post

পয়লা বৈশাখ ও আমাদের সংস্কৃতি

২৪ মার্চ ২০১৪
boishakhমো: আলমগীর হোসাইন যুগ যুগ ধরে আমাদের মাঝে নানা অনুষ্ঠান ও উৎসব চলে আসছে। যে অনুষ্ঠান বা উৎসব যতবেশি আকর্ষণীয় ও সার্বজনীন, তার গুরুত্ব ও ব্যাপ্তি ততবেশি। এমনই একটি উৎসব হচ্ছে পয়লা বৈশাখ। পয়লা বৈশাখ বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ বাংলা সনের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এ উৎসব উদযাপনে এসেছে পরিবর্তন ও বিকৃতি। বাংলাদেশের বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নেন। বিশ্বের সকল প্রান্তের বাঙালিরা এ দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় এবং বিগত দিনের সকল দুঃখ-কষ্ট ভুলে যাবার প্রচেষ্টা চালায়। সবার আন্তরিক চাওয়া থাকে যেন, নতুন বছরটি সমৃদ্ধ ও সুখময় হয়। ফিরে দেখা: খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভেই এ দেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে এ দেশে পঞ্জিকার ব্যবহার তেমন একটা ছিল না। ইসলামের আগমনের সাথে সাথে এ দেশে ইসলামী ঐতিহ্যমণ্ডিত হিজরি সনেরও প্রচলন শুরু হয়। হিজরি সন চন্দ্র সন হওয়ায় ঋতুর সাথে এর দৃঢ় সম্পর্ক নেই। ফলে রাজস্ব আদায়ে জটিলতা দেখা দেয়। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে সম্রাট আকবর সেই যুগের বিশিষ্ট মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে একটি নতুন সৌর সন আবিষ্কারের দায়িত্ব দেন। তিনি হিজরি সনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বর্ষ গণনা ৩৫৪ দিনের স্থলে ৩৬৫ দিন করে নতুন সন উদ্ভাবন করেন। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ মতান্তরে ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল জালালি সন পরে তা বঙ্গাব্দ বা বাংলাবর্ষ নামে পরিচিত হয়। বাংলা সনের উৎপত্তি হিজরি সন থেকে। বাংলা সন প্রকৃতপক্ষে হিজরি সনেরই সৌররূপ। ইসলামী ঐতিহ্য থেকে উৎসরিত এবং বরেণ্য মুসলিম বিজ্ঞানীদের হাতে উদ্ভাবিত ও উৎকর্ষিত বাংলা সন নিঃসন্দেহে মুসলমানদের গর্ব ও মর্যাদার প্রতীক। তাই নববর্ষের সকল অনুষ্ঠান হওয়া উচিত এদেশের বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর চিন্তাচেতনা, আদর্শ ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে। এটিই বাংলা নববর্ষের স্বাভাবিক ও চিরন্তন দাবি হওয়া উচিত। এক সময় আরবে পারস্যের অনুকরণে ‘নওরোজ’ এবং ‘মেহেরজান’ উৎসব অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে পালন করা হতো। যা ছিল ইসলামী আদর্শ ও চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী। তাই একে প্রতিরোধের জন্য নবী (সা) মুসলমানদের জাতীয় উৎসব হিসেবে দুই ঈদের প্রচলন করেন। কারণ ইসলাম নির্মল আনন্দ-বিনোদনে বিশ্বাস করে এবং উৎসাহিত করে। স¤্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত তারিখ-ই-ইলাহির মাসের নামগুলো প্রচলিত ছিল পারসি ভাষায়। যথা: ফার ওয়াদিন, আর্দি, ভিহিসু খোরদাদ, তির, আমারদাদ, শাহরিয়ার, আবান, আয়ুর দাই, বহম এবং ইলক্লদার মিজ। বাংলা সন অন্যান্য সনের মতোই সাত দিনকে গ্রহণ করেছে এবং দিনের নামগুলো অন্যান্য সনের মতোই তারকামণ্ডলীর ওপর ভিত্তি করেই করা হয়েছে। ইংরেজি বা গ্রেগারিয়ন বর্ষপঞ্জির শুর হয় মধ্যরাত হতে। অন্য দিকে বাংলা সনে দিনের শুরু ও শেষ হয় সূর্যোদয়ে। সংশোধিত বাংলা সন: ১৭ ফেব্রæয়ারি ১৯৬৬ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক বাংলা সন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে এ কমিটি বিভিন্ন বাংলা মাস ও ঋতুতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক জীবনে বাংলা সনের প্রায়োগিক কিছু সমস্যা ও তার প্রতিকার নির্ণয় করে সেগুলো থেকে উত্তরণের প্রস্তাবনা দেন। বাংলা সনের ব্যাপ্তি প্রেগারিয়ান বর্ষপঞ্জির মতোই ৩৬৫ দিনের। যদিও সেখানে পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণের পরিপূর্ণ সময়কেই যথাযথভাবে নেয়া হয়েছে। এ প্রদক্ষিণের মোট সময় ৩৬৫ দিন, ৫ ঘণ্টা এবং ৪৭ সেকেন্ড। এই ব্যবধান দূর করতে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে প্রতি চতুর্থ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি অতিরিক্ত দিন যোগ করা হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞাননির্ভর হলেও বাংলা সনে এই অতিরিক্ত দিনকে যোগ করা হয়নি। এই সমস্যাগুলোকে দূর করার জন্য ‘ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কমিটি’ বাংলা একাডেমির কাছে যে প্রস্তাবনা দেয় তা হচ্ছেÑ বছরের প্রথম পাঁচ মাস বৈশাখ থেকে ভাদ্র হবে ৩০ দিনের আর বাকি মাসগুলো অর্থাৎ আশ্বিন থেকে চৈত্র হবে প্রতিটি ৩০ দিনের মাস। প্রতি চতুর্থ বছরের ফাল্গুন মাসে একটি দিন যোগ করে তা হবে ৩১ দিনের। বাংলা একাডেমি সরকারিভাবে এই সংশোধিত বাংলা মাসের হিসাব গ্রহণ করেছে। যদিও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পুরনো বাংলা সনের প্রচলনই অনুসরণ করছে। আমাদের সংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতি একটি মহান সত্তায় বিশ্বাসের সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি মূল্যবোধের সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি সার্বজনীন সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। এ সংস্কৃতি পুরোপুরি মানবসভ্যতার কল্যাণের সংস্কৃতি। সাধারণ অর্থে সংস্কৃতি বলতে আমরা নাচ, গান, নাটক, নৃত্য, আবৃত্তি ও কৌতুক ইত্যাদিকে বুঝি। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এগুলো সংস্কৃতি নয়। এগুলোকে কেউ কেউ সংস্কৃতির অংশ হিসেবে দাবি করেন। সংস্কৃতির নিজস্ব স্বকীয়তা আছে। দেশ-কাল ভেদে সংস্কৃতি ভিন্ন হয়। সংস্কৃতির মূল লক্ষ্য সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা। এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী Muclver বলেছেন,Culture is that what we are অর্থাৎ ‘আমরা, আমাদের সত্তা, আমাদের পরিবারই হচ্ছে সংস্কৃতি’। ম্যাথিউ আরনল্ডের মতে, ‘সংস্কৃতি হচ্ছে খাঁটি হওয়া বা মার্জিত হওয়া বা রুচিশীল হওয়া।’ সংস্কৃতির গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন, সমাজবিজ্ঞানীE.B Tylor তার মতে, Culture is that complex which includes knowledge, belief, arts, moral, custom and any habits occurred by man as a member of society. সাবেক রাষ্ট্রপতি আ: রহমানের মতে, আমাদের সংস্কৃতিতে আমাদের জনগণের আবহমান লালিত আদর্শ, বিশ্বাস, ইতিহাস, ঐতিহ্য, জীবনাচার ও জীবনপদ্ধতি বিধৃত হবে এটাই স্বাভাবিক।boishakh-01 সবচাইতে ভালো সংজ্ঞা দিয়েছেন মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী। তিনি বলেন, সংস্কৃতি হচ্ছে দ্বীন ও দুনিয়ার এক মহত্ত¡র সমন্বয়। এ হচ্ছে একটি ব্যাপকতর জীবনব্যবস্থা যা মানুষের চিন্তা, কল্পনা, স্বভাব চরিত্র, আচার ব্যবহার, পারিবারিক কাজকর্ম, সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ড, রাজনৈতিক কর্মধারা, সভ্যতা ও সামাজিকতা সবকিছুর ওপরই পরিব্যাপ্ত। আর এ সমস্ত বিষয়ে যে পদ্ধতি ও আইন খোদা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তারই সামষ্ঠিক নাম হচ্ছে ইসলামী সংস্কৃতি। উপরোক্ত সংজ্ঞার বিশ্লেষণে এ কথা দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, সংস্কতি জোর করে চাপিয়ে দেয়ার কোনো জিনিস নয়, বরং সংস্কৃতি হচ্ছে নিজস্ব স্বকীয়তা ও নিজস্ব চিন্তার প্রতিফলন। এর মধ্যে বিনোদন, ঐতিহ্য ও শিক্ষণীয় বিষয় থাকবে। আমাদের দেশে প্রতি বছর বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে পয়লা বৈশাখ উদযাপন হয়। সময়ের ব্যবধানে অনুষ্ঠান উদযাপনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন ও বৈচিত্র্য। কিন্তু এই পরিবর্তন ও বিচিত্রতার অনেক বিষয় আমাদের ঐতিহ্যের সাথে সাংঘর্ষিক। আজকের দিনে, বাংলা সন পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে যে আয়োজন তা আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া সংস্কৃতি। আজকে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, যে সনের উৎপত্তি ও উৎকর্ষতা লাভ করেছে মুসলমানদের হাতে সেই সন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ পালন করা হয় বিজাতীয় সংস্কৃতির আদলে, যা এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণকে নিজস্ব ঐতিহ্যবোধ বিশ্বাস ও তাহজিব-তমদ্দুন তথা শেকড় থেকে বিছিন্ন করার গভীর ও পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। বাংলা নববর্ষের দিন একশ্রেণীর মানুষের মাঝে ‘পান্তা-ইলিশ’ খাওয়ার ধুম পড়ে যায় এবং নিজেরা যে বাঙালি তা জানান দেয়। এ যেন সেই গানের মতো “একদিন বাঙালি ছিলামরে”। এভাবে বিশেষ একদিন পান্তা খাওয়া গরিব মানুষের সাথে তিরস্কার নয় কি? এ যেন বাবা-মাকে এক বছর ভুলে থেকে বছরে একদিন বাবা-মা দিবস পালন করার মতো। আফসোস লাগে, সেই সব তরুণ-তরুণীদের জন্য যারা ইতিহাস না জানার কারণে এভাবে একটি বিজাতীয় সংস্কৃতির লালন ও উৎকর্ষতায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছে। আমরা বেশ কয়েক বছর থেকে লক্ষ্য করছি, নববর্ষের দিন আনন্দ-মিছিলের নামে কিছু তরুণ-তরুণী যে বেলেল্লাপনা প্রদর্শন শুরু করছে তা ধর্মপ্রাণ জনগণকে বিব্রত করছে। চারুকলা থেকে বিভিন্ন জীব-জন্তুর বিশাল বিশাল মূর্তি ও মুখোশ পরে এবং পূজার স্টাইলে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে রাস্তা প্রদক্ষিণ করা হয়। বাংলা নববর্ষ বরণ করার সাথে এসব বিষয়ের আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই, বরং এগুলো বিজাতীয় সংস্কৃতির অংশ। আজকাল প্রায় দেখা যায়, একটি বিশেষ শ্রেণীর লোকেরা ‘মঙ্গল-প্রদীপ’ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করেন। এসব কোন কিছুই আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তার প্রতিফলন নয়, এগুলো একটি বিশেষ ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ মাত্র। এ প্রসঙ্গে জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন, “আমাদের দেশের কিছু সংখ্যক মেরুদণ্ডহীন পরজীবী ও ধর্মচেতনাশূন্য এবং ইতিহাস বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ কিছু মূর্খ লোক এ দেশের কোন কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মঙ্গল প্রদীপের অয়োজন করে থাকে এবং কাঁসার ঘণ্টা বাজিয়ে থাকে। আমি সুস্পষ্ট ইতিহাসের ধারা অনুসরণ করে জানাতে চাই যে, মঙ্গল প্রদীপ ও কাঁসার ঘণ্টা সম্পূর্ণরূপে পৌত্তলিক এবং সাম্প্রদায়িক। তা ছাড়া এগুলো কোনক্রমেই এ অঞ্চলের মানুষের জীবনধারার সম্পর্কে যুক্ত নয়।” লেখক : কেন্দ্রীয় স্পোর্টস সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির