post

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের কষ্টক্লিষ্ট জীবন

মুহাম্মদ আবদুল জব্বার

০২ আগস্ট ২০২২

বিশ্ববাজারে বা দেশের বিশেষ কোনো পণ্য উৎপাদন কমে গেলে, আমদানিতে কোনো জট বাঁধলে সব সময় দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ে এটি চিরায়ত রেওয়াজ। কিন্তু চলতি বছরের শুরু থেকে একটি জিনিস লক্ষ্য করলাম জীবন নির্বাহের প্রায় সব কিছুর দাম বেড়েই চলছে। এতে বাংলাদেশ সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। এহেন অবস্থায় নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জীবন বাঁচানো কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। যদিওবা সরকার দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে আছে বলে দাবি করেছে। তাদের তথ্যমতে মাথাপিছু আয় ২৮২৪ ডলার, জিডিপি ৭.২৫%। কয়দিন আগে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী বলেছেন-“দেশের মানুষ চাইলে এখন তিনবেলা মাংস খেতে পারে।” আবার খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, “মানুষ বেশি ভাত খাবার কারণে চালের দাম বেড়েছে বলে দাবি করছেন।” তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, “কুরবানির সময় কুরবানির মাংস নেওয়ার লোক তিনি খুঁজে পাননি.- ..!”

সাধারণ মানুষ দেশের ক্ষমতাসীনদের কথার সাথে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পায় না। বরং প্রতিনিয়ত জীবন ধারণের ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে তারা জীবনপাত করছেন। এর সাথে নতুন করে যোগ হয়েছে, বিদ্যুতের ঘোষিত লোড শেডিং। গ্রামের আত্মীয়স্বজন এবং নিয়মিত পত্রিকার রিপোর্টের তথ্যমতে- আগে গ্রামে গড়ে ৪-৫ ঘণ্টা থাকতো না এখন লোডশেডিংয়ের ঘোষণার পর আরো নতুন করে ২-৩ ঘণ্টা যুক্ত হলো...। এই সরকারের উন্নয়নের গালগল্প এখন দেশের মানুষ অসার মনে করে। অনেকে নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে এবং সরকারিভাবে ঘোষিত তাই মূল্য বেড়েছে তা বলতে পারেন। যেমন... ভোজ্যতেল, জ¦ালানি তেল, এলপি গ্যাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদি। এক্ষেত্রে তেলের কারণে প্রায় প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ধরে নিলাম, কিন্তু অন্যান্য পণ্যের বা প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য কেন বৃদ্ধি কী পেলো?

বাজার কারতে গিয়ে/প্রয়োজন নির্বাহ করতে গিয়ে কিভাবে ব্যয় বাড়ছে আমরা একটু মিলিয়ে নিতে পারি। যেমন- ১. চাল ২. ডাল (সব ধরনের ডাল) ৩. শাক-সবজি ৪. মাছ ও গোশত (গরু/মুরগি/ছাগল/মহিষ)। ৫. বস্ত্র (পরিধানের) ৬. চিকিৎসা ও ঔষধ ৭. মশলাজাতীয় দ্রব্য ৮. গাড়ি ভাড়া ৯. বাড়ি ভাড়া ১০. শিক্ষা উপকরণ ১১. সন্তানের স্কুলের বেতন ১২. শিক্ষকের কোচিং ফি ১৪. নির্মাণসামগ্রী ইত্যাদি।

শাক-সবজি গরিবের শেষ ভরসা। গত দুই-এক বছরে প্রতিটি সবজির দাম কেজিতে ৩০-৪০ টাকা করে বেড়েছে। গত সপ্তাহে রাজধানীর এক বাজারে শাক-সবজি কিনতে গেলাম। এক টুকরো কুমড়ার (১ কেজি) দাম ৫০ টাকা, যা গত ৫-৬ মাস আগেও ২০-২৫ টাকায় কিনেছি। অন্যান্য শাক-সবজির কথা নাই বা বললাম।

চাল ও আটার দাম ৬ মাসে অনেক বেড়েছে। যা ছাড়া আমাদের চলেই না। চাল কেজিপ্রতি দশ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্যাকেটজাত আটা কেজিতে প্রায় ১৯ টাকা বেড়েছে। দুধ, চিনি, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন ও মশলাজাতীয় আইটেমের দামও বেড়েছে বেশ। এহেন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের কষ্টক্লিষ্ট জীবন।

মাছ-গোশতের দাম বেড়েছে অনেকাংশে। রাজাধানীর শাজাহানপুরে এক গরুর গোশতের দোকানে বছরের শুরুতে কেজিপ্রতি ৬৫০ টাকা মূল্য ছিল, আর এখন ৭৫০ টাকা। একইভাবে এক বছরের ব্যবধানে বয়লার ও পাকিস্তানি মুরগির কেজিতে মূল্য বেড়েছে প্রায় ১০০ থেকে ১৩০ টাকা। একজন অ্যাগ্রো মালিকের সাথে কথা বলে জানলাম যে তারা ফিড (মুরগির জন্য প্রক্রিয়াজাত খাবার) বানানোর জন্য গত বছর যে ভুট্টা ক্রয় করেছিল ২০-২২ টাকায় এ বছর তা ক্রয় করেছে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ টাকা দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই তাই এসবের মূল্য হু হু করে বেড়েই চলছে। ছাগল, মহিষের গোশত বা দেশি মুরগির দামের ব্যাপারে নাই বললাম। নিত্যপ্রয়োজনীয় মূল্যবৃদ্ধির এই দায় কার?

বছরখানেক আগেও বাজারে বাজার করতে গেলে ২-১ জন ভিক্ষুক সাহায্য চাইতেন। আর এখন বাজার করতে দাঁড়ালে সামনে পিছনে ডানে বাঁয়ে সাহায্য প্রার্থীর সংখ্যা অন্তত ৮-১০ জনে উন্নীত হয়েছে। তাদের অবস্থা দেখে মনে হয় দেশটা মহাসঙ্কটের দিকে চলছে। যদিওবা সরকার দেশের মানুষকে উন্নয়নের ফুলঝুরি শুনিয়ে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী ক্রয়ক্ষমতার বাইরে, সাধারণ জনগণ প্রতিদিনের খাদ্যসামগ্রী কিনতেই প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত। তাই সরকার সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে টিসিবির বুথ বাড়িয়েছে। রাজধানীসহ সারা দেশে ৮-১০ বছর আগেও টিসিবির পণ্য কিনতে ১০-১৫ জনের বেশি লোক দেখা যেতো না। আর এখন সর্বত্র টিসিবির পণ্য কিনতে শতশত লোক দীর্ঘ লাইন ধরছে। একটু সাশ্রয়মূল্যে পণ্য ক্রয়ের জন্য। যে পরিবারে সদস্যরা টিসিবি পণ্য লাইনে দাঁড়িয়ে সংগ্রহ করতে হবে স্বপ্নেও ভাবেনি তারাও এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন। এসব কিসের আলামত? দেশ কি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে নাকি শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটছে?

রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে গত মে মাসে বাচ্চার চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের সিরিয়াল নিলাম। ডাক্তারের ফি ১২০০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৮০০ টাকা। টেস্ট বা ঔষধের কথা বা নাই বললাম। হয়ত অনেকে বলবেন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করালে তো চিকিৎসাব্যয় কমে যায়। তাই সরকারি হাসপাতালে গেলেই হয়। আমিও বাচ্ছাদের চিকিৎসার জন্য ঢাকার মা ও শিশু হাসপাতালে গেলাম। ডাক্তার দেখানোর ৬টি কাউন্টারের (রুম) সামনে দীর্ঘলাইন। প্রচণ্ড গরম। চিকিৎসাপ্রার্থী আগত বাচ্ছাদের কান্নার রোল। মাথার উপরের মৃদ্যু ফ্যান ঘুরছে। এর মধ্যে কয়েকটি ফ্যান বিকল। কিছুক্ষণ সিরিয়াল সামনে এগুতে থাকে মাঝে মাঝে থমকে যায়। রুমের সামনে ডাক্তারের সহযোগীদের কাছে ডাক্তার কোথায় আছেন জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘স্যার নাস্তা করতে গেছেন।’ সেখানে সকাল ১০টা থেকে  বেলা ১টা পর্যন্ত লাইনে অপেক্ষার পর ডাক্তারের সাথে সাক্ষাৎ হলো। পরীক্ষার টেস্ট করতে গিয়ে আবার সিরিয়াল। ততক্ষণে বাচ্চারাসহ আমাদের অবস্থা গরমে ত্রাহি ত্রাহি। এহেন পরিস্থিতিতে এক রোগ সারতে গিয়ে প্রতিদিন আরো কত রোগ বেড়ে চলছে, তার ইয়ত্তা কে বা রাখে?

বিক্রেতাদের ভাষ্যমতে তারা বেশি দামে ক্রয় করে আনতে হয় তাই বেশি দামে ক্রেতাদের নিকট বিক্রি করতে হচ্ছে। তাই সব কিছুতে হু হু করে দাম বেড়ে গেছে। চিকিৎসা, শিক্ষা, বস্ত্র বিক্রেতা, বাড়িওয়ালাসহ সর্বপর্যায়ের সেবা প্রদানকারীরাও তাদের খরচ বেড়ে যাওয়ায় তারা সেবার দাম বাড়িয়েছে বলে দাবি করছে। তাই তারা ভোক্তা/গ্রাহকদের কাছ থেকে বেশি নিচ্ছেন বলছেন। এর মূল সমস্যা কোথায়? পণ্যের সিন্ডিকেট বাণিজ্য কারা করছে, তাদের খুঁজে বের করে আশু সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ সরকারের তরফ থেকে লক্ষণীয় নয়।

বাংলাদেশে কোনো পণ্যের দাম একবার বেড়ে গেলে তা আর কমার নজির নাই। আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে পেট্রোল, এলপি গ্যাস ও ভোজ্যতেলের দাম কতবার বেড়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নাই। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে কমার খবর প্রকাশ হলেও দেশের বাজারে তা কমার কোনো খবর নাই। অভিভাবকহীন রাষ্ট্র চলছে এক অনিশ্চিত গন্তব্যে। একজন মধ্যবিত্ত লেভেলের পরিবারের আয় ২৫-৩০ হাজার টাকা। তার এমনিতেই টানাটানির সংসার। এর মধ্যে যদি জীবনযাত্রার ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয় তাহলে মানুষ বাঁচবে কী করে? একেবারে খেটে খাওয়া দিনমজুরের কথা বাদই দিলাম। এই আকাশ-পাতাল সমন্বয়হীনতার অবসান কে ঘটাবে? দেশে বেকারত্ব হু হু করে বাড়ছে। লক্ষ কোটি তরুণ বেকার। তাদেরকে কর্মক্ষম হিসাবে তৈরি করতে সরকারের চোখে পড়ার মতো কোনো কর্মসূচি নেই, নেই কোনো কর্মসংস্থান। এহেন অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। তাই সরকারি ও বেসরকারি ভাবে এসব সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। কারণ দেশটা সবার। এই দেশ ও দেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। 

লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির