post

পাকিস্তান : মেমোগেট নিয়ে সরকারের সঙ্কট

১১ ফেব্রুয়ারি ২০১২
মীযানুল করীম পাকিস্তান অভাবনীয় রাজনৈতিক সঙ্কটের মুখে পড়েছে। মেমোগেট কেলেঙ্কারির জের ধরে সেনাবাহিনীই নয় শুধু, বিচার বিভাগের সাথেও সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঘটনাপ্রবাহ ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা-অনিশ্চয়তার মাঝে সুপ্রিম কোর্টের পদক্ষেপ এবং পার্লামেন্টে আস্থাভোট পর্যন্ত গড়ায়। ১৬ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট প্রাধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির বিরুদ্ধে জারি করেছে আদালত অবমাননার নোটিশ। বলেছে ১৯ জানুয়ারি তারিখে আদালতে হাজির হয়ে তাকে জবাব দিতে হবে। বিগত প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের প্রত্যাহার করা দুর্নীতির মামলাগুলো আবার চালু নির্দেশ না মানায় উপরিউক্ত নোটিশ দেয়া হয়। অ্যাটর্নি জেনারেল জানান, সুইস আদালতে এসব মামলা চালু করার ব্যাপারে সরকার আজ পর্যন্ত কিছু জানায়নি। সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, এ বিষয়ে ১৬ জানুয়ারির মধ্যে ব্যবস্থা নিতে। তা করা হয়নি। প্রেসিডেন্ট জারদারিও দুর্নীতি মামলার আসামি। তবে বর্তমান সরকার মনে কবে, ‘রাষ্ট্রপ্রধান রূপে তিনি সংবিধানিক সুরক্ষা ভোগ করছেন।’ অবশ্য জনগণ তাকে মহাদুর্নীতিবাজ মনে করে। মেমোগেট নামটা এসেছে ওয়াটারগেট অনুসরণে। ১৯৭৪ সালে ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিকসনের পতনের কারণ হয়েছিল। এবার একটা মেমো বা মেমোরেন্ডাম (দরখাস্ত বা আবেদনমূলক চিঠি)Ñ এর কারণে পাকিস্তানে সরকারের গদি কেঁপে উঠেছে। ঘটনা হলো, বিন লাদেন হত্যা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে মার্কিন বশংবদ পাক সরকারের বিরুদ্ধে জনমনে ক্ষোভ তীব্র হয়ে ওঠে। এ সুযোগে সেনা-অভ্যুত্থান ঘটার শঙ্কায় প্রেসিডেন্ট জারদারি আমেরিকার সাহায্য চেয়েছিলেন বলে মনসুর ইজাজ নামের ব্যবসায়ী জানিয়েছেন। মার্কিন প্রবাসী এই ব্যক্তি সম্প্রতি পত্রিকায় লিখে তথ্যটি ফাঁস করার পর তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ইজাজের দাবি, জারদারি সেনাপ্রধান জেনারেল কায়ানি ও আইএসআই প্রধান জেনারেল পাশার অপসারণে মার্কিন সহায়তা কামনা করে চিঠি দিয়েছিলেন ওয়াশিংটনকে। পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত হোসেন হাক্কানি এটি মনসুর ইজাজকে দেন যথাস্থানে পৌঁছাতে। তিনি কাজটি করে দিয়েছিলেন। প্রাপক মার্কিন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের তৎকালীন  চেয়ারম্যান জেনারেল মাইকমুলেন। তিনি প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইলেও পরে স্বীকার করেন যে, এ চিঠি পেয়েছিলেন। তবে চিঠিতে প্রাপ্তিস্বীকার করে কোনো স্বাক্ষর দেয়া হয়নি। এই মেমো বা চিঠির বিষয় ফাঁস হওয়ার পর পাক সেনাবাহিনী সঙ্গতকারণেই অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। সুপ্রিম কোর্ট মেমোগেট প্রসঙ্গে তদন্তের জন্য কমিশন গঠন করেছে। এই কমিশনের কাছে লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ প্রধান সেনাপতি জে. আশফাক পারভেজ কায়ানি এবং আইএসআই প্রধান লে. জে. আহমদ সুজা পাশা। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না নিয়ে এটা করায় প্রধানমন্ত্রী গিলানি বললেন, তাদের এই কাজটি সংবিধানপরিপন্থী ও অবৈধ। জবাবে সেনাপ্রধান বক্তব্য প্রত্যাহার বা ব্যাখ্যা করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রীকে। ১৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার জবাবদিহিতা পার্লামেন্টের কাছে, কোনো ব্যক্তির কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নই।’ তার সরকার এ দিন আস্থাভোট পেয়ে পার্লামেন্টে শক্তির প্রমাণ রাখতে চেয়েছে। তবে মেমোগেট এবং দুর্নীতি মামলার ইস্যুর পরিপ্রেক্ষিতে এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। স্মর্তব্য প্রেসিডেন্ট জারদারি ২০১০ সালের জানুয়ারিতে এক বিরাট সঙ্কটে পড়েছিলেন তাঁর দলের নেতৃবৃন্দসমেত। ঠিক দুই বছর পর এখন ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি আরেক রাজনৈতিক মহাবিপদের সম্মুখীন। তখন সুপ্রিম কোর্ট যুগান্তকারী রায়ে বিগত স্বৈরশাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফের এনআরও অর্থাৎ ‘জাতীয় সমঝোতা’ অধ্যাদেশকে সংবিধানপরিপন্থী ও অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন। ফলে ২০১০-এর সূচনালগ্নে জারদারিসহ পিপিপির নেতাদের বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার ফৌজদারি মামলা (দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের) পুনরুজ্জীবিত হয়। এর দুই বছরের মাথায় আবার মহামুসিবতে পড়েছে জারদারি-গিলানির নেতৃত্বাধীন পিপিপি সরকার। মার্চ মাসেই পাক পার্লামেন্টের উচ্চপরিষদ, তথা সিনেট নির্বাচন। এতে জয়ী হলে গরিষ্ঠতার জোরে পিপলস পার্টি আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভেটোর বলে কর্তৃত্ব করার আশা রাখে। তার প্রাক্কালে সরকার পতনের জন্য মেমোগেট উসিলায় সেনাষড়যন্ত্রের সন্দেহ পিপিপির। এক দিকে ক্রমহ্রাসমান জনপ্রিয়তা, অন্য দিকে অভ্যুত্থানের ভীতিÑ দুটো মিলে ক্ষমতাসীনদের দিশেহারা করে তুলেছে। আর বিচার বিভাগের সাহসী নিরপেক্ষতা জারদারিদের জন্য বিপদের সাথে আপদ যোগ করেছে। আপাতত মনে হয়, প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীর সাথে সশস্ত্রবাহিনী ক্ষমতার মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ জাতীয় রঙ্গমঞ্চে। গিলানি গালি দিলেন, সেনাবাহিনী ও আইএসআইর দুই প্রধান অনুমতি ছাড়া বক্তব্য দিয়ে অন্যায় করেছে। জবাবে সামরিক বাহিনী হুঁশিয়ার করে দিয়েছে ‘প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে জটিলতা দেখা দেবে এবং এর পরিণিতি শুভ হবে না।’ তবে অভ্যুত্থান দূরের কথা, সেনাবাহিনী বর্তমান সরকারের প্রতি অনুগত থাকবে বলে ‘দি ট্রিবিউন’ পত্রিকায় মন্তব্য করেছেন ভাষ্যকার ইরফান হোসাইন। তাঁর ভাষায়, বাইরে থেকে মনে হতে পারেÑ জারদারির অধীনে থেকে জেনারেলরা বিরক্ত। কিন্তু এর চেয়ে ভালো বিকল্প নেই। ক্ষমতাচ্যুতির প্রতিশোধে অধীর নওয়াজ শরিফের চেয়ে কমজোর জারদারিকেই তারা রাখতে চাইবেন। অবশ্য মঞ্চে ইমরান খানের আবির্ভাবে তাদের জন্য খুলে গেছে তৃতীয় একটি পথ। নিজেদের গণতন্ত্রী, প্রগতিশীল ও সেক্যুলার দেখাতে চান, এমন সাংবাদিক, কলামিস্ট ও অন্য বুদ্ধিজীবীরা পাক সেনাবাহিনীকে ক্ষমতালোলুপ ও গণতন্ত্র হত্যাকারী হিসেবে দেখাতে সব সময়ই তৎপর। তবে তাদের মনোভাব এমন যে, সেনাবাহিনী আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের অংশীদার না হলে সেটা হতো ভুল, আবার এখন সে যুদ্ধে শামিল হয়েও ঠিক কাজ করেনি। অর্থাৎ সামরিক বাহিনীর অযৌক্তিক বিরোধিতা করাকেও এই মহলটি মিশন হিসেবে নিয়েছে। অথচ তারা নির্বাচিত সরকার হওয়ার যুক্তি তুলে ধরে পিপিপির মতো দুর্নীতিবাজ ও ক্ষমতাপাগল দলের অপকর্ম আড়ালে থাকার সুযোগ দেন। পাশ্চাত্যপন্থী এবং ধর্মের প্রতি নিস্পৃহ রাজনীতিকরা তাদের চোখে উদার ও আধুনিক। মার্কিন ঊর্ধ্বতনমহল অতীতের মতো সেনানায়ককে আর সমর্থন দেবে না এবং কিন্তু বাধ্যগত জারদারি-গিলানি জুটিকে টিকিয়ে রাখতে চায়। এর প্রতিফলন ফরেন পলিসি ইন ফোকাস পত্রিকায় মার্কিন বিশ্লেষক ক্রিস্টিন ফেয়ারের অভিমত। তিনি হাক্কানিকে দায়মুক্তি দিয়ে বলেছেন, মেমোগেট হলো সেনাবাহিনী ও কোর গোয়েন্দাদের সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র। টার্গেট ছিল, এই অজুহাতে উচ্চ আদালতকে দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো। অর্থাৎ গণতন্ত্রের দরদি সেজে সশস্ত্র বাহিনীর সাথে বিচার বিভাগকেও সতর্ক করা হচ্ছে। একই মহলের জনৈক ভাষ্যকার লিখেছেন, পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের হাতে দোনালা বন্দুকÑ এক নলে এনআরও বাতিলের রায়, আরেক নলে মেমোগেট। এনআরও অধ্যাদেশবলে স্বৈরশাসক জেনারেল মোশাররফ পিপিপির জারদারিসহ নেতাকর্মীদের সাড়ে ৮ হাজার ফৌজদারি মামলা তুলে নিয়েছিলেন। অথচ এখন বলা হচ্ছে, সুপ্রিমকোর্ট নাকি কুড়াল মারতে চায় সেনাবাহিনীর অনুকূলে! ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সাবেক কূটনীতিক কুলদীপ নায়ারের একটি লেখা ১৪ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পাকিস্তানে সেনাশাসন, এমনকি প্রশাসনে বা সরকারে সশস্ত্রবাহিনীর প্রভাবেরও বিরোধী। তা সত্ত্বেও মেমোগেট পরিস্থিতিতে সেনাবিরোধী প্রচারণার পালে হাওয়া দেননি এবং জারদারিদের মতো বিতর্কিত রাজনীতিকদের পক্ষে সাফাই গাননি। কুলদীপ স্পষ্টভাবে বলেছেন, The argument that the Supreme Court surrendered to the army when it constituted the inquiry commission is churlish. অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট তদন্ত কমিশন গঠন করে সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, এই বক্তব্য রূঢ়তা এবং বদমেজাজের বহিঃপ্রকাশ। তিনি এরপরই লিখেছেন, প্রধান বিচারপতি ইফতিখার চৌধুরীকে সরিয়ে দিলে তা হবে অর্থহীন। তিনিই সে ব্যক্তি, যিনি সেনাবহিনীর হাতে দুর্ভোগের শিকার হয়েছিলেন জেনারেল মোশাররফের আমলে। পরিবারসহ তাঁকে একটি রুমে আটকে রাখা হয়েছিল। তাদের সব উপায়ে করা হয়েছিল হয়রানি। তবুও তিনি নতিস্বীকার করেননি। তাঁর সততা নিয়ে সন্দেহের যুক্তি বা ভিত্তি কোনটিই নেই। মি. টেন পার্সেন্ট হিসেবে খ্যাত দুর্নীতির মহারাজা জারদারির নেতৃত্বাধীন সরকার স্বৈরাচারী মোশাররফের কায়দায় প্রধান বিচারপতির চরিত্রহনন বা অপসারণের সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটেই এই মন্তব্য। কুলদীপ বলেছেন, ঘটনার গোড়া থেকে সত্যটা তুলে আনার জন্য সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারকদের নিয়ে কমিশন গঠনই ছিল একমাত্র পথ। পাকিস্তানে আর কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যা নির্ভরযোগ্য। কিন্তু এখনো সুপ্রিমকোর্টের ওপর মানুষের আস্থা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলকে অন্যান্য দেশের প্রেক্ষাপটে দেখলে হবে না। সামরিক অভ্যুত্থান এবং নির্বাচিত সরকার উৎখাত অবাঞ্ছিত, অবৈধ, নিন্দনীয় ও অগণতান্ত্রিক। তবে পাকিস্তানের মতো দেশে এর বিশেষ প্রেক্ষাপট, বৈশিষ্ট্য ও আনুকূল্য রয়েছে। যেমন যে কাঠামোর সেনাবাহিনীকে সমাজে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু বানিয়েছে, সে ব্যাপারে কোনো রাজনীতিক প্রশ্ন তুলতে পারেননি বা তোলেননি। আবার এটাও অনস্বীকার্য, পাকিস্তানে জনগণ বনসাই গণতন্ত্রের সময়টিতে পরবর্তী সেনা অভ্যুত্থানের অপেক্ষা করেছে ধৈর্যের সঙ্গে এবং অভ্যুত্থানের হয়েছে কোনো গুলিবর্ষণ ও প্রতিরোধ ব্যতিরেকেই। পাকিস্তানে সেনা বনাম সিভিলিয়ান সংঘাত নিয়ে কারণে-অকারণে নানা আলোচনা ও আশঙ্কা, পরামর্শ ও প্রচারণা। কিন্তু এর মূল কারণ খতিয়ে না দেখে এবং প্রতিকারের স্থায়ী পন্থা অবলম্বন না করে শুধু সমালোচনায় গণতন্ত্র নির্বিঘœ হবে না। চরিত্রের সংশোধন দরকার সেনাপতি ও রাজনীতিক, উভয়েরই। ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, অনিয়ম, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দুই তরফেই। বুলেটের ভয় দেখিয়ে গদি বাগিয়ে নির্বাচনী প্রহসনের বিকল্প ব্যালটের ফায়দা লুটে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ওয়াদা ভঙ্গ করা নয়। রাজনীতি ও সমরনীতি, দুই ক্ষেত্রেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অনেক ওপরে জাতিকে স্থান দিতে হয়। তুরস্কে কামাল পাশার আমল থেকে সরকার ও সংবিধানে, প্রশাসন ও পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর প্রাধান্য ও বিশেষ অবস্থান অগণতান্ত্রিক দৌরাত্ম্যে পর্যবসিত হয়েছিল। সেনাকর্তারা নির্বাচিত সরকারকে নিয়ে খেলতেন ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আউড়িয়ে। আজ তুরস্কে তাদের সেই দুঃসহ দাপট আর নেই। যে সেনাবাহিনী সাংবিধানিক আদালতের দোহাই দিয়ে গণতন্ত্র ও ইসলামকে হেয় করেছিল অতীতে, তাদের অন্যায় হস্তক্ষেপ বন্ধ করার প্রয়াসে সরকার অনেকটাই সফল। এর কারণ, নির্বাচিত একেপি সরকারের দেশপ্রেম, নিষ্ঠা ও মহতী লক্ষ্যের প্রভাবে তাদের প্রতি জনগণের সমর্থন। এবার সাবেক সেনাপ্রধানকে রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্তের দায়ে গ্রেফতার করা সহজ হলো এই প্রেক্ষাপটে। দীর্ঘদিন ধরে সেনাকর্মকর্তাদের বিশেষচক্র রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র গড়েছিল বিপুল ক্ষমতার জোরে। এই অন্যায় ক্ষমতার বৈধতা পেয়েছিল মনগড়া সংবিধান এবং আইনের ফোকর দিয়ে। কিন্তু নতুন শতাব্দীর সূচনা থেকে কামালবাদী কট্টর সেক্যুলার ও গণতন্ত্রবিরোধী সশস্ত্র বাহিনীর পালের হাওয়া সরে যেতে শুরু করে। কারণ, জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) নেতা রিসেপ তাইরিপ এরদোগান ও আবদুল্লাহ গুল পাকিস্তানি কায়দায় শুধু গণতন্ত্রের শ্লোগান দেননি, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছেন সুশাসন কায়েমে। সাহস ও দক্ষতার সাথে গণতন্ত্রকে অর্থবহ করে অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নে থেকেছেন নিরাপদ। জনগণ তাঁদের যোগ্যতা, সততা ও দায়িত্ববোধে মুগ্ধ হয়ে বারবার আস্থা জ্ঞাপন করেছেন ভোটের মধ্য দিয়ে। এ দিকে কমতে থাকে সেনাবাহিনীর মোড়লিপনা। ব্যঙ্গ করে কেউ কেউ বলতেন পাকিস্তানকে তিনটি ‘অ’ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেÑ অষষধয, অৎসু এবং অসবৎরপধ। তবে এখন পরিস্থিতি ঠিক তা নেই। সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রসঙ্গে কোনো কথা চলে না। আর সেনাবাহিনী ও আমেরিকার মাঝে ফাঁক তৈরি হয়ে তা বেড়ে চলেছে। আমেরিকা ইচ্ছামতো সেনাবাহিনীকে আর ব্যবহার করতে পারছে না। সবকিছুই মানা ছাড়িয়ে গেলে বুমেরাং হতে পারে। সেনাবাহিনী স্বদেশের জনগণের দিকে আর কত বন্দুক ধরবে বিদেশের ইঙ্গিতে? একেতো সামরিক শাসনের স্বর্ণযুগ বিদায় নিয়েছে, তদুপরি ক্ষমতা নিলে সেনানেতৃত্বে একদিকে পাশ্চাত্য হুমকি, অন্য দিকে ভারতকে মোকাবেলার চাপে থাকতে হবে। এই মুহূর্তে সেনাবাহিনী নয়, বশংবদ জারদারি গং আমেরিকার বেশি প্রিয়। সামরিক বাহিনীর মার্কিন সমরাস্ত্র প্রাপ্তির পথ বন্ধও হয়ে যেতে পারে ওয়াশিংটনের ইচ্ছায়। মার্কিন স্বার্থ পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার যদি রক্ষা করে, তা হলে সামরিক শাসক নি®প্রয়োজন। বেসামরিক শাসক যত সহজে গণতন্ত্রীয় মুখোশ পরতে পারে, উর্দিধারী তা পারে না বিশ্বাসযোগ্যতা কম থাকায়। স্মর্তব্য, বর্তমান সেনাপ্রধান জে. কায়ানি ২০০৭ সালে এ দায়িত্বে আসার পর অনেকবার বলেছেন, আমি চাই সেনাবাহিনী রাজনীতিতে জড়িয়ে না পড়–ক। পাকিস্তানে এ যাবৎ যারা ছিলেন সেনাপ্রধান, তাদের মধ্যে কায়ানিকে তুলনামূলকভাবে ধীরস্থির মনে হয়। গত কয়েকদিনে যে চরম সঙ্কট ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতি, তার মাঝেও সেনাাবহিনী ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছে চমৎকারভাবে। দেশটির সেনানেতৃত্বের গতানুগতিক স্বভাব থেকে এটা ভিন্ন বলে তাদের বর্তমান হিসেবি ভূমিকায় অবাক হতে হয়। একজন সামরিক বিশ্লেষক বলেছেন, ‘পরিস্থিতি একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না গেলে কায়ানি অভ্যুত্থান ঘটাবেন না।’ মেমোগেটের একজন খলনায়ক হোসেন হাক্কানি পাকিস্তানের সেক্যুলার মহলের অন্যতম শীর্ষব্যক্তিত্ব। ক্ষমতার রাজনীতির ঊর্ধ্বতন মহলের ঘনিষ্ঠ এই লোকটির বুদ্ধিজীবী বুদ্ধিজীবী ভাব তার সুবিধাবাদী চেহারা আড়াল করার সহায়ক। জঙ্গিবিরোধী হতে নিয়ে তিনি ধর্র্মীয় আদর্শভিত্তিক রাজনীতিরও প্রচণ্ড সমালোচক। তাই পশ্চিমী দুনিয়ার প্রিয়ভাজনদের তালিকাভুক্ত। লোকটিকে এখন মিডিয়া নির্দোষ এবং পরিস্থিতির শিকার বলে সহানুভূতির পাল বানাতে ব্যস্ত। কিন্তু সেক্যুলার অমুসলিম কলামিস্ট কুলদীপ নায়ার-এর কারেক্টার সার্টিফিকেট দিলেন এই ভাষায়Ñ এটা সম্ভব যে, (মেমোগেট ইসু্যুতে) হাক্কানি রাজনীতি খেলেছেন আলোচ্য বার্তাটি পাঠাতে গিয়ে। অবশ্য তার এমন কাণ্ড এটাই প্রথম নয়। হাক্কানির অতীতের দিকে লক্ষ করুন, এটা সুস্পষ্ট যে, তিনি একজন সুবিধাবাদী। তাঁর কৃতিত্ব হলো, তিনি নিজের স্বার্থে একদল থেকে লাফিয়ে অন্যদলে ভিড়ে যেতে পারেন। মেমোগেট নিয়ে ক্ষুব্ধ সেনাবাহিনী সরকারের আনুষ্ঠানিক অনুমতির প্রয়োজন বোধ না করেই সরাসরি লিখিত বক্তব্য দিয়েছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দলকে। এটা প্রধানমন্ত্রী গিলানির চোখে সংবিধান পরিপন্থী ও অবৈধ। তবে কুলদীপ নায়ার বলছেন, (সেনাপ্রধান) জেনারেল কায়ানী অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা সঞ্চার করলেও তার প্রশংসা করা যায়। হোসেন হাক্কানির সাথে আরেক হোতা মনসুর ইজাজ। এই ব্যক্তিই ফাঁস করে দিয়েছেন মেমোগেটে কাণ্ডকীর্তি কিন্তু সে কি সেনাবাহিনীর ভক্ত কোনো লোক, যে জারদারি-গিলানির বারোটা বাজাতে চায়? আসলে রহস্য এখানেই। তার ভূমিকা নিয়ে বিরাট সন্দেহ। মনসুর ইজাজ প্রকাশ্যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং আইএসআইকে সমালোচনা করে থাকেন। এরা ষড়যন্ত্রকারী বলে তার মন্তব্য। বাস্তবতা হলো, হাক্কানি-ইজাজকে কায়ানি-পাশার চেয়ে বেশি সৎ ও বিশ্বাসযোগ্য মনে করার কারণ নেই। প্রগতিমনা, ধর্মনিরপেক্ষ ও পাশ্চাত্যসেবী মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটি পাকিস্তানে গণতন্ত্রের দরদি সেজে লম্বা-চওড়া বহু কথাই বলছে। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ রাজনীতিক ও সেনাবাহিনী, কার সম্পর্কে কী ভাবে, তা কতটুকুই বা তুলে ধরা হয়। গণতন্ত্রে তো জনগণের স্থানই সর্বোর্ধ্বে। পাকিস্তান দেশটির সমস্যা হলো, সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বে ও সামরিকবাহিনী পরস্পরকে সহজে আস্থা নিতে পারে না। দ্বন্দ্বটা সরকার বনাম সামরিক বাহিনী বলা ভুল। কারণ, সামরিক বাহিনীতো সরকারের অংশ। বরং বলা যায়, বেসামরিক ও সামরিক কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব প্রচ্ছন্ন বা প্রকাশ্য, ক্ষীণ কিংবা জোরালোভাবে চলে আসছে। সেনাবাহিনী পাকিস্তানের গত ৬৪ বছরের ইতিহাসে ৪ বার ক্ষমতা দখল করেছেÑ ১৯৫৮, ’৬৯, ’৭৭ ও ’৯৯ সালে। ৬৪ বছরের বেশির ভাগ সময়েই দেশটা শাসিত হয়েছে উর্দিধারীদের দ্বারা। তাই রাজনীতিকরা অভ্যুত্থান আতঙ্কে ভোগেন। অপর দিকে রাজনৈতিক নেতারা দুর্নীতিদুষ্ট অযোগ্য, সন্ত্রাস লালনকারী এবং ক্ষমতার অপব্যবহারে আসক্ত। এ কারণে সামরিক বাহিনীর শ্রদ্ধা নেই তাদের প্রতি। যে যার অবস্থানে সততা, যোগ্যতা ও দেশপ্রেমের সাথে দায়িত্ব পালন করলে উভয়ের মাঝে আস্থার সম্পর্ক তৈরি হতো। লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির