post

নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষাই অপরাধের জন্মদাতা

হামিদুর রশিদ জামিল

৩০ জুলাই ২০২২

শিক্ষার মাধ্যমেই একজন মানুষের বিবেকের উন্নয়ন হয়। এজন্য বলা হয়ে থাকে, “শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড”। এবং যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। মানসিক ও নৈতিক উন্নয়ন শিক্ষার মাধ্যমেই হয়ে থাকে। এখন কথা হচ্ছে, সব শিক্ষার মধ্যেই কি নৈতিক শিক্ষা আছে? যদি সব শিক্ষার মধ্যে নৈতিক শিক্ষা থাকতো তাহলে আজ পৃথিবীতে এত অশান্তি, দুর্নীতি, মারামারি-হানাহানি বিরাজ করতো না। আমরা আমেরিকাকে সভ্য জাতি হিসেবে খুবই সমীহ করে থাকি। কিন্তু আমেরিকার অবস্থা কি আমরা জানি! এই সভ্য স্থানেই সেকেন্ডে-সেকেন্ডে ধর্ষণ হচ্ছে। কারণ, নৈতিকতার দীক্ষা তারা দিতে পারেনি। তারা হয়তো শিক্ষার জায়গায় উন্নয়ন করেছে কিন্তু নৈতিকতার জায়গায় পারেনি। ফলে, পাশ্চাত্য সভ্যতার মুখোমুখি হয়ে মানুষ তার নৈতিকতা যা আছে তাও বিসর্জন দিচ্ছে। আমেরিকান কালচারের সমালোচনা করতে গিয়ে ইতোমধ্যে অনেকেই বলে ফেলেছেন যে, আমেরিকান সভ্যতা আর বেশিদিন স্থায়ী হবে না। কারণ, তারা নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়েছে। আর ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে, যারা নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়েছে তারা এ পৃথিবীতে স্থায়ী হতে পারেনি। সুতরাং, এমন শিক্ষা অর্জন করতে হবে যা মানুষকে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়। এক্ষেত্রে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার কথা আমরা তুলে ধরতে পারি। কারণ, এ শিক্ষাব্যবস্থা সমাজকে, বিশ্বকে এমন মানুষ উপহার দিয়েছে যাদের নৈতিক চরিত্র মাটির উপর পর্বতের স্থাপনার ন্যায়।

শিক্ষা কী?

শিক্ষা শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে, Education. বস্তুত মানুষকে মানুষ করার আয়োজনই হচ্ছে শিক্ষা। কবি মিল্টনের ভাষায়, Education is the harmonious development of body mind and soul.” সক্রেটিস কিংবা প্লেটোর মত, নিজেকে জানার নামই হচ্ছে শিক্ষা। (know thyself) প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, ভাষাবিদ ও ইসলামী আন্দোলনের নেতা গোলাম আযমের ভাষায় শিক্ষা হচ্ছে, আপন প্রয়োজনের তাগিদে ইচ্ছাকৃতভাবে জ্ঞান অর্জনের নাম।

ইমাম রাগেব ইস্পাহানীর মতে, To better understand the underlying entity of an object. এখানেunderstanding দুই পর্যায়ের। প্রথমত, কোনো বিষয়ের অন্তর্নিহিত সত্তাটি অনুভব করা। দ্বিতীয়ত, একটি জিনিস সম্পর্কে অপর জিনিসের সাহায্যে সে জিনিসের থাকা বা না থাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। 

ইসলামী শিক্ষা ও জ্ঞান

ইসলামী জ্ঞান অথবা শিক্ষা খুব জনপ্রিয় একটি টার্ম। অবশ্য এ টার্ম নিয়ে কিছু সমালোচনাও আছে। মূলত শিক্ষার ইসলামীকরণ হচ্ছে, এমন একটি পদ্ধতি; যাতে নির্দিষ্ট বিষয় সঙ্কলনের মাধ্যমে পুনর্গঠন করা বুঝায় ও এর দ্বারা ‘আকিদাতুত তাওহিদ’ নামক বেসিক বিষয়টির ওপর স্থাপনা দাঁড় করার বিষয়ে আলোচনা করা হয়। ইসলামী শিক্ষা ও জ্ঞানের সংজ্ঞায়ন মনীষীগণ বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন: ‘ইসলামী জ্ঞানতত্ত্বের (Epistemology) আলোকে জ্ঞান হলো সেই সুনির্দিষ্ট ধারণা বা বোধ ও প্রত্যয়, যার মাধ্যমে আল্লাহ সম্পর্কে এবং তাঁর লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও নির্দেশনা সম্পর্কে দায়িত্বশীলতা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও দায়িত্ব পালনের বাস্তবতা সৃষ্টি হয়। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ এবং উভয়ের নির্দেশনাকে বুঝার ও সেই বুঝার ভিত্তিতে চলার সচেতনতা, অভিজ্ঞতার বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াই জ্ঞান। তাই এ দৃষ্টিকোণ থেকে ইহ-পারত্রিক, পারত্রিক ও সামাজিক জ্ঞান বিজ্ঞানকে ইসলামী ভাবধারায় বিন্যাস, বিচার-বিশ্লেষণ এবং গ্রহণ-বর্জন করার প্রক্রিয়া Process কে জ্ঞানের ইসলামীকরণ বুঝায়। “জ্ঞান ইসলামীকরণ মানে জ্ঞানের নতুন সংজ্ঞা দিতে হবে এবং তথ্যাদিকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। তথ্যাদির কার্যকারণ ও সম্পর্ক নিয়ে পুনর্বার চিন্তাভাবনা করতে হবে, উপসংহারগুলোর পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে, উদ্দেশ্যের পুনর্বিন্যাস করতে হবে এবং তা এমনভাবে করতে হবে যাতে বিষয়গুলোর দর্শনকে সমৃদ্ধ করে এবং ইসলামের উদ্দেশ্য সাধিত হয়। এই লক্ষ্যে ইসলামের পদ্ধতিকরণ ক্যাটেগরিগুলোকে যথা-সত্যের ঐক্য, জ্ঞানের ঐক্য, মানবতার ঐক্য, জীবনের ঐক্য এবং সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য-মানুষের প্রতি সৃষ্টির আনুগত্য এবং সর্বোপরি আল্লাহর প্রতি মানুষের আনুগত্য-এ চিন্তাধারার আলোকে পাশ্চাত্য ধারণাগুলোকে অবশ্যই সংশোধন করতে হবে এবং বাস্তবতাকে উপলব্ধি ও বিন্যস্ত করার সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। তদ্রƒপ, পাশ্চাত্য মূল্যবোধের স্থলে ইসলামী মূল্যবোধকে পুনঃস্থাপন করা উচিত এবং তদনুযায়ী প্রতিটি ক্ষেত্রে বিদ্যার্জনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে। “The Islamization of knowledge means involvement in intellectual pursuits, by examination, summarization, correlation, and publication, from the perspective of an Islamic outlook on life, humanity, and the Universe. 

The Islamization of knowledge may be understood as a cultural and intellectual project aspiring to correct the processes of thinking within the Muslim mind so that it can produce Islamic, social, and humanistic knowledge based on the two sources Muslims accept as the established source for knowing the truth: wahy (divine revelation) and wujud (existence). In this endeavor, we shall use reason and the senses to help us acquire such knowledge that cannot be established on revelation and existence.

ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা

মুসলিম বিশ্বের জনসংখ্যা হিসেবে বাংলাদেশ চতুর্থ স্থানে অবস্থান করলেও বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষা, আইনব্যবস্থার ইসলামীকরণ হয়নি। ব্রিটিশদের প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থা এখনো চালু থাকার ফলে বাঙালি মুসলমান শরীরগত দিক দিয়ে হয়তো মুসলমান কিন্তু মন-মগজে তারা এখনো ব্রিটিশদের শিক্ষা ও চিন্তাকেই শেষ পর্যন্ত লালন করে। তাই বাঙালি স্বাধীন হলেও তারা তাঁদের মাথা অন্যের কাছে বিক্রি করে নত হওয়ার ফলে এখনো পরাধীনই হয়ে আছে। মালয়েশিয়া স্বাধীন হয়েছে সময় বেশিদিন হয়নি কিন্তু তাঁদের অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থার মান হিসাব করলে বাংলাদেশের হার ৬০% এর বেশি হবে না। কারণ দেশের সেরা বিদ্যাপীঠ ঢাবির rank ৮০০ এর মধ্যে থাকতে না পারলেও মালয়েশিয়ার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকই ৫০ এর মধ্যে অবস্থান করে।

ব্রিটিশদের শাসনব্যবস্থা যেখানেই ছিল সেখানে তারা রাষ্ট্রীয় ও শাসনতান্ত্রিক প্রয়োজনে দুই ধরনের কাজ চালু রেখেছিল। প্রথমত, প্রশাসনের জন্য কর্মচারী তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, পুলিশ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

আফ্রিকার ঘানার বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, পণ্ডিত ও প্রধানমন্ত্রী ড. কুফি বুসিয়া আফ্রিকান দেশসমূহের শিক্ষাব্যবস্থা আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, “বিদেশী শিক্ষাব্যবস্থা অনুসরণ করে আমরা যদি অগ্রসর হই তাহলে আমাদের সমূহ ক্ষতি হবে। এই কারণে ক্ষতি হবে যে, আমরা স্বাধীনতার তাৎপর্য অনুভব করতে পারবো না এবং পূর্বতন শিক্ষাব্যবস্থার আদলে আমরা আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করবো। তার ফলে আমাদের জীবনের যথার্থ পরিস্ফুটন ঘটবে না।” ইমাম রাগেবের দৃষ্টিতে ইলম দুই প্রকার। তা হচ্ছে, ১. Theoretical ও ২. Practical

Theoretical হচ্ছে, নীতিগত জ্ঞান যখন অর্জিত হলো তখন তা পূর্ণতা পেল। আর Practical হচ্ছে, বাস্তব জ্ঞান সম্পূর্ণতা পায় না যতক্ষণ তা কাজে পরিণত করা যাবে। প্রথমটির দৃষ্টান্ত: এই বিশ্বলোকের অস্তিত্ব বা অবস্থিতি সম্পর্কিত জ্ঞান বা জানা। দ্বিতীয়টি হলো, ইবাদত সংক্রান্ত ইলম। তা শুধু জানলেই হবে না, তা বাস্তবে প্রয়োগও করতে হবে। এর আরো একটি দিক রয়েছে, বিবেক-বুদ্ধিগত ও ঐতিহ্যগত। বিবেক-বুদ্ধিগত জ্ঞান হচ্ছে, যা মানুষ চিন্তা-গবেষণা ও অনুমিতির মাধ্যমে অর্জন করে। আর ঐতিহ্যগত জ্ঞান হচ্ছে, কুরআন, হাদিস ও ইমাম, মুজতাহিদদের থেকে অর্জিত জ্ঞান। অর্থাৎ, অহি ও ইলহাম ভিত্তিক জ্ঞান।

শিক্ষার একটা উদ্দেশ্য থাকা একান্ত আবশ্যক। অর্থাৎ, শিক্ষা কেন- শিক্ষার মাধ্যমে আমরা কী অর্জন করব? কিংবা শিক্ষা না হলে ক্ষতি কি? সে ক্ষতিরই বা কারণ কি? এ বিষয়গুলো আমাদের সামনে পরিষ্কার থাকা দরকার। বস্তুত মানুষের জন্য শিক্ষা অপরিহার্য। এ ব্যাপারে দুনিয়ার সর্বকালের জ্ঞানী-গুণী ও চিন্তাবিদদের পূর্ণ ঐকমত্য রয়েছে। মানুষ উন্নত ও ক্রমবিকাশপ্রাপ্ত জীব হওয়ায় মর্যাদা, কর্তব্য ও ভবিষ্যৎও সেই অনুপাতে উন্নত ও বিকাশপ্রাপ্ত মান অনুযায়ী হবে। সাধারণ জীব-জন্তু ও মানুষের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, মানুষ একটা Rational Animal বুদ্ধিমান জীব। মানুষের জীবন একান্তভাবে বুদ্ধিনির্ভর। আর বুদ্ধি-নির্ভর বলেই তারা আল্লাহকেও অস্বীকার করেছে এবং প্রতিটি বিধানকে খেল-তামাশায় পরিণত করেছে। 

আধুনিক পাশ্চাত্য জগৎ-তা ধর্মনিরপেক্ষ হোক বা ধর্মহীন হোক-সর্বত্র মানুষ সম্পর্কে অত্র ধারণা প্রকটভাবে বিরাজমান। ফলে তাঁদের শিক্ষাব্যবস্থা মোটামুটি জীবতাত্ত্বিক পর্যায়ের। সে শিক্ষার ফলে উন্নতমানের জীবই তৈরি হচ্ছে এবং তাঁদের সভ্যতা-সংস্কৃতিও তাঁদের মতোই নিঃসাড় নিতান্তই পাশব প্রকৃতির। এ শিক্ষা থেকে গড়ে উঠা লোকজনই হচ্ছে, সমাজ-সংস্কৃতির ধারক। ফলে এদের ছোঁয়ায় যে জাতি গঠিত হচ্ছে তারাও রোবটের মতোই ও পাশবিকতার মধ্যে নিমজ্জিত। আর এ কারণেই তাদের তৈরি দর্শন ও বিজ্ঞান পাশবিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। পশু জগতে যা সচরাচর দেখা যায় তা তাদের মধ্যেও পাওয়া যায়। পশুদের স্বভাবতই আচরিত বিষয়গুলো তাদের মধ্যে বুদ্ধিভিত্তিক জায়গায় স্থান করে নিয়েছে। মৌলিকতার দিক দিয়ে কোন পার্থক্য নেই। ফলে তাদের শিক্ষায় শকুনির মতো উড্ডয়নশীল ও ব্যাঘ্রের মতো হিং¯্র প্রাণী গড়ে উঠছে। প্রকৃত মনুষ্যত্বের অধিকারী ও মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ ও নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি।

সুতরাং, শেষকথা, জ্ঞান অর্জন করা হয় ইসলামী শিক্ষা তত্ত্বে মানুষের সমস্ত মাত্রাকে বাস্তবায়িত ও নিখুঁত করার জন্য। নবী মুহাম্মদ সা. ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিপূর্ণতার সর্বোচ্চ ও সবচেয়ে দরকারি মডেল এবং ইসলামী শিক্ষার লক্ষ্য হলো মানুষ তার মতো জীবনযাপন করতে সক্ষম হবে। যদিও শিক্ষা মানুষকে এই জীবনে সুখের জন্য প্রস্তুত করে, সাইয়্যেদ হোসেইন নাসর ১৯৮৪ সালে লিখেছিলেন যে ‘এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো স্থায়িত্বের আবাস, এবং সমস্ত শিক্ষা অনন্তকালের স্থায়ী জগতের দিকে নির্দেশ করে।’ ইসলাম অনুযায়ী, শুধুমাত্র যুক্তির মাধ্যমে সত্য নির্ণয় করা সীমিত কারণ আধ্যাত্মিক এবং সাময়িক বাস্তবতা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। অনেক মুসলিম শিক্ষাবিদ যুক্তি দেন যে আধ্যাত্মিকতার উপর যুক্তির উপর জোর দেওয়া সুষম বিকাশকে বাধা দেয়। একচেটিয়া বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশিক্ষণ, উদাহরণস্বরূপ, প্রেম, দয়া, সহানুভূতি এবং নিঃস্বার্থতার উপাদানগুলোকে বিকাশ ও পরিমার্জন করার জন্য অপর্যাপ্ত, যার সবগুলোরই প্রভাব রয়েছে এবং শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়াগুলোর দ্বারা নিযুক্ত হতে পারে।

ইসলামে শিক্ষা দ্বিগুণ- বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান অর্জন (যুক্তি ও যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে) এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানের বিকাশ (ঐশ্বরিক উদ্ঘাটন এবং আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত)। ইসলামের বিশ্বদৃষ্টি অনুযায়ী উভয়ের জন্য শিক্ষার বিধান সমানভাবে করতে হবে। ইসলামে জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্য শেষ নয় বরং আরও উন্নত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনাকে উদ্দীপিত করার উপায় হিসাবে, যা বিশ্বাস এবং ধার্মিক কর্মের দিকে পরিচালিত করে।

আজ মানুষ শিক্ষিত হলেও নৈতিকতার বিকাশ ঘটাচ্ছে না। কারণ, বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে তারা শিক্ষিত হচ্ছে কিন্তু নৈতিক হচ্ছে না। পাশ্চাত্যের অনুকরণে শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলাম সাজানোর ফলে যারা শিক্ষিত হচ্ছেন তারাও পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে গ্রহণ করছেন। কিন্তু পশ্চিমা সংস্কৃতির বাহন হলো নোংরামি, যৌনতা ও অশ্লীলতা। তারা নারীকে ভোগের বস্তু ও পণ্যে পরিণত করেছে। শিক্ষার নামে নারী বিপণনের ফলে তারা নারীবাদের ধুম তুলছে সর্বত্র। তাই এক কথায় সরকারি আমলাদের নামে কামলা বানানোর প্রকল্প হাতে নিয়েছে তারা। এ কারণে তারা রক্তে-মাংসে মুসলমান হয়েও নিজের অজান্তে পশ্চিমা সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরছে। আমি ইতিমধ্যে পশ্চিমা সভ্যতার ভিত্তির কথা বলেছি। তাই জাতিকে শিক্ষিত করার পাশাপাশি নৈতিক ব্যক্তিতে পরিণত করাই আমাদের লক্ষ্য। এখন প্রশ্ন হল, ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে কি নৈতিক শিক্ষা দেওয়া সম্ভব? আজ আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করব।

এই সভ্য জায়গায় প্রতি মিনিটে নারী, শিশু, বৃদ্ধ নারী এমনকি পুরুষ পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। স্ট্যাটিস্টা ইন্টারন্যাশনাল অনুসারে অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধর্ষণের হার ৯১.৯২% (ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ)। এছাড়াও কালো অর্থনীতির সমস্ত হাতিয়ার যেমন- মাদক, চোরাচালান, অস্ত্র, অবৈধ অর্থ বাণিজ্য বিশেষ করে যে দেশগুলি পর্ন শিল্পে শীর্ষে রয়েছে, তাদের প্রায় সবই আমাদের এই উন্নত অর্থনীতির মাধ্যমে আরাধ্য হওয়ার পথ দেখাচ্ছে এবং প্রযুক্তির বাহাদুরি প্রদর্শন করছে।

মানসম্মত শিক্ষানীতির প্রকৃতি কেমন?

শিক্ষা শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ শস ধাতু থেকে। এর অর্থ শাসন করা, নিয়ন্ত্রণ করা, নির্দেশ দেওয়া, পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে, ‘শিক্ষা’ বলতে একটি নির্দিষ্ট জ্ঞান বা কৌশল আয়ত্ত করাকে বোঝায়।

সক্রেটিসের ভাষায়, “শিক্ষা হল মিথ্যার বিনাশ এবং সত্যের আবিষ্কার।” প্লেটো বলেছিলেন, “দেহ ও আত্মার পূর্ণ বিকাশ ও অগ্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই শিক্ষার উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত।” এরিস্টটলের মতে, “শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হলো ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা অনুমোদিত পবিত্র কার্যকলাপের মাধ্যমে সুখ অর্জন করা।”

অর্থাৎ, মানসম্মত শিক্ষানীতি সেই ব্যবস্থাকে নির্দেশ করে যা মানবদেহ ও আত্মার কাক্সিক্ষত ও ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশ ঘটাবে। আর এই আত্মা ও দেহের সুষম বিকাশের জন্য প্রয়োজন এমন একটি আদর্শ যার পূর্ণ রূপ ও দিক মানব জীবনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও উন্নত। এখানে একটি জাতির জন্য একটি শিক্ষাকে সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন যেখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা তাদের নিজস্ব রীতিনীতি ও ঐতিহ্য বজায় রেখে একটি ‘সাধারণ সংস্কৃতির মূল্যবোধ’ দ্বারা একত্রিত হবে। তাই ব্যক্তি চেতনা ও সঠিক ব্যক্তিত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে জাতীয় চেতনা ও জাতীয় মতামত সৃষ্টিই আদর্শ শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য। এবং এই উদ্দেশ্যে একটি পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত হতে হবে যা পরবর্তী প্রজন্মকে একটি অভিন্ন সংস্কৃতি ও আদর্শিক ভিত্তির উপর দাঁড়াতে এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম করে। আলবার্ট সিজারের কথা শোনা যায় আদর্শ শিক্ষানীতি হিসেবে। এই ক্ষেত্রে, তিনি পরামর্শ দেন যে তিনটি ক্ষেত্রে শিক্ষার অগ্রগতি গুরুত্বপূর্ণ: জ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি, মানুষের সামাজিকীকরণের অগ্রগতি এবং আধ্যাত্মিক অগ্রগতি। আধ্যাত্মিক মুক্তি ছাড়া মানুষের মুক্তি বা উন্নতি হতে পারে না। ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার প্রবক্তারা আজ পশ্চিমা সমাজের এই পরিণতিকে উদার শিক্ষার বিপরীতে দেখেন।

তাই সময় এসেছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল কারণ উদঘাটনের। বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষানীতি ব্রিটিশ আমলের শিক্ষানীতিরই ধারাবাহিকতা। ব্রিটিশরা ঔপনিবেশিক অঞ্চলে তাদের শাসন বজায় রাখার জন্য একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে।

১৮৩৮ সালে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গ্ল্যাডস্টোন তার হাতে একটি পবিত্র কুরআন ধরেন এবং হাউস অফ কমন্সে এটি তুলে ধরেন, এটি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে “এটি মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থ, কুরআন।” ব্রিটিশরা এখন অনেক মুসলিম দেশ দখল করেছে। বৃটিশরা যদি এসব দেশে বিনা বাধায় তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে চায়, তাহলে তাদের অবশ্যই কুরআনের শিক্ষা থেকে দূরে রাখতে হবে। এর পরিণামে, ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশকে “জাতিগতভাবে ভারতীয় কিন্তু মনে ইংরেজ” হিসাবে তৈরি করতে চেয়েছিল। ইংরেজ শিক্ষাবিদ লর্ড ম্যাকলিন ১৮৩৯ সালে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার সময় বলেছিলেন: “আমাদের অবশ্যই একটি শ্রেণি গঠনের জন্য আমাদের সর্বোত্তম উপস্থাপন করতে হবে, যারা আমাদের এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে দোভাষী হতে পারে, যাদের আমরা শাসন করি, এক শ্রেণির ব্যক্তি- রক্ত ও বর্ণে ভারতীয়, কিন্তু স্বাদে, মতামতে, নৈতিকতায় এবং বুদ্ধিতে ইংরেজি”।

অর্থাৎ, ‘বর্তমানে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রচেষ্টা হবে এমন একটি দল তৈরি করা যা আমাদের এবং আমাদের লক্ষ লক্ষ প্রজাদের মধ্যে দূত হিসেবে কাজ করতে পারে। রক্তে ও বর্ণে তারা হবে ভারতীয়। কিন্তু ইংরেজি থাকবে মেজাজে, মতে, নৈতিকতায় ও বুদ্ধিতে।

লর্ড ম্যাকলিন কর্তৃক প্রণীত শিক্ষানীতির কারণে পাকিস্তান বা বাংলাদেশ কর্তৃক গৃহীত কোনো শিক্ষানীতি এমন কোনো মৌলিক আদর্শগত পরিবর্তন আনতে পারেনি যা বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জন্য ধর্মীয় অনুশাসনের অনুমতি দিয়েছে এমন ‘সংস্কৃতি মূল্যের সাধারণ সেট’ নির্দেশ করে। আর তাই আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রণীত কোনো শিক্ষানীতি আদর্শিক অর্থে উত্তীর্ণ হতে পারেনি।

শিক্ষার লক্ষ্য কী হওয়া উচিত?

একটি আদর্শ শিক্ষানীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের আধ্যাত্মিক ও শারীরিক গুণাবলির বিকাশ। মানুষ আত্মাহীন বা দেহহীন নয়। মানুষকে দৈহিক প্রাণী হিসেবে গণ্য করলে শিক্ষাব্যবস্থায় আত্মার বিকাশের কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। আত্মা হল নৈতিকতার ভিত্তি। আত্মার উন্নতির ব্যবস্থা না করলে এই দেহ পশুর মতো আচরণ করবে। মানবদেহ দেহের সকল বস্তুগত চাহিদা পূরণে সর্বদা ব্যস্ত থাকে। যখন তার পেট খালি থাকে তখন সে খেতে ব্যস্ত থাকে। খাবারের প্রয়োজন বলে সে খাবার চুরি করেছে নাকি কঠোর পরিশ্রম করে উপার্জন করেছে তা নিয়ে মানুষের পেটে ব্যথা নেই। অন্যায়ভাবে খাবার নিয়ে এলেও নিরাপদে খেতে থাকে। কিন্তু তখন আত্মা বলতে শুরু করে যে কাজটি ভুল। পোষা প্রাণীরা দড়ি ছিঁড়ে এবং তাদের নিজস্ব সদয় মাস্টার দ্বারা সাজানো বাগান খেতে দ্বিধা করে না। নৈতিকতার বন্ধন ছিন্ন করতে পারলে মানুষের শরীরও পশুতে পরিণত হয়। মানুষের স্বাধীনতাও নিয়ন্ত্রিত হয় শুধুমাত্র নৈতিকতার দড়ি দিয়ে। আর এই দড়ির সীমা পর্যন্ত সে অবাধে চলাফেরা করতে পারছে।

যারা মানুষকে আত্মাবিহীন জড় পদার্থ মনে করে তারা শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করার সময় মানুষের বস্তুগত চাহিদার দিকে মনোযোগ দেয়। পক্ষান্তরে, যারা মানুষকে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে মনে করে বা তার জৈবিক চাহিদার প্রতি তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক উন্নতির উদ্দেশ্যে এগুলোর প্রচলন করে, তারাও মানুষকে উপযোগী প্রকৃত শিক্ষা দিতে সক্ষম নয়। অতএব, যে শিক্ষা মানুষের আত্মা ও দেহকে একটি সুন্দর সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিণতিতে পৌঁছাতে সক্ষম করে এবং নৈতিকতার সীমারেখার মধ্যে তাকে এই পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে সক্ষম করে, সেটাই মানুষের প্রকৃত শিক্ষা। যে শিক্ষা মানবতার উন্নতি এবং নৈতিকতার বিকাশে প্রাকৃতিক শক্তির প্রয়োগকে অনুপ্রাণিত করে তা হল শিক্ষা যা মানুষের জন্য উপযোগী। আর যে শিক্ষা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম অগ্রগতি সত্ত্বেও মানবতা ও আত্মার অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করে, তা প্রকৃতপক্ষে মানব-বিধ্বংসী শিক্ষা; এটাকে মোটেও উপযোগী শিক্ষা বলা যাবে না। কবি মিল্টন যেমন বলেছেন, “শিক্ষা হলো শরীর, মন ও আত্মার সুসংগত বিকাশ।” এইভাবে, নৈতিক চরিত্র গঠন; একটি সুখী ও সমৃদ্ধ জাতি গঠন; বস্তুগত জ্ঞানের সাথে নৈতিক শক্তির সংমিশ্রণ, সমাজকে কলুষিত এবং অসুখী করে তুলতে পারে এমন সম্ভাব্য কর্মগুলি প্রতিরোধ করা; শিক্ষার উদ্দেশ্য হল বিজ্ঞান ও সাহিত্যের সকল শাখায় নীতি ও মূল্যবোধের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা।

একটি সমৃদ্ধ ও আদর্শিক জাতি গঠন করতে হলে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও বয়সের সাথে খাপ খাইয়ে নৈতিক ও মানবিক করে গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প নেই। যদিও প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রম ২০২০-এ কিছু চমৎকার উপকরণ এবং প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার প্রতি যথেষ্ট অনীহা রয়েছে। শুধু নামে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা না দিয়ে ‘নৈতিক মূল্যবোধের’ ভিত্তিতে প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা জরুরি। এভাবেই জাতি নৈতিকতায় যোগ্য ও দক্ষ হয়ে উঠতে পারে। কারণ নৈতিকতা একজনের অর্জিত যোগ্যতা ও দক্ষতার সঠিক ব্যবহারের পথ নির্দেশ করে। নৈতিকতার অভাব থাকলে সামাজিক ন্যায়বিচার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতি গঠনে ছাত্রদের ব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। মূলত, মানুষ খারাপ মেজাজ দ্বারা প্রভাবিত হয়। শুধুমাত্র শক্তিশালী নৈতিক মূল্যবোধই মানুষকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষাই হতে পারে নৈতিক শিক্ষার একমাত্র ভিত্তি। তবেই জাতি একটি আদর্শ পাঠ্যক্রম পেতে পারে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাবি

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির