post

বিদ্যুতের খাতে নৈরাজ্য কাম্য নয়

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

০৫ এপ্রিল ২০২০
দেশ পরিচালনায় সরকারের তেমন কোন সাফল্য নেই। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সেক্টরে লাগামহীন নৈরাজ্য সরকারের ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করেছে বলেই অভিজ্ঞমহল মনে করছেন। মূলত দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা স্বস্তিদায়ক নয়। রাষ্ট্রের ব্যয়ভার নির্বাহ করতে সরকার অনেকাংশেই ব্যাংকঋণ নির্ভর হয়ে পড়েছে। সরকারের ঋণের চাহিদা মেটাতে গিয়ে অনেক ব্যাংকই এখন দেউলিয়া হওয়ার পথে। সঙ্গত কারণেই দেশের ব্যাংকগুলোতে এখন তারল্য সঙ্কটও দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় কথিত আমানত সুরক্ষার আইনের নামে ব্যাংক মালিকদের রক্ষার জন্য নতুন করে আইন প্রণয়নের আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে এবং ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক সে কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। প্রস্তাবিত নতুন আইন নিয়ে সর্বমহলে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠলেও সরকার ও সংশ্লিষ্টরা তাদের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন। ফলে অর্থনৈতিক সেক্টরে আমানতকারীরা নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেই পড়েছেন। দেশের অর্থনীতি যে একেবারে লেজেগোবরে অবস্থায় পড়েছে তা বারবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতেই উপলব্ধি করা যায়। কারণ, সরকার অর্থনৈতিক নৈরাজ্য কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আর এর চোট পড়ছে দেশের বিদ্যুৎ খাতের ওপর। প্রাপ্ত্য তথ্য মতে, গত ১২ বছরে ৭ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। কাকতালীয়ভাবে এসব মূল্যবৃদ্ধির ঘটনাকে সাধারণ মানুষ সম্পূর্ণ অনাকাক্সিক্ষত ও অযৌক্তিক বলেই মনে করছেন। কারণ, দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লেও বারবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। মূলত ব্যবসায়ী, ভোক্তা ও রাজনীতিবিদদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে বিদ্যুৎ ও পানির মূল্য বৃদ্ধি কেউই সঙ্গত মনে করছেন না। প্রাপ্ত তথ্য মতে, সম্প্রতি গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ৫ দশমিক ৩ ভাগ। তেলভিত্তিক উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সংস্কার করলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আবশ্যকতা দেখা দিত না বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুতের মাত্রাতিরিক্ত অপচয়, চুরি, দুর্নীতি বন্ধ করে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব ছিল। কিন্তু সরকার সে পথে অগ্রসর হয়নি বরং সাধারণ মানুষের পকেট কাটার জন্যই বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। যা গণদুর্ভোগ সৃষ্টি করবে বলেই সংশ্লিষ্টদের ধারণা। মূলত দেশের বিদ্যুৎ সেক্টরে সময়োপযোগী ও যুতসই পরিকল্পনার অভাবে এই সেক্টর ক্রমেই রুগ্ন হতে শুরু করেছে। কয়েকটি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে প্রচুর অর্থের অপচয় হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকেই। যা গরিবের ‘ঘোড়ারোগ’ হিসেবেই গণ্য করা হচ্ছে। উচ্চ মূল্যের তেলভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বন্ধ না করে বছরের পর বছর চালু রেখে এর বোঝা জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে প্রায় সকল মহল থেকেই অভিযোগ উঠেছে। মূলত বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম এখন নিম্নমুখী। ফলে তেলভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাওয়ার কথা। এমনি পরিস্থিতিতে তড়িঘড়ি করে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি কেউই যুক্তিযুক্ত মনে করছেন না বরং সরকারের এই সিদ্ধান্তকে দায়িত্বহীন বলেই মনে করা হচ্ছে। সম্প্রতি বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করে খুচরা পর্যায়ে গড়ে ৫.৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের এই বাড়তি বিদ্যুতের দাম গত মাস থেকেই কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। নতুন দরে খুচরা পর্যায়ে ইউনিট প্রতি ৫.৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭.১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাইকারি পর্যায়ে ৮.৪ শতাংশ বৃদ্ধি করে প্রতি ইউনিটে দাম রাখা হয়েছে ৫.১৭ টাকা। সেচ কাজে খুব বেশি খরচ বাড়ছে না। দেশের সার্বিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচক, প্রবৃদ্ধিসহ নানা দিক বিবেচনায় এ মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে সরকার সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন। কিন্তু সরকার বিষয়টি যত সহজভাবে বলছে বাস্তবতা কিন্তু তত সহজ নয়। কারণ, নতুন করে এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে জনজীবনে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা সামাল দেয়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য মোটেই সহজসাধ্য হবে না। মূলত গত বছরের জুনের শেষে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দুই মাসের মাথায় বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ানোর জন্য বিইআরসিতে প্রস্তাব পাঠাতে শুরু করে বিতরণ কোম্পানিগুলো। ২০১৯ সালের ২৮ নভেম্বর থেকে রাজধানীর ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) অডিটোরিয়ামে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) পাইকারি বিদ্যুতের দাম ২৩ দশমিক ২৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল। বিপরীতে ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়ানোর প্রয়োজন বলে মন্তব্য করে কমিশনের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। এর আগে ২০১৭ সালের নভেম্বরে পাইকারি বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৫ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ায় সরকার। যা সে বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে কার্যকর হয়। এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে আবাসিকে মাসে ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের খরচ বাড়ে ১৫ টাকা, ১৫০ ইউনিটে ৪৮ টাকা, ২৫০ ইউনিট পর্যন্ত ৯০ টাকা, ৪৫০ ইউনিট পর্যন্ত ১৯৬ টাকা এবং ১০০০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারীদের খরচ বাড়ে ৬০৪ টাকা। আমাদের দেশে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি একটি চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে বিদ্যুতের ওপর দিয়ে যত চোট গেছে অন্যক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যায়নি। বর্তমান সরকারের আমলে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এমনিতেই দেশের বাজার পরিস্থিতি চরমে উঠেছে। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লেও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। ধান ও চালের দামের মধ্যে কোন ভারসাম্য নেই। সবজির দাম সাধারণের নাগালের বাইরে অনেক দিন থেকেই। আর পেঁয়াজের মূল্য তো ইতোমধ্যেই বিশ্ব রেকর্ড করে ফেলেছে। কিন্তু সেদিকে খেয়াল না করেই ঘন ঘন বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জন্য মোটেই স্বস্তিদায়ক নয় বরং সাধারণ মানুষকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে বিদ্যুৎ খাতে লোকসানের কথা বলা হলেও তা সরকার পক্ষ ছাড়া বাস্তবসম্মত বলে মনে করছেন না কেউই। কর্তৃপক্ষের দাবি, বর্তমানে ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে ঘাটতি থাকায় প্রতি ইউনিটে ৩ শতাংশ হারে লোকসান দেয়া হচ্ছে। শুধু ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। বর্তমানে প্রতি ইউনিট পাইকারি বিদ্যুতের গড় সরবরাহ ব্যয় ৫ টাকা ৫৯ পয়সা। অথচ ২০১৬-১৭ অর্থবছরের হিসাবে পিডিবি পাইকারি পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৪ টাকা ৮৭ পয়সায় বিক্রি করে। এতে দেশের একক পাইকারি বিদ্যুৎ ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান পিডিবির ইউনিট প্রতি আর্থিক লোকসান ৭২ পয়সা। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে পিডিবি পাইকারি বিদ্যুতের প্রাক্কলিত সরবরাহ ব্যয় ধরেছে ইউনিট প্রতি ৫ টাকা ৯৯ পয়সা। এ হিসেবে ইউনিট প্রতি লোকসান হবে ১ টাকা ৯ পয়সা। এই বিপুল আর্থিক ক্ষতি সমন্বয় করার জন্যই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো উচিত বলে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। অন্য দিকে ভোক্তা ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলে মত দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেসব ব্যয় বিবেচনা করে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে সেগুলোর কোন ভিত্তি নেই বরং প্রায়ই অজুহাত মাত্র। আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি দামে তেল কিনে, ভর্তুকিকে লোন বিবেচনা করে ও ব্যয়বহুল জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে রাজস্ব ব্যয় বাড়িয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। যা জনগণের সাথে প্রকারান্তরে প্রতারণার শামিল। তাদের মতে, বাড়তি ও অযাচিত ব্যয় বাদ দিলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিবর্তে কমানো সম্ভব। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে ইতিবাচক নয়। মূলত বিদ্যুৎ খাতে লোকসান কমানোর উদ্দেশ্যে বারবার গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর যুক্তি মোটেই গ্রহণযোগ্য করে তোলা সম্ভব হয়নি। সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিদ্যুতের বিল বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা অনাদায়ী রয়ে গেছে। সেসব অর্থ আদায় করে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা কেনো নেয়া হয় না বলে অভিযোগও রয়েছে। এমতাবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সাধারণ মানুষকে বাড়তি অর্থনৈতিক চাপে ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ নতুন বছরের শুরুতেই অভিভাবকদের ওপর সন্তানদের পড়াশোনা বাবদ এমনিতেই বাড়তি খরচের চাপে পড়তে হয়। বিদ্যুতের বাড়তি দাম এর সাথে সংযুক্ত হলে তা বহন করা আরো কষ্টকর হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে। সুতরাং এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোকে যৌক্তিক বলে মনে করছেন আত্মসচেতন মানুষ। সরকারের পক্ষে অনেক চটকদার কথা বলে ২০১৭ সালে ষষ্ঠ দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সে বছর ৬ জুন পিডিবি বিইআরসির কাছে পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর একটি প্রস্তাব পাঠায়। প্রস্তাবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি হিসেবে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। বলা হয় বিদ্যুতের পাইকারির বিক্রয়মূল্য প্রতি ইউনিট ৪.০২ টাকার বিপরীতে ২০১২-১৩ অর্থবছরে সম্ভাব্য সরবরাহ ব্যয় ইউনিট প্রতি ৬.৮৭ টাকা হবে ফলে ঘাটতি হবে ইউনিট প্রতি ২.৮৫ টাকা। এই ঘাটতি কমানোর জন্যই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় পিডিবি। বিইআরসি এ বিষয়ে কথিত গণশুনানি শেষে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ২১.৮৯ শতাংশ বা ইউনিট প্রতি ৮৮ পয়সা বাড়ানোর সুপারিশ করে। উৎপাদন ও বিক্রয় মূল্যের মধ্যে ঘাটতি থাকলেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যৌক্তিক কি না সেই বিতর্কে যাওয়ার আগে দেখা দরকার উৎপাদন মূল্যের এই বৃদ্ধির কারণ কী এবং তা কতটা যৌক্তিক। পিডিবির প্রস্তাবনা থেকে দেখা যায় ২০১০-১১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের ব্যয় ছিল প্রতি ইউনিট ৪.২০৫ টাকা, ২০১১-১২ সালে ছিল ৫.৪৭০ টাকা এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে দাঁড়াবে ৬.৮৭ টাকা। পিডিবির মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবনাতেই স্পষ্ট বলা হয়, তরল জ্বালানির ব্যবহার, বেসরকারি খাত হতে বিদ্যুৎ ক্রয় এবং জ্বালানি ব্যয়ের অংশ বৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু পিডিপির এই দাবি ভোক্তা পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি বরং তা জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। জনশ্রুতি রয়েছে যে, দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে মূলত ডেসকো, ডিপিডিসি, পল্লী বিদ্যুৎ ও পিডিবি এবং বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে দুর্নীতি করার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত সাত বার পাইকারি এবং খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু জনগণের আর্থিক সামর্থ্য বাড়ানোর সরকারের কোন কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি। এমনিতেই দেশে নেই কর্মসংস্থান, সাধারণ মানুষের উপার্জন বাড়েনি ঠিক এ মুহূর্তে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি নিঃসন্দেহে গণদুর্ভোগ সৃষ্টি করবে। মূলত বিদ্যুতের দাম বাড়ানোকে একমাত্র সরকার পক্ষ ছাড়া অন্য কেউই যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য মনে করছেন না। সংসদের বাইরের বিরোধী দলগুলোর পক্ষে এই দাম বাড়ানোর কঠোর সমালোচনা করা হচ্ছে। এমনকি সংসদে বিরোধী দলও এই মূল্য বৃদ্ধির সমালোচনা করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও জনগণের পকেট কাটার জন্য আবারো বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। যেখানে বিদ্যুতের দাম কমানোর কথা, সেখানে আগের তুলনায় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ দাম বৃদ্ধির ঘোষণা আসায় এখন বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিটে বাড়বে ৩৫ পয়সা। যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর নিঃসন্দেহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। মূলত সরকারের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণেই ব্যাংক, বীমা, শেয়ার বাজারসহ সব অর্থনৈতিক খাত এখন প্রায় ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। সরকারও অনেকটা ঋণনির্ভর হয়ে পড়েছে। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো এখন দেউলিয়া হতে বসেছে। বৈদেশিক শ্রমবাজারসহ বৈশি^ক বাণিজ্যেও আমরা খুব একটা সুবিধা করতে পারছি না। এমতাবস্থায় বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধিকে কেউই পরিণামদর্শী ও যৌক্তিক মনে করছেন না। মূলত বারবার বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বিপাকে পড়ছে সীমিত আয়ের মানুষ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। শিল্প খাতেও পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। এমনিতে সরকারের ভ্রান্তনীতির কারণে দেশে বিনিয়োগে ভাটির টান পড়েছে। ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে চলছে মন্দাভাব। এমতাবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর অর্থ বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করার শামিল। এতে গোটা অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রতিযোগী মূল্যে শিল্প উৎপাদন সক্ষমতা ব্যাহত হবে বলেও অভিজ্ঞমহলের ধারণা। এ ছাড়া বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পগুলো, রফতানি সক্ষমতা, শিল্প বহুমুখীকরণ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি ব্যবসায় পরিচালনা ব্যয় বাড়বে। ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান কমবে। দেশে জ্যামিতিক হারে বাড়বে বেকারত্ব্। যা সামাল আমাদের ভঙ্গুর অর্থনীতির জন্য খুব একটা সহজ সাধ্য হবে না। এমনিতেই এশিয়ার সবচেয়ে বেশি বেকারত্বের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। একই সাথে শিল্পে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলে বাড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যও। বর্তমানে নিত্যপণ্যসহ সব কিছুর দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষ দিশেহারা। তার ওপর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর মাশুলও দিতে হবে নিম্ন আয়ের মানুষদের। কৃষি খাতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। এর ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে। নতুন করে বিদ্যুতের এই দাম বাড়ায় কৃষি ও শিল্প খাত ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। নতুন করে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে প্রতি মাসে নতুন করে বাড়তি টাকা গুনতে হবে ভোক্তাদের। এতে জীবনযাত্রার ব্যয় যেমন বাড়বে, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যসহ শিল্প খাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যৌক্তিক হয়নি। গণশুনানিতে ব্যবসায়ী, বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষ দাম না বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের যৌক্তিকতাও কোনোভাবেই প্রমাণিত হয়নি। দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি যে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় যে বিরূপ প্রভাব পড়বে তা পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি সাময়িক। তার ভাষায়, উৎপাদন খরচ মিলিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে আরো আধুনিক ও আপনাদের কাছে সহজলভ্য করার জন্য বিদ্যুতের দাম কিছুটা বাড়ানো হচ্ছে। তারপরও বিদ্যুতের উপর সরকারকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। এই ভর্তুকি কমানোর জন্য, বিদ্যুৎ উৎপাদন করার জন্য সাময়িকভাবে দাম বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয়ের কথায় কেউই আশ্বস্ত হতে পারছেন না। অতীত পরিসংখ্যান মন্ত্রী মহোদয়ের কথার অনুকূলে যায় না। সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাতীয় সংসদে তথ্য প্রকাশ করে বলেছেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বিগত ১০ বছরে ৬ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে ২০১১ সালে দুইবার এবং ২০১২, ২০১৪, ২০১৫ এবং ২০১৭ সালে একবার করে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। সর্বশেষ চলতি মাসে বিদ্যুতের দাম সপ্তম দফায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু বিদ্যুতের দাম কমার রেকর্ড এখন পর্যন্ত নেই। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীও জাতীয় সংসদে জোরালোভাবেই জানিয়েছেন, বিদ্যুতের দাম কমার কোন সম্ভবনা নেই। মূলত সেতুমন্ত্রী ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর কথার মধ্যে কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বরং সেতুমন্ত্রীর বক্তব্যকেই অযৌক্তিক মনে করা হচ্ছে। তাই আগামী দিনে বিদ্যুতের দাম কমবে এমন কথায় কারো কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না বরং দেশের বিদ্যুৎ খাতে অনাকাক্সিক্ষত নৈরাজ্য সৃষ্টিরই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যা কারো কাম্য নয়। লেখক : কলামিস্ট ও কথাসাহিত্যিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির