post

বিতর্কিত পারমাণবিক যুগে বাংলাদেশ!

০৮ নভেম্বর ২০১৩

তানভীর আহমেদ

[caption id="attachment_2004" align="alignleft" width="300"] রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এর সাথে শেখ হাসিনা[/caption]

পাবনার রূপপুরে এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হতে যাচ্ছে। তিনটি চুক্তির আওতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ করবে রাশিয়ান ফেডারেশনের এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট। এই পারমাণবিক চুক্তির প্রতিবাদে এবং এ প্রকল্প বন্ধের জন্য সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন সাইটে বিভিন্ন প্রতিবাদ উঠে আসছে বেশ কিছুদিন ধরেই। একই সঙ্গে পরিবেশ রক্ষায় বেশ কয়েকটি সংগঠন এ প্রকল্পটি বন্ধ করার জন্য স্মারকলিপি, মানববন্ধন, পোস্টার-লিফলেট বিলি, মাইকিং ইত্যাদি করে এলেও সব সমালোচনাকে ঊর্ধ্বে রেখে গত ২ অক্টোবর এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরিত্যক্ত হয় ১৯৭১ সালে পাবনা জেলায় অবস্থিত রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পাধীন একটি সরকারি উদ্যোগ। বিদ্যুতের চাহিদা সরবরাহ নিশ্চিত পরিকল্পনায় ১৯৬১ সালে পাবনায় রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সহায়ক প্রকল্পের বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, কর্মকর্তাদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণসহ অত্যাধুনিক বাসস্থান গড়ে তোলা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের পরেই অর্থের অভাবে পরিত্যক্ত হয় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। চার যুগে শুধুই ব্যর্থতা স্বাধীনতার পর ১৯৭৮-৭৯ সালে একটি সম্ভাব্যতা জরিপ করা হয়। জরিপে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাংলাদেশের জন্য যথার্থ এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হিসেবে চিহ্নিত হয়। ১৯৮০ সালে একনেক ১২৫ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অনুমোদন করে; কিন্তু অর্থায়নসহ অন্যান্য সমস্যায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়নি। ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছরে এ প্রকল্পের একটি ফলোআপ স্টাডি করা হয়। এ স্টাডিতেও প্রকল্পটি কারিগরি এবং আর্থিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রকল্পটি নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে এ প্রকল্পই যথেষ্ট ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ জাতির জন্য সম্মানের বিষয়। একই সময়ে বিজ্ঞান ও তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকলেও রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র রিখটার স্কেলে ১০ মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করার মতো করে তৈরি করা হবে। এ সম্পর্কে কোনো ধরনের গবেষণা হয়েছে কি না বা কোন্ বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে এ তথ্য দিয়েছেন সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি। স্বভাবতই ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বর্তমান সময়ে বিতর্ক হওয়ার আগে পারমাণবিক বর্জ্য, আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক চলছিল। বিতর্ক চলছিল অন্যান্য পন্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেয়ে প্রায় চারগুণ বেশি ব্যয় করে এই পরমাণু বিদ্যুৎ স্থাপনার লাভ-ক্ষতি, মাত্রাতিরিক্ত পরিচালন ব্যয়, পরমাণু বর্জ্য অপসারণ, স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার জনগণ ও বিশেষজ্ঞদের কথা অগ্রাহ্য করছে, যা শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও চরম হুমকিস্বরূপ। অতীত ইতিহাস ও বর্তমান দেখলে আমরা যে ভয়াবহ চিত্র পাই তাতে বাংলাদেশকে ধ্বংসের জন্য এ ধরনের একটি প্রকল্পই যথেষ্ট। বিভিন্ন দেশ বন্ধ করে দিচ্ছে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র জার্মানি, ইংল্যান্ডসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কয়েকটি দেশ পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিচ্ছে, বন্ধ করে দিয়েছে নতুন কেন্দ্র স্থাপন। রাশিয়ার চেরনোবিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ার থ্রি-মাইল আইল্যান্ড ও সাম্প্রতিক জাপানের ফুকুশিমাসহ বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্ঘটনা সাধারণ জনগণ ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে চরম ভয় ও উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। যার ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চালু পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ও নির্মাণ কাজ চলছে এমন কেন্দ্রও বন্ধ করার জন্য সেসব দেশের সাধারণ জনগণ আন্দোলন করছেন। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও আন্দোলন চলছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ইউরেনিয়াম সঙ্কটে পৃথিবী পৃথিবীতে ইউরেনিয়ামের পরিমাণও স্বল্প। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, হাই গ্রেড ইউরেনিয়ামের মজুত আছে প্রায় ৩৫ লাখ টন। বর্তমানে প্রতি বছর ইউরেনিয়াম ব্যবহৃত হচ্ছে প্রায় ৬৭ হাজার টন। এই হারে ব্যবহার হলে বর্তমান মজুত ৫০ বছরের মধ্যে শেষ হবে। আর যদি পৃথিবীর বর্তমান বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় সবটাই জোগাতে হতো পরমাণু বিদ্যুৎকে তবে তা দিয়ে চলত মাত্র ৯ বছর। হাই গ্রেড-লো গ্রেড মিলিয়ে এই মুহূর্তে ইউরেনিয়ামের মোট মজুত প্রায় ১ কোটি ৪৪ লাখ টন, যার বেশিরভাগ থেকেই ইউরেনিয়াম উত্তোলন করা ক্রমে ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। অনেক খনি আবার এরই মধ্যে পরিত্যক্তও হয়ে গেছে। পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যগত ঝুঁকি ইউরেনিয়াম মাইনিং, পরমাণু রিঅ্যাক্টর নির্মাণ, টাওয়ার শীতলীকরণ, পরমাণু বর্জ্যরে পরিবহন ইত্যাদি বিষয়গুলো আমলে নিলে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বায়ুমণ্ডল, পরিবেশ ও প্রাণীর ক্ষতি করে, সে বিষয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৯৭ সালে কিয়োটো প্রটোকলে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রকে Clean Development provision থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়। জন উইলিয়াম এবং ফিলিপ স্মিথ ২০০৪-এর এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, একটি আধুনিক প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় একটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ করে তিন ভাগের এক ভাগ। তাছাড়া পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে কয়েক হাজার গুণ ক্ষতিকর সিএফসি অর্থাৎ ক্লোরোফ্লোরোকার্বন নিঃসরিত হয় যাকে ‘মনট্রিল প্রটোকলে’ পরিবেশ দূষণের দায়ে আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও পরমাণু রিঅ্যাক্টর প্রতি বছর বায়ুমণ্ডলে ও পানিতে প্রায় মিলিয়ন কুরি (তেজস্ক্রিয়তার একক) তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ছড়ায়। এসব আইসোটোপের তালিকায় আছে ক্রিপ্টন, জেনন, আর্গনের মতো নিস্ক্রিয় গ্যাসসমূহ, যেগুলো চর্বিতে দ্রবণীয় এবং রিঅ্যাক্টরের আশপাশে বসবাসকারী কোনো লোক তার নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করলে তা তার ফুসফুসের মাধ্যমে প্রজনন অঙ্গসহ দেহের চর্বিযুক্ত টিস্যুতে স্থানান্তরিত হতে পারে। তদুপরি তেজস্ক্রিয় মৌলগুলো থেকে নিঃসরিত গামা রশ্মি ডিম্বাণু ও শুক্রাণুতে আকস্মিক পরিবর্তন ঘটিয়ে সূচনা করতে পারে বংশানুসৃত রোগের। ট্রিটিয়াম নামক হাইড্রোজেনের একটি আইসোটোপও আমরা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাই, যা অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়ায় তেজস্ক্রিয় পানি উৎপন্ন করে। এই পানি ত্বক, ফুসফুস এবং পরিপাকতন্ত্রের মাধ্যমে লোকজনের দেহে প্রবেশ করে তার ডিএনএ মলিকিউলে ঢুকে যেতে পারে, যার পরিণাম বড় ধরনের বিপর্যয়। নারী ও শিশু দ্রুত ক্যান্সারে আক্রান্ত হবে ২০০৮ সালে জার্মান সরকার তার বাণিজ্যিক ১৬টি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশপাশে বসবাসকারী শিশুদের ওপর একটি গবেষণা চালায়। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে যতই যাওয়া যায় শিশুদের দেহে ক্যান্সার বিশেষত লিউকোমিয়ায় আক্রান্তের ঝুঁকি তত বাড়তে থাকে। ওই গবেষণা থেকে জানা যায়, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে বসবাসকারী শিশুদের লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তার বাইরে বসবাসকারী শিশুদের তুলনায় অন্ততপক্ষে দ্বিগুণ। গবেষণায় দেখা যায়, পরমাণু রিঅ্যাক্টরের আশপাশে অবস্থিত লোকালয়গুলোতে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ২৬-২৮ জন, যেখানে গড়পড়তা স্তন ক্যান্সারজনিত মৃত্যুহার হচ্ছে প্রতি লাখে ২০-২২ জন। এই গবেষণাটি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে যারা বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ডিপার্টমেন্টের গবেষণায় দেখা গেছে, সবচেয়ে পুরনো পরমাণু কেন্দ্রগুলোর আশপাশে স্তন ক্যান্সারজনিত মৃত্যুহার ১৯৫০-৫৪ থেকে ১৯৮৫-৮৯ সময়কালে বেড়েছে ৩৭ শতাংশ, যেখানে পুরো আমেরিকা জুড়ে গড়ে তা বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ। গত ৩৩ বছরে নতুন পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেনি যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ার থ্রি মাইল আইল্যান্ডে ১৯৭৯ সালের ২৮ মার্চ একটি পরমাণু দুর্ঘটনা ঘটে। এই দুর্ঘটনার পর এখন পর্যন্ত নতুন আর কোনো পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেনি যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৮০ সালে থ্রি মাইল আইল্যান্ড ঘটনার পরপরই সুইডেন রেফারেন্ডামে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে। ১৯৮৬ সালের চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর সবাই ধরে নিয়েছিল পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিন বুঝি এবার ফুরাচ্ছে। জার্মানি কেবল নতুন পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধই করেনি, সেই সঙ্গে একে একে বন্ধ করে দিচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ কেন্দ্রগুলো। বেলজিয়াম, তাইওয়ান, জাপানও ক্রমে সরে আসছে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে। এমনকি নিজস্ব বিদ্যুতের শতকরা ৭৭ ভাগ পরমাণু শক্তি থেকে পাওয়া ফ্রান্সের জনগণ সেদেশের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করার জন্য সরকারকে ব্যাপকভাবে চাপ দিচ্ছে। দেশে দেশে বন্ধ হচ্ছে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্রাজিলের অ্যাংরা-১ পরমাণু কেন্দ্রটি কিছু দিন পরপর যন্ত্রপাতি বিকল হওয়ার কারণে ২০০০ সালের মে’তে হাজার হাজার গ্যালন তেজস্ক্রিয় নোনাপানি প্ল্যান্ট থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে এবং খোদ ব্রাজিলে এই খবর ৪ মাস অপ্রকাশিত ছিল। পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কোম্পানিটি এই খবর সরকারকে জানায়নি। এর ফলে ব্যাপক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হয় বিপুলসংখ্যক মানুষ। জাপানের বিপর্যয়ের পর জার্মানি ৭টি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। অবশ্য জাপানের ঘটনার আগে ফ্রান্স, ফিলিপাইনসহ কিছু দেশ কয়েকটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। সুইডেনে শেষ পরমাণু চুল্লি নির্মাণের কাজ হয়েছিল ১৯৮৫ সালে, স্পেনে ১৯৮৮, জার্মানিতে ১৯৮৯, ইংল্যান্ডে ১৯৯৫ সালে। ১৯৯৮ সালে জার্মান সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, সে দেশের সব কটি চুল্লি পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেয়া হবে। ২০০০ সালের মধ্যে ফ্রান্সে ২০০টি পরমাণু চুল্লি চালু হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে চালু চুল্লির সংখ্যা মাত্র ৫৯টি। নতুন চুল্লি নির্মাণেরও পরিকল্পনা নেই। ফ্রান্সে ইলেকট্রিসাইট দ্য ফ্রান্সের মতো সরকারি সংস্থা বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার মালিক হওয়া সত্ত্বেও বিপুল খরচের দায়ে তারা দিশেহারা। আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের বর্তমান ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৩শ’ কোটি ডলার। রক্ষণাবেক্ষণের সামর্থ্য কি বাংলাদেশের আছে? সবাই যখন একের পর এক পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিচ্ছে সেখানে বাংলাদেশ সরকার পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে ‘সম্মানিত’ হওয়ার পরিকল্পনা আঁটছে। এতে জনগণ ভীত হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছ থেকে ভিভিআর-১০০০ মডেলের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র আমদানি করতে চায়। রাশিয়া কেবল রিঅ্যাক্টর এবং তার কাঁচামাল ইউরেনিয়াম বেচবে। স্বাস্থ্যগত, আর্থিকসহ সামগ্রিক ক্ষতির বিষয়টি যদি বাদও দেই তবুও প্রশ্ন থেকে যায় রাশিয়ার কাছ থেকে যে পরমাণু পাওয়ার প্লান্ট কিনতে যাচ্ছে সেটা স্থাপন, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কোনো সামর্থ্য কি বাংলাদেশের আছে? পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানির উৎস ইউরেনিয়াম এবং সেই ইউরেনিয়ামের কাঁচামাল প্রক্রিয়াজাতকরণের সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও কেন বাংলাদেশ পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে যাচ্ছে সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ। দিন যতই যাবে বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ বাড়বে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যগত সমস্যা এবং প্রযুক্তিগত অদক্ষতা ছাড়াও বাংলাদেশে এরই মধ্যে বৈদেশিক ঋণের জালে আটকে গেছে। বৈদেশিক ঋণ এবং শর্তের জালে আবদ্ধ দেশের জন্য পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাড়তি বিপদ হলো এর আর্থিক দায়। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় এককালীন বিনিয়োাগের পরিমাণ বিপুল। আবার শুরুতে যে পরিমাণ অর্থের কথা বলা হয় তাও ঠিক থাকে না। দিন যত যায়, ততই বিনিয়োাগকৃত অর্থের পরিমাণ বাড়তে থাকে। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বাংলাদেশকে সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট নিতে হবে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশসহ যেসব দেশ সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট কিংবা নানান ব্যাংক ও দাতা সংস্থার কাছ থেকে ঋণের মাধ্যমে প্রকল্প হাতে নিয়েছে, সেখানেই শাসক শ্রেণী লাভবান হয়েছে, জনগণ হয়েছে আরও বেশি ঋণগ্রস্ত। এর বিনিময়ে জনগণ যে নিরাপদ, নিশ্চিত বিদ্যুৎ সরবরাহ পেয়েছে তাও নয়। বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ খরচ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি ডলার অর্থাৎ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, এ কেন্দ্র থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হওয়ার কথা। দ্বিতীয় ইউনিটটি চালু হলে ২০২০ সাল নাগাদ ওই কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ পাবে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এই খরচ যে আরও বাড়বে সেটি নিশ্চিত। বিকল্প পন্থায় বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রূপপুর প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, বিভিন্ন দেশের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রাথমিক যে হিসাব দেয়া হয় শেষ পর্যন্ত সেই ব্যয় গিয়ে দাঁড়ায় কয়েকগুণ বেশি। অথচ ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে খরচ হয় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ রকম আটটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন সম্ভব, যেখান থেকে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) কয়লা, গ্যাস ও পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ব্যয়ের যে হিসাব দিয়েছে, সেখানেও দেখা যায়, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ খরচ অনেক বেশি। আইইএ হিসাব মতে, একটি ২৫০ মেগাওয়াটের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে খরচ হয় ১ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০ হাজার কোটি টাকায় ৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা সম্ভব, যেখান থেকে ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। অন্যদিকে আইইএ’র হিসাবে ২৫০ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে খরচ হয় ১ হাজার ৬৫ কোটি টাকা, যা দিয়ে ৯টি ২৫০ মেগাওয়াটসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ সম্ভব। এছাড়া বায়ু ও সোলার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ খরচ আরও কম। তাছাড়া বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালনা ব্যয় জ্বালানি তেল, কয়লা, গ্যাস, পানি, বায়ু ও সোলার এনার্জির চেয়ে অনেকগুণে বেশি। এখানে স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্ভাবনাও নেই। তাহলে বাংলাদেশ এই বিপজ্জনক ও বাড়তি খরচের পথে এগুচ্ছে কেন? বিপর্যয় ঘটলে সামাল দেয়া যাবে না! বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও জনসংখ্যা ঘনত্বের কারণে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য মোটেই উপযোগী নয়। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনো দুর্ঘটনায় যে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটবে তা সামাল দেয়া কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। জাপানের মতো উন্নত দেশও এখন পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপর্যয় এড়াতে পারছে না। চেরনোবিল, থ্রি মাইল আইল্যান্ডের মতো বড় বড় দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে প্রযুক্তির দিক দিয়ে শীর্ষে অবস্থানকারী দেশগুলোতে। যারা নিজস্ব দক্ষতাকে কেন্দ্র করে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছিল। আর বাংলাদেশের মতো দেশের যেখানে সামান্য পানি, তেল ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো দুদিন পর পর বিকল হয়ে যায় এবং মেরামতের অভাবে পড়ে থাকে বছরের পর বছর সেখানে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল প্রযুক্তি ভালোভাবে চলবে সেটা কল্পনাও করা যায় না। ভারত-পাকিস্তানের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রও বাংলাদেশের জন্য হুমকি শুধু বাংলাদেশের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রই নয়, ভারত ও পাকিস্তানের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও বন্ধ করা জরুরি। ভারতে ২০টি পরমাণু চুল্লির মাধ্যমে ছয়টি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৪ হাজার ৭৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। আরও পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। পাকিস্তানে আছে তিনটি, যার মাধ্যমে সে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ উৎপাদিত হয়। ভারতে দীর্ঘদিন ধরে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপক্ষে সে দেশের সচেতন মানুষ সোচ্চার। বাংলাদেশের যেমন পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্পের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত নয়, তেমনি ভারত ও পাকিস্তানে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রও বন্ধ করা জরুরি। কারণ উপমহাদেশের ভৌগোলিক ও জনসংখ্যাগত অবস্থান কোনোক্রমেই পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপযোগী নয়। এখানে অবস্থিত যে কোনো একটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপর্যয় এই অঞ্চলে মহাবিপর্যয় ডেকে আনবে। উন্নত দেশগুলো যেখানে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে অসহায় সেখানে দারিদ্র্যপীড়িত এই অঞ্চলে সেই ব্যবস্থা কোনোক্রমেই উপযোগী ও টেকসই নয়।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির