post

নেতৃত্ব

ড. আহমাদ তোতনজি

১০ নভেম্বর ২০২০

অনুবাদ : আলী আহমাদ মাবরুর নেতৃত্বের অনুপম বৈশিষ্ট্য মুসলিম হিসেবে আমাদের সামনে অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে আছেন রাসূল করিমের সা. মতো একজন নেতা। আল কুরআন ও নবীজির সা. সুন্নাহর মতো দুটো বরকতময় নেয়ামত সাথে থাকায় মুসলিমরা অনেক বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত ও সমৃদ্ধ। শুধু নেতৃত্ব নয়, বরং যাপিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহই হলো আমাদের জন্য যাবতীয় নির্দেশনার মূল উৎস। আল কুরআনে আল্লাহ বলেন, “যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রাসূলুল্লাহর মাঝেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।” (সূরা আহজাব : ২১)

নেতৃত্বের যোগ্যতা মাত্র কয়েক দিন আগ পর্যন্ত অনেক মানুষই এভাবে ভাবতে অভ্যস্ত ছিল যে, নেতৃত্ব একটি জন্মগত বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ কিছু মানুষ নেতৃত্বের যোগ্যতা নিয়েই জন্মগ্রহণ করেন। আবার অনেকেই বলতো যে, নেতৃত্ব একটি দক্ষতা কৌশল। নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ দানের মাধ্যমে অনেকের মাঝে নেতৃত্বের গুণাগুণকে বিকশিত করা যায়। আপনি যদি বিষয়টি নিয়ে আগে না ভাবেন, কিংবা ভেতরের এই সুপ্ত জ্ঞানগুলোকে নিয়ে যদি অনুশীলন না করেন তাহলেও কোনো সমস্যা নেই। আপনি যেকোনো মুহূর্ত থেকেই এগুলোর চর্চা করে নিজেকে একজন যোগ্য নেতা হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেন। এ পর্যায়ে আমরা নেতৃত্বের কিছু মৌলিক গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করবো, যেগুলোকে আপনি শনাক্ত ও উন্নত করার মাধ্যমে নিজেকে নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করতে পারেন।

প্রথমটি হলো- কম্যুনিকেশন তথা যোগাযোগ : যোগাযোগে দক্ষ ও পারদর্শী হওয়াটা খুবই প্রয়োজন। যোগাযোগ করতে না জানলে আপনি মানুষকে নেতৃত্ব দিতে পারবেন না। আমরা যখন যোগাযোগে দক্ষ হওয়ার কথা বলছি, তার মাধ্যমে মূলত আমরা নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপনশৈলী, অপরের কথা শোনার যোগ্যতা, বা বডি ল্যাংগুয়েজসহ অনেক কিছুকেই বোঝাতে চাইছি। এখানে উল্লেখ্য যে, শুধু মৌখিক বয়ান নয়, বরং লিখিত বয়ানের ক্ষেত্রেও এ বিষয়গুলো একইভাবে প্রযোজ্য হবে। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো- ইন্টেগরিটি অর্থাৎ সততা, ন্যায়পরায়ণতা বা বিশুদ্ধতা : সততা ও বিশুদ্ধতা ছাড়া কোনো সফলতা অর্জনই সম্ভব নয়। একজন নেতাকে সবসময় জনশক্তির সামনে অনুকরণীয় আদর্শ হতে হয়। নেতার যদি সততা না থাকে, তারপরও জনশক্তি তাকে অন্ধের মতো অনুসরণ করে যাবে- এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। একজন সৎ নেতা তখনই সফল হয়, যখন তার কথা ও কাজে মিল থাকে। যখন তার মাঝে মূল্যবোধের অনুশীলন থাকে। নেতাকে সময়ের কাজ অবশ্যই সময়ের মধ্যেই শেষ করতে হবে। হযরত ইউসুফের (আ) কথা ভাবুন। কিভাবে তিনি মিশরের রাজার কাছে নিজেকে বিশ্বস্ত ও সৎ হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন। ষ “বাদশাহ বলল : তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি তাকে নিজের বিশ্বস্ত সহচর করে রাখব। অতঃপর যখন তার সাথে মতবিনিময় করল, তখন বলল : নিশ্চয়ই আপনি আমার কাছে আজ থেকে বিশ্বস্ত হিসাবে মর্যাদার স্থান লাভ করেছেন।” (সূরা ইউসুফ : ৫৪)। এর উত্তরে ইউসুফ (আ) বলেন, আমাকে দেশের ধন-ভাণ্ডারে নিযুক্ত করুন। আমি বিশ্বস্ত রক্ষক ও অধিক জ্ঞানবান। (সূরা ইউসুফ : ৫৫) ষ আবার হযরত মুসা (আ) এর কথা ভাবুন। হযরত শুআইবের (আ) দুই মেয়ে তার বিষয়ে পিতাকে সুপারিশ করে বলেছিলেন এভাবে, “বালিকাদ্বয়ের একজন বলল পিতা: তাকে সেবক হিসেবে নিযুক্ত করুন। কেননা, আপনার সেবক হিসেবে সে-ই উত্তম হবে, যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত।” (সূরা কাসাস : ২৬) ষ নেতৃত্বের তৃতীয় গুণ হলো জবাবদিহিতা। একজন প্রকৃত নেতা তার টিমের যেকোনো কাজ ও এর ফলাফলের জন্য দায়বদ্ধ থাকেন। ভালো বা মন্দ, সফলতা ও ব্যর্থতা- সব কিছুর দায়ই তাকে নিতে হবে। নেতার মাঝে জবাবদিহিতার মানসিকতা থাকলে দলের অন্যান্য সদস্যদের মাঝেও দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয়। তারা আস্থাবান ও আত্মবিশ্বাসী হয়। ফলে তারা নিজেদের স্বাভাবিক সক্ষমতার ঊর্ধ্বে ওঠেও বাড়তি পরিশ্রম করে একটি উত্তম ফলাফল অর্জনে সচেষ্ট হয়। ষ নেতৃত্বের চতুর্থ গুণ হলো সহানুভূতি ও মমত্ববোধ। প্রকৃত নেতার মনটি এতটাই বড় ও উদার হয় যাতে তিনি তার অনুসারীদের কথা অনুভব করতে পারেন। জনশক্তির মানসিকতা, আশা-ভরসা, স্বপ্ন ও সংকটগুলোকে তিনি উপলব্ধি করতে পারেন। প্রকৃত নেতা জনশক্তির সাথে উদারভাবে মিশতে পারেন, ব্যক্তিগত সম্পর্কও গড়ে তুলতে পারেন। নেতা তার এই মমত্ববোধ দিয়ে জনশক্তির হৃদয়কে জয় করে নেন। ফলে, তারাও নেতার আনুগত্য করতে কোনো ধরনের দ্বিধাবোধ করে না। ষ আদর্শবান নেতার পঞ্চম গুণ হলো বিন¤্রতা ও বিনয়। নেতৃত্বের পদটি খুবই লোভনীয়। নতুন দায়িত্ব পাওয়ায় অনেকের মধ্যে গর্ব, অহংকার চলে আসতে পারে। কিন্তু দলের সদস্যদের সাথে একজন নেতা কতটুকু ন¤্র ও বিনয়ী হতে পারে তার ওপরই নেতৃত্বের সার্থকতা নির্ভর করে। নেতা যখন বিনয়ী হয় তখন তার নেতৃত্ব কার্যকর ও ফলপ্রসূ হয়। জনশক্তির মাঝেও নেতার বিষয়ে সম্মান ও আস্থা তৈরি হয়। জনশক্তি তখন নিজের সর্বোচ্চটুকু বিলিয়ে দেয়ার জন্যও প্রস্তুত হয়ে যায়। ষ একজন যোগ্য নেতার মাঝে ষষ্ঠ যে গুণটি থাকতে হয় তাহলো সহনশীলতা। একজন নেতার সফলতার মানদণ্ড কেবলমাত্র সুসময়ে তার ভূমিকার মধ্য দিয়েই বোঝা যায় না। বরং একজন নেতা তার দুঃসময়ে কী ভূমিকা পালন করে বা নিজের সংকটময় মুহূর্তগুলোকে কিভাবে অতিক্রম করে তার মধ্য দিয়েই তার নেতৃত্বের যোগ্যতা নির্ধারিত হয়। সহনশীলতা নেতৃত্বের এমনই এক বৈশিষ্ট্য যা হুট করে নয় বরং দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় অর্জিত হয়। সহনশীল হওয়া মানেই কঠোর হওয়া নয়। টিমের অন্য কোনো সদস্যের সাথে কর্কশ আচরণ করাও সহনশীলতা নয়। কঠিন পরিস্থিতি মুকাবেলা করতে গিয়ে যদি একজন নেতা আচরণগতভাবে কঠিন ও কঠোর হয়ে যান- তাহলে এর কোনো মানে হয় না। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়লে একজন নেতাকে বাহ্যত কঠোর হতে হবে আর অভ্যন্তরীণভাবে বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে দলের সদস্যদের সাথে নরম ও কোমল আচরণ করতে হবে। ষ ভালো একজন নেতার সপ্তম গুণ হলো তাকে অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী হতে হবে। একজন নেতা কতদূর চিন্তা করতে পারেন তার আলোকেই জনশক্তির ওপর তার প্রভাবের মাত্রা নির্ধারিত হয়। একজন যোগ্য নেতা তার সংগঠনকে সঠিক নির্দেশনার ওপর জারি রাখেন। প্রয়োজনমতো নিজের বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তও প্রদান করেন। নেতা নিজে যে স্বপ্নটি দেখেন তিনি তার জনশক্তির মাঝেও তা সংক্রামিত করার চেষ্টা করেন। ফলে অধীনস্থ জনশক্তি আর নেতৃত্ব একই স্বপ্ন বুকে নিয়েই অগ্রসর হতে থাকে। যদি একটি টিমের সকলে মিলে একটি স্বপ্নকে লালন করে, স্বপ্নটিকে বিশ্বাসও করে তাহলে তার বাস্তবায়ন সহজ হয়ে যায়। একটি স্বপ্নকে লালন করতে গেলে আগে সেই স্বপ্নটিকে দেখতে হয়। একজন যোগ্য নেতা তার জনশক্তিকে তার লালিত স্বপ্নকে দেখতে বা কল্পনা করতে সাহায্য করেন। ষ নেতৃত্বের অষ্টম গুরুত্বপূর্ণ গুণ হলো প্রভাব। নেতার স্বপ্ন যখন জনগণের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখনই নেতৃত্বের প্রভাব তৈরি হয়। নেতৃত্ব আর নেতৃত্বের প্রভাব এমন দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- যা পরস্পরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নেতা হতে গেলে তার কিছু প্রভাব থাকতেই হবে। একজন নেতা তখনই তার টিমকে প্রভাবিত করতে পারেন যখন টিম সদস্যরা তার ওপর ভরসা রাখে, তাকে বিশ্বাস করে। মনে রাখতে হবে, আস্থা ও সম্মান অর্জন করে নিতে হয়, এগুলো এমনি এমনি আসে না। নেতৃত্ব কোনো সহজ কাজ নয়। অনেক পরিশ্রম করে একজন নেতাকে একটি অবস্থানে যেতে হয়। তখনই কেবল তার প্রভাব তৈরি হয়। ষ ভালো ও যোগ্য নেতার নবম গুণটি হলো ইতিবাচকতা। একজন নেতা সবসময় তার দলকে ইতিবাচক দিকে অনুপ্রাণিত করেন। এক্ষেত্রে দলীয় সদস্যদের ব্যক্তিগত লক্ষ্য বা অর্জনের ওপর তিনি নির্ভর করেন না। বাহ্যত জনশক্তির যে আচরণ বা ব্যবহারযোগ্য নেতা সেগুলোকেই ইতিবাচকভাবে সংশোধন করে থাকেন। নেতা তার জনশক্তির সামনে ভবিষ্যৎকে হাজির করেন। ফলশ্রুতিতে, জনশক্তি সেই ভবিষ্যৎ গল্পটিকে বিশ্বাস করেন, ধারণ করেন এবং তার ওপর অটল থাকেন। সেই ভবিষ্যৎটিকে বাস্তবায়ন করার জন্যও তারা কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ষ নেতার আরেকটি গুণ হলো প্রতিনিধিত্ব নিরূপণ। একজন নেতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো স্বাভাবিক কোনো একটি কাজ করতে করতে তাতে নেতৃত্ব দিতে শুরু করা। নেতাকে শুধু নিজের সফলতা বা অর্জন নিয়ে সন্তুষ্ট হলেই হয় না। তাকে তার টিমের বা সামষ্টিক অর্জনও নিশ্চিত করতে হয়। নেতাকে নিজের হাতে একটি কাজ করার পাশাপাশি অন্যকে দিয়েও কাজ করিয়ে নিতে হয়। নেতৃত্বের এসব বৈশিষ্ট্য অর্জনের পাশাপাশি আমাদেরকে আরো কিছু কাজ করতে হবে। বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এ জাতীয় কাজের কোনো বিকল্প নেই। যেমন: ষ নেতাকে মানবতার কল্যাণের জন্য কাজ করে যেতে হয়। রাসূল সা.কে মদিনায় সকল মতের, সকল পক্ষের লোক নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিল কারণ তারা নিশ্চিত ছিল যে, নবী মুহাম্মাদ সা. তাদের সকলের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করতে পারবেন। তৎকালীন মদিনায় নানামুখী সঙ্কট ছিল। আল্লাহর রহমতে, নবীজি সা. সেই সব সমস্যাকেই ধাপে ধাপে সমাধান করতে পেরেছিলেন। ফলে, জনগণ তার ও তার নেতৃত্বের বিষয়ে সন্তুষ্ট ছিল। কারণ দীর্ঘ সময় ধরে চলা নৈরাজ্যকে রহিত করে নবীজি সা. মদিনায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। ষ রাসূল সা. যতগুলো মৌলিক ধারণা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠা। মদিনাবাসীর জন্য এ ধরনের শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি ছিল একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা। রাসূল সা. বলতেন, ‘যে তোমাদের সাথে সদাচরণ করেছে আর যে জুলুম করেছে, সবার সাথেই ভালো ব্যবহার করো। সবার কল্যাণ সাধন করার চেষ্টা করো।’ ষ মুসলিম হিসেবে আমাদের বৈশিষ্ট্যগুলো অমুসলিমদের তুলনায় একেবারেই আলাদা। আমাদের নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি রচিত হয় কুরআন ও হাদিসের আলোকে। একজন অমুসলিম যা করে বা যা করার পরিকল্পনা করে তাতে ওহির কোনো নির্দেশনা থাকে না। কিন্তু আমাদের সাথে বিশ্বজগতের মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সম্পর্ক রয়েছে। জ্ঞানের সমন্বয় অর্থাৎ জাগতিক এবং ওহিলব্ধ জ্ঞানের সমন্বয়েই একজন মুসলিমের মনন তৈরি হয় যা তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে দেয়। আল্লাহ পাক আল কুরআনে ইরশাদ করেন, ষ “যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করলেন যে, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তবে তোমাদেরকে আরও দেবো এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর।” (সূরা ইবরাহিম : ৭) ষ একে অন্যকে সাহায্য করা। মুসলিম নেতাদের উচিত যার যার জায়গা থেকে একে অপরকে সাহায্য করা। এটা তখনই সম্ভব হবে যখন আমরা কিছু পয়েন্টে একমত হতে পারবো আর ছোটখাটো ভিন্নতাগুলোকে এড়িয়ে যেতে পারবো। খুব বেশি বিষয়ে আমাদের মতবিরোধ থাকে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়: বছর কয়েক আগে শ্রীলংকায় মুসলিমদের মধ্যে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। মসজিদগুলোতে বেশ কিছু মুসলিম নিহত হয়েছিল। এ ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে তাদের তিক্ততা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, তাদের কেউ কেউ আমাকে বলেওছিল যে, ‘আমরা জানি যে কিভাবে লড়াই করতে হয়।’ আমি তাদেরকে বলেছিলাম, ‘লড়াই বা সংঘাতের চিন্তা যেন আপনাদের মাথায় না আসে। বরং আপনারা প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলুন। তাকে বোঝান যে, আপনারা দেশে কোনো সংঘাত চান না, কোনো ধরনের সহিংসতার সাথে আপনাদের সম্পৃক্ততা নেই। আপনারা এমন কিছু করতেও আগ্রহী নন, যাতে দেশের অর্থনীতি ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে বললো, কিন্তু প্রেসিডেন্ট তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিলেন না। মুসলিম নেতারা তখন জুমার নামাজের খুতবায় সামষ্টিক ঐক্য ও সংহতি নিয়ে নিয়মিত বক্তব্য দিতে থাকলেন। মুসলিম হিসেবে তাদের করণীয় সম্পর্কেও নানা আলোচনা রাখলেন। এরপর একে একে শ্রীলংকার ৯টি মুসলিম দলও প্রেসিডেন্টের সাথে গিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানেরই বার্তা দিলো। কিন্তু প্রেসিডেন্ট কিছুই করতে পারছিলেন না। দেশটির সাধারণ নির্বাচনের তখন মাত্র এক সপ্তাহ বাকি ছিল। নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে দেশটির একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকা খবর প্রকাশ করলো যে, এই অক্ষম ক্ষমতাসীন দল আর পুনঃনির্বাচিত হবে না। এবং হলোও তাই, তারা আসলেই আর নির্বাচনে জয়ী হতে পারলো না। মুসলিমরা বিরোধী দলের সাথে সমঝোতায় গেলো আর বিরোধী দলই বিপুল ভোটে নির্বাচনে জয় পেয়ে গেলো। এভাবে পরস্পরকে সাহায্য করে, সবাই মিলে মিশে আমরা একটি নৈরাজ্যমুক্ত এবং শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ে তুলতে পারবো। আল্লাহ বলেন, ষ “আর যারা কাফের তারা পারস্পরিক সহযোগী, বন্ধু। তোমরা যদি এমন ব্যবস্থা না কর, তবে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বিস্তার লাভ করবে এবং দেশে নৈরাজ্য ও অকল্যাণ সংঘটিত হবে।” (সূরা আল আনফাল : ৭৩) ষ বিশ্বজুড়ে আমরা এখন এই বাস্তবতাই দেখতে পাচ্ছি। এটা মর্মান্তিক যে, আমাদের হাতে বিদ্যমান সংকটের সমাধান থাকার পরও আমরা নিজেদেরকে এবং উম্মাহকে সেই সমাধান থেকে বঞ্চিত করছি। শেষ বিচারের দিনে হয়তো আল্লাহর কাছে আমাদেরকে এ অক্ষমতার বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ অন্যত্র আরো ইরশাদ করেন, ষ “আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভাল কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই উপর আল্লাহ তা’আলা দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশীল, সুকৌশলী।” (সূরা তাওবাহ : ৭১) ষ সর্বোত্তম জাতি। আমাদেরকে বিশ্ববাসীকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য অবশ্যই জেগে উঠতে হবে। যেমনটা আল্লাহ বলেছেন, “তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যেই তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।” (সূরা আলে ইমরান : ১১০) ষ কুরআনের কাছে ফিরে আসা। আমাদেরকে অবশ্যই কুরআনের নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে। কুরআনকে নিজেদের জীবনে প্রতিফলিত করতে হবে। কুরআন থেকে শিক্ষা নিতে হবে। রাসূল সা. ও তার সাহাবিরা মিলে কিভাবে মদিনায় একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন- সে প্রক্রিয়া থেকেও আমাদেরকে অনেক কিছু শিখতে হবে। রাসূল সা. বলেন, হে মানব সম্প্রদায়। তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও, খাদ্য দান কর এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন তোমরা তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় কর। তাহলে নিশ্চয়ই তোমরা সহীহ-সালামতে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (তিরমিজি-২৪৮৫) ষ নিখুঁতভাবে কাজ করা। আরবিতে এ বিষয়টিকে বলা হয় ইতকন। অমুসলিমরা আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে গেছে। আমরা এখন অনেকটাই পশ্চাৎপদ। এমতাবস্থায় আমরা যারা মুসলিম আছি তাদেরকে বিধর্মীদের তুলনায় আরো অনেক বেশি কাজ করতে হবে। অমুসলিমরা যদি প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা কাজ করে, আমাদেরকে দ্বিধাহীনভাবে ১০ ঘণ্টা কাজ করার চেষ্টা করতে হবে, যাতে আমরা তাদের অবস্থানে পৌঁছতে পারি। আর নিকট ভবিষ্যতে তাদেরকে অতিক্রম করেও যেতে পারি। এটা বললাম পরিমাণগত হিসেবে। দ্বিতীয়ত আমাদেরকে কাজ করতে হবে নিখুঁত মানে। আল্লাহ নিশ্চয়তা দিয়েছেন যারা একনিষ্ঠভাবে কাজ করবে, তিনি তাদেরকে বাড়তি হারে নেয়ামত দান করবেন। “সৎ কর্মশীলদেরকে অতিরিক্ত দানও করব।” (সূরা বাকারা : ৫৮)। রাসূল সা. বলেছেন, যারা প্রতিটি কাজ যথাযথভাবে এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমে করে, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন। (মুসলিম-১৯৭৬)। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে সবচেয়ে প্রশংসনীয় ও পছন্দনীয় গুণ হলো ইহসান। ষ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (গবেষণা ও উন্নয়ন)। অমুসলিমরা এ খাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে। আমরা মুসলিমরা কতটুকু করি? আমাদের এখনই অন্তত এতটুকু পরিসরে গবেষণা ও উন্নয়নের কাজ শুরু করা উচিত- যা আমরা নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। এই ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে উন্নত করতে পারবো। আমাদের কর্মদক্ষতাকে বিকশিত করতে পারবো। সর্বোপরি, আমাদের বর্তমান সময়টিকে ফেলে আসা অতীতের চেয়ে সুন্দর করে তুলতে পারবো।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমি বিশ্বাস করি, এই শতাব্দীটি হতে যাচ্ছে ইসলামের শতাব্দী। আমি এর নগণ্য একটি অংশ হতে চাই। আমি চাই, আপনারাও এর অংশ হয়ে যান। আপনাদের দিক থেকেও তেমন চাহিদা থাকা প্রয়োজন। আমি আমার জীবিত থাকা অবস্থাতেই ইসলামের এই জাগরণ দেখে যেতে চাই। আর আপনাদেরও কামনা থাকা উচিত, যাতে আপনারা আপনাদের জীবদ্দশায় তা দেখতে পারেন। তবে সে জন্য আমাদের সকলকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। ক্লান্তি আর হতাশা যেন আমাদেরকে গ্রাস না করে। কখনো হাল ছেড়ে দেবেন না। পরিশেষে এটুকুই বলি, মুসলিম হিসেবে আমার ও আপনার সকলের অনেক বেশি দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা রয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে মুসলিম হিসেবে বাছাই করেছেন; এটা কোনো সাদামাটা বিষয় নয়। তাই আমাদের সর্বত্র এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে যে, ইসলাম রহমত ও নেয়ামত সম্পন্ন একটি জীবন বিধান। মানুষকে আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহ সুষ্ঠুভাবে প্রদানের ঘোষণা দিয়েই ইসলাম পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছে। ইসলামকে তাই মানুষের সামনে সহজ ও সাবলীলভাবে তুলে ধরতে হবে। সব ধরনের জটিলতা পরিহার করতে হবে। সবাই যেন ইসলামকে রহমত হিসেবেই বিবেচনা করতে পারে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এ আলোচনা থেকে উপকৃত হওয়ার তাওফিক দিন। আমিন।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির