post

বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ আমাদের ২৮ অক্টোবর

০৭ অক্টোবর ২০১১
ড. মু. শফিকুল ইসলাম মাসুদ পল্টন মোড়ে তীব্র উত্তেজনার মাঝেও রীতি অনুযায়ী জনসভা শুরু করার ক্ষেত্রে কোন ব্যাঘাত ঘটেনি। কুরআনের কর্মীরা দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিবেদিত বলেই পেটে তীব্র ক্ষুধা ও পিপাসার্ত বুক নিয়ে অতন্দ্রপ্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজপথে। তেলাওয়াতের প্রতিধ্বনি ক্ষুধা আর পিপাসার রাজ্যে যেন নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে। মাত্র দশ হাত দূরে হায়েনাদের মরণছোবল আর ঠিক তার পাশেই পিনপতন নীরবতায় তেলাওয়াতের মাধ্যমে জনসভা শুরু দেখে বুক ভরে গেল। আল্লাহর পক্ষ থেকে নেয়ামতের মত কে যেন একজন এই বিরাট ডামাডোলের মধ্যে কিছু খাবার নিয়ে এলো যা প্রয়োজনের চেয়ে খুবই নগণ্য। কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার! মনে হলো প্রত্যেকেই প্রচণ্ড রকম ক্ষুধার্ত থাকার পরও নিজে না খেয়ে অপর ভাইকে খেতে দেয়ার এক অন্য রকম প্রতিযোগিতা। একে একে সবাই পেট পুরে খেল অথচ কী বরকতময় খাবার! যেন তা কখনো শেষ হওয়ার নয়। পানি দিয়ে কেউ পিপাসা নিবারণ করছেন, কেউবা ক্ষত-রক্তাক্ত স্থানে দিয়ে একটু শরীরটা ঠাণ্ডা করার অবকাশ পাচ্ছেন। চরম শত্র“কে বন্ধু করে নেয়ার এক বাস্তব নমুনা চোখের সামনে পড়তেই চোখ পানিতে ভিজে গেল। একটু আগে যে পুলিশ আমাদের নিরপরাধ নিরস্ত্র কর্মীদের দিকে তেড়ে আসছিল, ছুড়ে মারছিল কাঁদানে গ্যাস- শিবিরকর্মীরা নিজেরা খেতে না খেতেই সমান ভাগে ভাগ দিল আমাদের অদূরে অবস্থানরত পুলিশ ভাইদের জন্য। প্রথমে পুলিশের ভাইয়েরা খানিকটা অবাক হয়ে নিতে রাজি হচ্ছিল না। পরে দায়িত্বশীল ভাইদের অনুরোধে তৃপ্তির সাথে সবাই খেয়ে নিলেন। মনে হলো এই পুলিশ এবং এই দেশ আমাদের রাষ্ট্রের সম্পদ একে রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরও আছে। দেশপ্রেমের নমুনা জীবন বিপন্ন হবার মুহূর্তেও তাই বিলুপ্ত হয়নি হৃদয় থেকে। কিন্তু হায়েনারা হিংস্র পশুকেও হার মানালো। জনসভা শুরু হতে না হতেই পাশের চারতলা বিল্ডিং থেকে সোজা জনসভার মহাসমুদ্রের মাঝে শক্তিশালী বেশ কিছু বোমা ছুড়ে মারল। মনে হলো অনেকেই মারা যাবেন। কিন্তু আল্লাহর কী অপার করুণা তার বান্দার জন্য! বোমার বিকট আওয়াজ আর ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার হয়ে গেলেও আমাদের ভাইয়েরা ধীরস্থিরভাবে ঠিক তার পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন, যেন কারোরই কিছু হয়নি। তার ঠিক কিছু পরেই শুরু হলো বন্দুক দিয়ে গুলি ছোড়া সেই একই স্থান থেকে। আমরা বন্দুকের গুলি দেখতে পাচ্ছি কিন্তু কোন এক শক্তির ইশারায় কোথায় এসে যেন তা ব্যর্থ  হয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখনও ইস্পাতকঠিন অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের কুরআনপ্রিয় কর্মীরা। আমরা বুঝতেই পারছিলাম শত্র“ পক্ষের এটা মরণ কামড়। এখন তারা দুর্বল হয়ে এসেছে। আর আমাদের জনসভাও আজ সফল প্রায়। শ্রদ্ধেয় আমীরে জামায়াতও অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় দেশ ও জাতির উদ্দেশে লাখো জনতাকে সামনে রেখে এই উত্তেজনার মাঝেও এমনভাবে বক্তব্য রাখলেন, যেন এই পল্টনে কিছুই ঘটেনি। বক্তব্য শুনে মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। মঞ্চ থেকে নেমে এলে বিডিআর উভয় পক্ষকে মাঠ ছেড়ে দিতে বললে আমরা জনসভা সফল হয়েছে ভেবে সবাইকে বিদায় করে অফিসের দিকে ফিরে যেতেই একজন এসে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদতে শুরু করলো। আমাদের প্রিয় মুজাহিদ ভাই আর নেই। তাকে ফিরিয়ে দিন মাসুদ ভাই।  সান্ত্বনা দেয়ার কোন ভাষা খুঁজে পেলাম না। শহীদ মুজাহিদ দেশের জন্য আল্লাহর দ্বীনের জন্য জীবন দিয়েছেন। আল্লাহ তাকে কবুল করেছেন এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কি আছে। আল্লাহ তো আমাদের মত গুনাহগারদের কবুল করলেন না। এতটুকু ছাড়া আর কিছুই বলার ছিল না আমার। ইবনে সিনা হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে গিয়ে দেখলাম এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। যেন পাঁচ-জনের জনের ক্ষত-বিক্ষত লাশ পড়ে আছে। ডাক্তার বললেন, কোন আশা নেই যদি আল্লাহর কোন ফায়সালা থাকে তা ভিন্ন। খুব কষ্টে কান্না থামিয়ে রাখলাম। পাশের রুমের এক মারাত্মক আহত ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে হাত তুলতেই কান্না আর ধরে রাখতে পারলাম না। জ্ঞান ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আমরা সবাই মিলে কাঁদলাম সেই ভাইটির জন্য, কী অবিশ্বাস্য! পাশের আরেকটা রুমে গিয়ে আহত রেজাউল করিম ভাইয়ের সাথে কথা বলছি, এমন সময় সেই রুমের ভাইটি গিয়ে আমাকে বললেন, যার জন্য দুআ করেছেন, সে আপনার সাথে কথা বলতে চায়। গিয়ে দেখলাম সত্যি নড়াচড়া করছে, হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে হাত মেলানোর জন্য। প্রাণভরে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। ইতোমধ্যেই আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন শহীদ মুজাহিদ, প্রিয়ভাই সাইফুল্লাহ মুহাম্মদ মাসুম ও প্রিয়ভাই শিপন। জানাজা হওয়ার কথা ছিল আমাদের প্রিয়ভাই আমানেরও। আল্লাহ আমাদের আবেদন শুনলেন। ফিরিয়ে দিলেন আমানকে আমাদের মাঝে। ডাক্তারদের কথা মতো তৎকালীন আমীরে জামায়াতকে চারজনের জানাজার কথা বলেছিলাম। কিন্তু আল্লাহর করুণা যে, আমাদের মুনাজাত তিনি শুনলেন। হাসপাতাল থেকে অফিসে ফিরে যেতে মক্কা থেকে ফোন করলেন একজন ভাই। বললেন, ঘাবড়াবেন না আমরা কাবার গিলাফ ধরে আপনাদের জন্য সেই ঘটনার পর থেকে দুআ করছি, আল্লাহ আপনাদের সাহায্য করুন। হৃদয়টা ভরে গেল, মনে হলো আমরা একা নই। আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন এবং আমরাই বিজয়ী হবো। সত্যি আল্লাহ আমাদের বড় বিজয় দিয়েছেন। ২৮ অক্টোবর আমাদের জন্য একটা দিন শুধু নয়। এ দিনটি আমাদের জন্য প্রেরণার এটি অনেক বড় শেখার এক মুহূর্ত। বদরের প্রান্তরে আমরা ছিলাম না ঠিক, কিন্তু অন্য রকম এক বদর পেয়েছি আমাদের জীবনে, যা সুদূরপ্রসারী এক জীবন্ত নমুনা হয়ে থাকবে সকল সঙ্কটে, বিজয়ে আর জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে। ২৮ অক্টোবর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগেই এক ভয়ঙ্কর নারকীয় কাণ্ডের কর্মসূচি ঘোষণা করে বসল আওয়ামী লীগ। টেলিভিশনের পর্দা কাঁপিয়ে আঙুল নাচিয়ে নাচিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন এক ফর্দ দাবি। সে দাবি পূরণ না হলে বন্ধ করে দেবেন রাজপথ এবং ড. ইয়াজউদ্দিন ও এম এ আজিজকে ভাতে-পানিতে মারবেন বলে ঘোষণা দিলেন তারা। বাজারের ইট-মারা ছিঁচকে রাজনৈতিক কর্মীরা ঘোষণা করল, তারা কাঁচাবাজার সরবরাহ করবে না তাদের। যেন তাদের সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার। শেষ পর্যন্ত তারা ঘোষণা করলেন দাবি না মানলে বঙ্গভবনে অক্সিজেন সরবরাহও বন্ধ করে দেবেন। খোদার ওপর খোদাগিরির কর্মসূচি! আল্লাহ তায়ালার আসমানে যেখানে বায়ুর প্রবাহ আছে, সেখানে প্রাণীর বেঁচে থাকার অক্সিজেনের সরবরাহ আছে। আল্লাহর আসমানের বায়ুপ্রবাহ থেকে তারা ছেঁকে তুলে নেবেন অক্সিজেন। নিঃশ্বাস বন্ধ করে অক্সিজেনবিহীন চেম্বারে হত্যা করবেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতিকে। কী ঔদ্ধত্যপূর্ণ কর্মসূচি ছিল তাদের। আর শেখ হাসিনা ঘোষণা করলেন, লগি-বৈঠা নিয়ে আওয়ামী লীগ কর্মীরা দলে দলে চলে আসবে রাজধানীতে। তারা লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করবে জোট সরকার সমর্থকদের। এ কর্মসূচি নিয়ে কোনো রাখ-ঢাক ছিল না। রাতারাতি ফুটপাথের ফার্নিচারের দোকানগুলোতে অর্ডার গেলো লগি-বৈঠা তৈরির। তারা সকল কাজ ফেলে লেগে গেল বৈঠা-লগি তৈরিতে। মানুষ মারার হাতিয়ার তৈরি ও গণহত্যার উসকানি দেওয়ার মত কর্মসূচি। এ কথা শেখ হাসিনা যত বললেন তার পরিষদরা বললেন তা শত গুণে। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী মাস্তান, খুনি, লুটেরা কর্মীরা নতুন নতুন বৈঠা নিয়ে এসে হাজির হলেন রাজধানী ঢাকায়। লক্ষ্য জোট সরকারের সমর্থকদের সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করা। তারপরের ঘটনা দূর অতীতের স্মৃতি নয়, ২৮ অক্টোবর ২০০৬ রাজপথে নেমে এল সবাই। বিএনপি নয়া পল্টনে তাদের অফিসের সামনে, জামায়াত পুরানা পল্টন এলাকায়, আর বিবি এভিনিউতে আওয়ামী লীগ অফিস এলাকায় তাদের কর্মীরা। সে অবস্থান নিতে কোন দোষ ছিল না, যদি না তা শান্তিপ্রিয় হতো। সরকার ঘোষণা করেছিল, লগি-বৈঠাসহ কোনো লাঠিসোটা বা আঘাত করার উপযুক্ত কিছু বহন করতে পারবে না কেউ। শুনল না আওয়ামী লীগ ও তাদের মোসাহেবরা। তারপর পল্টন এলাকায় আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাদের নেতাদের নির্দেশে যে ঘটনা ঘটালো, তাতে শঙ্কিত হয়ে গেল গোটা বাংলাদেশ। শত শত স্টিল ও ভিডিও ক্যামেরার সামনে তারা অকারণেই আক্রমণ করে বসল একজন নিরীহ যুবককে। হেঁটে আসছিল সে। সাধারণ, নিরীহ, নিরস্ত্র, সুদর্শন এক যুবক। হাঠৎ কয়েকজন লগি-বৈঠাধারী সন্ত্রাসী তার ওপর আক্রমণ করে বসল। লগি- বৈঠার হামলা। সটান পড়ে গেল সে যুবক। ক্ষত বিক্ষত দেহ। তার ওপরই তারা আঘাত করতে লাগল লাঠি-বৈঠা দিয়ে। মৃত্যু নিশ্চিত করেও থামেনি তারা। সেই লাশের ওপর উঠে  পৈশাচিক উল্লাসে লাফাতে শুরু করল লগি-বৈঠাধারীরা। প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি কেউ। কিন্তু টেলিভিশনের সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানে এক আতঙ্কিত রিপোর্টার অশ্র“রুদ্ধ কণ্ঠে বলছিলেন, লগি- বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে এই মাত্র হত্যা করা হলো একজন নিরীহ যুবককে, যেন তারা পিটিয়ে সাপ মারছে। এই লোমহর্ষক হৃদয়বিদারক ঘটনা যে শুধু পল্টনেই ঘটালো, তা নয়। ঘটল আরো একাধিক স্পটে। মৃত্যু নিশ্চিত করে থামলো লগি- বৈঠাধারী শেখ হাসিনার সোনার ছেলেরা। ২৮ অক্টোবর যখন কিছু কিছু চ্যানেলে হত্যা অত্যাচার ও নির্যাতনের এই মর্মান্তিক দৃশ্য বারবার সম্প্রচার হচ্ছিলো মনে হচ্ছিলো এসব প্রচারমাধ্যম তাদের সমর্থনপুষ্ট বাহিনীর বিজয়গাথা প্রচার করছেন, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এসব অসহনীয় দৃশ্য দেখানোর মাধ্যমে তারা চেয়েছিলেন জনগণকে জামায়াত-শিবির করার পরিণতি স্মরণ করিয়ে দিতে, তরুণদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে। সেদিন কিন্তু তারা ভেবেই উঠতে পারেননি প্রচারযন্ত্র তার নিরপেক্ষতা ঠিকই বজায় রেখেছে অত্যাচার নির্যাতন-নির্মমতার জ্বলজ্যান্ত দলিল হয়ে গেছে এসব কিন্তু যদি ঘটনা হতো উল্টো তাহলে এই প্রচারমাধ্যমই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এক জঘন্য প্রচারযুদ্ধে নেমে যেতো জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে। ১. প্রথমেই তারা এই নিষ্ঠুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের সব দায়-দায়িত্ব জামায়াত-শিবিরের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতো। প্রথমে হামলা কারা কিভাবে করেছে তা চেপে গিয়ে প্রতিহামলার এপিসোড দিয়ে ঘটনার সূচনা দেখাতে মোটেও ভুল করতো না। ২. তারপরই শুরু করতো জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে একাত্তরের প্রসঙ্গে তুলে অন্যরকম প্রচারণা। অতীতের সব অপপ্রচারকে নতুন করে সম্প্রচার করা হতো। এক তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে বসতো তারা। ৩. এরপর শুরু হতো ঘটা করে টক-শো, সাক্ষাৎকার, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর নতুন এক যুদ্ধের আয়োজন। অবাক হওয়ার বিষয় হলো- এসব অপপ্রয়াস নিতে তারা এরপরও ভুল করেননি। কিন্তু মিথ্যাকে পুঁজি করে কতদূর যাওয়া যায়? ৪. যদি আমাদের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দক্ষ কারিগরদের সততা ও সাহস আরো বৃদ্ধি করে বিনয়ের সাথে অনুরোধ করবো আসুন না একবার সাহসী হয়ে প্রকৃত সত্যটিকে আরো একবার প্রকাশ করি। হাস্যকর হলো কোন কোন বুদ্ধিজীবী ও নেতা ২৮ অক্টোবরের লগি-বৈঠার হামলাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে মুক্তিযুদ্ধে ‘যার যা আছে তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার’ সাথে তুলনা করেছেন। হায়রে মুক্তিযুদ্ধ! হায়রে তুলনা! হায়রে আমাদের বিবেক! তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের পাল্লায়ে দেশ আজ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের করদরাজ্যে পরিণত হতে চলছে। ৫. প্রিন্ট মিডিয়ায় পরদিন থেকে যেসব সাফাইমূলক প্রবন্ধরাজি ছাপা হয়েছে তা  দেখে মনে হয়নি আমরা কোন সুস্থ সমাজে বসবাস করছি। আমাদের কলমজীবীরা বুঝেন না কলম থাকলেই যা তা লেখা যায় না, আর যাচ্ছে তাই কিছু লেখলেই তা লেখা হয়ে যায় না, অন্তত পাঠকের সেই অন্ধত্ব ও চোখ বুজে গ্রহণ করার দিন শেষ হয়ে গেছে। এ নৈরাজ্য পিপাসু দলটিকে কিভাবে জাতি গ্রহণ করতে পারে? এ বর্বরতা সৃষ্টিকারী দল দেশ ও জাতির জন্য কী ভয়াবহ অভিশাপ! এ দলের সাথে কোন সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষ কিভাবে স¤পৃক্ত হতে পারে? এদের অতীত ইতিহাস আর বর্তমানের নাটোরসহ সারাদেশের বর্বর, পৈশাচিক ও হিংস্র কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে এদের কোন পরিবর্তন হয়নি, হবেও না। এদের অস্তিত্ব দেশ জনগণ ও সার্বভৌমত্বের জন্য এক বিপর্যয়ের অশনিসঙ্কেত। ১৯৭১-৭৫ ও ১৯৯৬-২০০১ এবং তৎপরবর্তী সময় নতুন করে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আজ  পর্যন্ত তাদের অপশাসনের ইতিহাস বিশ্বকোষের কয়েক ভলিউমে সঙ্কলন হবে না। তাদের কর্মকাণ্ডের করুণ কিছু চিত্রের নমুনা নিম্নরূপ :
  •     বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা, সন্ত্রাস ও হত্যার সূচনা করে।
  •   বাংলাদেশের গণতন্ত্র গলাটিপে হত্যা করে বাকশাল কায়েম করেছিল।
  •   দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে দেশকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছিল।
  •     সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করে গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল।
  •    শিল্প, কল-কারখানা বন্ধ করে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার করেছিল।
  •    লাল বাহিনী, রক্ষীবাহিনী, শেখ বাহিনী সৃষ্টি করে লুটপাট, অত্যাচার নির্যাতনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল।
  •   দেশকে পার্শ্ববর্তী দেশের তাঁবেদার দেশে পরিণত করেছিল, এদের সময় কলকতার এক সভায় আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীকে দুইবার মুখ্যমন্ত্রী বলা হয়েছিল।
  •    তারাই বাংলাদেশকে পানি বণ্টনের অসম চুক্তি করে দেশকে মরুভূমিতে পরিণত করার ব্যবস্থা করেছিল।
  •   দেশের মূল অংশ ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিল।
  •   দেশে ১৯৭৪ সালে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করে লাখ লাখ মানুষ হত্যা করেছিল।
  •   এরাই জাসদের হাজার হাজার প্রতিবাদী কর্মীদের রাজনৈতিকভাবে খুন করেছিল।
  •   জাতীয় সংসদের পবিত্র স্থানে ঝঢ়বধশবৎ হত্যার ভয়াল অপরাধ সংঘটিত করেছিল তারাই।
  •   দেশের অগণিত প্রতিষ্ঠান দলীয়করণের ও পারিবারিক করণের নির্লজ্জ ঘটনা সূত্রপাত তাদেরই আমলে।
  •  পার্বত্য চুক্তি সম্পাদন করে হাজার হাজার বাঙালি হত্যাকারী ভারতীয় মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের স্বার্থরক্ষার্থে দেশের সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট করেছিল।
  • সৃষ্টি করেছিল গত ২৮ অক্টোবর ’০৬ লোমহর্ষক, বর্বর, পৈশাচিক ও মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড।
  •    ২০০৯ সালের বিডিআর হত্যাকাণ্ডের নির্মমতা তাদেরকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধই করেনি বরং জনগণের বিবিকের আদালতে তারা আজ আসামির কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান।
  •   নাটোরে প্রকাশ্য দিবালোকে উপজেলা চেয়ারম্যান বাবু হত্যাকাণ্ডের নির্মম দৃশ্য আজকের নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের নতুন উপহার।
অপরাধীদের ক্ষমা করার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার আহবান জানালেন বর্তমান সরকারের খোদ আইনমন্ত্রী। আমরা ধন্যবাদ জানাই তাকে, কিন্তু ২৮ অক্টোবরের ঘটনায় জড়িতদের বিচার না করে শুধু ক্ষমা নয় সে সকল অপরাধী আজ বর্তমান সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে লালিত। আমরাও বিশ্বাস করি হত্যাকারীদের প্রতি ক্ষমাশীল ও আপসকামীরা হত্যার সহযোগী। এদের প্রতি করুণার অর্থ হত্যা ও খুনকে পৃথিবীতে লালন করার শামিল। সকল দেশে ও সমাজে হত্যাকারীদের শাস্তির বিধান লিপিবদ্ধ রয়েছে। ইহা মানবতার দাবি ও মৌলিক অধিকারের দাবি। প্রকাশ্য দিবালোকে লগি- বৈঠা দিয়ে, অস্ত্র উঁচিয়ে মানুষ খুন করল যারা, যাদেরকে সহজে শনাক্ত করা যায়, ক্যামরার ফুটেজে রয়েছে তাদের জঘন্য চেহারা আর হাতে অস্ত্র তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচার না করার মানে হত্যা ও খুনকে উসকে দেয়ার মত অপরাধ। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের প্রথম দায়িত্ব মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করা। রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীল এবং তৎকালীন   সেনাপ্রধান পর্যন্ত ২৮ অক্টোবর ’০৬ এর নৃশংস হত্যার নিন্দা করেছেন। কিন্তু ইহাই কি শেষ। হত্যাকারীদের এ আশকারা দান মানবতার প্রতি ও বিবেকের গালে চপেটাঘাত তুল্য। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে আজ জোরালো  আওয়াজ  শোনা যাচ্ছে। বহুদিন পর হলেও আমাদের ক্ষীণ কণ্ঠে যে আওয়াজ ধ্বনিত হয়েছিল তা আজ গোটা জাতির কণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত। আমার কাছে দুর্নীতিমুক্ত সমাজের আগে প্রয়োজন খুনমুক্ত সমাজ ও বিশ্ব। হাজার দুর্নীতির সমষ্টি অর্থের অঙ্কে যত বিলিয়ন ডলার হোক না কেন একজন মানুষের খুন ও জীবন এর চেয়েও বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মূল্যবান। জাহেলিয়াত আজ সভ্যতার মুখোশ পরে অভিনয়ে অবতীর্ণ। প্রাচীন অসভ্যতা আবার আধুনিকতার আবরণে মানবতার সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লুণ্ঠনকারীরা নিজেদেরকে বলছে মানবতাবাদী বলে। নারীদের চরিত্র হননকারী ও তাদের সতীত্ব বিনষ্টকারীদের পরিচয় দেয়া হচ্ছে নারী অধিকার আন্দোলনকারী বলে। সমগ্র পৃথিবীব্যাপী সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীরা নাকি শান্তির মহাদূত! আর নিজ দেশের আজাদি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সংগ্রামী ও লড়াকুরা সন্ত্রাসী ও মৌলবাদী! ইতিহাসে এ কঠিন সময় সম্ভবত আর আসেনি। আজকে যারা সত্যের পক্ষে অসত্যের বিরুদ্ধে লড়বে- তাদেরকে সমগ্র ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। মোকাবেলা করতে হবে দেশে দেশে তাদের প্রতিষ্ঠিত ও আশ্রিত তাঁবেদারদের সৃষ্ট নির্যাতন ও জুলুমের হাজার মনজিল। লেখক : সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির