post

বছরজুড়ে টালমাটাল অর্থনীতি আগামীতেও অনিশ্চিত যাত্রা

মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ

০৬ জানুয়ারি ২০১৮
বছরজেুড়ে টালমাটাল অবস্থায় চলছে দেশের অর্থনীতি। একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অন্যদিকে অর্থনীতির সূচকগুলোর নেতিবাচক অবস্থায় চলেছে পুরো বছর। বিশেষ করে আমাদের দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কমায় অর্থনীতি ছিল নেতিবাচক অবস্থায়। এ ছাড়া ব্যাংকের খাতে সীমাহীন দুর্নীতি, কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস, নতুন উদ্যোক্তা না আসা, বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ, কৃষি, পোশাক শিল্প খাতে একের পর এক দুর্ঘটনায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বছরজুড়েই স্থবির ছিল অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক। এ দিকে, দেশের রাজনীতিতে অনিশ্চিত যাত্রা বিরাজ করায় অর্থনীতির এই নেতিবাচক ধারা আগামী বছরও বিরাজ করবে বলে আশঙ্কা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করছেন এই মুহূর্তে অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা আনতে না পারলে আগামী বছর অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল ব্যাংকিং খাত। ঋণ কেলেঙ্কারি, অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে এ খাত। দেউলিয়া হয়ে গেছে কয়েকটি ব্যাংক। এমনকি অনেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করতে পারছে না। এ ছাড়া সরকারি ব্যাংকগুলোতে চলছে হরিলুট অবস্থা। জনগণের করের টাকা দিয়ে বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিচ্ছে তারা। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক নেতিবাচক অবস্থা বিরাজ করছে। গণমাধ্যমেও এ নিয়ে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশও পেয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশে সরকারি-বেসরকারি-বিদেশি সব মিলে মোট ৫৭টি ব্যাংক রয়েছে। আর্থিক অবস্থার অবনতি হওয়া ১৩টি ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও বিশেষায়িত ব্যাংক আটটি। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স, ন্যাশনাল, ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়ালে পরিস্থিতি কয়েক বছর ধরে খারাপ। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের একাধিক ব্যাংকের মালিকানা বদল নিয়েও নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে আমানতকারীদের মধ্যে বড় ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ ছাড়া বিনিয়োগ কম হওয়ার কারণে ব্যাংকে অলস টাকার পাহাড় জমেছে। উদ্যোক্তারা ঋণ না নেয়ায় ব্যাংক পরিচালনায় চরম বেকায়দার মধ্যে পড়েছেন ব্যাংকাররা। অনেকে ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করে ব্যাংক ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। দেশের ব্যাংকিং খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার অলস উদ্বৃত্ত থাকার পরও বাড়ছে ব্যাংকঋণের সুদহার। এতে উদ্যোক্তারা ঝুঁকছেন বিদেশি ঋণে। যা দেশের ব্যাংকিং খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ ছাড়া ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদের কারণে দেশীয় উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগে আসছেন না। বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাতে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রদানযোগ্য তহবিল পড়ে রয়েছে। কিন্তু নানা প্রতিকূলতা ও ঋণের উচ্চ সুদের কারণে দেশীয় উৎস থেকে ঋণগ্রহণে ব্যবসায়ীরা বরাবরই অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে কেবল ব্যবসা সম্প্রসারণ বা মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিই নয়, সস্তা সুদের ঋণ এনে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে থাকা চড়া সুদের ঋণ সুদাসলসহ এককালীন পরিশোধও করে দিচ্ছেন অনেকে। তবুও সুদের হার না কমিয়ে দেশের ব্যাংকগুলো বিদেশ থেকে নেয়া ঋণের জামিনদার হচ্ছে। তবে চরম অস্থিরতার মাঝেও নতুন করে তিনটি ব্যাংক অনুমোদন দেয়ার চিন্তা করছে সরকার। যেটি ভাবিয়ে তুলেছে সাধারণ মানুষকে। একের পর এক ব্যাংক অনুমোদন দিয়ে এভাবে দেউলিয়া হওয়ার কোনো মানে দেখছে না তারা। প্রতিটি ব্যাংকের মালিকানায় আছেন সরকারদলীয় ব্যক্তিরা। দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক কারণেই দেশি, প্রবাসী ও বিদেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। আর তাই এসব উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাতে হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা জানান, প্রবাসীরা বাংলাদেশের জন্য বিরাট সম্ভাবনার ক্ষেত্র। প্রতি বছর প্রচুর বাংলাদেশি বিদেশ যাচ্ছেন। তারা অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। তবে অদক্ষ শ্রমিক, প্রশাসনিক দুর্বলতা ছাড়াও বাধা কম নয়। এসব বাধা দূর করতে পারলে জনশক্তি জনসম্পদে পরিণত হবে। কিন্তু সরকারের আমলারা তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করান। এতে অনেকটা বিপাকে পড়েন প্রবাসী কর্মীরা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে সাত শতাংশের উপরে। কিন্তু জনগণ এর কোনো সুফল পাচ্ছে না। চলতি বছরে চালের দাম বৃদ্ধির কারণে ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে বলে জানিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম। আগামীতে চাল উৎপাদন, আমদানি ও সরবরাহ ঠিক রাখতে একটি কার্যকর চাল নীতিরও প্রস্তাব করছে ওই প্রতিষ্ঠানটি। ব্যাংকিং খাতে কেলেঙ্কারি এবং খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশেরও কথা জানানো হয় প্রতিবেদনটিতে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে বলে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। বছরের শেষে এসে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে লাগামহীনভাবে। ফলে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। ডলারের দাম, পণ্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার কারণে কমেছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধির হার কম এবং আমদানি ব্যয় বেশি বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা চাপে পড়ে। টাকার অবমূল্যায়ন ও মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার মধ্যে মিল ছিল না। বছরের মাঝামাঝি রোহিঙ্গাদের কারণে অর্থনীতিতে আরও চাপ বাড়ে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সব মিলিয়ে নানা সঙ্কটের মধ্য দিয়ে ২০১৭ সালের অর্থনীতি পার করেছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের সঙ্কট মোকাবেলার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দুই হাজার দু’শত টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তবে বিদেশীদের কাছ থেকে ত্রাণ পাওয়া গেছে চোখে পড়ার মতো। রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকার পরও চলতি বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) নিরাপদ মান অনুযায়ী, একটি দেশের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমান রিজার্ভ থাকলেই তাকে নিরাপদ মাত্রার ধরা হয়। বাংলাদেশে বছরে গড়ে আমদানি ব্যয় হয় ৩৫০ কোটি ডলার। এ হিসাবে বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে নয় মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। তার পরও বছরজুড়েই ডলার বাজার ছিল অস্থির। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ডলারের দাম কমেছে ৩ টাকা ৭৫ পয়সা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বছরজুড়ে নাজেহাল ছিল সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে চাল, সবজি, পেঁয়াজসহ অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম ছিল চোখে পড়ার মতো। অন্যান্য বছরের মতো এবারও বৃদ্ধি করা হয়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম। যা সাধারণ মানুষের উপর ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন হলেও সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা ছিল নীরব। কারণে জনগণের সাথে তোদের কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকায় তারা সাধারণ মানুষের কষ্ট বুঝেনি। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে বছরজুড়ে গণমাধ্যমে অনেক রিপোর্ট প্রকাশ হতে দেখা গেছে। বছর শেষে এসে শহরে বেড়েছে আরেক দফা বাসা ভাড়া। এতে বিপাকে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। দেশের অর্থনীতি যে ধরনের চাপে রয়েছে তাতে চলতি অর্থবছর সরকার প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে তা অর্জিত হবে না। এর কারণ অব্যাহতভাবে কমছে রফতানি, রেমিট্যান্স ও রাজস্ব আদায়। এ ছাড়া বিনিয়োগে ৮০ শতাংশ অবদান রাখা বেসরকারি খাত অনেকটাই বিনিয়োগশূন্য। সবকিছু মিলিয়ে সরকার যা বলছে তার থেকে বাস্তবতা অনেক তফাৎ। আমাদের দেশে ট্যাক্স বাড়লে দাম বাড়ে, কিন্তু ট্যাক্স কমলেও দাম কমে না। তাই বাজেটে যেসব পণ্যের ওপর ট্যাক্স কমানো হয়েছে তার দাম যাতে কমে, সরকারের উচিত সেদিকে নজরদারি বাড়ানো। পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন হওয়ার কিছুটা চাপে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিদেশী ফান্ডে বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশের অর্থনীতি অনেক স্বস্তিতে থাকবে। কারণ বিদেশী ঋণের সুদের হার অনেক কম। গেল বছর রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম ছিল। ফলে চলতি বছরের জন্য সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হবে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করার পাশাপাশি রাজনৈতিকদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে, যাতে দেশে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকে। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মানসম্মত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, বন্দর, সড়ক, রেলওয়ে ও বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হবে। আর বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাতে হবে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারলেই সমৃদ্ধির মহাসড়কে হাঁটতে পারবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি। লেখক : সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির