post

বাতিলের ফুৎকারে সত্যের আলো কোনো দিন নিভে যাবে না

মোহাম্মদ নুর উদ্দিন

১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫
অতীত মানুষের প্রেরণার উৎস। অতীতের প্রেরণায় মানুষ সামনের দিকে এগিয়ে চলে। অতীতের শোক মানুষকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। ২৮ অক্টোবর আমাদের জন্য তেমনই একটি গৌরবময় অতীত। এই অতীত ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের প্রেরণা জোগাবে যুগ যুগ ধরে। সেই দিন ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা প্রমাণ করেছে তারা রক্ত দেবে কিন্তু আল্লাহর নূরকে নিভাতে দেবে না। তারা জীবন দেবে কিন্তু আল্লাহর জমিন থেকে আল্লাহর দ্বীনকে মুছে যেতে দেবে না। আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া আমার মত একজন গুনাহগার বান্দাহকে সেই গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষী হওয়ার সুয়োগ দিয়েছিলেন। ২০০৬ সালের ২৫ অক্টোবর ছিল ঈদুল ফিতর। ২৮ অক্টোবর আমাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সকল জনশক্তিকে ২৭ অক্টোবরের মধ্যে ঢাকায় উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তাই ঈদের ছুটি সংক্ষিপ্ত করে গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছাই ২৭ অক্টোবর রাতে। পরদিন অর্থাৎ ২৮ অক্টোবর সকালে ছিল আমাদের মতিঝিল থানার ঈদপুনর্মিলনী। ঈদপুনর্মিলনী শেষে আমাদের সমাবেশের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়। তারপর আমাদের যার যার দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়। সমাবেশের স্থান ছিল বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেট। তাই আমাদের তৎকালীন থানা সভাপতি রেজাউল করিম ভাই আমাকে ১০ জন জনশক্তি দিয়ে পাঠালেন সমাবেশস্থলে। আমরা সেখানে পৌঁছাই সকাল ১০টায়। সেখানে যাওয়ার পর আমাদের শৃঙ্খলার দায়িত্ব দেয়া হলো পুরানা পল্টন হোটেল কস্তুরীর গলিতে। সেই দিন প্রেস ক্লাবের সামনে ছিল আওয়ামী লীগের সমাবেশ। সকাল সাড়ে ১০টার কিছুক্ষণ পর থেকে বিজয়নগর দিক থেকে আওয়ামী লীগের মিছিল আসা শুরু করলো। আমি মিছিলের দিকে তাকিয়ে দেখি তাদের সবার হাতে লগি-বৈঠা। তাদের নেত্রী খুনি হাসিনার নির্দেশে তারা সবাই লগি-বৈঠা হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। তারা পল্টন থেকে বিজয়নগর মোড় পর্যন্ত আমাদের যে মাইকগুলো লাগানোর কথাছিল সব লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে ফেলে দিচ্ছে আর তারগুলো ছিঁড়ে ফেলছে। আমরা পুলিশকে বিষয়টি জানালেও তারা সেদিন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। লগি-বৈঠার মিছিল যখন পল্টন মোড়ে পৌঁছায় তখন তারা প্রেস ক্লাবের দিকে না গিয়ে বায়তুল মোকাররমের দিকে মোড় নেয়। তাদের লক্ষ্য ছিল জামায়াতের মঞ্চ ভাঙচুর করা। তারা চেয়েছিল জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের মহানগরী ও কেন্দ্রীয় অফিসে হামলা করবে। আল্লাহর অশেষ রহমতে তাদের সেই স্বপ্ন সফল হয়নি। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা যে মানবপ্রাচীর গড়ে তুলেছিল তা আওয়ামী সন্ত্রাসীদের আক্রমণ ভেদ করতে পারেনি। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা সেদিন রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে কিন্তু ইসলামবিরোধী শক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে দেয়নি। তাই মনে পড়ে গেল কবি মতিউর রহমান মল্লিকের গান- “কোন সাহসে চাও নেভাতে অগ্নিগিরি বল/ চোখ রাঙিয়ে যায় কি রোখা জোয়ার টলমল।” সেই দিন আমরা চতুর্দিক থেকে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের আক্রমণের শিকার হই। হঠাৎ করে তারা কস্তুরির গলি দিয়ে আমাদের ওপর হামলা চালায়। আমরাও প্রতিরোধ গড়ে তুলি। শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। আমি তাকিয়ে দেখলাম বৃষ্টির মতো ইট ও বিভিন্ন রকম কাচের বোতল আসছে আমাদের ওপর। এইভাবে প্রায় আধা ঘণ্টা মারামারি চলে। এর মধ্যে আমাদের অনেক ভাই আহত হয়। হঠাৎ একটি আদলা ইট এসে পড়ে আমার পায়ের ওপর। আমার ডান পায়ের শক্তি একেবারে শেষ হয়ে যায়। আমি এক পাশে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকি। পায়ের ব্যথা কিছুটা কমে এলে আমি আবার আমার ভাইদের সাথে যোগ দেই। আমাদের গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আমাদের তৎকালীন মহানগরী সেক্রেটারি রফিক ভাই। এ ছাড়া আমাদের সাথে মহানগরী পশ্চিমের কিছু ভাই ছিল। সব মিলিয়ে আমাদের গ্রুপের সদস্য পঞ্চাশের মতো ছিল। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার একপর্যায়ে আমি আর শহীদ মুজাহিদ আওয়ামী সন্ত্রাসীদের কবলে পড়ে যাই। তারা দশ থেকে বারোজন আমার ওপর হামলা করে। তারা প্রথমে আমার মাথায় লগি-বৈঠা দিয়ে আঘাত করে। সাথে সাথে আমার মাথা ফেটে রক্ত ঝরা শুরু হয়। আমার ওপর তারা এলোপাতাড়িভাবে লগি-বৈঠা দিয়ে আঘাত করতে থাকে। একপর্যায়ে আমার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হতে শুরু করে এবং আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। আমাদের কয়েকজন ভাই আমার এই অবস্থা দেখে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করলে তারা আমাকে রেখে সরে যায়। তখনও আমার জ্ঞান ছিল। হাফিজ ভাই ও তছলিম ভাই আমাকে ধরাধরি করে রিকশায় তোলেন। আমার নাকে মুখে রক্ত দেখে তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। আমাকে প্রথমে নেয়া হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইন হাসপাতালে। সেখানে তারা মাথায় ব্যান্ডেজ করে রক্তক্ষরণ বন্ধ করে। তবে ভর্তি করতে অপারগতা প্রকাশ করে। পরে আমাকে নিয়ে য়াওয়া হয় ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল মতিঝিল শাখায়। সেখানে আমার মাথায় সেলাই করা হয় এবং আমাকে হাসপাতালের ষষ্ঠ তলার একটি বেডে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণ পরই আমার পাশের বেডে নতুন করে যোগ হন তৎকালীন কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদক ড. রেজাউল করিম ভাই ও আমাদের মহানগরী সভাপতি কামাল হোসেন ভাই। সেই দিন বিকেল থেকেই আমি আমার ডান পাশের অংশে বোধশক্তি কম পাচ্ছিলাম। আমার পুরো ডান পাশই কেমন যেন অবশ হয়ে আসছিলো। বিকেল ৪টার দিকে আমি কয়েক টুকরো আপেল খাওয়ার পর বারবার বমি হতে শুরু করে। তাই ডাক্তার দ্রুত সিটি স্ক্যান করাতে বলেন। আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল কাকরাইল শাখায়। সেখানে সিটি স্ক্যান করানোর পর জানা যায় যে আমার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হচ্ছে এবং মস্তিষ্কের চার পাশে রক্ত জমাট হয়ে আছে। তাই ডাক্তার দ্রুত অপারেশন করতে বলেন। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরই আমাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর টানা দুই দিন আমার কোন জ্ঞান ছিল না। জ্ঞান ফিরলে দেখি আমার বেডের পাশে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ ও আমীরে জামায়াত মতিউর রহমান নিজামীসহ আরও ৫-৬ জন আইসিইউতে থাকা আমাদের জন্য আল্লাহর দরবারে হাত তুলে দোয়া করছেন। জ্ঞান ফিরছে দেখে তারা অত্যন্ত খুশি হলেন। আমার জ্ঞান ফেরার ব্যাপারে সবাই অনেক আশঙ্কায় ছিলেন। পরে শুনলাম আমার সাথে অপারেশন করা হয়েছিল শহীদ মাসুম ভাইয়ের। কিন্তু তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। শহীদ মাসুম ভাইয়ের কফিনের সাথে আমার জন্যও দেয়া হয়েছিল কফিনের অর্ডার। আল্লাহ পাক আমাকে এইবারের মতো বাঁচিয়ে রাখলেন। আমিরে জামায়াত চলে যাওয়ার পরে নার্স একজন এসে বললেন বাইরে আপনাকে দেখার জন্য অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছেন। আপনি একটু হাত তুলে তাদের আশ্বস্ত করুন। আমি হাত তুলে সবাইকে জানালাম যে আল্লাহ পাক তখনও আমাকে জীবিত রেখেছেন। তারপর টানা ১১ দিন শুধুমাত্র স্যালাইনের ওপর বেঁচে থাকা। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় সারাক্ষণ আমার পাশে ছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় ইব্রাহিম ভাই। এই সময় আমার জন্য অনেকে অনেক কষ্ট করেছেন যাদের ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবো না। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল অনেক বছর। এখন ২০১৫ সাল। জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে অনেক ঝড়। মুখোমুখি হয়েছি জেল, জুলুম নির্যাতনের। কিন্তু এসব কিছুই তুচ্ছ মনে হয় যখন চোখের সামনে ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা আজ শাহাদাতের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তাদের এই শাহাদাত আমাদের নতুন করে সাহস জোগায় আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি নেয়ার। এই প্রস্তুতি নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখার, বাতিলের সকল বাধা মোকাবেলা করে একটি সুন্দর সোনালি সমাজ প্রতিষ্ঠার। আর যারা মৃত্যুকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসে দুনিয়ার কোন শক্তি তাদের পরাজিত করতে পারবে না। ইনশাআল্লাহ। লেখক : ২৮ অক্টোবর ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের হামলায় আহত

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির