post

দারসুল হাদিস

০৯ সেপ্টেম্বর ২০১২
সরল অনুবাদ : হজরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম (সা) ইরশাদ করেছেন : দুনিয়া ঈমানদারের বন্দিশালা এবং কাফিরের জান্নাত (সহীহ আল মুসলিম) বর্ণনাকারীর পরিচয় হজরত আবু হুরাইরা (রা) হলেন সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী। আবু হুরাইরা তার উপাধি। ইসলাম গ্রহণের আগে তার নাম ছিল ‘আবদে শামস’ বা আবদে ওমর। রাসূলে আকরাম (সা) সে নাম পরিবর্তন করে ‘আব্দুর রহমান’ রাখেন। ইসলাম গ্রহণের পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মতো তিনি নবী (সা) এর সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন। সর্বদা মসজিদে নববিতে পড়ে থাকতেন। তিনি ছিলেন আসহাবে সুফফাদের অন্যতম একজন। তিনি সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী হওয়ায় অনেকে তাকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। তাই তিনি বলেন, ‘তোমরা হয়তো মনে করছো আমি খুব বেশি হাদিস বর্ণনা করি। আমি ছিলাম হতদরিদ্র। পেটে পাথর বেঁধে সর্বদা রাসূলে আকরাম (সা) এর সাহচর্যে কাটাতাম। আর মুহাজিররা ব্যস্ত থাকতো ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে আর আনসারগণ ব্যস্ত থাকতো ধনসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে।’ হজরত আবু হুরাইরা (রা) ছিলেন জ্ঞানের সাগর। মহানবী (সা) নিজেই বলেছেন : ‘আবু হুরাইরা জ্ঞানের আধার।’ (বুখারী) হাদিসের এই জীবন্ত উজ্জ্বল নক্ষত্র হিজরি ৫৯ সনে ৭৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁর বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা মোট ৫ হাজার ৩৭৪টি। হাদিসটির গুরুত্ব মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা। দুনিয়া মানুষের কর্মক্ষেত্র। এখানে আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক জীবন পরিচলনা করতে হবে। যাদের জীবন আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক হবে, তারাই মুমিনের মর্যাদা লাভ করবেন। আর যারা ইচ্ছেমতো আল্লাহর নির্দেশের সীমা অতিক্রম করে জীবন পরিচালনা করবে তারাই কাফির। সে জীবনদর্শনের দিকে ইঙ্গিত করেই এ হাদিসের বক্তব্য। প্রকৃতপক্ষে একজন মুমিন ও কাফিরের জীবনের স্বরূপ উন্মোচন করা হয়েছে উল্লিখিত হাদিসটিতে। ব্যাখ্যা বন্দিশালায় কোন কয়েদি পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। বন্দিজীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কর্তৃপক্ষের আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ আইন লঙ্ঘন করার অধিকার কোন বন্দীর নেই। যখন যে আদেশ তাকে দেয়া হয় সে আদেশ মানতে সে বাধ্য। বন্দী কখনো এ কথা বলতে পারে না যে, আমি এ আদেশ মানবো, অমুক আদেশ মানবো না। দুনিয়ার জীবনও মুমিনের জন্য বন্দিশালার মতো। কারণ এখানে সে পূর্ণ স্বাধীন নয়। মন যা চায় তা সে করতে পারে না। দুনিয়ার প্রেমে প্রেমাসক্ত হয়ে মুমিন আল্লাহর হুকুমের বিপরীত কোন হুকুম পালন করতে পারে না। অপর দিকে জান্নাতের বৈশিষ্ট্য হলো সেখানে কোন কাজ ও তৎপরতা নিয়ন্ত্রিত নয়। ইচ্ছেমতো জীবন যাপন করতে পারবে। জান্নাতিদের কোন ইচ্ছে অপূর্ণ থাকবে না। সর্বত্র সুখ আর সুখ। জান্নাতের আরাম আয়েশ ছেড়ে জান্নাতিগণ কখনো বাইরে যেতে চাইবে না। কোটি কোটি বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও কোন জান্নাতবাসী হাঁফিয়ে উঠবে না। যদিও পৃথিবী কখনো জান্নাতের সাথে তুলনীয় হতে পারে না। তবুও পৃথিবীকে কাফিরদের জান্নাত বলার অর্থ হচ্ছে কাফিররা দুনিয়াকে জান্নাত মনে করে। তারা তাদের জীবনকে আল্লাহপ্রদত্ত সীমার বাইরে থেকে ভোগ করতে চায়। তারা দুনিয়ার জীবনকে উপভোগ করার জন্য সম্ভাব্য সকল পথ অবলম্বন করে থাকে। প্রবৃত্তির হুকুম ও চাহিদা অনুযায়ী জীবন যাপন করে। তারা আখিরাতে বিশ্বাসী না হওয়ার কারণে দুনিয়ার জীবনকে সুন্দর ও উপভোগ্য করার জন্য জীবনপাত করে। অথচ একদিন তাকে এ সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে খালি হাতে মুসাফিরের মতো বিদায় নিয়ে চলে যেতে হবে। বন্দীগণ যেমন বন্দিশালাকে নিজের গৃহ মনে করে না, নিজ গৃহে ফেরার জন্য সর্বদা ব্যাকুল থাকে। তেমনি মুমিনগণ পৃথিবীকে আবাসস্থল মনে করে না। তাই দুনিয়ার জীবনে আরাম আয়েশ ও ভোগ বিলাসের মোহ তার থাকে না। বরং তার মন চির সুখের জান্নাতে যেতে ব্যাকুল থাকে। এ জন্য সে তা লাভ করার জন্য কঠিন প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকে এবং সকল বিপদ আপদ দুঃখ-কষ্টকে হাসিমুখে বরণ করে নেয়। আল্লাহ বলেন, ‘‘বস্তুত আমরা মানুষকে কঠোর কষ্ট ও শ্রমের মধ্যে সৃষ্টি করেছি।” (সুরা বালাদ : ৮) সুতরাং এ দুনিয়া মানুষের জন্য আরাম আয়েশের জায়গা নয় বরং কঠোর শ্রম ও কষ্টের জায়গা। পৃথিবীর সকল সুখ, আরাম আয়েশ একত্র করলেও আখিরাতের তুলনায় খুবই নগণ্য। রাসূলে আকরাম (সা) বলেন : আল্লাহর কসম! আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার দৃষ্টান্ত হলো তোমাদের কোন ব্যক্তি সমুদ্রের মধ্যে তার আঙুল ডুবিয়ে দেখল যে, তাতে কত পানি লেগে এসেছে। (মুসলিম) অন্য হাদিসে আছে যে, গোটা পৃথিবীর মূল্যও আল্লাহর নিকট মাছির পালকের তুল্য নয়। তাই এই নগণ্য বস্তুর পেছনে যারা ব্যস্ত থাকে তারা বোকা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর যদি পরকালের অনন্ত সুখ-সম্ভার চির-বসন্ত বিরাজিত জান্নাত কেউ পেতে চায় তবে তাকে কঠোর পরিশ্রমের পথই বেছে নিতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। শিক্ষাবলি ১. দুনিয়ার সুখ আসল ও চিরস্থায়ী নয়। ২. পৃথিবী মানুষের স্থায়ী নিবাস নয় সাময়িক পরীক্ষাকেন্দ্র মাত্র। ৩. পরকালের বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের কারণেই মানুষের কৃতকর্মে দুটো ধারার সৃষ্টি হয়। ইতিবাচক ও অপরটি নেতিবাচক। ৪. ইতিবাচক পথের শেষ মানজিল জান্নাত এবং নেতিবাচক পথের শেষ মানজিল জাহান্নাম। তথ্যসূত্র : ১. সহীহ আল মুসলিম। ২. মিশকাতুল মাসাবিহ। ৩. মা’আরিফুল কুরআন : মুফতি মুহাম্মাদ শফী।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির