শাহ্ মোহাম্মদ মাহফুজুল হক#
বিপ্লব শব্দের অর্থ পরিবর্তন, আবর্তন, পরিক্রমণ। সাধারণত বিপ্লব বলতে কোন প্রতিষ্ঠিত নীতি, আদর্শ বা ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে অন্য কোনো নীতি, আদর্শ, কাঠামো বা ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করাকে বোঝায়। ঐতিহাসিক বিপ্লবগুলোর অনুঘটক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পৃথিবীর কোন বিপ্লব বা পরিবর্তন স্বাভাবিক পথে আরাম-আয়েশে কিংবা পুষ্পমালা দিয়ে বরণ করে হয়নি। প্রত্যেকটি বিপ্লব বা পরিবর্তনের ইতিহাস রচিত হয়েছে অসংখ্য বিপ্লবী মানুষের রক্ত-মাংস, আর ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে; হাসিমুখে জীবন বিলিয়ে দেয়ার মাধ্যমে।
একটি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখার কারণে সমাজের সবচেয়ে সৎ, দক্ষ ও নিরপরাধ মানুষগুলোকে শতাব্দীর সেরা মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে বিচারের নামে অবিচার করে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিয়ে মানুষরূপী পশুদের বিজয়োল্লাস, ক্রসফায়ারের নাটক সাজিয়ে পরিকল্পিতভাবে সম্ভাবনাময়ী তরুণদেরকে হত্যা, বাসাবাড়ি থেকে তুলে নিয়ে বø্যাংক পয়েন্ট থেকে গুলি করে কিংবা চোখ উপড়ে ফেলে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়া, মিথ্যা মামলা দিয়ে বছরের পর বছর কারাগারে আটকে রাখা এবং ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়ে বন-জঙ্গলে কিংবা খোলা আকাশের নিচে দিনাতিপাত করতে বাধ্য করা; এই ধরনের অমানবিক নির্যাতন আমাদের নিকট খুবই অপরিচিত হলেও বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে এই ঘটনাগুলো খুবই পুরাতন। পৃথিবীর আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিপ্লবগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দমনপীড়ন চালিয়ে কিংবা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বিপ্লব ঠেকানো সম্ভব হয়নি বরং আরো ত্বরান্বিত হয়েছে।
বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ যাকে সৃষ্টি করা না হলে এই পৃথিবী সৃষ্টি করা হতো না, সেই প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা:) ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত ছিলেন সবার নিকট সবচেয়ে প্রিয়, আল আমিন তথা বিশ্বাসী। কিন্তু চল্লিশ বছর বয়সে যখন তিনি তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করে একটি নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিপ্লবী আহŸান প্রচার শুরু করলেন তখনই তার ওপর নেমে আসে বর্বর নির্যাতন। পাগল, জাদুকর, গণক ইত্যাদি উপাধি দিয়ে উপহাস করা হয়। খানায়ে কাবায় নামাজরত অবস্থায় পশুর নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে কিংবা গলায় কাপড় পেঁচিয়ে করা হয় হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা। দীর্ঘ তিন বছর বন্দী রাখা হয় শিআবে আবু তালেবে। পাগলের মতো ছোট ছেলেদেরকে লেলিয়ে দিয়ে পাথর নিক্ষেপ করে ক্ষতবিক্ষত করা হয় তায়েফের ময়দানে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হত্যা করে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয় হিজরত পূর্ববর্তী রাতে। ঘাতকদের চোখে ধুলা দিয়ে আল্লাহর কুদরতে শত্রæবেষ্টনী ভেদ করে মদিনার পথে রওনা দেয়ার পর ঘোষণা করা হয় শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে আসার জন্য বিশাল অঙ্কের পুরস্কার। পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া হয় সুমাইয়া (রা:), ইয়াসির (রা:), আম্মার (রা:), খোবায়ের (রা:), হামজা (রা:)সহ অগণিত প্রিয় সাহাবীকে। নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করে বাধ্য করা হয় মদিনায় হিজরতে করতে। বদর, ওহুদ, খন্দকসহ ২৭টি যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে এবং ৮২টি যুদ্ধে মহানবী (সা:) পরোক্ষ পরিচালনা করে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে সূচনা করলেন বিপ্লবের সোনালি ইতিহাস। রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন, সিরাত ইবনে হিসাম, মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ (সা:) সহ বিভিন্ন সিরাতগ্রন্থ পড়ার মাধ্যমে এই ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা অর্জন করতে পারি।
বিশ্বজুড়ে সাড়া জাগানো বিপ্লবগুলো পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই যখন যারাই প্রচলিত শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন করে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে পা বাড়িয়েছে তাদেরকেই অমানবিক নির্যাতন, নিষ্পেষণ সহ্য করে দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়েই তা অর্জন করতে হয়েছে।
ফরাসি বিপ্লব
ফরাসি বিপ্লবকে আধুনিক যুগের ভিত্তিমূল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই বিপ্লব বিশ্বব্যাপী এক নবজাগরণের সূচনা করে। এই বিপ্লব ১৭৮৯ থেকে ১৮১৫ সালের মধ্যে সংঘটিত হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে চতুর্দশ লুইয়ের আমল ছিল ফ্রান্সের এক গৌরবময় যুগ। কিন্তু রাজা চতুর্দশ লুইয়ের মৃত্যুর পর থেকে সমগ্র অষ্টাদশ শতাব্দীব্যাপী ফ্রান্সের জাতীয় গৌরব ক্রমেই স্থিমিত হতে শুরু করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ফরাসি বিপ্লব ফ্রান্সের অন্তঃসারশূন্য রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামোর ওপর চরম আঘাত হানে। ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসে পরিবর্তন সূচনা হয় এবং যাজকতন্ত্র ও রাজতন্ত্র পরিবর্তিত হয়ে প্রজাতন্ত্র ও গণতন্ত্রের উত্থান ঘটে, যা আধুনিক বিশ্বের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ফরাসি বিপ্লবের পেছনে জন লক, জ্যা জ্যাক রুশো ও ভলতেয়ার প্রমুখের এনলাইটেড মুভমেন্ট, সামন্ত প্রথা, শ্রেণীবৈষম্য, যাজক ও রাজপরিবারে সদস্যদের দৌরাত্ম্য, শাসক স¤প্রদায়ের সীমাহীন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। ফরাসি বিপ্লবের ক্ষেত্র রচনা করে অভিজাত স¤প্রদায়। আর তা পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে বুর্জোয়া স¤প্রদায়ের বিদ্রোহ ও অভ্যুত্থানে। অবশেষ বিপ্লব সাফল্য লাভ করে সাধারণ জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণে। ঐতিহাসিক গুডউইন মন্তব্য করেছেন, “কৃষকদের অর্থনৈতিক অভিযোগ ও মধ্যবিত্তশ্রেণীর রাজনৈতিক অসন্তোষের তুলনায় অভিজাতশ্রেণীর প্রতিক্রিয়াশীল উচ্চাকাক্সক্ষাই ছিল ফরাসি বিপ্লবের আশু কারণ।” সরকারের আয়-ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে মন্ত্রী ক্যালন অভিজাত ও যাজকদের কৃষি জমির ওপর কর ধার্যের প্রস্তাব দেন। বাড়তি করের বোঝায় শঙ্কিত অভিজাতগণ ক্যালনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে এ অভিজাতগণ রানী অ্যান্টোয়নেটের মাধ্যমে ক্যালনকে পদচ্যুত করতে সমর্থ হয়। পরবর্তীতে তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হন। অভিজাতদের চাপে ও অর্থসঙ্কট মোচনের জন্য ষোড়শ লুই স্টেটস জেনারেল নামক জাতীয় সভার আহŸান করেন। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের এর ৫ মে এর অধিবেশন শুরু হয়। উল্লেখ্য, ১৭৫ বছর পর পুনরায় স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আহŸান করা হয়। পুরাতন বিধি অনুসারে স্টেটস জেনারেল সমাজের অভিজাত, যাজক ও জনসাধারণ এই তিন শ্রেণীর নির্বাচিত প্রতিনিধিগণকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল। সদস্য সংখ্যা ছিল ১২১৪। যাজকের সংখ্যা ছিল ৩০৮, অভিজাতদের সংখ্যা ছিল ২৮৫, এবং তৃতীয় শ্রেণীর সংখ্যা ছিল ৬২১। স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন শুরু হলে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধিগণ জাতীয় অথবা প্যাট্রিয়ট দল গঠন করে। অপর দিকে তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধিগণ ফরাসি জাতির জন্য একট সংবিধান প্রণয়নের জন্য ২০ জুন ১৭৮৯ একটি শপথ গ্রহণ করেন। এটাকে টেনিসকোর্ট শপথ বলা হয়। ২৩ জুন ১৭৮৯ রাজা ষোড়শ লুই একটি ঘোষণাপত্র প্রচার করে জনসাধারণের জন্য কিছু সুযোগসুবিধা মঞ্জুর করেন। ২৭ জুন ১৭৮৯ ষোড়শ লুই তিন শ্রেণীর প্রতিনিধিগণকে একত্রে যোগদান করে মাথাপিছু ভোটদানের অধিকার মঞ্জুর করেন। কিন্তু সামগ্রিক অব্যবস্থাপনার ফলে অর্থনীতিতে ধস নামে। শ্রমিকরা চাকরি হারাতে থাকে। মধ্যবৃত্ত শ্রেণীর ওপর মাত্রাতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে দেয়ায় তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। খাবারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেতে থাকে। জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় রাজা ষোড়শ লুই নির্যাতনের পথ বেছে নিয়ে সকল ধরনের মিছিল সমাবেশ ও রাজনৈতিক কর্মসূচি নিষিদ্ধ করে, বিভিন্ন অজুহাতে ১৭০০০ লোককে বিচারের নামে ফাঁসি দেয় এবং অগণিত মানুষ জেলখানায় থেকে মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু সকল ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে বিক্ষুব্ধ জনতা রাস্তায় নেমে আসে।
১৭৮৯ সালের এপ্রিল মাসে বুভুক্ষ নর-নারী প্যারিসে রুটির দোকান ও কারখানাগুলো ভাঙচুর করে। অপর দিকে ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে অধিক পরিমাণে আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে জনতা স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের অত্যাচারের প্রতীক বাস্তিল কারা দুর্গটি আক্রমণ করে। ষোড়শ লুই এই সংবাদ পেয়ে এক সহচরের নিকট এই অভিমত প্রকাশ করেন ‘ঞযধঃ রং ৎবাড়ষঃ’। সহচরটি প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘ঝরৎ, রঃ রং হড়ঃ ৎবাড়ষঃ, রঃ রং ৎবাড়ষঁঃরড়হ’। বাস্তিলের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবী জনগণ প্যারিসের পৌরসভার ভার নিজেদের হাতে তুলে নেন। তারা প্রতিনিধি নির্বাচন করে এবং নগরীর শান্তি শৃঙ্খলার জন্য বিপ্লবীগণ ‘ন্যাশনাল গার্ড’ নামে জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন করে। ১৭৮৯ এ বুর্জোয়া বিপ্লবের সাথে সাথে কৃষক বিপ্লবের অভ্যুত্থান ঘটে এবং ১৭৮৯ সালের ৪ আগস্ট জাতীয় পরিষদে অধিবেশন বসে ও একাধিক আইন পাস করে সামন্ত প্রথার বিলোপ ঘটানো হয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে রাজাকে সিংহাসন চ্যুত করে ফরাসি জনগণ ফরাসি বিপ্লবের ইতি টানেন। বিভিন্ন উত্থান পতনের পর ১৭৯৯ সালে নেপোলিয়ান বোনাপার্ট সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে এবং বিপ্লবের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেন।
কিন্তু পুঁজিবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতার কারণে ফরাসি বিপ্লব সকল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পুরোপুরি সফল হয়নি। মূলত এই বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণ অনেক অধিকার ফিরে পেলেও মানুষে মানুষে ভেদাভেদ হ্রাস করার পরিবর্তে এই ব্যবধান বৃদ্ধিই পেয়েছে বৈকি!
রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব
রুশ বিপ্লব পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। এই বিপ্লব ‘অক্টোবর বিপ্লব’ নামেও পরিচিত। রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে মূলত জার্মান সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্কস ও ফরাসি দার্শনিক ফ্রেডারিক এঙ্গেলের প্রচারিত সমাজতন্ত্র বাস্তব রূপ লাভ করে। এই বিপ্লবের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, ১৮৯৮ সালে ভøাদিমির ইলিচ উলিয়ানভের (ছদ্মনাম-লেনিন) নেতৃত্বে রাশিয়ার তৎকালীন রাজধানী পিটার্সবার্গে সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি গঠিত হয়। এই পার্টির ভেতরে দু’টি ধারা সৃষ্টি হয়েছিলÑ বলশেভিক আর মনশেভিক। মনশেভিকরা ছিলেন নরমপন্থী এবং সমাজ উন্নয়নে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রয়োজন আছে বলে তারা মনে করতেন। অন্য দিকে বলশেভিকরা ছিলেন কট্টরপন্থী। তারা কেবলমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবে বদ্ধপরিকর ছিলেন।
মানবসমাজের ইতিহাস হচ্ছে শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ইতিহাস। রুশ বিপ্লবের প্রেক্ষাপট তার ব্যতিক্রম নয়। তৎকালীন রাশিয়া ছিল অনেক অঞ্চল নিয়ে গঠিত এক বিশাল রুশ সম্রাজ্য। এর আয়তন ছিল পৃথিবীর সমস্ত স্থলভাগের এক ভাগ এবং ইউরোপের প্রায় অর্ধেক। কিন্তু সেই সময় জমিদার কর্তৃক কৃষকদের ওপর অমানবিক নির্যাতন, শাসক জার নিকোলাস-২ এর সীমাহীন দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, ব্যাপক খাদ্যঘাটতি এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শুরুর দিকে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার নিকট পরাজয় ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে জনগণ ছিল অতিষ্ঠ। বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে ১৯১৭ সালে ৮ মার্চ, যখন পেট্রোগ্রাডের সুতারকলে মহিলা শ্রমকিরা রুটির দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরবর্তীতে তারা দেশ্যব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দেন। ধর্মঘটের তৃতীয় দিনে সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেয়। এর মধ্যে জার পেট্রোগ্রাডে আসার চেষ্টা করলে রাস্তা কেটে ও রেললাইন তুলে তাকে আসতে বাধা দেন বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। নিকোলাস জারের অনুগত সেনাপতি আইভানভ পেট্রোগ্রাড উদ্ধারে ব্যর্থ হলে জার দ্বিতীয় নিকোলাস ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এইভাবে বিপ্লবের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়।
মার্চ বিপ্লবের পর রাশিয়ার জাতীয় সংসদ ‘ডুমার’ সদস্যরা একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করে। বিভিন্ন মধ্যপন্থী দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠিত হয়। তারা রাশিয়াতে একটি সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধর্ম, বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারা অস্ট্রিয়া ও জার্মানির সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ারও সিদ্ধান্ত নেন। ঐ সময় ভøাদিমির লেলিন দীর্ঘ প্রবাসজীবন কাটিয়ে সুইজারল্যান্ড থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং তার ‘এপ্রিল থিসিস’ ঘোষণা করেন। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে প্রত্যাখ্যান এবং জমিদার ও প্রজাপতিদের উচ্ছেদ করা ছিল তার থিসিসের মূল লক্ষ্য। এই সময় রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে শ্রমিক ও যুদ্ধফেরত সৈনিকদের নেতৃত্বে সোভিয়েত বা মুক্ত অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হয়। ভøাদিমিরের ঘোষণায় উৎসাহিত হয়ে জমিদার ও প্রজাপতিদের জমি বিতরণের দাবিতে কৃষকরা আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং দলে দলে জমিদারদের ক্ষেত-খামার লুট, ভূমি সম্পত্তি দখল এবং সরকারি কর্মচারীদের হত্যা শুরু করে। যাকে ইতিহাসবেত্তারা কৃষিসন্ত্রাস হিসেবে চিহ্নিত করে। এক পর্যায়ে শ্রমিক ও জুনিয়র সৈন্যরাও আদেশ অমান্য করে কৃষকদের সাথে যোগ দিতে শুরু করে। এ অবস্থায় অস্থায়ী সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। আর এই সুযোগে মেনশেভিক অর্থাৎ সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠরা আলোকজান্ডার কেরেনক্সির নেতৃত্বের ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু যুদ্ধে রুশ বাহিনীর পরাজয় এবং জার্মানি কর্তৃক রিগা দখল করার পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতির দ্রæত অবনতি হয়। লেনিনের নেৃতত্বাধীন বলশেভিকরা সেনাবাহিনীর যে অংশ নিয়ন্ত্রণ করতো তারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। পাশাপাশি তারা বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সোভিয়েত (মুক্ত অঞ্চল) ঘোষণা করে এমন এক পরিস্থিতিশীল পরিবেশে ১৯১৭ সালের ৬ ও ৭ নভেম্বর বলশেভিকরা বিদ্রোহী হয়ে রেলস্টেশন, রাষ্ট্রীয় ব্যাংক, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও অন্যান্য সরকারি ভবন দখল করে নেয়। পতন ঘটে আলেকজান্ডার কেরেনক্সি সরকারের। এভাবেই সম্পন্ন হয় রুশ বিপ্লব।
এই বিপ্লবের জন্য তাদেরকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। ১৮৮৭ সালে লেনিনের বয়স যখন ১৯ বছর তখন লেনিনের ভাই আলেকজান্ডার সোস্যাল নাগরিক দলের সদস্য হওয়ার কারণে এবং সরকারকে উৎখাতের অভিযোগ এনে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয় জার সরকার। এই অবিচারের কারণেই লেনিন কার্লমার্কসের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সোস্যাল নাগরিক দলে যোগ দেয়। ১৮৯৫ সালে ডিসেম্বরে লেনিনসহ পার্টির বৃহৎ অংশই গ্রেফতার হয়। এবং পরবর্তীতে তাকে পূর্ব সাইবেরিয়া দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ১৯০৫ সালে তাদের পার্টির হাজার হাজার মানুষের এক মিছিলে আক্রমণ চালিয়ে এক হাজার জনকে জবাই করে জার সরকারের সন্ত্রাসী বাহিনী এবং দুই হাজারের অধিক সদস্য মারাত্মকভাবে আহত হয়। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী ক্ষমতাসীন জার সরকারের এত সকল জুলুম নির্যাতন ও দমন পীড়ন বিপ্লব ঠেকাতে পারেনি। যদিও রুশ বিল্পব যে স্বপ্ন নিয়ে সাধিত হয়েছিল তা মানুষের কাক্সিক্ষত স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনি।
চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব
পৃথিবীর ইতিহাসে চীন হচ্ছে দ্বিতীয় রাষ্ট্র যেখানে রাশিয়ার পর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। ১৯৪৯ সালে ১ অক্টোবর মাও জে দংয়ের নেতৃত্বে এই বিপ্লব সংঘটিত হয়। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের হাওয়া পাশের চীনেও পড়তে শুরু করে। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় দুই জন অধ্যাপক লি তা চাও এবং ছেন তু সিউয়ের তত্ত¡াবধানে সর্বপ্রথম ১৯১৮ চীনের মাকর্সবাদী পাঠচক্র গঠিত হয়। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাও জে দং ঐ পাঠচক্রে যোগদান করেন। ১৯২১ সালের ১ জুলাই চীনের সাংহাইয়ে কমিউনিস্ট পার্টি ১৩ জন্য সদস্য নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয়। ১৯২৩ সালের কমিউনিস্ট পার্টির কুয়ো মিং তাং পার্টির সাথে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। ১৯২৫ সালে ২৯ মে বিদেশী হস্তক্ষেপ ও শ্রমিক গ্রেফতারের প্রতিবাদে শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের সমর্থনে বের হওয়া মিছিলে ব্রিটিশ পুলিশ কর্তৃক গুলি করার প্রতিবাদে ব্রিটিশবিরোধী তুমুল আন্দোলন শুরু হয়। বিভিন্ন গণমুখী আন্দোলন সংগ্রামের কারণে কমিউনিস্টদের শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় কুয়ো মিং তাং পার্টির নেতা চিয়াং কাইশেক আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন ও ১৯২৭ সালে ২২ মার্চ সাংহাই এ কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে এবং বহু কমিউনিস্টকে হত্যা করে। এই অভিযান প্রতিরোধ করার জন্য মাও জে দং মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রদের দিয়ে লালফৌজ গঠন করে। এই কাজকে আরো ত্বরান্বিত করার জন্য মাও জে দং তার অনুসরীদের নিয়ে চিয়াংসি গমন করেন এবং স্থানীয় কৃষকদের সহায়তায় সেখানে তাদের বেইজ এরিয়া তৈরি করে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেন। কিন্তু ১৯৩৪ সালে চিয়াং কাইশেকের উন্নত সেনাবাহিনী এ এলাকায় থাকা কমিউনিস্টদের দুর্গ গুঁড়িয়ে দেয় এবং তাদেরকে চিয়ংসি ত্যাগে বাধ্য করে। গেরিলা যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে ১৯৩৪ সালে কমিউনিস্টরা মাও জে দংকে পার্টির নেতৃত্বে থেকে অপসারণ করে এবং সম্মুখ যুদ্ধের নীতি গ্রহণ করে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সেনবাহিনীর উন্নত সমরাস্ত্রের কারণে সম্মুখ যুদ্ধেও পরাজিত হয় কমিউনিস্টদের লালফৌজ বাহিনী। চলতে থাকে কমিউনিস্ট নিধন অভিযান।
এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য ১৯৩৪ সালের ১৬ অক্টোবর লালফৌজ মূল বাহিনী চিয়াংসি থেকে শত্রæব্যূহ ভেদ করে উত্তর সেনসির উদ্দেশে লংমার্চ শুরু করে। ঐতিহাসিক এই লংমার্চ ১ লাখ লোক নিয়ে প্রায় ৮ হাজার মাইল অতিক্রম করে। লংমার্চটি সুদীর্ঘ এই পথে বিভিন্ন পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, জনমানবহীন জলাশয় এবং বিভিন্ন বিপদসঙ্কুল গিরিপথ ভেদ করে লক্ষ্যে পৌঁছায়, যা বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর কমিউনিস্টদের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আত্মবিশ্বাস আরো একধাপ বাড়িয়ে দেয়। ১৯৩৫ সালে মাও জে দংকে পুনরায় কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। ১৯৩৬ সালে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রুশ বিপ্লব থেকে শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় সোভিয়েত (মুক্তাঞ্চল) গঠন করে কমিউনিস্টরা। এরই মধ্যে জাপান মাঞ্চুবিয়া দখল করার জন্য চীন আক্রমণ করলে চিয়াং কাইশেক ও কমিউনিস্টদের মধ্যে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। ১৯৩৭-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত মাও জে দং তার লালফৌজ বাহিনী নিয়ে জাপানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয় এবং জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। কমিউনিস্টরা এই যুদ্ধের সময়েও বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কাজটি সফলভাবে অব্যাহত রাখে। কমিউনিস্টদের এই দ্বৈত ভূমিকার কারণে জাপানের সাথে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই চীনে চিয়াং কাইশেকের বাহিনীর সাথে কমিউনিস্টদের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, যা ‘চীনা গৃহযুদ্ধ’ নামে পরিচিত। ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে মাও জে দং গ্রামাঞ্চল থেকে লোক এনে শহর ঘেরাও নীতি প্রয়োগ করে এবং কুয়ে মিং তাং বাহিনীকে আত্মসর্ম্পণে বাধ্য করে।
১৯৪৯ সালে ক্ষমতাসীন কুয়েমিং তাং পার্টির প্রধান চিয়াং কাইশেক পদত্যাগ করে লি জোং রেনকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করেন এবং কমিউনিস্টদের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব দেন। কিন্তু কমিউনিস্টরা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং তৎকালীন রাজধানী নানচিং দখল করে। মাও জে দং ১৯৪৯ সালের ১লা অক্টোবর চীনকে গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে এবং নিজে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের চেয়ারম্যান পদ গ্রহণ করে। এরই মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় মাও জে দং এর স্বপ্নের ঐতিহাসিক চীনা বিপ্লব।
চীনা বিপ্লব এখন পর্যন্ত টিকে থাকলেও তা মাও সেতুং এর সমাজতান্ত্রিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থাকে গ্রহণ করে নিয়েছে। যা এই বিপ্লবের আদর্শিক ব্যর্থতাকেই প্রমাণ করে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লব
ইরানে ইসলামী বিপ্লব পৃথিবীর ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। ষাটের দশকে ইরান ছিল খুবই পবিত্র এক দেশ এবং ধনী-গরিবের ব্যবধান ছিল অনেক বেশি। তবে ইরানের লোকজন ছিল খুবই ধর্মভীরু। এ সময় ক্ষমতাসীন রেজাশাহ পাহলভি ছিলেন সম্পদশালী ও পাশ্চাত্যের সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে আসক্ত একজন ক্ষমতাধর শাসক। তার শাসনামলে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ ও পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব দিন দিন বাড়তে থাকে এবং ধর্মীয় বিশ্বাস ও সমাজে তার প্রভাব কমতে থাকে। রেজাশাহ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিভিন্ন চুক্তি ও লেনদেনের মাধ্যমে সম্পর্ক জোরদার করতে থাকে যা স্থানীয় জনগণের মধ্য বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। এ সময় শাহের সামগ্রিক কার্যক্রমে ক্ষুব্ধ ধর্মীয় সম্প্রদায় ‘ফিদইয়ানে ইসলাম’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলে। রেজাশাহ পাহলভি তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে এই সংগঠনের অনেক সদস্যকে গ্রেফতার করে এবং বেশ কয়েকজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। সত্তরের দশকে রেজাশাহ বেশ কিছু সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করে, যা জমিদার, আলেমসমাজ ও বিশিষ্ট জনদের উল্লেখযোগ্য অংশ কর্তৃক ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। আয়াতুল্লাহ খোমেনি ছিলেন ঐ সময়ের খুবই জনপ্রিয় শিয়া আলেম। এই সংস্কারের প্রস্তাবকে কুফরি প্রস্তাব হিসেবে ফতোয়া দেন। ১৯৬৩ সালের ২২ মার্চ হোম শহরে মদের দোকানের উদ্বোধনকে কেন্দ্র ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা বিক্ষোভের আয়োজন করলে শাহের বিশেষ বাহিনী শাভাক (ঝঅঠঅক) ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যৌথভাবে বিক্ষুপ্ত ছাত্রদের ওপর ক্র্যাকডাউন চালায় এবং শত শত ছাত্রকে হত্যা করে। ইমাম খোমেনি এই হত্যাকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং রেজাশাহকে স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে ঘোষণা দেয়। এ সময় আয়াতুল্লাহ খোমেনির জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায় এবং তিনি শাহবিরোধী প্রতীকে পরিণত হন। ১৯৬৩ সালের ৫ জুন আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে সরকার গ্রেফতার করলে সারা দেশে দাঙ্গা বেঁধে যায়। সরকার তা দমনে মার্শাল-ল জারি করে। সমস্ত বাহিনী ট্যাঙ্ক, কামান, যুদ্ধবিমান নিয়ে প্রতিবাদীদের ওপর হামলা করে। ১০-১২ হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ মারা গেছে বলে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়। শাহ পাহলভি সরকার খোমেনিকে ইরাকে নির্বাসনে পাঠায় এবং ধর্মীয় গুরুসহ হাজার হাজার লোককে গ্রেফতার করে। এই ধরনের দমন পীড়ন চলতে থাকে।
সময়ের সাথে রেজাশাহ পাহলভি আমেরিকার সহযোগিতায় অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং বাস্তবে বিভিন্ন সেক্টরে ইর্ষনীয় উন্নয়ন হয়। কিন্তু সর্বব্যাপী দুর্নীতি, ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি, ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর নির্মম দমন পীড়নের কারণে জনগণ শাহের শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসে আয়াতুল্লাহ খোমেনির ছেলে মুস্তফা খোমেনিকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সরকারের বিশেষ বাহিনীর সাভাকের সদস্যদেরকে এ জন্য দায়ী করা হয়। ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি মাসে ছাত্ররা অধিকতর স্বাধীনতার দাবিতে বিক্ষোভ বের করলে সরকারি বাহিনীর গুলিতে শতাধিক ছাত্র নিহত হয়। আয়াতুল্লাহ খোমেনি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভের ডাক দেন। বিভিন্ন মুফতি, ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ নেতা এবং ছাত্র জনতা খোমেনির ডাকে সাড়া দিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। দেশব্যাপী সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। দেশের বাইরে দেশে বিভিন্ন ইরানি অ্যাম্বাসিতে হামলা করে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা।
প্রতিবাদকারীদের দমন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে বিপুল সংখ্যক প্রতিবাদকারী হতাহত হলে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমাসহ বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি অফিসে হামলা চালায় প্রতিবাদকারীরা। এ সময় কর্মস্থলে যোগ না দেয়ার আহŸান জানিয়ে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয় ইমাম খোমেনিসহ সরকারবিরোধী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে রেজা শাহ পাহলভি পুনরায় সামরিক আইন ও কারফিউ জারি করে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয়। এ সময় ৪১০ জন লোক লোক নিহত হয়। এরপর বিক্ষোভের মাত্রা আরও বাড়ায় বিপ্লবী জনতা। রেজাশাহ পাহলভি তার রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য জেনারেল গোলাম আলি অভিশকে যে কোনো মূল্যে রাজধানী তেহরান রক্ষার দায়িত্ব দেয়।
সেনাবাহিনী স্থল ও আকাশপথে আক্রমণের মাধ্যমে প্রতিবাদকারীদেরকে সিটি স্কয়ার থেকে সরিয়ে দেয়। প্রতিবাদকারী চার দিকে থেকে শহরকে ঘিরে ফেলে এবং মলটভ ককটেল দ্বারা সেনাবাহিনীর আক্রমণের জবাব দিতে শুরু করে। এই দিনে প্রায় ২০০০-৩০০০ লোক মারা যায়। তাই এই দিনটি ইরানের ইতিহাসে কালো শুক্রবারে (বø্যাক ফ্রাইডে) নামে আজও পরিচিত।
রেজা শাহ পাহলভি সাদ্দাম হোসেনকে ম্যানেজ করে আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে ইরাক ছেড়ে ফ্রান্সে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে। কিন্তু ফ্রান্সে গিয়ে খোমেনি আরো স্বাধীনভাবে আন্দোলনরত জনগণকে দিকনির্দেশনা দেয়ার সুযোগ পান।
এ দিকে আন্দোলনের মাত্রা যত বাড়তে থাকে সরকারি বাহিনী কর্তৃক হত্যা ও নির্যাতন ততই বাড়তে থাকে। পাশাপাশি আন্দোলনের তীব্রতা দেখে সরকারি কর্মকর্তা ও বাহিনীর সদস্যরা দেশ থেকে তাদের সম্পত্তি ও আত্মীয়-স্বজনকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া শুরু করে।
অবশেষে ১৮ নভেম্বর ১৯৭৮ সালে সেনাবাহিনীর সদস্যরা প্রতিবাদী জনতার ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করলে রেজাশাহ পাহলভি শাহ বখতিয়ারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে ১৯৭৮ সালের ১৬ জানুয়ারি দেশ ছেড়ে মিসরে পালিয়ে যান। কিন্তু ফ্রান্স থেকে ইমাম খোমেনি তার অনুসারীদেরকে শাহ পাহলভি কর্তৃক নিয়োগকৃত প্রধানমন্ত্রী বখতিয়ারের শাসন অস্বীকার করার ডাক দেয়।
১ ফেব্রæয়ারি ১৯৭৯ সুদীর্ঘ ১৫ বছরের নির্বাসন জীবন শেষে বিজয়ী বেশে আয়াতুল্লাহ খোমেনি দেশে ফিরে আসেন। আয়াতুল্লাহ খোমেনি দেশে আসার পর তার নির্দেশনায় আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ আলি বেসাতি ইসলামী রিপাবলিকান পার্টি (আইআরপি) প্রতিষ্ঠা করেন, যা দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১১ ফেব্রæয়ারি তরুণ বিপ্লবীরা অস্ত্রাগার আক্রমণ করে অ¯্র ছিনিয়ে নিয়ে, রেডিও স্টেশন, বিভিন্ন অফিসে হামলা করে এবং ইরানে কর্মরত পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষ করে আমেরিকার কর্মকর্তাদেরকে বন্দী করে। গণভোটসহ নানান ধাপ অতিক্রম করে ১ এপ্রিল ১৯৭৯ সালে ইমাম আয়াতুল্লাহ খোমেনি ইরানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেন।
পৃথিবীর ইতিহাসের সাড়াজাগানো সব কয়টি বিপ্লব পর্যালোচনা করে দেখা যাবে যে, কোন সুনির্দিষ্ট আদর্শ বা লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করার আন্দোলন যতই বেগবান হয়েছে কায়েমি শক্তি; সমস্ত রাষ্ট্রীয় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তি ব্যবহার করে সেই বিপ্লবী আন্দোলনকে নিঃশেষ করে দেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর আন্দোলনের কর্মীদেরকে নির্যাতন, নির্বাসন, হত্যা, গুপ্ত হত্যা ও বিচারের নামে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা কোনো কিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি। আদর্শিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বিপ্লবের সাময়িক পরাজয়ের গøানি, সহকর্মীদের লাশ আর রক্ত সাগর পাড়ি দিয়ে নুতন নতুন কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে লক্ষ্য পানে এগিয়ে গিয়ে বিপ্লবের অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে বিপ্লবীরা।
বাংলাদেশে ন্যায্যতা ও গণ-অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিপ্লবের এই ঐতিহাসিক আয়নায় আত্ম-অবলোকন করার সময় এসেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের জন্য জনশক্তিদেরকে এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ক্ষমতাবাদীদের হুঙ্কার, চারদিকে সহযাত্রীদের ক্ষতবিক্ষত দেহ, ফাঁসির রশিতে নেতৃবৃন্দের ঝুলন্ত লাশ আর পরিস্থিতির ভয়াবহতা দেখে বিচলিত হওয়ার সুযোগ নেই। রাসূল (সা:)-এর উত্তরাধিকারী হিসেবে তারই বিপ্লবের অনুঘটক হয়ে আমরাও যদি পরিকল্পনা আর নতুন নতুন কৌশল গ্রহণ করে দৃঢ় কদমে এগিয়ে যেতে পারি, বাংলাদেশে আমাদের স্বপ্নের ইসলামী বিপ্লব হবেই হবে ইনশাআল্লাহ।
লেখক : কেন্দ্রীয় মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির