পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই), আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি (এএনপি), জামায়াতে ইসলামী ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। মালয়েশিয়ায় ক্ষমতাসীনদের প্রশ্নবিদ্ধ বিজয় মালয়েশিয়ার নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোট ‘ভাগ্যজোরে’ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। এই গরিষ্ঠতা বাস্তবে উল্লাসের বদলে উৎকণ্ঠার কারণ হতে পারে। ৫ মে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পার্লামেন্টগুলোর নির্বাচন সম্পন্ন হয়। এতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ক্ষমতাসীন বারিসান নাসিওনাল বা ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবং সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের পাকাতান রাকায়েত বা পিপলস অ্যালায়েন্স। নির্বাচনে ভোট গ্রহণের ৮ ঘণ্টা পর নির্বাচন কমিশনের প্রধান আজিজ ইউসুফ প্রাথমিক ফলাফল ঘোষণা করেন। কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে ২২২ আসনের ১৩৩টিতে বারিসান এবং ৮৯টিতে পাকাতান জিতেছে। ‘বাঘে-মহিষে লড়াই হবে বলে কে জেতে, তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত’Ñ ব্যাপকভাবে এমন ধারণার মধ্যেই নাজিব রাজাক শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে গেলেন। তার নেতৃত্বাধীন বারিসান আপাতত উৎরে গেছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে পরিচালিত জরিপে ব্যক্তি হিসেবে আনোয়ারের জনপ্রিয়তা নাজিবের চেয়ে বেশি দেখা গেছে। তা ছাড়া বিরোধী জোটের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির আভাসও মিলেছিল। তাই  বেশির ভাগ লোকের ধারণা ছিল, ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর থেকে একটানা ক্ষমতাসীন ‘আমনো’ দলটিকে এবার হেরে বিদায় নিতে হবে। যা হোক, বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি কারচুপি ও অনিয়মের গুরুতর অভিযোগ আনলেন সরকারের বিরুদ্ধে। ভোটারদের নখে লাগানো ‘অমোছনীয়’ কালি ভোট দেয়ার পরই উঠে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে সন্দেহ হচ্ছে, অনেকের বেলায় এমনটি ঘটে থাকতে পারে। তা হলে বহু জালভোট পড়ার আশঙ্কা করাই স্বাভাবিক। মিডিয়া জানায়, একটি নির্বাচন কেন্দ্রের দায়িত্বশীল এই কালির ব্যাপারে অভিযোগ পেয়েও কোনো ব্যবস্থা নেননি; বরং রহস্যময় হাসি হেসেছেন। তাই সন্দেহ হয়, তিনি ‘কালির কারসাজি’ অবগত কিংবা এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার সাধ্য নেই। এ দিকে আনোয়ারের জোট আরো অভিযোগ এনেছে, ‘দোদুল্যমান’ আসনগুলো পাওয়ার উদ্দেশ্যে বারিসান সরকার ‘বিদেশী’ ভোটারদের সুযোগ দিয়েছে ভোট দেয়ার। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকেরাও সন্দেহ করেছেন, ‘দাল মে কুছ কালা হ্যায়।’ মালয়েশিয়ার নির্বাচনে এক কোটি ৩০ লাখ ভোটারের রেকর্ডসংখ্যক ৮০ শতাংশ অংশ নিয়েছেন। ভোট দিলেন ফেডারেল সংসদের ২২২টি এবং ১২ রাজ্যের প্রাদেশিক সংসদের ৫০৫টি আসনে প্রার্থী নির্বাচনের লক্ষ্যে। প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায়, ‘বারিসানের শক্ত ঘাঁটি’ জোহর বারু, পাহাং, সাবাহ-সারাওয়াক ও মালাক্কায় ক্ষমতাসীনরা জয়ী হয়েছেন। আর বিরোধী জোট জয়লাভ করছে পেরাক, ননাং, সেলাঙ্গর ও কেলানতান রাজ্যে। নির্বাচনে বারিসান একটি ছাড়া কেন্দ্রের সব আসনে এবং ১২টি প্রদেশের সব ক’টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। বিরোধী মোর্চা পাকাতানের শরিক পিকেআর দল কেন্দ্রে ৯৯টি এবং প্রদেশে ১৭২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল। এ জোটের ইসলামপন্থী দল, ‘পাস’ কেন্দ্রে ৭৩ এবং প্রদেশ পর্যায়ে ২৩৬ আসনে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল। বিরোধী জোটের আরেক অংশীদার, ডিএপি কেন্দ্রে ৫১টি আর প্রদেশগুলোর ১০৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়। এবার বিরোধী জোট আগের চেয়ে অনেক বেশি আসন পাওয়ার আশা ছিল। এমনকি কোনো কোনো মহল বলেছিলেন,  বিরোধী দলগুলোর মোর্চা দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জেতার মতো বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনও অসম্ভব নয়। ফলাফলে দেখা গেছে, আনোয়ারের পিকেআর একটি হারিয়ে ৩০টি আসন ধরে রেখেছে। পাস হারিয়েছে দুইটি, ধরে রেখেছে ২১টি আসন। অপর দিকে প্রভাবশালী চীনা সম্প্রদায়ের ডিএপির আসন ২৮ থেকে ৩৮টিতে উন্নীত হয়েছে। মোট মিলিয়ে পাকাতান রাকায়াত জোটের আসন ৭টি বেড়ে পৌঁছেছে ৮৯-এ। তবে প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় এটা তেমন সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না। বরং সংখ্যাগুরু মালয়ীদের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে আর্থিকভাবে এগিয়ে থাকা চীনা জনগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান প্রভাব। বারিসান জোটে তাদের দল এমসিএর আসন ১৫ থেকে ৬টিতে নামলেও তারা বিরোধী জোটের ডিএপির মাধ্যমে সংগঠিত শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় চীনারা প্রভাব বাড়াতে চাইলে মালয়ী জনগোষ্ঠীর বিরূপ প্রতিক্রিয়াই স্বাভাবিক। ইতোমধ্যেই চীনাদের দল ডিএপির ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এর একজন বড় নেতা নির্বাচনে একই জোটের ইসলামপন্থী দল ‘পাস’কে ভোট না দিতে বলেছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় অনেক মালয়ী মুখ ফিরিয়ে নেন বিরোধী জোট থেকে। এর বিপরীতে মাহাথিরের মতো প্রবীণ নেতা ক্ষমতাসীন জোটের সপক্ষে নেমে বক্তব্য দিয়েছেন। এতে অনেকেই হয়েছেন প্রভাবিত। যখন আনোয়ার ইব্রাহিম নির্বাচনে কারচুপির বিরুদ্ধে সারা দেশে বিক্ষোভের ডাক দিচ্ছেন, তখন বিজয়ী নাজিব রাজাক জনগণের মধ্যে সংহতি ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দিচ্ছিলেন। বিরোধী দলের পক্ষে ‘চীনা সুনামি’ বয়ে যাওয়া সুফল দেয়নি। আর নাজিব বলছেন, তিনি বিপর্যয় ঠেকাতে পেরেছেন নিজের দল ও জোটের। তবে পর্যবেক্ষকদের অভিমত, জিতলেও নাজিব রাজাকের সম্মুখে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। দলের বাইরে জনসমর্থনের অপর্যাপ্ততা আর দলের ভেতরে ক্ষমতা হারানোর শঙ্কা মিলে নাজিবের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ প্রয়োজন যে, এবার মোটের ওপর ভোট বেশি পেয়েও বিরোধীরা কম আসন এবং ক্ষমতাসীনেরা কম ভোট বাগিয়েও বেশি আসনে জিতেছে। কারণ বারিসান বেশি জয়ী হয়েছে কম ভোটার, এমন আসনে। মালয়েশিয়ার দু’টি অংশ। মূল ভূখণ্ড এবং সুবৃহৎ দ্বীপের অংশ সাবাহ-সারাওয়াক। এবার সাবাহ-সারওয়াকে বারিসান ৪৬টি আসন বেশি পেল পাকাতানের চেয়ে। অর্থাৎ দেশের বাকি অংশে পাকাতান সামান্য ব্যবধানে হলেও বেশি আসনে জিতেছে। তার আরেকটি সান্ত্বনা, বারিসান গতবার হারানো সংখ্যাগরিষ্ঠতা ফিরে পায়নি। তদুপরি ৭টি আসন খোয়াতে হলো তাদের। এ ছাড়া বর্তমান মেয়াদের শুরুতেই নাজিবের অস্বস্তি। কারণ হয়তো চলতি বছর শেষ হওয়ার সাথে সাথে তার  প্রধানমন্ত্রিত্বও শেষ হয়ে যাবে দলের চাপে। এর বিপরীতে আনোয়ারের পাকাতানের ৭টি আসন বেড়েছে। তারা ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। বারিসান ৬০ শতাংশ ভোট পেলেও ৪৪ বছরে এটাই তাদের প্রতি সর্বনিম্ন জনসমর্থন। অথচ নাজিব হারানো আসন পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার করেছিলেন, ক্ষমতাসীন জোট শহরের চেয়ে গ্রামে আগের চেয়ে ভোট পেয়েছে কম। রাজধানীসংলগ্ন সেলাঙ্গরের মতো গুরুত্বপূর্ণ শিল্প প্রদেশ এবং প্রধান বন্দর পেনাং এলাকার নিয়ন্ত্রণও ফিরে পায়নি ভোটাভুটিতে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বারিসান জোট ভালো ফল না করায় তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী আবদুল্লাহ আহমদ বাদাবিকে সরকার ও দলÑ দু’টিরই প্রধানের পদ ছাড়তে হয়েছিল। আমনো দলের বর্তমান প্রধান নাজিব রাজাকও হয়তো সে পথেই হাঁটছেন। অক্টোবর বা নভেম্বর মাসে দলের সম্মেলনে তিনি নিজের নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারবেন কি না বলা কঠিন। লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির