post

বাংলাদেশের বর্তমান দারিদ্র্য পরিস্থিতি

ড. মুহাম্মদ নাজমুস সাকিব

১৫ ডিসেম্বর ২০১৯

বর্তমানে বাংলাদেশ ২১ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। আর অতিদরিদ্র মানুষের হার ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৮ সালের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ১৩ মে ২০১৯ এই তথ্য প্রকাশ করেছে। ২০১৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপের চূড়ান্ত ফলাফলে এই চিত্র ফুটে উঠেছে। জরিপ অনুযায়ী দেশের খানাপ্রতি তথা পরিবারপ্রতি মাসিক গড় আয় দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯ শত ৮৮ টাকা। ২০১০ সালে ছিল ১১ হাজার ৪ শত ৭৯ টাকা। দেশের একজন ব্যক্তি প্রতি মাসে গড়ে ৩ হাজার ৯ শত ৪০ টাকা আয় করেন। হাউজ হোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভে প্রকল্পের চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুষ্ঠানে এ তথ্য প্রকাশ করেন বিবিএসের মহাপরিচালক ড. কৃষ্ণা গায়েন। আগের ছয় বছরের ব্যবধানে মাসিক মাথাপিছু আয় ও পরিবারের আয় দুই ক্ষেত্রেই বেড়েছে। ২০১০ সালেও দেশের একজনের প্রতি মাসে আয় ছিল ২ হাজার ৫৫৩ টাকা। ছয় বছরের ব্যবধানে ব্যক্তির গড় আয় বেড়েছে ৫৪ শতাংশ। আর পরিবারের আয় বেড়েছে ৪ হাজার ৫০০ টাকা। তবে এই আয় কোন ব্যক্তি বা পরিবারের একক আয় নয়। সব মানুষ ও পরিবারের আয়কে মানুষ ও পরিবারপ্রতি ভাগ করে দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ সালে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ দশমিক শূন্য শতাংশ সেখানে ২০১৬ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে। এর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বিবিএস প্রক্ষেপণ করেছে যে ২০১৮ সাল নাগাদ দারিদ্র্যের হার ২১ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। আর ২০০৫ সালে যেখানে অতিদরিদ্র বা হতদরিদ্রের হার ছিল ২৫ দশমিক ১ শতাংশ সেখানে ২০১৬ সালে তা কমে ১২ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে। ২০১৮ সালে তা আরও কমে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। ২০১৬ সালের পর বিবিএস আর কোনো খানা আয় ও ব্যয় জরিপ করেনি। এই বিষয়ে কৃষ্ণা গায়েন বলেন, এর আগে প্রাথমিক ফলাফল দেওয়া হয়েছিল। এখন চূড়ান্ত ফলাফল দেওয়া হলো। প্রাথমিক ফলাফলের সঙ্গে চূড়ান্ত ফলাফলের খুব বেশি পার্থক্য নেই। এবার আসি, এ দেশের মানুষ আয়ের কত অংশ কোথায় খরচ করেন। একটি পরিবার প্রতি মাসে ভোগ, ব্যয়ে খরচ করে ১৫ হাজার ৪ শত ২০ টাকা। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ এখন যত আয় করেন, তার অর্ধেকের বেশি খাদ্যবহির্ভূত পণ্য কিনতে খরচ করে থাকেন। জরিপের ফল অনুযায়ী, খাদ্যপণ্য কিনতে এ দেশের মানুষ আয়ের ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ খরচ করেন। এ ধরনের চিত্র প্রথমবারের মতো পাওয়া গেছে। অন্য খানা আয় ও ব্যয় জরিপগুলোতে দেখা গেছে, আয়ের অর্ধেকের বেশি খরচ করতে হতো খাদ্যপণ্য কিনতে। যেমন, ২০১০ সালে জরিপ অনুযায়ী, আয়ের ৫৪ দশমিক ৮ শতাংশ খরচ করতেন খাদ্যপণ্যে। এর আগের জরিপে অর্থাৎ ২০০৫ সালে আয়ের ৫৩ দশমিক ৮ শতাংশ খরচ হতো খাদ্যপণ্যে। অবশ্য মানুষের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যপণ্যের চেয়ে অন্য পণ্যে বেশি খরচ করে থাকেন। আয় ও ভোগ ব্যয় বাড়লেও মানুষের ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ কমেছে। এ দেশের মানুষ খাবারের মাধ্যমে দৈনিক গড়ে ২২১০ ক্যালরি গ্রহণ করে। ২০১০ সালেও ২৩১৮ ক্যালরি গ্রহণ করত। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আসছে। এখন ভাত খাওয়ার প্রবণতা কমেছে। জরিপের ফল অনুযায়ী, একজন বাংলাদেশি দৈনিক গড়ে ৩৬৭ গ্রাম ভাত খায়। ২০১০ সালে দৈনিক ৪১৬ গ্রাম ২০০৫ সালে ৪৪০ গ্রাম ভাত খেত। তবে মাছ-মাংস, ডিম, শবজি, ডাল খাওয়া বেড়েছে। কমেছে ফল ও দুধ খাওয়া। কৃষি পেশার প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। এ দেশের ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মজীবী কৃষির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাকিরা অন্য খাতের পেশায় আছেন। ছয় বছর আগে কর্মজীবীদের ৩৬ শতাংশের মতো কৃষি খাতে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। মানুষের জীবনযাত্রায়ও বেশ পরিবর্তন এসেছে। পাকা ঘরে বসবাস যেমন বেড়েছে, তেমনি সুপেয় পানি, স্যানিটারি ব্যবস্থারও উন্নতি হয়েছে। জরিপ অনুযায়ী দেশের ৮৪ শতাংশ ঘরে টিনের ছাউনি। আর অর্ধেক পরিবারের ঘরে ইটের দেয়াল। তবে এখনো ৩৫ শতাংশের মানুষ কাঁচা পায়খানা ব্যবহার করে। পাকা পায়খানা ব্যবহার করে ৬১ শতাংশের বেশি মানুষ। খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করে প্রায় ৩ শতাংশ মানুষ। আর ৫ শতাংশ মানুষ টিউবওয়েলের পানি পান করে। দেশের ৭৬ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ-সুবিধার আওতায় এসেছে। দরিদ্র পরিবারের ৯০ শতাংশ শিশুই স্কুলে যায়। আর দারিদ্র্যসীমা পার হওয়া পরিবারের যায় ৯৫ শতাংশ। প্রকল্প পরিচালক দীপঙ্কর রায় বলেন, এই জরিপটির মাধ্যমে দারিদ্র্যের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায়। এসডিজির প্রথম লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে না নির্মূল করা। এই লক্ষ্যটা কতটা অর্জিত হচ্ছে তা, পর্যবেক্ষণ করতে এই ধরনের জরিপ অব্যাহত রাখতে হবে। এ ছাড়া সরকারের নানা ধরনের নীতিনির্ধারণে জরিপটি কাজে লাগবে। কৃষ্ণা গায়েন জনান, ২০০৫ সালে মোট ১০ হাজার ৮০টি পরিবার ২০১০ সালে ১২ হাজার ২৪০ পরিবার নিয়ে জরিপ করা হয়েছিল। ২০১৬ সালে নমুনা খানার সংখ্যা বাড়িয়ে ৪৬ হাজার ৮০টি করা হয়। এই প্রকল্পের প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করা হয় গত ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে বিশ্ব দারিদ্র্য নিরসন দিবসে। তিনি বলেন, চলতি মে ২০১৯ সালের এই চূড়ান্ত প্রতিবেদন বই আকারে প্রকাশ করা হবে। স্বাধীনতা অর্জনের ৪৮ বছরের অগ্রযাত্রায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সূচকে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি অর্জিত হলেও এখনও বাংলাদেশ বহুবিধ সমস্যার জর্জরিত। দারিদ্র্য কমলেও বেকারত্ব, নিম্ন জীবনযাত্রার মান, নিরক্ষরতা, জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করণে পিছিয়ে থাকা, মানবপাচার, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ অভিবাসন যাত্রা, কার্বন নিঃসরণ, পরনির্ভরশীলতা, কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে অনগ্রসরতা রাজনৈতিক কেন্দ্রীয়করণ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব প্রাকৃতিক সম্পদের অপর্যাপ্ততা, আবিষ্কৃত প্রাকৃতিক সম্পদের উত্তোলন ও সুষ্ঠু ব্যবহার করতে না পারা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা, পরিবেশ দূষণ ও পরিবেশের ওপর নানা ধরনের আক্রমণ, নদী দূষণ ও দখল, হতোদ্যোম বেসরকারি খাত, নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণ; হত্যা, শিশু ধর্ষণ; হত্যা, অবৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জনের ধান্দা বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতির পথে সঙ্কট তৈরি করছে। এক সময় দারিদ্র্য বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দারিদ্র্য থেকে এদেশ এখনও মুক্তি পায়নি। দারিদ্র্যের প্রভাব আয়ের ক্ষেত্রে এবং জ্ঞানের ক্ষেত্রের পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। এটি সত্যি দুর্ভাগ্যের যে, দারিদ্র্য বিমাচনের ফলপ্রসূ ও কার্যকর পদ্ধতির একমাত্র ধারক হয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ থেকে এখনও দারিদ্র্য দূর হয়নি। শুধু বাংলাদেশ কেন, গোটা মানবজাতি দারিদ্র্যের মতো বড় সমস্যা মোকাবিলা করছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ও অধিকাংশ মানুষ আজ দারিদ্র্য সমস্যার জর্জরিত। বর্তমানে শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করছে এবং তাদের অধিকাংশ শুধু বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে। উন্নয়নশীল দেশসমূহে বিশেষ করে মুসলিম দেশসমূহে দারিদ্র্য উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও ইসলামে দারিদ্র্য কুকুরের মতই ঘৃণিত। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ডা: মাহাথির মোহাম্মদ ২০১৯ সালের ২০ এপ্রিল এক বক্তৃতায় বলেন, আমাদের বুঝতে হবে যে উন্নত জাতি হয়ে ওঠা কখনোই সম্ভব হবে না, যদি আমরা কেবল সুউচ্চ দালানই দেখাতে থাকি, বিপরীতে আমাদের নদীগুলো দূষিত হয়ে যায়, আমাদের বনভূমির জায়গা মরুর আকার ধারণ করে এবং যে বাতাসে আমরা শ্বাস নিই, তা মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়ে। বিশ্বের দুই পরাশক্তির স্নায়ুযুদ্ধ থেমে গেলেও স্নায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে তীব্র যুদ্ধ আজও অব্যাহত আছে এবং এই চরম শত্রুকে পরাস্ত করা বেশ কষ্টসাধ্য। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় দৃষ্টি অসম আয় ব্যবস্থাই দারিদ্র্যের মূল কারণ। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মানুষ অযৌক্তিক বিবেকবর্জিত ও অসৎপন্থা, সুদ, কালোবাজারি, মজুদদারি, চোরাচালান, টেন্ডারবাজি, সিন্ডিকেট করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদি পুঁজি পরিস্থিতিদের সম্পদের পাহাড় গড়াতে সাহায্য করে। বিপুল জনগোষ্ঠীর হাতে ক্রয় ক্ষমতা না থাকায় নিত্য ব্যবহার্য পণ্য ক্রয় করে মৌলিক প্রয়োজন পূরণের ক্ষমতা তাদের থাকে না। দারিদ্র্য এখনও বাংলাদেশের সমস্যা। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির এ এক কঠিন সঙ্কট। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে দারিদ্র্যের প্রধান প্রধান কারণসমূহের মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি, পূর্ণবেকারত্ব ও অধিকারত্ব, অসৎ দুর্নীতিবাদ নেতৃত্ব। সম্পদের সুষ্ঠু আহরণ ও ব্যবহার ব্যবস্থা যথাযথ না থাকা দারিদ্র্যের বিদ্যমান শোধনমুক্ত সমাজব্যবস্থা বিত্তবানদের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়া। সুদভিত্তিক অর্থনীতি সুদভিত্তিক মাইক্রোক্রেডিট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতারণা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সামাজিক দুর্ঘটনা, উদ্যোক্তার অভাব, গরিবদেরকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত করে রাখা, দুর্বল মাত্রার সম্পদ ব্যবস্থাপনা, সম্পদহীনতা আয় ও সম্পদের আসন বণ্টন, অবৈধ পন্থায় উপার্জনের রমরমা সুযোগ, সমন্বিত পরিকল্পনা ও উদ্যোগের অভাব, অনগ্রসর কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা, কৃষকদের ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, অশিক্ষা, নারীদের শিক্ষা পিছিয়ে থাকা, কারিগরি জ্ঞানের অভাব, বিদ্যমান ভূমি মালিকানার ধরন ও কাঠামো, প্রশাসনিক দুর্বলতা, মূলধনের অপ্রতুলতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সামাজিক নিরাপত্তা অভাব, অর্থনৈতিক প্রাকৃতিক নিম্নহার, স্বাস্থ্যসেবার অভাব ও পুুষ্টিহীনতা ইত্যাদি বাংলাদেশে দরিদ্র্যতা সৃষ্টির জন্য দায়ী। উল্লিখিত দারিদ্র্যের কারণসমূহ এটি নিশ্চিত করছে যে, দারিদ্র্য দূরীকরণের দরকার। এ জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত ও সুসংগঠিত প্রয়োগ। লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট ও উন্নয়ন গবেষক

তথ্যসূত্র:

১. খানা আয় ও ব্যয়, প্রথম আলো প্রতিবেদন, দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ মে ২০১৯, পৃ: ১৪। ২. উদ্ধৃত শওকত হোসেন, জিডিপির হিসাব কর্তন বিশ্বাসযোগ্য, দৈনিক প্রথম আলো, ১৫ মে ২০১৯ পৃ: ১১।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির