post

দুই সংস্কৃতির সমস্যা । এবনে গোলাম সামাদ

০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

দুই সংস্কৃতির সমস্যাপ্রথিতযশা বিজ্ঞানী এবং খ্যাতিমান সাহিত্যিক সি পি স্নো ১৯৫৯ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বক্তৃতাটির বিষয় ছিল, ‘দুই সংস্কৃতি’ (The Two Cultures) এই বক্তৃতায় তিনি বোঝাতে চান, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা দুই সংস্কৃতির সমস্যা সৃষ্টি করছে। যারা বিজ্ঞান পড়ছে তারা মানবিক বিষয় সম্বন্ধে থাকছে অজ্ঞ। পক্ষান্তরে যারা মানবিক বিষয়সমূহ পড়ছে তারা জানছে না বিজ্ঞান সম্বন্ধে। এই না জানার ফলে এই দু’ভাবে শিক্ষিতের সংস্কৃতি হয়ে পড়ছে ভিন্ন। যারা বিজ্ঞান পড়ছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যা হচ্ছে, যারা মানবিক বিদ্যা অনুশীলন করছে, অর্থাৎ সাহিত্য, ভাষা, ইতিহাস এবং দর্শন পড়ছে, তাদের তা হচ্ছে না। জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে দৃষ্টিকোণ হচ্ছে ভিন্ন। আর তাই এই দুয়ের (সংস্কৃতির) ক্ষেত্রে ঘটছে বিভাজন। আগের দিনের শিক্ষাব্যবস্থায় এতটা বিভাজন সৃষ্টির সুযোগ ছিল না। সি পি স্নো বলেন, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার একটা লক্ষ্য হওয়া উচিত এই ব্যবধান যাতে কমে আসে তার চেষ্টা করা। তার এই বক্তৃতা বিলাতের শিক্ষাজগতে বেশ আলোচ্য হতে পেরেছিল। শিক্ষার আদর্শ এবং প্রয়োজন নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু বলেছেন। একজন খ্যাতনামা সমাজতাত্ত্বিকের মতে, ‘বিজ্ঞান মানুষের মনে সত্যের প্রতি অনুরাগ জন্মায়। শিল্পকলা চর্চা মানুষের মনে বাড়ায় সৌন্দর্যবোধ। আর সাহিত্য এবং ইতিহাস চর্চার ফলে মানবমনে সৃষ্টি হতে পারে কল্যাণের আকর্ষণ ও অকল্যাণের প্রতি বীতরাগ।’ সামগ্রিক শিক্ষানীতি প্রণয়নে তাই এদের সবার ওপর থাকতে হবে গুরুত্ব। মানুষকে শিক্ষিত করার লক্ষ্য হলো তার দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা। আর যাকে বলে প্রশিক্ষণ তার লক্ষ্য হলো মানুষকে কোন একটা বিশেষ কাজের জন্য উপযোগী করে তোলা। শিক্ষা আর প্রশিক্ষণ এক অর্থবোধক নয়। বিলাতের এক সময়কার জনপ্রিয় দার্শনিক জোয়াড বলেছেন, শিক্ষার লক্ষ্য হলো তিনটি: মানুষকে জীবিকার জন্য উপযুক্ত করা, গণতান্ত্রিক দেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে উপলব্ধি করে সুনাগরিক হওয়ার উপযুক্ত হতে ব্যক্তিকে সাহায্য করা এবং সব মানুষের মধ্যে যে সুপ্ত সৃজনীশক্তি থাকে তার বিকাশে সহায়তা করা। জোয়াডের মতে, ‘যাদের সাধারণ শিক্ষার ভিত্তি দৃঢ় হয়, তারা নতুন প্রযুক্তি অনেক সহজে গ্রহণ করতে পারে। কারণ, সাধারণ শিক্ষা মানুষকে যুক্তি, বুদ্ধি প্রয়োগে অধিক কুশলী করে।’ দুই সংস্কৃতির সমস্যাআমাদের দেশে দুই সংস্কৃতির সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এটা কেবলই যে বিজ্ঞান আর মানবিক বিদ্যাসমূহ পৃথকভাবে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে বলে ঘটছে, তা নয়। আমাদের দেশে সৃষ্ট এই সমস্যার স্বরূপ বুঝতে হলে আরো কতগুলো আনুষঙ্গিক বিষয়ের আলোচনা করতে হয়। বিজ্ঞান বলতে আমরা সাধারণভাবে বুঝি বস্তুজগৎ এবং সমাজজীবনের কাঠামো ও আচরণ নিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে আলোচনা। যার ভিত্তি হলো পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষণ। বিজ্ঞান অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করে না। তার লক্ষ্য পর্যবেক্ষণলব্ধ বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে সম্বন্ধ নির্ণয়। বিচার করে দেখা, তা থেকে কোন সাধারণ নিয়ম (Law) পাওয়া সম্ভব হচ্ছে কি-না। অর্থাৎ কোন্ কোন্ ঘটনা কোন্ কোন্ ঘটনার সঙ্গে নিত্য সম্বন্ধযুক্ত তা নিরূপণ করতে চায় বিজ্ঞান। সমাজের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের পদ্ধতি নির্ভর করে কেবল পর্যবেক্ষণের ওপর। সমাজবিজ্ঞানকে তাই বলতে হয় অসম্পূর্ণ বিজ্ঞান। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা কিছু প্রবণতা খুঁজে পেতে পারি। যাকে বলা যেতে পারে সাধারণ প্রবণতা। এই যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি, এটা আমরা পাই ইউরোপের কাছ থেকে। ইংরেজ রাজত্বের আগে আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। যুক্তিকেন্দ্রিক তা ছিল না। ইউরোপেও শিক্ষাব্যবস্থা এক সময় ধর্মকেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু ক্রমে ক্রমে সেখানে শিক্ষায় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারতা লাভ করতে থাকে। মানুষ জিজ্ঞাসু হয়ে ওঠে। শাস্ত্র কিংবা গুরু উপদেশ শিক্ষার ক্ষেত্রে আর মুখ্য স্থান অধিকার করে থাকে না। এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের দেশে আসে বাইরে থেকে। এটা আমরা লাভ করি পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমে। আমাদের দেশে দুই সংস্কৃতির সমস্যা দেখা দেয় পাশ্চাত্য শিক্ষা আর আমাদের দেশের সনাতন শিক্ষার মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হওয়ার ফলে। বিজ্ঞানকে আমরা ভাবতে থাকি বিদেশী জিনিস, দেশী জিনিস নয়। আমরা গৌরব করতে চাই কবিরাজি আর হেকেমি চিকিৎসা নিয়ে। ইউরোপে ঠিক এমন কিছু ঘটতে পারে না। কারণ, ইউরোপে চিকিৎসাবিজ্ঞান বিকশিত হয় তার ভেতরের চেষ্টায়। যদিও ধর্মতাত্ত্বিকরা অনেক বিষয়ের বিরোধিতা করেছেন। যেমন মৃতদেহ কেটে গবেষণা করবার; অজ্ঞান করে অস্ত্রোপচারের। ধর্মতাত্ত্বিকরা মনে করতেন প্রসূতিকে সন্তান প্রসবের সময় কষ্ট পেতেই হবে। কারণ, তা হলো ঈশ্বরের বিধান। চিকিৎসকের উচিত নয় এই কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করা। কিন্তু ইউরোপে মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কৃত হয়েছে। তা দিয়ে দেখে জীবাণু আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে। মানুষ জেনেছে বহু রোগ হয় জীবাণুর আক্রমণে; শয়তানের প্রভাবে নয়। যৌনব্যাধির জীবাণু আছে। তা হলো জীবাণুজনিত রোগ। অনৈতিকতার কারণে তা হয় না। মানুষ যতই অনৈতিক হোক, যৌনরোগের জীবাণু না থাকলে মানুষ কখনো কোন যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে না। আমরা জীবাণুর কথা জানতাম না। কলেরা রোগের জীবাণু আবিষ্কারের জন্য জার্মান বিজ্ঞানী ‘কক’কে আসতে হয়েছিল কলকাতায়। আমরা ইউরোপীয় আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে বলেছি ইউরোপীয় সভ্যতা হলো জড়বাদী (Materialistic) আর আমাদের সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত অধাত্ম চেতনার (Spiritual values) ওপর। এখানে দুই সংস্কৃতির সমস্যা সৃষ্টি হয় ভিন্ন কারণে। এখানে শিক্ষার জগৎ বিভক্ত হয়ে পড়ে পাশ্চাত্য আর স্বদেশী শিক্ষার মধ্যে। স্বদেশী শিক্ষায় পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান স্থান পেতে চায় না। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে এ দেশেও নানা বিষয়ে গবেষণা আরম্ভ হয়। মানুষের মন সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এর পাশাপাশি অনেক প্রবলভাবেই থাকে বিজ্ঞানকে অস্বীকারের চেষ্টা। দুই সংস্কৃতির সমস্যামুসলমান সমাজে সর্বত্রই ইংরেজবিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধেছে। ইংরেজি তথা পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণে বিরোধিতা করা হয়েছে। সমগ্র বাংলায় ঊনবিংশ শতকে চলেছে ওয়াহাবি আন্দোলন। যা এ দেশে আসে আরব থেকে। মানুষ এর প্রভাবে হতে চায় বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদী মুসলমান। এর ফলে বাংলার মুসলমান সমাজে বাড়ে মক্তব- মাদরাসা শিক্ষার প্রভাব। ইংরেজি শিক্ষাকে ভাবা হতে থাকে ইহজাগতিক। তা পারলৌকিক মুক্তির সন্ধান দিতে পারে না বলেই পরিত্যাজ্য। বাংলায় নবাব আবদুল লতিফ চান মুসলমান সমাজে জাগরণ আনতে। আধুনিক বিশ্বের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা সম্বন্ধে মুসলমানদের সজাগ করতে। তিনি ১৮৬৩ সালে স্থাপন করেন “মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি”। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে মুসলমান সমাজে মানসিক সচেতনতা সৃষ্টি করা এই সোসাইটির লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। নবাব আবদুল লতিফের চেষ্টায় দু’টি সরকারি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। একটি রাজশাহী শহরে, আর একটি চট্টগ্রামে। এই দু’টি সরকারি মাদরাসায় ধর্মীয় বিষয়ের সঙ্গে অন্য বিষয় শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। আরবি-ফারসির সঙ্গে ইংরেজি ভাষাও শিক্ষা দেয়া হতে থাকে। নবাব লতিফ চেয়েছিলেন এমন একটা মিশ্র শিক্ষাব্যবস্থার উদ্ভব করতে, যাকে মুসলমানরা বিদেশী ভাববে না, ইসলামবিরোধী মনে করবে না। কিন্তু সেই সঙ্গে এর মাধ্যমে এসে পৌঁছাতে পারবে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো। ক্রমে ক্রমে মুসলিম সমাজের একাংশের মনেও জাগতে থাকে বিশ্বজগৎ সম্বন্ধে জানবার কৌতূহল। আগ্রহ দেখা দেয় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি। নবাব সলিমুল্লার বিশেষ চেষ্টায় ঢাকায় ১৯২১ সালে স্থাপিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যার মাধ্যমে পূর্ব বঙ্গের মুসলিম সমাজে একটা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী দ্রুত গড়ে ওঠা সম্ভবপর হয়। হিন্দুরা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনের প্রচণ্ড বিরোধিতা। কারণ, তারা ভাবেন এর ফলে তাদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইংরেজ আমলেই পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলমান আর সনাতন ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে একটা বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। যার জের এখনও চলছে। বরং বলতে হয় সম্প্রতি কিছুটা বেড়েই উঠেছে। আমাদের আলেমসমাজ বিরোধিতা করতে আরম্ভ করেছেন ইউরোপের কাছ থেকে পাওয়া প্রাকৃতিক বিজ্ঞান গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণার। তারা বিদ্যালয়ে চাচ্ছেন আরবি ভাষা শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে। তাদের বক্তব্য আরবি ভাষার মাধ্যমেই প্রকাশ ঘটেছে ইসলাম ধর্মের। এই ভাষার মাধ্যমেই বাড়তে পারে ইসলাম সম্বন্ধে জ্ঞান। আরবি ভাষার মাধ্যমেই কেবল শক্ত হতে পারে মুসলিম উম্মাহর প্রতি টান। বাড়তে পারে বিশ্ব মুসলিম ঐক্য। এর যে ধরনের জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন, তা বাংলাভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। খুব বেশি দিনের কথা নয়, একসময় বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে অনেকেই ভাবতেন, বাংলা হলো হিন্দুর ভাষা, এটা ঠিক তাদের ভাষা নয়। ভাষা নিয়ে এই বিভ্রান্তি অবশ্য বেশ পুরনো। বাংলাভাষায় মুসলমান কবিদের লেখার পরিচয় আমরা পাচ্ছি খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে শাহ মুহাম্মদ সগীর (বা সগিরী) রচনা করে ‘ইউসুফ-জুলিখা’ কাব্য, পারস্যের কবি জামীর (১৪১৪-১৪৯২ খ্রি:) লেখা ‘ইউসুফ-জোলেখা’ কাব্যের অনুসরণে। তিনি বাংলায় কাব্য রচনার কৈফিয়ত দিতে গিয়ে বলেছেন, তিনি বাংলায় লিখছেন বাংলাভাষী মানুষের জন্য। তার কথায়, তিনি যা লিখছেন, তা কোন বানানো কাহিনী নয়। এর ভিত্তি, আছে ইসলামী কেতাবে। তিনি তা কেবল বলতে যাচ্ছেন বাংলা ভাষায়: ইছফ-জলিখা কেচ্ছা কিতাব প্রমাণ দেশী ভাষে মোহাম্মদ ছগিরী এ ভান। এরপর বাংলা ভাষায় যে মুসলমান লেখকের লেখা আমরা পাচ্ছি, তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরগলপুর নিবাসী সৈয়দ সুলতান। তিনি অনেকগুলো বই লেখেন : নবীবংশ, শবেমেরাজ, জ্ঞানপ্রদীপ। তিনি বাংলাভাষায় বই লেখার যুক্তি দিতে গিয়ে বলেছেন: আল্লাএ বুলিছে, ‘মুঞি যে দেশে যে ভাষা সে দেশে সে ভাষে কৈলু রসুল প্রকাশ। এক ভাষে পয়গম্বর এক ভাষে নর। বুঝিতে ন পারিব উত্তর পদুত্তর। আজ আমাদের দেশের কিছু ‘ইসলামপন্থী’ যেন চাচ্ছেন এই ঐতিহ্যটুকুকে আবার অস্বীকার করে খাঁটি মুসলমান হতে। যার ফলেও দেখা দিচ্ছে, বলতে গেলে আর একভাবে দুই সংস্কৃতিরই সমস্যা। ইসলামের ইতিহাস আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, ভাষার সমস্যা অন্যত্রও ছিল। হানাফি মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফা আল-নুমান বিন সাবিত (৭০০-৭৬৭ খ্রি:) বলেছেন, নামাজ কিংবা খুতবা যেকোন ভাষায় পড়া যেতে পারে। তার শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ বলেছেন, যে লোক আরবি ভাষা জানে না, সে তার আপন ভাষায় এবাদত করতে পারে। পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলমান হানাফি মাযহাবভুক্ত। আমাদের আলেমসমাজের সঙ্গে পাশ্চাত্য ধারায় শিক্ষিত মুসলমানদের চিন্তার ফারাক কমাবার জন্য একটা বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে: ইউরোপ ও আমেরিকায় অনেকে ধর্মযাজক হয়ে থাকেন। কিন্তু এদের চিন্তাধারার সঙ্গে সমাজের অন্যদের ভাবনা-ধারণার এখন আর বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি হতে দেখা যাচ্ছে না। কারণ, কেউ ধর্মযাজক হবার আগে অন্যদের মতই গ্রহণ করেন সাধারণ শিক্ষা। সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করার পর তারা নিয়ে থাকেন ধর্মীয় ব্যাপারে বিশেষ শিক্ষা। সাধারণত তারা অন্যদের সঙ্গে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি গ্রহণ করবার পর নিয়ে থাকেন ধর্মবিষয়ে বিশেষ শিক্ষা। তাই সমাজের অন্যদের সঙ্গে তাদের চিন্তা-চেতনার বিরাট ব্যবধান ঘটতে পারে না। তারা তাদের ধর্মের মূল বক্তব্যকে অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন যুগোপযোগীভাবে। আমাদের আলেমদের ক্ষেত্রে শিক্ষাটা প্রধানত হলো ধর্মীয়। আর তা চলেছে সনাতন ধারায়। আলেমদের সাধারণ শিক্ষার মান মোটেও উন্নত নয়। এই মান বাড়াবার চেষ্টা হওয়া উচিত। তা হলে দুই সংস্কৃতির সমস্যা অনেক কমে যেতে পারবে। ইংরেজ আমলের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনেক কর্মকর্তা চেয়েছিলেন এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে তাতে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনতে। লর্ড হেসটিংস কলকাতায় মাদরাসা স্থাপনের অর্থ বরাদ্দ করেন। কলকাতা মাদরাসা ইংরেজ আমলে প্রথম সরকারি অর্থে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু এরপর ইংরেজের শিক্ষানীতিতে পরিবর্তন আসে। লর্ড বেন্টিঙ্ক ছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ সমাজ দার্শনিক জেরিমি বেন্থামের বিশেষ ভক্ত। বেন্থাম ১৮২৯ সালের ১৯ নভেম্বর তাকে একটা চিঠি লিখে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের পরামর্শ প্রদান করেন। আজ পেছনে তাকিয়ে মনে হয় না পাশ্চাত্য শিক্ষা আমাদের জন্য ক্ষতিকর হয়েছিল। ইংরেজ শাসন ১৯৪৭ সালে শেষ হয়েছে। কিন্তু ইংরেজি ভাষা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবে পরিণত হতে পেরেছে পৃথিবীর প্রথম ভাষাতে। ইংরেজি ভাষায় এখন যত বিষয়ে যত বই ও পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে অন্য কোন ভাষায় তা প্রকাশিত হচ্ছে না। বাংলা এখন আমাদের শিক্ষার মাধ্যম। বাংলাভাষার অনুশীলন করতে গিয়ে ইংরেজি ভাষাকে অবহেলা করা আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ, এই ভাষার মাধ্যমেই আমরা সহজে যোগাযোগ রাখতে পারি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে। পরিচিত হতে পারি বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারের সঙ্গে। বাংলা, ইংরেজি শেখার পর আমরা অন্য ভাষা চর্চা করতে পারি। ধর্মের ভাষা হিসেবে চর্চা করতে পারি আরবি। কিন্তু সকলের জন্য আরবি শেখা অপরিহার্য বিবেচিত হওয়া উচিত নয়। ভাষা শিখতে গিয়ে যদি আমরা আমাদের সব সময় ও শক্তি নিয়োজিত করি, তবে আমরা অন্য বিষয় শিখবার সময় পাবো না। সেসব বিষয় শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তিও অবশিষ্ট থাকবে না। শিক্ষার ক্ষেত্রে এখন সবদেশেই অনুভূত হচ্ছে যে, বিজ্ঞান ও মানবিকী বিদ্যাসমূহকে কিশোর বয়সের ছাত্রদের জন্য পৃথক করা যুক্তিযুক্ত নয়। এক পর্যায়ে শিক্ষাকে হতে হবে সবকিছু মিলিয়ে যাকে বলে সাধারণ শিক্ষা, তাই। বিজ্ঞানের নামে মানবিকী বিদ্যাসমূহকে অবহেলা করা পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার পরিপন্থী। বলা হয় মানুষ সামাজিক প্রাণী। কিন্তু সে যে কতটা সামাজিক সেটা এখনও যথাযথভাবে নির্ণীত হয়নি। মানুষ সামাজিক হয়ে জন্মায় না। তাকে শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক করে তুলতে হয়। আর এক্ষেত্রে বিজ্ঞানের তুলনায় মানবিকী বিষয়সমূহই সম্ভবত আমাদের অধিক কাজে আসে। বিজ্ঞান আমাদের জ্ঞান দেয়। কিন্তু মূল্য বিচারের কোন মাপকাঠি (Scale of values) প্রদান করে না। বিজ্ঞানের জয়গান করতে গিয়ে আমরা যেন একেবারে যান্ত্রিক হয়ে না পড়তে চাই। সবকিছুকে যেন ব্যাখ্যা করতে না চাই অন্ধ অচেতন প্রাকৃতিক শক্তির সাহায্যে। মানুষ চিন্তা করে, কল্পনা করে, সংকল্প করে। আপন আশা আকাক্সক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে চায় নিজের সত্তাকে। এটাই মানব অস্তিত্বের বিশিষ্টতা। যে কীর্তির বলে মানুষ আর পাঁচটা প্রাণীকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছে, তাই তার সংস্কৃতির ভিত্তি। দার্শনিক মহলে ধর্ম নিয়ে বিতর্ক এখন ক্রমশই কমে আসছে। কারণ, এখন অনেকেই মনে করেন, এমন কিছু প্রশ্ন আছে, যার কোন উত্তর মানব বুদ্ধি কখনই খুঁজে পাবে না। বিশ্বজগৎ আছে। এই থাকাটাই সত্য। এই থাকার পেছনে যুক্তি খুঁজতে যাওয়া বৃথা। এই রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধময় ভুবনে সবকিছুকে বুঝতে যাবার চেষ্টা করাও বৃথা। দার্শনিক জর্জ সাস্তায়ানা (১৮৬৩-১৯৫২) বলেছেন, জন্ম আর মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত প্রশ্নের উত্তর মানুষ কোন দিনই পেতে পারবে না। আমরা কেবল যা পারি, তা হলো, এই দুই-এর মাঝখানের সময়টুকুকে উপভোগের চেষ্টা করে যেতে।

লেখক : বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির