post

পরিবেশ সৃষ্টি ও চাপ : সাংস্কৃতিক আন্দোলন

শুকরান সাবিত

১২ জুন ২০২২

কর্মপদ্ধতির আলোকে পরিবেশ সৃষ্টি ও চাপ হচ্ছে- চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে জাতীয় জীবনে একটা পবিত্র পরিবেশ সৃষ্টির তৎপরতা চালানো। এর ফলে কী হবে? কর্মপদ্ধতি বলছে, এ তৎপরতা যখন উল্লেখযোগ্য ছাত্রদেরকে সংশ্লিষ্ট করতে পারবে তখন সমাজ ও জাতীয় জীবনে তা একটি শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করবে। আর এহেন চারিত্রিক শক্তি দিয়ে আমরা কর্তৃপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করতে বদ্ধপরিকর।

পরিবেশ সৃষ্টি ও চাপের যে সংজ্ঞায়ন এখানে করা হয়েছে তার যথার্থ বুঝ আমরা পেয়েছি কিনা সেটা ভাবতে হবে। ‘একটা পবিত্র পরিবেশ’ সৃষ্টির তৎপরতা চালাতে ‘চারিত্রিক মাধুর্য’ অপরিহার্য। এ তৎপরতায় ‘উল্লেখযোগ্য ছাত্রদেরকে সংশ্লিষ্ট’ করার অন্য মানে দাঁড়ায়, জনমত গঠন। জনমত কিভাবে গঠিত হয়? কুরআনে আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকারের যে নির্দেশনা, সেটিই জনমত তৈরির উপায়।

চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে সমাজ বদলানোর ধারণা একটি ইতিবাচক তৎপরতা, আমর বিল মারুফের নমুনা। ইতিবাচক তৎপরতা হলো, সমাধান। কিন্তু পরিবেশ সৃষ্টির আরও ফলপ্রসূ কর্মকৌশল হচ্ছে সমস্যা নিয়ে কাজ করা।

যেহেতু আমরা পরিবেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে চাপ সৃষ্টি বা চলমান পরিবেশ-প্রতিবেশ বদলিয়ে ফেলার বিপ্লবী কর্মসূচি হাতে নিয়েছি, সুতরাং এখানে কোথাও একটা ‘সমস্যা’র উপস্থিতি আছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না; সে জন্যই আমরা হন্যে হয়ে সমাধানের দিকে ছুটতে চাইছি। কারো নজরে কোন বিষয় সমস্যাপূর্ণ মনে না হলে সেটা কেউ সরাতে চায় না।

কিন্তু আমরা কিসের সমাধান চাইছি, কী সেই সমস্যা, সেটা অনেকাংশেই হয়তো বুঝে উঠতে পারিনি। ধরা যাক, আমরা চাই মানুষ এখন থেকে তিন বেলা রুটি খাবে। কিন্তু কেন সে এই আকাম করতে যাবে? যেখানে ভাত খেয়েই তার দিব্যি চলে যায়! দীর্ঘদিনের অভ্যাস কী কারণে সে বদলাতে যাবে? কেউ এ কথায় কান দিবে না, যদিও সেটা আমাদের হাজার বছরের দাবি হয়! মানুষকে কথা শোনানোর সঠিক তরিকা হচ্ছে সমাধানের আগে সমস্যার কথা বলা, তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা। ধরি, তিন বেলা ভাত খেলে নানামুখী রোগ-বালাই জমাট বাঁধবে শরীরে। পয়লা কাজ হচ্ছে, এই সমস্যাটা আগে চিহ্নিত করতে হবে; দুসরা, তা সবার নজরে আনতে হবে। এটাই হচ্ছে সঠিক কর্মকৌশল।

প্রাথমিক যুগে মক্কার মুশরিক, মদিনার কাফির আর ঈমানদারদের উপরে এই কর্মকৌশলই প্রয়োগ করা হয়েছে। তবে এটিই একমাত্র কর্মকৌশল নয়। আসলে কুরআনের কর্মকৌশল ছিল চারটি-

১. সমস্যা চিহ্নিতকরণ

২. সমস্যার ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপন

৩. তা থেকে বিরত রাখা

৪. সমাধানের পথে উৎসাহিত করা

যেমন, আল্লাহ তায়ালা জিহাদ বিমুখতার সমস্যা সমাধানে মনোযোগী হলেন। তিনি বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, জিহাদ করো। কিন্তু সর্বত্র এটাই বলেননি। বেশ কিছু জায়গায় প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। কুরআনুল কারিমে তিনি জানতে চান, “তোমরা কি মনে কর যে, তোমাদেরকে এমনিতেই ছেড়ে দেওয়া হবে? যে পর্যন্ত আল্লাহ জেনে না নেবেন তোমাদের মধ্যে কারা তাঁর পথে জিহাদ করেছে, আর আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মু’মিনদের ছাড়া অন্য কাউকে বন্ধু ও অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করেনি? তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আল্লাহ বিশেষভাবে অবহিত।” (সূরা তাওবা : ১৬)

এই আয়াতটি মু’মিনদের জন্য বিশেষ একটু নজর দিলে দেখা যায়, সে সময় জিহাদ না করার মানসিকতা অথবা জিহাদে দুর্বলতার সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। আল্লাহ প্রশ্ন তুলেছেন, জিহাদ না করে কি পার পেয়ে যাবে বলে মনে করো? তোমরা কাফির-মুশরিকদের বন্ধু বানিয়ে নাওনি তো? 

আরেকটি আয়াত দেখা যাক, “সম্পদ জমা করার প্রতিযোগিতা মোহাচ্ছন্ন করে রাখে তোমাদের; যতক্ষণ না তোমরা কবরে যাচ্ছ। এটা (ঠিক) নয়, তোমরা দ্রুতই জানতে পারবে।” (সূরা তাকাছুর : ১-৩)

এই যে খুব সুনির্দিষ্ট করে সমস্যা চিহ্নিত করার কৌশল এটা অত্যন্ত কার্যকরী। আল্লাহ তায়ালা আয়াতগুলোতে এটা বলেননি যে, তোমরা জিহাদযাত্রা করো! অথবা এটিও বলেননি যে, সম্পদ জমা করা থেকে বিরত থাকো। বরং সোজা করে বলার চেয়ে এভাবে বাঁকিয়ে বলাতে বাক্যে যেমন এক দ্যোতনা সৃষ্টি হয়েছে, কলবেও এক চাঞ্চল্য ও অস্থিরতার জন্ম দেয়; সমস্যার পরিণাম সম্পর্কে তৈরি হয় সচেতনতা।

সাংস্কৃতিক আন্দোলন মানে শুধুই গান-কবিতা, নাটক, উপন্যাস আর মুভি নয়। এই সঙ্কীর্ণ ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সংস্কৃতি এতটা ছোট নয়। আসলে কর্মপদ্ধতির পরিবেশ সৃষ্টি ও চাপ যতটা না রাজনীতি সংশ্লিষ্ট; তারচে অনেক গুণ সংস্কৃতি সম্পর্কিত। ‘পবিত্র পরিবেশ’ মানে হলো ব্যক্তি, পরিবার থেকে সমাজ ও রাষ্ট্র সবখানেই দ্বীনিয়াতের নিশান উচ্চকিত হবে। তাছাড়া বাংলাদেশে ইসলামের বিরুদ্ধে যেটি সবচাইতে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবে সাফল্য এনেছে, সেটি রাষ্ট্রশক্তি নয়; সংস্কৃতি। রাষ্ট্রশক্তি এর পিছনে দাঁড়িয়েছে, মূল ফ্রন্টে নয়। পলাশী বিপর্যয়ের পর থেকে রাষ্ট্রীয় মদদে এদেশে ইসলামকে সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলশেভিক বিপ্লবের পর এটি মুসলমানদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়। এরপর তারা এর সমাধানকল্পে চারটি কৌশলই প্রয়োগ করেছে। বিপরীতে উপমহাদেশের আজাদির পর ঘটেছে ইসলামপন্থীদের বিপর্যয়। ফলে সম্পূর্ণ ফাঁকা মাঠ পেয়ে ওই সময়ে যে কিকগুলো দিয়েছে দুষ্কৃতকারীরা, তার ফল আজকে তারা ভোগ করছে। প্রসঙ্গত বলে নেয়া জরুরি, একই সময়ে ইসলামপন্থীদের একটি মহল এদেশে বহুকাল প্রচলিত মুসলিম রসম-রেওয়াজকে ইসলামী আকিদার পরিপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর শেফার জন্য সঠিক ট্রিটমেন্ট না করে এসব রসম-রেওয়াজের গলা কাটতেই উদ্যত এই মহলটির প্রভাব আমাদের মধ্যেও বেশ লক্ষ্য করা যায়। 

আসলে রেওয়াজ বা প্রথামাত্রই ইসলামী আকিদার সাথে সাংঘর্ষিক, এই ধারণা শুদ্ধ নয়। বরং ইসলামের নির্দেশনা হচ্ছে, অন্য ধর্মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এমন রেওয়াজ থেকে বিরত থাকা। তবে অন্য ধর্মের রেওয়াজের বিপরীতে ইসলাম নিজেই ইবাদতের সূচনা করেছে। দুই ঈদ কিন্তু মুশরিকদের রেওয়াজের বিপরীত স্রােত; ইসলামের প্রাক-প্রাথমিক যুগে দুই ঈদ ফরয ছিল না। ইসলাম ফিতরাতের ধর্ম হিসাবে অন্য জাতির তাহজিব-তমদ্দুনকে দূরে ঠেলে দেয় না। বরং ইসলামী আকিদার বিপরীত অংশটাই বাদ দেয় শুধু। কিন্তু আমাদের দেশে হয়েছে বিপরীত। কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে বাঙালি মুসলমানের ফিতরাত, উৎসবপ্রবণতার উপর একের পর এক আঘাত হানা হয়েছে। 

এর ফলে যেটা হয়েছে, ধর্মীয় ইবাদতের বাইরেও বাঙালি মুসলমানের সামাজিক ও পারিবারিক পর্যায়ে মুসলমানিত্বের যেসব চিহ্ন ছিল, তা হারাতে বসেছে। চতুর্মুখী বিপর্যয়ের মুখে ইসলামী তমদ্দুন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে চার কৌশলের বদৌলতে সুশোভিত ও মহীরুহ হয়ে উঠেছে ইসলামবিরোধী অপশক্তি। এর সমাধানের জন্য ইবাদতমুখী হওয়ার পাশাপাশি আকিদার ভিত্তি ঠিক রেখেই ওইসব রেওয়াজ ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হওয়া জরুরি। কেননা সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের বিপরীতে সংস্কৃতিই হয়ে উঠবে হাতিয়ার। অন্য ধর্ম সংশ্লিষ্ট না হলে যেহেতু ইসলাম রসম-রেওয়াজ গ্রহণের অনুমতি দেয়, সেহেতু আকিদাগত পরিশুদ্ধতার দিকে খেয়াল রেখে তা গ্রহণে দোষ নেই।

এর বাইরেও নির্দিষ্ট করে সাহিত্য, গান ও নাটক-সিনেমার কথা বলতে গেলে, আমাদের কাজগুলোতে সমস্যা চিহ্নিত হচ্ছে না। শুধু আবেগ, আবেশ ও কিছু স্বপ্নের ধারণা দেওয়া। সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও প্রশ্ন উত্থাপন দর্শনের আসল কাজ। দর্শন প্রশ্ন উত্থাপন করে এবং তা নিয়েই কাজ করে। একইভাবে সাহিত্য ও নাটক-সিনেমাতেও সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও প্রশ্ন উত্থাপন কৌশল ব্যবহৃত হয়। সমাধান নিয়ে এদের কাজ নেই। সমালোচকেরা সাহিত্যের সমালোচনা করতে গিয়ে স্পষ্টভাবেই বলেন, সমাজের কোনো সমস্যাকে নিখুঁত বাস্তবধর্মী করে চিহ্নিত করাই সাহিত্যিকের কাজ, সমাধান দেওয়া সাহিত্যিকের কাজ নয়।

জাতীয় আদর্শে আমরা গণমুখী। কিন্তু আমরা গণমানুষের দোরগোড়ায় সেভাবে পৌঁছাতে পারছি না; না রাজনৈতিক, না সাহিত্য-সাংস্কৃতিক। অন্যদিকে বিপরীতপন্থী, মানে গণবিমুখ মহল সুচারুভাবে এই কাজটি সম্পন্ন করে জাতীয় আদর্শ বদলিয়ে দিতে তৎপর। কিভাবে করেছে? আমরা যখন মানুষকে ‘চারিত্রিক মাধুর্য’ দিয়ে ইনসাফপূর্ণ ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখাতে ব্যস্ত, তখন তারা চিহ্নিত সমস্যা নিয়ে তাদের হৃদয়ের দরজায় নাড়া দিয়েছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, তারা বিপরীতপন্থী ও গণবিমুখ। দেশভাগের পর একের পর এক তারা রচনা করেছে নাটক-উপন্যাস, নির্মাণ করেছে সিনেমা। যেগুলোতে সত্য-মিথ্যার সম্মিলনে ইসলামী তাহযিব-তমদ্দুনের উপর তোলা হয়েছে প্রশ্ন।

বাংলা সাহিত্য আমার একাডেমিয়া হওয়ায় সাহিত্যে রাজনৈতিক আদর্শের প্রভাব রাখা যাবে না, এই বক্তব্য প্রথম বর্ষ থেকেই মুখস্থ। কিন্তু আমি বিষয়টা বুঝে উঠতে পারতাম না। তারা যেসব রচনা করেছে সেটা তো তাদের আদর্শই প্রচার করছে! আসলে তাদের কৌশলটি হচ্ছে নিজের আদর্শের নাম-গন্ধ না নিয়ে চিহ্নিত সমস্যার উপর প্রশ্ন উত্থাপন ও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় গড়ে তোলা। এতে রচনাও থাকলো রাজনৈতিক আদর্শের প্রভাবমুক্ত। ব্যস, রচিত হলো একটি উৎকৃষ্ট সাহিত্য, নির্মিত হলো শিল্পগুণ সম্পন্ন মুভি।

বিপরীতে আমাদের গল্প, কবিতা, নাটক, সিনেমা আর গানে কি উঠে আসে? সমাজের অসঙ্গতি উঠে আসে না, উত্থিত হয় না কোন প্রশ্ন। প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রেই মুখ্য বিষয় ধর্ম ও রাজনৈতিক দর্শন। সাহিত্য-সংস্কৃতির আধ্যাত্মিক অংশ হিসাবে এটি থাকবেই, কিন্তু আধুনিক সাহিত্য ও সিনেমায় এটি পরিত্যক্ত। বিশ্বব্যাপী প্রচলিত আধুনিক সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যের সাথে এটি খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। তার উপরে যেটা হয়েছে, আদর্শের ভাবালুতা থাকলেও তার কোনো প্রকৃষ্ট উদাহরণও পেশ করতে পারিনি আমরা। যেমনটা আজকালকের তুরস্কের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে। আদর্শের আলাপের চেয়ে অন্তত সেই আদর্শের বাস্তব উদাহরণও কাজ আসবে। কিন্তু আমাদের শিল্প-সাহিত্যে এই ঘাটতির ফলে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ময়দানে সৃষ্টি হয়েছে কল্পিত দু’টি ধারা। একটি কথিত ইসলামী, আরেকটি আধুনিক, মূলধারা। অথচ আমরাই গণমুখী, গণ আদর্শের প্রতিধ্বনি আমাদের কণ্ঠেই আসছে; আমরাই মূলধারা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এটি আদর্শের ডামাডোল পেটানোর জায়গা নয়।

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির