post

পহেলা মে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকারের আন্দোলন

আতিকুর রহমান

১১ মে ২০২১

পহেলা মে পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের কাছে একদিকে যেমন খুবই তাৎপর্যময় তেমনি অনেক বেশি আবেগ ও প্রেরণার দিন। প্রায় দেড়শত বছর আগে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের ঐক্যবদ্ধ দুর্বার সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় বিজয়ের ধারা। সেই বিজয়ের ধারায় উদ্ভাসিত বর্তমান বিশ্বের সকল প্রান্তের প্রতিটি শ্রমজীবী মানুষ। কারণ এ দিনটির মাধ্যমে তারা কাজের প্রাথমিক স্বীকৃতি পেয়েছে। পহেলা মে একদিনের আন্দোলনের ফসল নয় বরং দীর্ঘ সময় ধরে দাবি আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামে কিছুটা প্রাপ্তি এবং স্বীকৃতি অর্জিত হয়েছে এই দিনে। তাই ঐতিহাসিক মে দিবস বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ শ্রমিকের মর্যাদা রক্ষার দিন। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন।

ক্রমাগত অবহেলা ও নিপীড়ন বর্তমান আধুনিক বিশ্বে যেখানে যতটুকু সুন্দর বিরাজমান তার পেছনে রয়েছে শ্রমজীবী মানুষের হাতের ছোঁয়া, রয়েছে হাড়ভাঙা পরিশ্রম। এ মানুষগুলোর সবচেয়ে বড় অধিকার বা দাবি হলো, তাদের শ্রমের যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভ এবং সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা। কিন্তু পৃথিবীর সমাজব্যবস্থা আজও এদের সঠিক মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়নি। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে দেশে দেশে শ্রমজীবী মানুষের কষ্টের সীমা ছিল না। মালিকরা নগণ্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে দরিদ্র মানুষের শ্রম কিনে নিতেন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাড়ভাঙা শ্রম দিয়েও শ্রমিকরা ন্যায্যমূল্য পেতেন না। মালিকরা উপযুক্ত মজুরি তো দিতেনই না, বরং সুবিধা-অসুবিধা ও দুঃখ-কষ্ট পর্যন্ত বুঝতে চাইতেন না। মালিকরা তাদের অধীনস্থ শ্রমিককে দাস-দাসীর মতো মনে করতেন এবং তাদের সাথে পশুর মতো ব্যবহার করতেন। সুযোগ পেলেই চালাতেন নানা শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন। বলতে গেলে শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকারও তখন রক্ষিত হতো না। শরীরের ঘাম আর সীমাহীন শ্রমের বিনিময়ে মালিক অর্জন করতেন সীমাহীন সম্পদ অথচ তার ছিটেফোঁটাও শ্রমিকের ভাগ্যে জুটত না। সপ্তাহে ৬ দিনের প্রতিদিনই গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টার অমানবিক পরিশ্রম করতো কিন্তু তার বিপরীতে মিলত নগণ্য মজুরি। যা দিয়ে সংসার চলত না, স্বজনের মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবার তুলে দেয়া সম্ভব হতো না। অনিরাপদ পরিবেশে রোগ-ব্যাধি, আঘাত, মৃত্যুই ছিল তাদের নির্মম সাথী। একদিকে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার ও দাবি দাওয়ার কথা মন খুলে মালিকদের কাছে বলতে পারতো না অপরদিকে তাদের পক্ষ হয়ে বলার মতও কেউ ছিল না। কাজের যেমন সুনির্দিষ্ট সময় ছিল না, তেমনি ছিল না সাপ্তাহিক ও অন্যান্য ছুটি। চাকরির স্থায়িত্ব ও মজুরিসহ সকল বিষয় ছিল মালিকের ইচ্ছাধীন বিষয়। চরম বিপদের দিনেও শ্রমিকরা ছুটি পেত না। দায়িত্বপালন কালে দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যু ঘটলে তার পরিবারকে কোন ক্ষতিপূরণ দেয়া হতো না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দিন-রাতে প্রায়ই ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতো তারা। শ্রমিকরা তাদের দাবি দাওয়ার কথা বললে মালিকরা তাদের ওপর ক্ষেপে যেতো, এমনকি মালিকদের ভাড়াটে মাস্তানরা তাদের ওপর জুলুম করতো। মালিকরা শ্রমিকদের কলুর বলদের মতো খাটাতো। তাদের ওপর অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দিতো। এতে শোষণ-নিপীড়ন ও বঞ্চনাই শ্রমিকের পাওনা হয়ে দাঁড়ায়। ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা নামক বিখ্যাত বইতে ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস শ্রমিক শ্রেণীর নিদারুণ দারিদ্র্যের চিত্র তুলে ধরে লিখেছেন যে, “প্রতিটি বৃহৎ শহরেই ছিল এক বা একাধিক বস্তি, যেখানে শ্রমিকরা ঠাসাঠাসি করে বাস করতো। এটা সত্যি যে, ধনীদের প্রাসাদের নিচে অন্ধকারের আনাচে-কানাচে প্রায়ই থাকে দরিদ্রের অবস্থান, কিন্তু দরিদ্রের জন্য নির্ধারিত করা হয়েছে এখানে একটা পৃথক অঞ্চল, যাতে করে ধনিক শ্রেণীর দৃষ্টি থেকে দূরে অবস্থান করে দরিদ্র মানুষ তার সাধ্যমত জীবন সংগ্রাম করে এগিয়ে যেতে পারে। পুঁজিবাদী শোষণের বর্বরতা প্রসঙ্গে ওই বইতে বলা হয়েছে যে, “শিল্প মালিকদের ঘৃণ্য অর্থ লালসা জন্ম দিল বহু সংখ্যক ব্যাধির। স্ত্রী লোকেরা সন্তান ধারণে অনুপযুক্ত হলো, শিশুদের অঙ্গ বিকৃতি ঘটলো, পুরুষরা দুর্বল হলো, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ভেঙেচুরে গেলো। একটা সমগ্র প্রজন্মই ব্যাধিতে এবং দৈহিক অক্ষমতায় সর্বনাশপ্রাপ্ত হলো এবং তার একমাত্র কারণ হলো বুর্জোয়াদের অর্থের ঝুলিটিকে ফাঁপিয়ে তোলা।” পুঁজিবাদী নির্যাতনের নৃশংসতা প্রসঙ্গে এই বইতে আরো বলা হয়েছে, “কিভাবে সর্দাররা নগ্ন শিশুগুলোকে তাদের শয্যা থেকে ধরে আনে এবং লাথি ঘুষি মারতে মারতে তাদের কারখানায় ঠেলে নিয়ে যায়। শিশুদের জামা কাপড়গুলো তাদের হাতেই থাকে আর কিভাবে ঘুষি মেরে তাদের ঘুম ছাড়িয়ে দেওয়া হয়, কিভাবে তা সত্ত্বেও শিশুগুলো কাজ করতে করতে আবার ঘুমিয়ে পড়ে এবং আবার কিভাবে সর্দারের ডাকে একটি অসহায় ঘুমন্ত শিশু ধড়মড় করে জেগে ওঠে। কিভাবে অতি ক্লান্ত শিশুগুলো শুকনো কারখানা ঘরে পশমের মধ্যে লুকিয়ে থেকে ঘুমিয়ে পড়ে এবং আবার কিভাবে চাবুক খেয়ে কারখানা থেকে বিতাড়িত হয়, কিভাবে শত শত শিশু রাতে এত ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে যে, নিদ্রালুতার জন্য এবং খিদে বিনষ্ট হওয়ায় রাতের খাবার খেতে পারে না।” একদিকে পুঁজিপতি শ্রেণীর সমৃদ্ধি, বিলাস ও চাকচিক্য এবং অন্যদিকে শ্রমিক শ্রেণীর নিদারুণ দারিদ্র্য ও তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতনের বাস্তবতায় শুরু থেকেই এই দুই শ্রেণীকে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। তাই একই সাথে জন্ম নেয়া এবং একই সাথে থাকতে বাধ্য হওয়া দুই শ্রেণীর মধ্যে লড়াই-সংগ্রাম জন্মালগ্ন থেকেই চলতে থাকে।

অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধতা ক্রমাগত অবহেলা এবং মালিকদের সীমাহীন অনাচার, অর্থলিপ্সা ও একপাক্ষিক নীতির ফলে শ্রমিকদের মনে ক্রমেই জমতে শুরু করে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও দ্রোহ। এ ধরনের শোষণ, নির্যাতন ও নিপীড়ন কিভাবে প্রতিরোধ করতে হবে শ্রমিকরা তা জানতো না। এই অমানবিক পশুসুলভ অবস্থা থেকে শ্রমিকরা মুক্তি পেতে চাইতো। কল-কারখানার কাজ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারবে বলে তারা ভাবতে পারতো না। মেশিনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হতো বলে দম ফেলার সময়টুকুও মিলতো না। ফলে শ্রমিক শ্রেণীর কাছে সেই সময়ে পুঁজিপতি শ্রেণী নয়, যন্ত্রদানবই ছিল প্রধান শত্রু। এর ফলে ১৭৬০ এর দশক থেকে শ্রমিকের রূপকথার রাজা হিসাবে ইতিহাসে উল্লিখিত এক শ্রমিক নেড লুড এর নেতৃত্বে শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেশিন ভাঙার, কারখানা বাড়িতে আগুন দেয়ার আন্দোলন শুরু করে। ‘নেড লুড’ এর নাম অনুসারে এ আন্দোলনের নাম হয়েছে লুডাইট আন্দোলন। কিছুদিনের মধ্যে এ আন্দোলন সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৩০ সাল পর্যন্ত এ আন্দোলন প্রাধান্য বিস্তার করে রাখে। লুডাইট আন্দোলন চলার সময়ে ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণী শুরু করেছিলো ধর্মঘট আন্দোলন। কিছুকালের মধ্যে ইউরোপের কিছু দেশ ও আমেরিকায় ধর্মঘট আন্দোলন শ্রমিক শ্রেণীর দাবি আদায়ের সবচেয়ে ব্যাপক ও কার্যকর হাতিয়ারে পরিণত হয়। এসব স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণী ক্রমেই সচেতন হয়ে উঠতে থাকে এবং সংগঠিত হওয়ার পথে অগ্রসর হয়। প্রথম দিকে শ্রমিকরা প্রাথমিক ধরনের ক্লাব বা ইউনিয়নে সংগঠিত হয়। শ্রমিকরা তাদের স্বল্প আয় থেকে সামান্য অর্থ বাঁচিয়ে ছোট ছোট সমবায় অর্থভাণ্ডার গড়ে তোলে। এসব ক্লাবের সদস্য হওয়ার জন্য চাঁদা এবং পরবর্তী সাপ্তাহিক বা মাসিক চাঁদা একটি বিশেষ বাক্সে জমা রাখা হতো। এ কারণে এ ধরসের ক্লাব ‘বক্স ক্লাব’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠে। এসব বক্স ক্লাবের অর্থভাণ্ডার থেকে অসুস্থ ও ছাঁটাই হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের প্রয়োজনে অর্থ সাহায্য দেয়া হতো। তারপর কোনো শ্রমিক বা তার পরিবারের অন্য কোনো সদস্য অসুস্থ বা মৃত্যু মুখে পতিত হলেও এ অর্থভাণ্ডার থেকে অর্থ দেওয়ার নিয়ম চালু হয়। ১৭৯০ সালের পর থেকেই পুঁজিপতি শ্রেণীর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনার জন্য শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৭৯৯-১৮০০ সালে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আইন পাস করে। তখন ইংল্যান্ডের শ্রমিকরা গোপন ও আধা গোপনে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার কাজ চালিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন এবং জনমতের চাপে ১৮২৪ সালে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। অধিকার আদায়ের ধারাবাহিক সংগ্রামের অংশ হিসেবে ১৮৩০ সনে শ্রমিকরা গঠন করে ‘ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দি প্রটেকশন অব লেবার’ (National Association for the protection of Labour)। এর তিন বছর পর গঠিত হয় Grand National Consolidated Trade Union নামে এক সংগঠন। এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ছিল ৫ লাখ।

ইউরোপের অন্যান্য দেশেও পুঁজিপতি শ্রেণী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন অঙ্কুরে বিনষ্ট করার জন্য নানা ধরনের নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। ফ্রান্সে শ্রমিকদের ধর্মঘট আন্দোলন শুরু হওয়ার সাথে সাথেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে থাকে। ১৭৯১ সালে নিষিদ্ধ করে এক আইন পাস করা হয়। ১৮৩০ থেকে ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সে এবং ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত জার্মানিতে নানা ধরনের আইন জারি করে প্রকৃতপক্ষে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন অকেজো করে রাখার চেষ্টা হয়। দমননীতি সত্ত্বেও অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক ইউরোপ ও আমেরিকায় ধর্মঘট আন্দোলনের ব্যাপ্তি ঘটে। কারখানা মালিকদের প্রতি চরম ঘৃণাই ছিল এই সংগ্রামের মূল প্রেরণা। ১৫ দিন সুশৃঙ্খল ও নির্ভীকভাবে শহর দখলে রাখার পর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে এই অভ্যুত্থান পরাজয় বরণ করে। কিছু দিনের মধ্যেই ১৮৩৪ সালের ৯ এপ্রিল আবার সংগ্রাম শুরু হয়। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ও সভা-সমাবেশ বেআইনি করার আইন পাসের চেষ্টা এবং শ্রমিক ধর্মঘটের সংগঠকদের অন্যায় বিচারের প্রতিবাদে এই সংগ্রাম প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক রূপ নেয়। ‘স্বাধীনতা, সমতা, সৌভ্রাতৃত্ব নতুবা মৃত্যু’ এই শ্লোগান সংবলিত প্রচারপত্র বিলি করে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের আহবান জানানো হয়। সরকারি বাহিনীর সশস্ত্র হামলা মোকাবিলা করার জন্য আন্দোলনকারী শ্রমিকরাও অস্ত্র সংগ্রহ করে এবং শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো দখল করে রাখে। লাল ব্যানারে স্লোগান লেখা হয়, ‘বুর্জোয়াদের হটাও, প্রজাতন্ত্র কায়েম নতুবা মৃত্যু।’ ৭ দিন বীরত্বপূর্ণ ও সাহসী লড়াই চালানোর পর শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র সেনাবাহিনীর কাছে লিয়নস শহরের সশস্ত্র অভ্যুত্থান দ্বিতীয় বারের মতো পরাজয় বরণ করে। লিয়নস শহরের সশস্ত্র অভ্যুত্থান খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। কিন্তু ইংরেজ শ্রমিকদের প্রথম স্বতন্ত্র রাজনৈতিক আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে চলে। এই আন্দোলন ‘চার্টিস্ট আন্দোলন’ বলে পরিচিত। এই আন্দোলন ১৮৩৬ সালে থেকে শুরু হয়ে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তবে অনেক দিন পর্যন্ত এই আন্দোলনের রেশ ছিল। চার্টিস্ট আন্দোলন রাজনৈতিক দাবিতে ব্যাপক গণআন্দোলনে রূপ নেয়। এই আন্দোলনকে সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর প্রথম গণআন্দোলন বলে উল্লেখ করা যেতে পারে।

১৮৩৬ সালে লন্ডনের দক্ষ কারিগররা ‘লন্ডন শ্রমজীবী মানুষের সমিতি’ নামে একটি রাজনৈতিক গ্রুপ গঠন করে। র‌্যাডিকেল চিন্তাধারার ব্যক্তিরা এই সমিতিটি প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৩৭-৩৮ সালে শ্রমিক শ্রেণীর মধ্য থেকে দুটি প্রাথমিক ধরনের রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম হয়। এই সংগঠন দুটো র‌্যাডিকেল বুর্জোয়াদের উত্থাপিত উপরোক্ত দাবিনামা নিয়ে আন্দোলনে নামে। ইংরেজিতে ‘দাবিনামা’ শব্দকে ‘চার্টার অব ডিমান্ড’ বলে। সেই থেকে এই আন্দোলন চার্টিস্ট আন্দোলন নামে পরিচিত। ১৮৪০ সালের জুলাই মাসে উপরোক্ত দাবিগুলোর ভিত্তিতে আন্দোলনকে অগ্রসর করে নেয়ার জন্য এক সভায় শ্রমিক শ্রেণীর প্রথম গণভিত্তি সম্পন্ন রাজনৈতিক সংগঠন ‘জাতীয় চার্টার সমিতি’ গঠিত হয়। ১৬৮৪ সালের দিকে নিউ ইয়র্কে সর্বপ্রথম ঠেলাওয়ালাদের ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। ১৭৬৩ সালে চার্লসটনে চিমনি পরিষ্কারক শ্রমিকরা একত্র হয়ে দাবি-দাওয়া না মানা পর্যন্ত কাজ করবে না বলে ঘোষণা দেয়। ১৭৭০ সালে নিউ ইয়র্কে পিপা প্রস্তুতকারক শ্রমিকদের ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। ১৭৭৮ সালে নিউ ইয়র্কের ছাপাখানার ঠিকা শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে একত্র হয়। ১৭৮৬ সালে ফিলাডেলফিয়ার ছাপাখানার ঠিকা শ্রমিকরা সর্বপ্রথম তীব্র ধর্মঘট আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায় এবং দাবি আদায় করতে সক্ষম হয়। ১৮২৩ সালে আমেরিকার ইতিহাসে সর্বপ্রথম মহিলা শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে সাধারণ ধর্মঘটে যোগ দেয়। এই মহিলা শ্রমিকরা ছিল নিউ ইয়র্কের দর্জি শ্রমিক। ১৮২৮ সালে সর্বপ্রথম শিল্প ও কারখানার শ্রমিকরা ধর্মঘট আন্দোলন শুরু করে। এই ধর্মঘট আন্দোলন ছিল পোশাক কারখানার শ্রমিকদের। ১৮৪২ সালে আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণীর ট্রেড ইউনিয়ন ও ধর্মঘট করার আইনগত স্বীকৃতি লাভ করে। ১৮৪৭ সাল থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে ১০ ঘণ্টা শ্রম দিবস আমেরিকার সকল রাজ্যে আইনগত স্বীকৃতি পায়। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের ঠিক পূর্ব মূহূর্তে ১৮৬১-৬২ সালে জাতীয় ভিত্তিতে কয়েকটি শ্রমিক ইউনিয়ন গঠিত হয়। এগুলোর মধ্যে ঢালাই শ্রমিক, মেশিন নির্মাতা শ্রমিক ও কর্মকারদের ইউনিয়নগুলোই ছিল প্রধান। গৃহযুদ্ধের সময়ে জাতীয় ভিত্তিতে গঠিত এই ইউনিয়নগুলোর বিলুপ্তি ঘটে। গৃহযুদ্ধ শুরুর আগে ১৮৬০ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নারী শ্রমিকরা একত্র হয়ে নারী শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করে। নারী শ্রমিকদের ওপর বাড়তি শোষণ ও নির্যাতনের ফলেই তারা স্বতন্ত্রভাবে আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়। পরবর্তীকালে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ৮ মার্চ দিনটিই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্বীকৃতি লাভ করে। গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক পরেই কয়েকটি স্থানীয় শ্রমিক সংগঠন জাতীয় পর্যায়ে মিলিত হয়ে একটি ফেডারেশন গড়ে তোলার আগ্রহ প্রকাশ করে। ১৮৬৬ সালের ২২ আগস্ট ৬০টি ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের ৬০ হাজার সংগঠিত শ্রমিক প্রতিনিধিকে নিয়ে বালটিমোর শহরে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ‘ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন’ নামে একটি ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। লোহা ঢালাই শ্রমিকদের তরুণ নেতা উইলিয়াম এইচ, সিলভিস জাতীয় ভিত্তিতে এই সংগঠনটি গড়ে তোলার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি এ সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বে ‘ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন’ সংগঠনই সর্বপ্রথম আমেরিকাতে ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবি উত্থাপন এবং দাবির সমর্থনে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তাব ও উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৮৭০ এর দশকে আমেরিকার শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে কয়েকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। ১৮৭৪ সালে নিউ ইয়র্কের টমকিন স্কয়ারে এক শ্রমিক জনসভায় পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। ১৮৭৫ সালে পেনসিলভানিয়া অঞ্চলের কয়লা খনি মালিকরা খনি অঞ্চল থেকে জোর করে খনি শ্রমিকদের সংগঠন উচ্ছেদ করার চেষ্টা করে। এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে শ্রমিকরা রুখে দাঁড়ায়। আন্দোলনকারী ১০ জন খনি শ্রমিককে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হয়। এ ঘটনার পটভূমিতে ১৮৭৭ সালে রেল ও ইস্পাত কর্পোরেশনের লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের ধর্মঘট সংগ্রাম সংঘটিত হয়। কর্তৃপক্ষ ধর্মঘট আন্দোলনের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী নামায়। ধর্মঘটী শ্রমিকরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াই চালায়। এই সংগ্রাম প্রচণ্ড দমননীতি ও আক্রমণের মুখে পরাজয় বরণ করে। কিন্তু এসব সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবির আন্দোলন এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার’ নামে একটি সংগঠন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ১৮৮৪ সালের ৭ অক্টোবর ওই সংগঠনের চতুর্থ সম্মেলনে ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবিতে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয়, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় সংগঠিত ট্রেড ও লেবার ইউনিয়নের ফেডারেশন এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছে যে, ১৮৮৬ সালের ১ মে তারিখ থেকে দৈনিক ৮ ঘণ্টাকেই কাজের দিন বলে আইনত গণ্য করা হবে। এই সাথে আমরা সকল শ্রমিক সংগঠনের কাছে সুপারিশ করছি যে, তারা যেন উপরোক্ত তারিখের মধ্যে এই সিদ্ধান্তের সাথে খাপ খাইয়ে নিজ নিজ এলাকায় আন্দোলন পরিচালনা করে।’ প্রস্তাবটি গ্রহণ করার পর ফেডারেশন বুঝতে পারলো যে, সকল শ্রমিক ঐক্যবদ্ধ করা ছাড়া লড়াইয়ে জয়লাভ করা সম্ভব নয়। তাই তারা অপর একটি সংগঠন ‘নাইটস অব লেবার’কে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানান। নাইটস অব লেবার সংগঠনটি আমেরিকার ফেডারেশন অব লেবারের চাইতে অনেক বড় সংগঠন ছিল। পরবর্তী সময়ে এ সংগঠনটি ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবিতে ধর্মঘট আন্দোলনের বিরোধিতা করে। ফলে শ্রমিকদের কাছ থেকে এই সংগঠনটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণী যখন জাতীয় ভিত্তিতে একটি মাত্র স্লোগান সংগঠিত হচ্ছে; তখন আমেরিকার নানা অঞ্চলে, কল-কারখানায় ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিসহ অন্যান্য দাবিতে ধর্মঘট আন্দোলন ব্যাপক ও তীব্র আকার ধারণ করে। ১৮৮১ থেকে ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ৫০০ ধর্মঘট ও তালাবদ্ধ আন্দোলন হয়। এগুলোতে গড়ে দেড় লাখ শ্রমিক যোগ দেয়। এসব ধর্মঘটের মূল স্লোগান ছিল ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবস। ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম, ৮ ঘণ্টা বিনোদন-এভাবে ২৪ ঘণ্টাকে সমানভাবে ভাগ করে নেয়া হয়। ক্রমেই এই যুক্তিসঙ্গত ও মানবিক দাবি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কোনো কোনো কারখানার শ্রমিকরা নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি আদায় করে নিতে সক্ষম হয়। যেসব জুতা কারখানায় ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি আদায় হয়ে গেছে, শ্রমিকরা সেসব জুতার নাম দিল ‘৮ ঘণ্টা জুতা’। সিগারেট কারখানায় দাবি মেনে নিলে তার নাম হলো ‘৮ ঘণ্টা চুরুট’ ইত্যাদি। এভাবে সর্বত্র ‘৮ ঘণ্টার উন্মাদনা’ সারা আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে।

বাংলাদেশে শ্রমিকদের অবস্থা বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং আইএলও কর্তৃক প্রণীত নীতিমালার স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। এই দেশে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা অনেক। শ্রমিক দিবসের প্রেরণা থেকে বাংলাদেশ মোটেও পিছিয়ে নেই। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শাসন থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে মে দিবস পালিত হয়। ঐ বছর সদ্য স্বাধীন দেশে পয়লা মে সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়। তারপর থেকে আজও পয়লা মে সরকারি ছুটির দিন বহাল আছে। এদিন শ্রমিকরা মহা উৎসাহ ও উদ্দীপনায় পালন করেন মে দিবস। তারা তাদের পূর্বসূরিদের স্মরণে আয়োজন করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। শ্রমিক সংগঠনগুলো মে দিবসে আয়োজন করে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ও কল্যাণমুখী কর্মসূচির। শ্রমিকরা এদিন তাদের নিয়মিত কাজ থেকে সাময়িক অব্যাহতি পেয়ে থাকে। আনন্দঘন পরিবেশে তারা উদযাপন করেন মহান মে দিবস। রাষ্ট্রের সরকারি দল ও বিরোধী দলসহ অন্যান্য বিভিন্ন সংগঠনও দিনটি পালন করে থাকে। এদিন দেশের সকল প্রচারমাধ্যম ও পত্রপত্রিকায় শ্রমিকদের পক্ষে সভা-সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের খবর ফলাও করে প্রচার করা হয়। এইতো মাত্র ৮ বছর পূর্বে ২০১৩ সনের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সাভারে রানা প্লাজায় শ্রমিকদের উপর স্মরণকালের ভয়াবহ ভবন ধসে প্রায় বার শতাধিক নিরীহ শ্রমিকের করুণ মৃত্যু পুরো জাতিকে শোকাহত করে। ঘটনার আট বছর পূর্ণ হলেও রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে নিখোঁজ ১০৫ জন শ্রমিকের সন্ধান আজও মিলেনি, এমনকি অনেকের কপালে ক্ষতিপূরণের অর্থও জোটেনি। এর পূর্বে ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের গার্মেন্টস কারখানায় আগুন লেগে ১১১ জন শ্রমিক পুড়ে মারা যায়। এর আগে ২০১০ সালে হামিম গার্মেন্টসসহ তিনটি গার্মেন্টসে অনেক শ্রমিকের প্রাণ চলে যায়। এসবের অধিকাংশ ঘটনা ঘটেছে শুধুমাত্র মালিক শ্রেণীর গাফিলতির কারণে। এভাবে প্রায় প্রতি বছর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোয় বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এসব দুর্ঘটনায় অনেক নারী-পুরুষ-শিশু মারা যায়। দুর্ঘটনায় যেসব শ্রমিক মারা যায়, তাদের পরিবারের রুটি-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যায়। তারা চোখেমুখে অন্ধকার দেখে। আর মালিক শ্রেণীরা এ থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। আজকের এই দ্রব্যমূল্যের বাজারে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য বেতন পাচ্ছে না। যেখানে শ্রমিক আন্দোলন হয়েছিল ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের জন্য। যেখানে বাংলাদেশের গার্মেন্টসগুলোতে এখনও ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ১২ ঘণ্টা কাজ করানো হচ্ছে। বিনিময়ে বেতন দেয়া হচ্ছে নাম মাত্র। যা দিয়ে একজন মানুষ চলাফেরা করা কষ্টকর। আজকে শ্রমিকদের কোন নিরাপত্তা নেই। মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে তারা পেটের দায়ে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বেতন বকেয়া রেখে উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে চায়। এ নিয়ে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় দ্বন্দ্ব দেখা যায়। আমাদের দেশে শ্রমিকদের একটি বড় অংশ নারী ও শিশু। এসব নারী ও শিশু বিভিন্ন কল-কারখানা, বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পে বেশি কাজ করে থাকে। অথচ আমাদের সংবিধানে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ। শিক্ষাসহ বিভিন্ন সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা হচ্ছে বঞ্চিত। এসব শিশু স্নেহ-ভালোবাসার অভাবে এক সময় অপরাধ জগতে পা বাড়ায়। আসলে আমরা শ্রম বা শ্রমিকের মর্যাদা বুঝেও বুঝতে চাই না। একজন মানুষের জীবনধারণের জন্য যা যা প্রয়োজন, অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এসবই একজন শ্রমিকের প্রাপ্য। আর এটাই হচ্ছে শ্রমিকের প্রকৃত মর্যাদা। একুশ শতকে এসে শ্রমিকরা এর কতটুকু মর্যাদা বা অধিকার ভোগ করছে? বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। কারণ শ্রমিকরা এ দেশের সম্পদ। তাদের কারণেই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। তাদের অবহেলার চোখে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তাদের কাজের ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মহান মে দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে আমরা শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকারের কথা বলি কিন্তু বাস্তবে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে শাসক, প্রশাসক ও মালিক গোষ্ঠী আদৌ আন্তরিক হতে পারিনি। যদিও সময়ের ব্যবধানে শ্রমজীবী মানুষের যান্ত্রিক বিপ্লবের কারণে কাজের পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু পরিবর্তন আসেনি শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে। তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার অদ্যাবধি পর্যন্ত অধরাই থেকে গেল। বাংলাদেশে কাজের ক্ষেত্রে পোশাক শ্রমিকের পর নির্মাণ শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যাদের রক্ত ও ঘাম মিশে আছে তারাও তাদের শ্রমের ন্যায্য পাওনা অনেক সময় পায়না। শ্রম দিয়ে যারা শ্রমের মূল্য পায় না তারাই জানে জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার লড়াই কত কষ্টের? শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিকের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং দেশের শ্রম আইনে সংবিধান অনুসারে শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষিত আছে। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার যেন কিতাবে আছে গোয়ালে নেই! বরাবরই এই দেশের দিনমজুর শ্রেণীর মেহনতি মানুষ বঞ্চিত ও শোষিত। বাংলাদেশের গৃহ কর্মীরাও কর্মক্ষেত্রে নানাবিধ নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। গৃহকর্মীর গায়ে গরম ইস্ত্রির সেকা দিয়ে পিট ঝলসিয়ে দেয়া এবং নানাবিধ নির্যাতনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। শুধু তাই নয় গৃহ কর্মীদের ওপর বর্বর নির্যাতনের পাশাপাশি খুন ধর্ষণও করা হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ কৃষিকাজ ও কৃষিপণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে জীবন-জীবিকা পরিচালনা করলেও কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী, কালোবাজারি ও সিন্ডিকেটের কারণে কৃষকরা কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে অহরহ বঞ্চিত হচ্ছে। এমনিভাবে পরিবহন সেক্টরে কর্মরত প্রায় ৫০ লক্ষাধিক শ্রমিক প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জনসাধারণের সেবা প্রদান করলেও তাদের মজুরি নির্ধারণে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নীতিমালা আজও প্রণয়ন করা হয়নি। লাখ লাখ রিকশা শ্রমিক প্রতিনিয়ত তাদের জীবন পরিচালনায় মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে। এ শ্রেণীর শ্রমিকদের জীবন মান উন্নয়নে রেশনিং, চিকিৎসাসেবা ও সন্তানদের শিক্ষা অধিকার আজও নিশ্চিত হয়নি। আমরা শ্রমিক অধিকার নিয়ে কথা বলি তার তুলনায় বাস্তবে শ্রমিকের অধিকার ও অর্জন অনেক সীমিত।

মে দিবসের মূল্যায়ন শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে শ্রমিকরা তাদের কিছু অধিকার অর্জন করলেও সকল দিক থেকে শ্রমিকরা তাদের অধিকার পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি। মে দিবস ঘটা করে পালন হলেও শ্রমিকরা আজও অবহেলা ও অবজ্ঞার স্বীকার। আজও তারা তাদের কাক্সিক্ষত মজুরি নিশ্চিত করতে পারেনি। কর্মক্ষেত্রে ৮ ঘণ্টা শ্রমের নিয়ম হয়তো বা প্রতিষ্ঠা হয়েছে, কিন্তু থামেনি শ্রমিক নিপীড়ন এবং প্রতিষ্ঠিত হয়নি শ্রমিকের প্রকৃত মর্যাদা ও শ্রমের মূল্য। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অহরহ শ্রমিক বিক্ষোভ থেকে আমরা সহজেই এটা অনুধাবন করতে পারি। বেতন বৃদ্ধি কিংবা বকেয়া বেতন আদায়ের নিমিত্তে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের অধিকাংশ গার্মেন্টে নৈরাজ্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। গার্মেন্টস শ্রমিকরা দাবি আদায়ে বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ করে যাচ্ছে। মালিক পক্ষ হর-হামেশাই শ্রমিকদেরকে ঠকিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলন ঠেকানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে শ্রমিক নেতা-নেত্রীদেরকে গ্রেফতার করানো হচ্ছে। গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা আমিনুলকে দীর্ঘদিন গুম করে রেখে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কাজেই এটি দৃঢ়তার সাথে বলা যায় আজও দুনিয়ার কোথাও শ্রমিক-মালিক সু-সম্পর্ক, শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি এবং তাদের বাঁচার উন্নত পরিবেশ কাক্সিক্ষত মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক সংগঠন হিসেবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে শ্রমিকদের অধিকারসমূহ স্বীকৃতি লাভ করে। আইএলও শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ পর্যন্ত ১৮৩টি কনভেনশন প্রণয়ন করে। এর মধ্যে ৮টি কোর কনভেনশনসহ ৩৩টি কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে বাংলাদেশ। তা ছাড়া দেশে বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী সরকার শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতকরণে দায়বদ্ধ। কিন্তু আমাদের শ্রমিকরা কতটুকু অধিকার পাচ্ছে, শ্রমিকদের কতটুকু কল্যাণ সাধিত হয়েছে আজ এই সময়ে তা কঠিন এক প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ লেবার ফোর্সের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশের মোট শ্রমিকসংখ্যা প্রায় ৫ কোটি। এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশ মহিলা শ্রমিক। মে দিবস যায়, মে দিবস আসে। কিন্তু শ্রমিকদের ভাগ্য যেন আর খোলে না।

শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামী শ্রমনীতির অনিবার্যতা আধুনিক বিশ্বের পুঁজিবাদী ও সমাজবাদী রাষ্ট্র দর্শনের কোনটাই শ্রমিকের প্রকৃত অধিকার ও মর্যাদার ন্যূনতম সমাধান দিতে পারেনি। তারা মুখে শ্রমিক অধিকারের কথা বললেও বাস্তবে শ্রমিকদেরকে পুঁজি করে রাজনীতি করাসহ অগাধ অর্থ বৈভবের মালিক হয়েছে। ফলে এখনও শ্রমিক-মজুররা নিষ্পেষিত হচ্ছে। মালিকের অসদাচরণ, কম শ্রমমূল্য প্রদান, অনপযুক্ত কর্ম পরিবেশ প্রদানসহ নানা বৈষম্য শ্রমিকের দুর্দশা ও মানবেতর জীবনযাপনের কারণ হয়ে আছে। যে অধিকারের জন্য শ্রমিকরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন শিকাগোর রাজপথে, তা বাস্তবে এখনও অর্জিত হয়নি। আজও শ্রমিকেরা পায়নি তাদের কাজের উন্নত পরিবেশ, পায়নি ভালোভাবে বেঁচে থাকার মতো মজুরি কাঠামো এবং স্বাভাবিক ও কাক্সিক্ষত জীবনের নিশ্চয়তা। মূলত ইসলামী শ্রমনীতি চালু এবং সৎ ও ন্যায়বান লোকদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা আসলে তারাই শ্রমিকের অধিকার আদায় ও রক্ষার ক্ষেত্রে সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারবে। তা ছাড়া কোনোভাবেই শ্রমিকসমাজের প্রকৃত অধিকার ও মর্যাদা আদায় সম্ভব হবে না। ইসলামী শ্রমনীতি প্রতিষ্ঠা হলে ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে দেশের শ্রমনীতিকে ঢেলে সাজিয়ে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। মানুষের মত বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী মজুরি নির্ধারণ করা হবে। একজন মালিকের নিজের স্বজনরা যে রকম জীবনযাপন করবে তার অধীনস্থ শ্রমিকরাও সে রকম জীবনের নিশ্চয়তা পাবে। কাজেই শ্রমিক সমাজসহ দেশের সচেতন জনগোষ্ঠীকে ইসলামী শ্রমনীতি চালু ও বাস্তবায়নের নিমিত্তে সৎ ও ন্যায়বান লোকদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা আনয়নে প্রচেষ্টা চালানো জরুরি।

মে দিবসে আমাদের প্রত্যয় মহান মে দিবসকে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রকৃত অর্থে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে শ্রমজীবী মানুষসহ সকল দায়িত্ববান নাগরিকদেরকে শ্রমিকদের জীবন মানোন্নয়নে নি¤েœাক্ত দাবিসমূহ বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দাবি আদায়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। ১. ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে দেশের শ্রমনীতিকে ঢেলে সাজানো। ২. শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে মুনাফায় শ্রমিকদের অংশ প্রদান করা। ৩. সকল বন্ধ কল-কারখানা চালু করা। ৪. শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়া বেতন মজুরি অবিলম্বে পরিশোধ করা। ৫. জাতীয় ন্যূনতম মজুরি কাঠামো নির্ধারণ ও অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা। ৬. গার্মেন্টস শ্রমিকদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার উপযোগী মজুরি নির্ধারণ করা। ৭. শ্রমিকদের ন্যায়বিচার ত্বরান্বিত করার স্বার্থে শ্রমঘন এলাকায় শ্রম আদালত প্রতিষ্ঠা করা। ৮. শ্রমজীবী মানুষের জন্য বাসস্থান, রেশনিং, চিকিৎসা ও তাদের সন্তানদের বিনামূল্যে শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা। ৯. কল-কারখানায় ঝুঁকিমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা। ১০. আহত ও নিহত শ্রমিকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা। ১১. শ্রমিকদের পেশাগত ও নৈতিক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা। ১২. নারী ও পুরুষের বেতন-ভাতার সমতা বিধান করা। ১৩. কল-কারখানায় নারী শ্রমিকদের জন্য প্রসূতিকালীন ছুটি ও ভাতা প্রদান নিশ্চিত করা। ১৪. নারী শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য শিশু যত্নাগার স্থাপন করা। ১৫. শিশু শ্রম বন্ধ করা। ১৬. সকল পেশায় অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নিশ্চিত করা এবং সকল পেশার শ্রমিকদের শ্রম আইনের সুবিধা প্রদান নিশ্চিত করা। ১৭. শ্রমিকের প্রতি মালিকের সহনশীল মনোভাব পোষণে কর্তৃপক্ষকে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া। ১৮. শ্রমিকদের মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখে তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার আলোকে কাজ দেয়া। ১৯. সঠিক সময়ে শ্রমিকের মজুরি পরিশোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ২০. ইসলামী শ্রমনীতি বাস্তবায়নের আন্দোলনে শ্রমজীবী মানুষসহ সকলকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করা।

পরিশেষে বলবো যে, আসুন আমরা সবাই মিলে শ্রমজীবী মানুষের সত্যিকার মুক্তি অর্জনে যার যার অবস্থান থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করি। নির্যাতিত-নিপীড়িত ও অধিকারবঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করি এবং শ্রমজীবী মানুষের পরকালীন মুক্তি অর্জনে তাদেরকে ইসলামী আদর্শের পতাকাতলে শামিল করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করি। ইসলামী শ্রমনীতি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে আন্দোলনকে শক্তিশালী করি। মহান আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন। আমিন। লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির