post

পহেলা এপ্রিল মুসলিম জাতির আত্মোপলব্ধির স্মারক

২৬ মার্চ ২০১২
মুহাম্মদ আবু সাঈদ খান এপ্রিল মাস মুসলিম ইতিহাসের এক হৃদয়বিদারক শোকময় মাস। বিশেষ করে ১ এপ্রিল যা বর্তমানে এপ্রিল ফুল (april fool) অর্থাৎ এপ্রিলের বোকা নামে পরিচিত। এ দিবসে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে Practical jokes বা বাস্তব বা ব্যবহারিক তামাশার নামে বহু উৎসবের ব্যবস্থা করা হয়। এ দিন হাসি তামাশার মাধ্যমে বন্ধু প্রিয়জনের সাথে মিথ্যা প্রতারণা করে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করা হয়। বর্তমানে পাশ্চাত্যের অনুকরণে মুসলিম বিশ্বেও তরুণ-তরুণীদের মাঝে এ উৎসব পালনের আগ্রহ দিন দিন বেড়ে চলছে। অথচ এর পেছনের ইতিহাস একজন মুসলিমকে উৎসব পালনে উৎসাহিত করে না বরং এক শোকাবহ চেতনা ও প্রতিবাদের আগুন প্রজ্বলিত করে একজন সত্যিকারের মুসলিম তরুণ-তরুণীর হৃদয়ে। তা ছাড়া ইসলামে এমনিতেই মিথ্যা প্রতারণা করে আনন্দ উল্লাস নিষিদ্ধ। সত্যিকারের ইতিহাস না জানায় মুসলিমসমাজ নিজেদের অজান্তেই নিজেদের প্রতি জুলুম করছে। হযরত আদম (আ)-এর মাধ্যমে পৃথিবীতে মানবজাতির পথ চলা শুরু। অতঃপর নূহ (আ)-এর সময় প্লাবনে তাঁর সাথে নৌকায় ওঠা জাতি থেকে পৃথিবীতে পুনরায় মানববংশের বিস্তার লাভ করে। আল্লাহ বলেন, ‘‘তার (নূহ আ) বংশধরদেরকেই বংশপরম্পরায় বিদ্যমান রেখেছি।” (সূরা সাফফাত :৭৭ আয়াত) তার তিন সন্তান- হাম, সাম ও ইয়াফাস। তাফসিরে সাফাওয়াতুতের বর্ণনানুযায়ী হামের বংশধরগণ ক্রমান্বয়ে আফ্রিকা চলে যান। সামের বংশধর মূলত মধ্যপ্রাচ্যে ও পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে বসবাস করেন। ভারতের দ্রাবিড়গণ তাদের বংশধর বলে বোঝা যায়। ইয়াফাসের বংশধর অনেকে ইরানে বসবাস করেন। তাদের একদল ভারতে আসেন যারা আর্য নামে পরিচিত। অন্য দল ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এ জন্য ইউরোপ, ভারতের আর্য ও প্রাচীন ইরানের ভাষা সংস্কৃতি ও ধর্মের মধ্যে অনেক মিল পাওয়া যায়। যার অন্যতম পহেলা এপ্রিল। বসন্তের শেষ দিকে অর্থাৎ এপ্রিল মাসে ভারতের হিন্দুগণ হোলি উৎসবের আয়োজন করে। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী ভগবান বিষ্ণুর অবতার মানবরূপ শ্রীকৃষ্ণের সাথে গোপন লীলাখেলার স্মৃতি উদযাপনে তারা এ উৎসবের আয়োজন করে। এ উৎসবই প্রাচীন ইউরোপে রোমান ধর্মের হিলারিয়া (Hilaria) উৎসব। এ উপলক্ষে নানা রকম অশ্লীল, আনন্দ-উৎসব প্রচলিত ছিল ইউরোপে। পরবর্তীতে ইউরোপে খ্রিষ্টান ধর্মের আগমন ঘটলে ভিন্নমত দমনে লাখ লাখ ইহুদি ও মুসলিমদের ওপর এমনকি ভিন্ন মতাবলম্বী খ্রিষ্টানদের ওপরও তারা হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। এটি তাদের মাঝে শুধু হত্যাকাণ্ড নয় বরং হত্যা উৎসবে পরিণত হয়। আগুনে পুড়িয়ে ও নানাভাবে মুসলমানদের হত্যা করলেও খ্রিষ্টান ধর্মযাকগণ এক্ষেত্রে সকল পাপাচারের অনুমতি দিয়েছিলেন। এ কারণে খ্রিষ্টান ইউরোপে এপ্রিল ফুল দিবসে হিলারিয়া বা হোলি উৎসবে বিভিন্ন প্রকার পাপাচার, মিথ্যা ও অশ্লীলতাকে প্রশ্রয় দেয়া হতো। এমনি একটি মিথ্যাচার ও বর্বরতা ছিল স্পেনের মুসলিমদের সাথে ইউরোপের খ্রিষ্টানদের এপ্রিল ফুল। ৮৯৮ হিজরি মোতাবেক ১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজা ফার্দিনান্ড ও রানী ইসাবেলার যৌথ খ্রিষ্টান বাহিনী মুসলিমদের শেষ রাজধানী স্পেনের গ্রানাডা শহর দখল করতে সক্ষম হয়। তারা এ সময় এপ্রিল ফুল নামে মুসলিমদের প্রতারণা করে তাদের মাঝে গণহত্যা চালায়। ৯২ হিজরি মোতাবেক ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে মুসলমানগণ গথ রাজাদের পরাজিত করে স্পেনে আগমন-পরবর্তী দীর্ঘ প্রায় ৮০০ বছরের শাসনামলে মুসলিমগণ কখনোই খ্রিষ্টানদের জোর করে ধর্মান্তরিত করেননি, তাদের ওপর নির্যাতন চালাননি। তারা পূর্ণ ধর্মীয় ও নাগরিক স্বাধীনতা ভোগ করেছে। কিন্তু মুসলিমদের ওপর খ্রিষ্টানদের বিজয়ের পর তারা শুধু মুসলমানদের নাগরিক ও ধর্মীয় সুবিধা হরণ করেনি বরং লাখ লাখ মুসলিমকে আগুনে পুড়িয়ে জাহাজ ডুবিয়ে ও গণজবাই অনুষ্ঠানে জবাই করে হত্যা করে। অসংখ্য মসজিদ আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়। তেমনি ১৪৯৩ সালে গ্রানাডায় তারা ঘোষণা দেয় মসজিদে আশ্রয় নেয়া মুসলিমদের হত্যা করা হবে না। সরলপ্রাণ লাখ লাখ মুসলিম যখন মসজিদে আশ্রয় নেন তখন তারা মসজিদে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে মুসলিমদের হত্যা করে। এ প্রতারণার ইতিহাস স্মরণ করতেই তারা আজ এপ্রিল ফুল নতুন আমেজে পালন করে। বর্তমান বিশ্বের প্রতি একজন মুসলিম সামান্য চেতনা নিয়ে প্রত্যক্ষ করলেই দেখতে পারে যে ধারাবাহিকতায় বিভিন্নভাবে জাতিসংঘের আইনের আশ্রয় নিয়ে বৈধ অবৈধ সকল পন্থায় খ্রিষ্টানগণ মুসলিমদের প্রতি অত্যাচার-নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। আফগানিস্তান-ইরাকসহ বহু মুসলিম রাষ্ট্র এর প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য। এর নাম দিয়েছে তারা বুশের ভাষায় ‘ক্রুসেড’ যা তাদের পুরনো ক্রুসেড নামক হত্যা যজ্ঞেরই পুনরাবৃত্তি। তাই এপ্রিল ফুলের ইতিহাস একজন মুসলিমের নিকট কোনোভাবেই আনন্দের নয় বরং শোকের ও প্রতিবাদের। একদিকে এ দিবসের উৎসব খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় চেতনার অংশ তা একজন মুসলিম কখনোই এর অনুকরণ করতে পারে না। অন্য দিকে ইতিহাসের চেতনায় এ দিবস একজন মুসলিমকে প্রতিবাদী করে তুলবে, আত্মচেতনায় বলীয়ান হয়ে তারিক বিন যিয়াদের সে বিজয়ের স্বপ্ন আঁকবে। প্রস্তুতি নেবে এক নতুন ভবিষ্যতের। তাছাড়া মিথ্যা ও প্রতারণার মাধ্যমে ইসলামে আনন্দ উদযাপনকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। হাদিসে মিথ্যা কথা বলা মুনাফিকের আলামত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়াকে জঘন্য ধরনের গুনাহ সাব্যস্ত করা হয়েছে। মিথ্যা অপবাদের জন্য ৮০ বেত্রাঘাতের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। রাসূল (সা) আনন্দ বিনোদনকে উৎসাহিত করেছেন। তবে তার জন্য তিনি মিথ্যা বলা বা প্রতারণাকে বৈধ করেননি। রাসূল (সা) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি মানুষ হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে তার জন্য ধ্বংস। তার জন্য ধ্বংস! তার জন্য ধ্বংস।” (তিরমিযী, তিনি হাদিসটিকে হাসান বলেছেন) তিনি আরো বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা বর্জন করে এমনকি কৌতুক করতেও মিথ্যা বলে না, তার জন্য জান্নাতের মধ্যখানে একটি বাড়ির জন্য আমি দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।” (আবু দাউদ, হাদিসটি হাসান) তাই একজন মুসলিমের জন্য কোনোভাবেই প্রতারণা ও মিথ্যার মাধ্যমে এপ্রিল ফুল পালন বৈধ নয়। বরং মুসলমানেরা আজ এপ্রিল ফুলকে সামনে রেখে নিজেদের পর্যালোচনা করতে পারে। কেন দীর্ঘ ৮০০ বছর স্পেন মুসলমানদের পদানত থাকার পরও তা হাতছাড়া হয়েছে। যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূতিকাগার হিসেবে মুসলমানরা স্পেনকে গড়ে তুলেছে সেখানে নিজেদেরকেই মসজিদে আগুনে পুড়ে মরতে হয়েছে। এ ইতিহাস থেকে মুসলমানদের শিক্ষা নিতে হবে আত্মরক্ষার-বিজয়ের প্রস্তুতির। আজ বিশ্বব্যাপী মুসলিমগণ নির্যাতিত নিপীড়িত। এর কারণ উদঘাটনে হাদিসে যা এসেছে তার মূল কথা হচ্ছে মুসলমানগণ পার্থিব জীবনের প্রতি আজ খুবই বেশি ঝুঁকে পড়েছে এবং শাহাদাতের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। রাসূল (সা) বলেছেন, এমন এক সময় আসবে যখন চতুর্দিক  থেকে জাতিসমূহ তোমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে যেরূপ খাবারের দস্তরখানের ওপর ক্ষুধার্ত ব্যক্তি ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমরা (সাহাবীগণ) বললাম, সেদিন কি আমরা সংখ্যায় কম থাকব? তিনি বললেন, না তোমরা অনেক থাকবে। তবে তোমরা স্রোতের ফেনার ন্যায় ভেসে যাবে আর তোমাদের শত্রুদের মনে তোমাদের ব্যাপারে কোনো ভয় থাকবে না। আর তোমাদের অন্তরে ওয়াহান সৃষ্টি হবে। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল  (সা) ওয়াহান কী? তিনি বললেন, পার্থিব জীবনের প্রতি ভালোবাসা এবং মৃত্যুর (শাহাদাত) প্রতি অনীহা। (মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ, আলবানী হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন। তাই এপ্রিল ফুলের উৎসবে মেতে না উঠে বরং আখিরাতের প্রতি অধিক আগ্রহী করে নিজেদের জীবন গড়ে তোলা এবং শাহাদাতের মৃত্যুর প্রস্তুতি নেয়াই হচ্ছে মুসলমানদের দায়িত্ব। আজ এপ্রিল ফুল মুসলমানদের মাঝে তাদের আত্মপর্যালোচনাকে জাগ্রত করবে, তারা নিজেদের উপলব্ধি করতে শিখবে এই আমার প্রত্যাশা। লেখক : সাবেক কেন্দ্রীয় আইনবিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির