post

বিরোধী দল মোকাবেলায় সরকারি পদক্ষেপ প্রচলিত আইন ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার পরিপন্থী

১২ আগস্ট ২০১১
অ্যাডভোকেট মো: সাইফুর রহমান স্বাধীন রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকার ও বিরোধী দল একে অন্যের পরিপূরক হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে এর ভিন্ন চর্চা লণীয়। জনগণের জানমাল, ইজ্জতের নিরাপত্তা এবং শান্তি শৃঙ্খলা ও সামগ্রিক উন্নতি বিধান সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হলেও মনে হয় সরকার আসল লক্ষ্যে থেকে বিচ্যুত হয়ে বিরোধী দল দমনেই রাষ্ট্রশক্তির অধিকাংশই প্রয়োগে ব্যস্ত। বিষয়টি দুঃখজনক হলেও বর্তমান সরকারের জন্য তা স্বভাবগত। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের লেবাস নিয়ে যতবারই মতায় এসেছে ততবারই অনেক বেশি অগণতান্ত্রিক আচরণই সরকারের মৌলিক কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারসমূহ সরকার একের পর এক ভঙ্গ করছে। জনগণের এই মৌলিক অধিকার হননের মতো অপরাধ থেকে সরকার নিজেকে মুক্ত রাখার জন্য পঞ্চদশ সংশোধনীর মতো কিছু স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংবিধান মানুষের মৌলিক অধিকারের যে গ্যারান্টি দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার তার পরিবর্তন ঘটিয়ে রাষ্ট্রের নাগরিকদের কারাগারে পাঠানোর এক অভিনব কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ গণতন্ত্রের নিয়মনীতির সীমা অতিক্রম করে মূলত সরকার তার নাগরিকদের বিদ্রোহী করে তুলছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ধারা ৩৭ এ প্রদত্ত প্রত্যেক নাগরিকের সমবেত হওয়ার এবং জনসভা করার যে মৌলিক অধিকার স্বীকৃত রয়েছে এবং ধারা ৩৯(১) এ চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। সরকার ভিন্ন কৌশলে তার অনুসারীদের মাধ্যমে মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমা দায়ের করে এবং ঐ সমস্ত মামলা আদালতের মাধ্যমে প্রাপ্ত আদেশের অপ-প্রয়োগ করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে হয়রানির কূটকৌশল অবলম্বন করেছে। এটি অত্যন্ত লণীয় ব্যাপার যে কোন নিম্ন আদালত, আসামির বা যে কোন পরে বিরুদ্ধে যে কোন আদেশ দিলে তা কার্যকর হতে অথবা যথাস্থানে পৌঁছতে কয়েক মাস সময় লেগে যায়। সেখানে মাত্র ৩ ঘণ্টার ব্যবধানে রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে আদালত কর্তৃক গ্রেফতারি পরোয়ানা লাভ করে সরকারি পুলিশ বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করার যে লক্ষণীয় তৎপরতা দেখাচ্ছে সেখানে পুলিশ বাহিনী সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে অতিমাত্রায় সক্রিয় থাকছে। অথচ বড় বড় অপরাধীরা নির্বিঘনো ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিরোধী দল দমনে পুলিশের পাশাপাশি সরকারের বিচার বিভাগকে নিজেদের ইচ্ছামাফিক সক্রিয় করছে। মোবাইল কোর্টের দায়িত্ব একজন ম্যাজিস্ট্রেট যেমনিভাবে ভেজালবিরোধী অভিযানে ভূমিকা রেখে জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারেন তেমনিভাবে একজন ম্যাজিস্ট্রেট সরকারের ইচ্ছামাফিক বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে সরকারের প্রিয়পাত্র হতে পারেন। হরতালের আগে সরকারের দলীয় কর্মীদের তথ্য মতে মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়ে রাস্তায় অবৈধ সমাবেশ বা অবস্থানের অভিযোগ তোলে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি প্রয়োগ করে তাদের কারাগারে প্রেরণের যে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেটগণ স্থাপন করেছেন এবং সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উক্ত ম্যাজিস্ট্রেটদের পে সাফাই গেয়েছেন। এতে প্রতীয়মান হয় চলমান সরকার বিরোধী আন্দোলন দমনে এটি সরকারের অপকৌশল মাত্র যা সরকারের মর্জিমত পরিচালিত হচ্ছে। আইন পেশায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ মোবাইল কোর্টের প্রদত্ত বিরোধী কর্মীদের শাস্তি দিয়ে কারাগারে প্রেরণের অভিনব প্রক্রিয়াকে বেআইনি, অসাংবিধানিক বলে আখ্যায়িত করেছেন। সময়ের ব্যবধানে এই প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে এবং তিগ্রস্ত প নিয়মতান্ত্রিকভাবে তার তিপূরণ পাওয়ার অধিকারী হবেন। বিষয়টি সরকার যথার্থ বিবেচনায় না নিলে আইন ভিন্ন গতিতে পরিচালিত হবে এবং নিয়মতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিবর্তে হিংস্র, উগ্রপন্থী এবং অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ উন্মুক্ত হবে। যা হবে অনাকাক্সিত ও অনিভিপ্রেত। শান্তিপূর্ণ মিছিল, মিটিং এবং মানববন্ধন কর্মসূচি বাংলাদেশের জনগণের চিরাচরিত এবং অতি পরিচিত গণতান্ত্রিক অধিকার। এই অধিকার প্রয়োগে জনগণ অনেক বেশি অভ্যস্ত। বর্তমান সরকার মতায় আসার পর পুলিশের পোশাক পরা অবস্থায় কিছু সংক ব্যক্তি হঠাৎ করে মিছিল-মিটিংয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং মিছিলটি পণ্ড করে নেতাকর্মীদের বেধড়ক লাঠিপেটা করে। পরদিন পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায় পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে পুলিশ মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে এবং শত শত লোকের বিরুদ্ধে মামলা করে। বিষয়টি কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। সংবিধানের প্রদত্ত মৌলিক অধিকার বলে একজন মানুষ অন্যায়, অবিচার ও দুঃশাসন এর বিরুদ্ধে রাজপথে নামতে বাধ্য হয়। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এবং পুলিশ প্রশাসনের অন্যতম দায়িত্ব হলো শান্তিশৃঙ্খলা ও জানমাল রার্থে কার্যকর ভূমিকা রাখা। অথচ পুলিশের কর্তব্য কাজের বাধা দেয়ার অভিযোগে রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। অথচ ঘটনাটি হলো পুলিশ কর্তৃক জনগণের সাংবিধানিক অধিকার পালনে বাধা দেয়া। যে সমস্ত পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে রাজনৈতিক দল এবং তাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অন্যায়, অত্যাচার এবং নির্যাতনমূলক আচরণ করে তাদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। একজন তিগ্রস্ত মানুষ তার মৌলিক অধিকার ও জানমালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণকারী ঐ সমস্ত পুলিশের বিরুদ্ধেও আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী হবেন। হরতাল মোকাবেলায় হরতালকারীদের চেয়ে সরকারি দলের ক্যাডার পুলিশের প্রত্য সহযোগিতা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অবস্থায় এবং পুলিশ প্রটেকশনে রাজপথে মিছিল মিটিং করার যে দৃশ্য জনগণ অবলোকন করেছে এবং হরতাল শেষে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হরতালকারীদের নিয়ে যে উপহাস করেছেন এতে জনগণকে ভিন্ন পথে ভিন্ন কায়দায় সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে অনেক বেশি উৎসাহিত করতে পারে, এতে দীর্ঘদিনের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের যে সংস্কৃতি বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছিল আওয়ামী লীগ বিএনপি শাসনামলের শেষের দিকে লগি-বৈঠা দিয়ে পল্টন হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তাতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। আওয়ামী লীগই একমাত্র দল যারা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিবর্তে হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডকে অনেক বেশি উৎসাহিত করল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ইতঃপূর্বে চট্টগ্রামে লালদিঘির ময়দানে প্রদত্ত বক্তব্য বাংলাদেশের সুশীলসমাজকে অনেক বেশি ভাবিয়ে তোলে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই লাশের পরিবর্তে লাশের কথা বলেছেন। বাংলাদেশের বিরোধী দল দমনে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর যে ন্যক্কারজনক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চালানো হলো তা দীর্ঘদিনের লালিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে বিবেকবান মানুষের প্রত্যাশার তেমন কিছু নেই শুধু প্রচলিত নিয়মনীতি রাজনৈতিক শিষ্টাচারকে সহনীয় পর্যায়ে চলতে দেয়া। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন, গণতান্ত্রিক আচরণ যথার্থ অবস্থানে ফিরিয়ে আনার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে সরকারের দায়িত্বই অনেক বেশি। লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, ঢাকা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির