post

নেতৃত্বের উৎকর্ষতা ও আমাদের করণীয়

১৬ আগস্ট ২০১৪

মো: জিল্লুর রহমান

Crearনেতৃত্ব শব্দটি ছোট্ট কিন্তু ব্যাপক অর্থবোধক। এই ছোট্ট শব্দটির প্রায়োগিক গুরুত্ব এত বেশি যে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র কোন কিছুই এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে পারে না। ক্ষুদ্র ব্যক্তি থেকে বৃহৎ রাষ্ট্র পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা চলমান। সুতরাং চলমান জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই অনুষঙ্গের উৎকর্ষতা বা বিকাশ সাধনের চেষ্টা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। যেকোনো সংগঠন, সমাজ বা রাষ্ট্রে সুষম উন্নয়ন ও এর ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছার কেবলমাত্র উপায় হলো একটি যোগ্য নেতৃত্ব। যোগ্য নেতৃত্ব যেমন কোনো সংগঠন, সমাজ বা জাতিকে সফলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে, আবার বিপরীত দিকে অযোগ্য নেতৃত্ব ঠিক একটি সংগঠন, সমাজ বা জাতিকে ধ্বংসের অতল তলে নিমজ্জিত করতে পারে। অতএব যেকোনো সংগঠন বা জাতির অনুসারীদের সর্বাগ্রে যে বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় এনে এর বিকাশ ও উৎকর্ষতায় মনোনিবেশ করতে হবে তা হলো নেতৃত্ব। নেতৃত্ব আসলে কাকে বলে বা এর স্বরূপ কী? এটি একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন! নেতৃত্ব হলো কোনো গোষ্ঠী, গ্র“প বা জাতিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার যোগ্যতা বা ক্ষমতা। নেতৃত্বকে আমরা একটি বাসের ড্রাইভারের সাথে তুলনা করতে পারি। একটি বাসের অনেক যাত্রী থাকলেও সামনের ব্যক্তিটি  স্টেয়ারিং ধরে যেমনিভাবে বাসকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেন তেমনিভাবে কোনো সংগঠন বা সমাজ বা জাতিকে সামনে থেকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়ার সকল আয়োজন যিনি পরিচালনা করেন তিনি নেতা এবং তার কর্মকাণ্ড হলো নেতৃত্ব। নেতৃত্ব শব্দটির ইংরেজি হলো Leadership  শব্দটি এর ক্রিয়া Lead হতে উৎপত্তি যার অর্থ চালনা করা বা পরিচালনা করা। এক্ষেত্রে ইংরেজিতে ব্যবহৃত উক্তিটি নেতৃত্বের বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করতে পারে। যেখানে বলা হয়েছে Leader shows the way অর্থাৎ যিনি পথ দেখান তিনিই নেতা এবং দেখানোর প্রক্রিয়াই নেতৃত্ব। নেতৃত্বের গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা)-এর হাদিস থেকে আরো পরিষ্কার ধারণা পেতে পারি। যেখানে তিনি বলেন, “তোমরা যদি কোথাও বের হও আর সংখ্যায় তিনজন থাকো তাহলে তার মধ্য থেকে একজনকে নেতা বানিয়ে নাও।’’ অর্থাৎ নেতৃত্ব অপরিহার্যতার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ বা সংশয় থাকার কোনো সুযোগ নেই। এবার নেতৃত্বের ধরন নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। সাধারণভাবে চার ধরনের নেতৃত্ব আমরা সমাজে দেখতে পাই। একটি হলো মহৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব যার মাধ্যমে সংগঠন, সমাজে বা রাষ্ট্রে কল্যাণ, সুখ ও উন্নয়নের এক সুষম সমন্বয়ের সৃষ্টি হয়। অপর দিকে যোগ্য কিšুÍ নীতিহীন নেতৃত্ব যার কারণে সমাজে বৈষম্য, বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, অরাজকতা ইত্যাদি দেখা দেয় এবং এক অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করে। আর এক ধরনের নেতৃত্বও দেখা যায় যা হলো নীতিবান কিন্তু অযোগ্য। এ ধরনের নেতৃত্বের ফলে সমাজের ধারাবাহিকতা নষ্ট হয় এবং বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়। সুতরাং নেতৃত্বের মাপকাঠিকে যোগ্যতা ও নীতির সুষম সমন্বয় যার চূড়ান্ত রূপ মহৎ নেতৃত্ব। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রিয় নবীর বাণী অত্যন্ত বিবেচনাযোগ্য। তিনি বলেন, “তোমরা সকলেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকটি দায়িত্বের ব্যাপারে তোমরা কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে।” অতএব ইহকালীন সফলতা ও পরকালীন মুক্তির একমাত্র পথ হলো জবাবদিহিতামূলক মহৎ নেতৃত্ব। মহৎ নেতৃত্ব বিকাশের উপায় মহৎ নেতৃত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে চারটি মৌলিক ভিত্তি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা অপরিহার্য : (ক) সাহস (Courage) :  নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাহস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে সাহস শব্দটি যে সেকল ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় তা হলো : সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাহস গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অটল থাকার সাহস সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পর ইতিবাচক বা নেতিবাচক যেকোনো ধরনের Feedback মোকাবেলা করার সাহস। সর্বোপরি যেকোনো ধরনের হুমকি (Threat) মোকাবেলা করার সাহস। (খ) সুদৃষ্টি বা দূরদৃষ্টি (acumen) : মহৎ নেতা সবার সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন কিন্তু তার সুদৃষ্টি অনেক সামনে থেকে তাকে নেতৃত্ব দেন। ইংরেজিতে বলা হয় ‘Leading from the front.” এ ধরনের কর্মকাণ্ডই ব্যক্তিকে মহৎ নেতৃত্বে পরিণত করে। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বই কেবল একটি সংগঠনকে নির্বিঘেœ তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে। (গ) জ্ঞানের দক্ষতা (Expert of knowledge) : মহৎ নেতৃত্ব বিকাশের পথে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামক হলো জ্ঞান। সকল বিষয়ে সম্যক জ্ঞান অর্জন হলো মহৎ নেতৃত্বের পূর্বশর্ত। জ্ঞান নেতৃত্বের যোগ্যতাকে বিকশিত করে, ব্যক্তির উদারতা বৃদ্ধি করে এবং অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি উৎস হতে জ্ঞান আহরণ করা যেতে পারে। প্রথমত যেমন পূর্বজ্ঞান (Cognitive), অভিজ্ঞতা (Experience), অবলোকন (observation) এবং ঐশী জ্ঞান (revealed)। উপরোক্ত উৎসসমূহের মধ্যে ঐশী জ্ঞান নেতৃত্বের পরিপূর্ণতা আনয়নে সব থেকে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। কারণ ঐশী জ্ঞানের মধ্যে অপরাপর সবগুলো উপাদান নিহিত থাকে। এ ছাড়াও সকল মনীষীর জীবনী থেকে লব্ধ জ্ঞান চলার পথের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। মনে রাখতে হবে মহৎ নেতৃত্বের মাপকাঠির ভিত্তিই হবে জ্ঞানভিত্তিক নেতৃত্ব। (ঘ) সংগঠিত করার ক্ষমতা (ability to organize) : মহৎ নেতৃত্বের মূলত চূড়ান্ত মাপকাঠি হলো সবাইকে সংগঠিত করার যোগ্যতা অর্জন করা। মহৎ নেতৃত্বের চারিত্রিক সম্মোহনী  বৈশিষ্ট্য সবাইকে সংগঠিত করতে সাহায্য করে। প্রতিপত্তি বা শক্তির মহড়ায় সংগঠিত রূপ স্থায়িত্ব পায় না। সময়ের ব্যবধানে তার অনুসারীগণই নেতার শত্র“তে পরিণত হয়। কিন্তু মহৎ নেতৃত্বের গুণাবলি দ্বারা সংগঠিত অনুসারীগণ বিপদ আপদ, ভাল-মন্দ সর্বাবস্থায় নেতাকে প্রাচীরের ন্যায় ঘিরে রাখে এবং প্রতিটি কদমে তাকে প্রাণ দিয়ে সহযোগিতা করে। সুতরাং সংগঠিত করার যোগ্যতা বা দক্ষতা ব্যক্তির নেতৃত্বকে শুধুই মহৎই করে না বরং নেতৃত্বকে স্থায়ী ও সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করায়। সফলভাবে নেতৃত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে-উপরোক্ত মৌলিক উপাদানসমূহ অর্জনের ক্ষেত্রে নি¤েœাক্ত দক্ষতাসমূহ (Skills) অর্জন করা অপরিহার্য : দলগত ব্যবস্থাপনা (Team management) কৌশলগত দক্ষতা (Strategic tools) সমস্যা সমাধানের দক্ষতা (Problem solving skills) সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা (Decision making skills) সময় ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত দক্ষতা (Time management skill) স্ট্রেস ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত দক্ষতা (Stress management skill) কমিউনিকেশন দক্ষতা (Communication skill) সৃজনশীল কৌশল সংক্রান্ত দক্ষতা  (Creativity techniques skill) শিক্ষণ দক্ষতা (learning skill) ক্যারিয়ার দক্ষতা (Career skill) উল্লিখিত দক্ষতাসমূহ একটি সফল ও মহৎ নেতৃত্ব বিকাশের জন্য এতটাই অপরিহার্য, যেমন মানবদেহের প্রতিটি উপাদান তার স্বাভাবিক চলাচলের জন্য অপরিহার্য। এখানে প্রতিটি দক্ষতাই সমভাবে অর্জন করা জরুরি তবুও দুই-একটি বিষয়ে কিছু আলোচনা করা যেতে পারে। চাপ ব্যবস্থাপনা (Stress management) সংক্রান্ত দক্ষতা অর্জনের জন্য ব্যক্তির সামনে দু’টি পথ উন্মুক্ত থাকে। প্রথমত দৃঢ়তার সাথে চাপকে মোকাবেলা করা। দ্বিতীয়ত, চাপ নিতে না পেরে মাঠ থেকে পলায়ন করা। ইংরেজিতে বলা হয়- Fight or flight. এ ছাড়া ক্যারিয়ার সংক্রান্ত দক্ষতা সমাজে ব্যক্তিকে মর্যাদার আসনে আসীন করে এবং আত্মসম্মানবোধ ও সকল ক্ষেত্রে দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করে। যেকোনো সংগঠন বা সমাজের নেতৃত্বের বিকাশ বা উৎকর্ষতার একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে একটি সফল ও কার্যকর (effective) পরিবর্তন। একটি কার্যকর ও সফল পরিবর্তনের (change) জন্য বিকশিত নেতৃত্বের নি¤œল্লিখিত চারটি স্তরে (যা একটির সাথে অন্যটি সম্পৃক্ত) কিছু গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা থাকা একান্ত অপরিহার্য। প্রথমস্তর পূর্ণজ্ঞান বা বোধশক্তিসম্পন্ন যোগ্যতা (Cognitive competences) : এই  স্তরে যে সমস্ত গুণাবলি থাকা প্রয়োজন- ক) সৃজনশীলতা (Creativity) খ) স্বনির্ভরতা (Self rellience) গ) সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা (Problem solving capabilities) ঘ) বিশ্লেষণধর্মী যোগ্যতা (Analytical abilities) ঙ) বহুমুখী চিন্তা (Divergent thinking) চ) ভবিষ্যৎমুখিতা (Future oriented) ছ) ভালো পরার্শক (Good consolation) জ) সূক্ষ্ম বিবেচনাবোধ (Critical approach) দ্বিতীয় স্তর আনুষ্ঠানিক যোগ্যতা (Functional competences) এই  স্তরে যে সমস্ত গুণাবলি থাকা প্রয়োজন- ক) কমিউনিকেশন দক্ষতা (Communication skill) খ) প্রযুক্তিনির্ভর বা বিশেষ জ্ঞানভিত্তিক দক্ষতা (Technological or special knowledge) গ) ক্যারিয়ার পরিকল্পনা (Career planning) ঘ) ব্যবস্থাপনা যোগ্যতা (Managerial abilities) ঙ) শক্তিশালী সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতা (Strong decision making abilities) চ) জ্ঞানের দক্ষতা (knowledge abilities) তৃতীয় স্তর সামাজিক যোগ্যতা (social competence) এই  স্তরে যে সমস্ত গুণাবলি থাকা প্রয়োজন- ক) আন্তঃব্যক্তি সম্পর্কীয় দক্ষতা (Inter-personal skill) খ) কর্মক্ষমতা (Working abilities) গ) বহুমুখী সাংস্কৃতিক দক্ষতা (Cross-cultural abilities) ঘ) উদারতা ( Flexible to others) ঙ) চাপ প্রশমন দক্ষতা (Stress management capabilities) চ) মোটিভেশন ভূমিকা (Motivational role) ছ) নৈতিক দক্ষতা (Ethical skill) জ) সমন্বিত দক্ষতা (Integration skill) চতুর্থ স্তর সফল পরিবর্তন (Successful change): এই  স্তরে যে সমস্ত গুণাবলি থাকা প্রয়োজন- ক) উৎপাদন/ফলাফলমুখিতা বৃদ্ধি (Increase in productivity) খ) সম্পর্ক বৃদ্ধি (Increase in relationship quality) গ) শক্তিশালী সমন্বয় (strong co-operation) ঘ) সাংগঠনিক সংস্কৃতি ও পরিবেশ শক্তিশালীকরণ (Strengthen organizational culture & climate ঙ) জনশক্তির সন্তুষ্টি অর্জন (Manpowers’ satisfaction) চ) বিবাদ/ ভুল বোঝাবুঝি দূরীকরণ (Reduce conflict) যেকোনো সংগঠন বা সমাজে একটি সফল ও অনিবার্য পরিবর্তনের জন্য সৎ, যোগ্য ও মহৎ নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব তৈরির জন্য দরকার একদল প্রতিশ্র“তিশীল সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নচারী জনগোষ্ঠীর যারা জীবনের মিশন হিসেবে নেতৃত্বকে বেছে নেবেন এবং উল্লিখিত বিষয়সমূহ অর্জনে সম্মুখপানে ধাবিত হবেন সুপরিকল্পিতভাবে। তাদের মিশন হবে ইংরেজ কবি রবার্ট ফ্রস্টের ভাষায়Ñ The woods are lovely, dark and deep. But I have promises to keep, and miles to go before I sleep miles to go before I sleep.’’ লেখক : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক [email protected]

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির