post

মদের লাইসেন্স প্রদান নৈতিক অবক্ষয়ের পথ উন্মোচন

ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম

১৩ এপ্রিল ২০২২

বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এ দেশের মাটি ও মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে ইসলামী তাহজিব-তমদ্দুনের গভীর প্রভাব রয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, যা সংবিধানেও খচিত রয়েছে। দেশের মেজরিটি পার্সেন্ট মানুষ মুসলমান। রাজধানী ঢাকাকে ‘মসজিদের শহর’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। অথচ ক্ষমতাসীন সেক্যুলার সরকার এসব কিছুকে অগ্রাহ্য করে প্রায়শ ইসলাম ও সামাজিক বাস্তবতা এ দুটিকেই অগ্রাহ্য করে বিভিন্ন সময়ে আইন ও নীতিমালা পাস করে আসছে। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের প্রবর্তিত মাদকবিষয়ক নতুন নীতিমালা প্রণয়ন ও সংসদে পাস। মানুষের তাহজিব তমদ্দুন ঈমান আকিদা বিশ্বাস-এর বিপরীত কোনো আইন সংবিধানসম্মত নয় বরং সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। সরকার সেই রকম একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সমস্ত জিনিসকে হারাম করা হয়েছে তা কখনো আইনের মাধ্যমে হালাল হতে পারে না।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ঈমানদারগণ! এ মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদি ও ভাগ্য নির্ণায়ক শরসমূহ এ সমস্তই হচ্ছে ঘৃণ্য শয়তানি কার্যকলাপ। এগুলো থেকে দূরে থাকো, আশা করা যায় তোমরা সফলতা লাভ করবে। (সূরা আল-মায়িদাহ : আয়াত: ৯০)
মদ এমন একটি হারাম জিনিস যার মাধ্যমে সমাজে অশান্তি অস্থিরতা নৈরাজ্য ও অনৈতিকতা, উচ্ছৃঙ্খলতা, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা এবং সামাজিক বিপর্যয় দেখা দেয়। তারই একটি জ্বলন্ত প্রমাণ গত ২ মার্চ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে মাদকসহ গ্রেফতার ছেলের ‘ক্রসফায়ার’ চাইলেন ডিএনসিসির প্যানেল মেয়র।
পুলিশ জানিয়েছে, বুধবার রাতে তারা রাজধানীর মিরপুর-১১ নম্বরের বি ব্লকের মিল্লাত ক্যাম্পের সামনে থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্যানেল মেয়র জামাল মোস্তফার ছেলেকে গ্রেফতার করেছে। তার নাম রফিকুল ইসলাম রুবেল। তার কাছ থেকে ইয়াবা ও হেরোইন জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় সম্প্রতি পল্লবী থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেছে পুলিশ।
জামাল মোস্তফা কাফরুল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। ছেলের এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে তার ক্রসফায়ার চেয়েছেন জামাল।
তিনি বলেন, ‘ইয়াবা ও হেরোইনসহ রুবেলের গ্রেফতারের বিষয়টি আমি শুনেছি। প্রশ্ন হলো- খাওয়া, পরা কিসের কষ্ট ছিল তার। তারপরও কেন সে এমন কর্মকাণ্ডে জড়ালো, মাথায় ঢুকছে না। তার কারণে বারবার নাজেহাল হচ্ছি। পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সম্মান নষ্ট হচ্ছে। এত মানুষের ক্রসফায়ার হয়; এমন ছেলে থাকার চেয়ে পুলিশ যদি তাকে (রুবেল) ক্রসফায়ার দিতো কষ্টটা কিছুটা কমতো।’
আর কোনো পরিবার যেন এমন পরিস্থিতির শিকার না হয়, তাই মাদক থেকে যুবসমাজকে দূরে থাকার অনুরোধ জানান এই প্যানেল মেয়র।
পল্লবী থানার ওসি পারভেজ ইসলাম জানান, রুবেল ১১ পুরিয়া হেরোইন ও ৭৫ পিস ইয়াবা নিয়ে বিক্রির জন্য সেখানে অবস্থান করছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তারা অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করেন। (আমাদের সময়)
যার কারণে দেশে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। ইসলামী দল ও সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও এ নীতিমালার বিপক্ষে তোলা হয়েছে জোরালো প্রতিবাদ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হতে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে প্রকাশিত গেজেটে মুদ্রিত তথ্য অনুযায়ী ‘অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০২২’ নামে এই বিধিমালাটি ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮’ বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদিত হয়েছে। এই বিধিমালা অনুযায়ী-
- ২১ বছরের বেশি বয়সী যে কেউ মদ্যপানের পারমিটের জন্য আবেদন করতে পারবে।
- দেশী ও বিদেশী মদ্যপানের জন্য লাইসেন্স নিতে যথাক্রমে ১৫০ টাকা ও ৩০০০ টাকা ফি প্রদান করতে হবে।
- কোনো এলাকায় ১০০ জন মদ্যপানের লাইসেন্সধারী থাকলে সেখানে নতুন বার চালু করার অনুমতি দেয়া হবে।
এ ছাড়াও ২৭৬ পৃষ্ঠায় কলেবরে মুদ্রিত উক্ত গেজেটে আরো বহু বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে যা প্রকৃতপক্ষে সমাজবিধ্বংসী। আর প্রকৃত চিত্র হলো ঢাকার কোনো ক্লাব বা বারেই মদ্যপানের কথিত লাইসেন্স পরীক্ষা করা হয় না। টাকা থাকলে যে কেউ সেসব জায়গায় গিয়ে মদ্যপান করতে পারে। সূত্র : ভয়েস অব আমেরিকা।

মাদক বিধিমালার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া

বিশিষ্টজনদের মতে নতুন এই বিধিমালার কারণে তরুণদের মধ্যে মদ্যপান বেড়ে যাওয়ার পথ সুগম হয়েছে। এছাড়া দেশে ইতঃপূর্বে ১২১টি প্রতিষ্ঠানের অধীনে ১৬৫টি মদের বার রয়েছে যা নতুন বিধিমালার সহজ শর্তাবলির কারণে আরো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল মনে করেন মদ্যপান ২১ বছরের এই নতুন সংযোজিত সহজ শর্ত তরুণদেরকে মদ্যপানে উৎসাহিত করতে পারে।

ইসলাম ও বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মদ্যপান

ইসলামে বিজ্ঞানসম্মত কারণেই মদ্যপান হারাম বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো মদ্যপানের কারণে মানুষের স্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পায়। মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে তার করণীয় কী উপলব্ধি করতে পারে না। কারণ, মানুষের ‘আকল’ বা সুষ্ঠু স্বাভাবিক জ্ঞান সুরক্ষিত না হলে সে নিজের, পরিবারের, দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের সবার ক্ষতি করবে। ব্যভিচার নিষিদ্ধ, নারী-পুরুষের বৈবাহিক সূত্রে পবিত্র বন্ধন বংশগতির পবিত্রতা সুরক্ষার জন্য। তা না হলে মানুষ আর ইতর প্রাণীর প্রভেদ থাকে না।
হাদিসে এসেছে অর্থাৎ প্রত্যেক নেশাদায়ক বস্তুই মদ, আর প্রত্যেক মদই হারাম। অন্যত্র এসেছে, “তোমরা মদ্যপান করো না, কারণ মদ হলো সকল পাপের মূল।” অন্য হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা মদ থেকে বেঁচে থাক। কেননা তা অশ্লীল কাজের মূল।’
মদপানকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না : রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘সর্বদা মদ পানকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’
মদ্যপের ৪০ দিনের সালাত কবুল হয় না : আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নেশাদার দ্রব্য পান করবে আল্লাহ তার ৪০ দিন সালাত কবুল করবেন না। যদি এ অবস্থায় মারা যায় তাহলে জাহান্নামে যাবে। যদি তাওবাহ করে তাহলে আল্লাহ তার তাওবাহ কবুল করবেন। আবার নেশাদার দ্রব্য পান করলে আল্লাহ তার ৪০ দিন সালাত কবুল করবেন না। যদি এ অবস্থায় মারা যায় তাহলে জাহান্নামে যাবে। আর যদি তাওবাহ করে তবে আল্লাহ তার তাওবাহ কবুল করবেন। আবার যদি নেশাদার দ্রব্য পান করে আল্লাহ তার ৪০ দিন সালাত কবুল করবেন না। এ অবস্থায় মারা গেলে জাহান্নামে যাবে। তাওবাহ করলে আল্লাহ তার তাওবাহ কবুল করবেন। লোকটি যদি চতুর্থবার মদ পান করে আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন ‘রাদাগাতুল খাবাল’ পান করাবেন। সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সা.! ‘রাদাগাতে খাবাল’ কী? রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, ‘আগুনের তাপে জাহান্নামিদের শরীর হতে গলে পড়া রক্তপুঁজ মিশ্রিত গরম তরল পদার্থ।’
মদের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের প্রতি রাসূলুল্লাহ সা.-এর অভিসম্পাত : মদের সাথে সম্পর্ক রাখে এমন দশ শ্রেণীর লোকের প্রতি রাসূল সা. অভিশাপ করেছেন। (১) যে লোক মদের নির্যাস বের করে (২) প্রস্তুতকারক (৩) মদপানকারী (৪) যে পান করায় (৫) মদের আমদানিকারক (৬) যার জন্য আমদানি করা হয় (৭) বিক্রেতা (৮) ক্রেতা (৯) সরবরাহকারী এবং (১০) এর লভ্যাংশ ভোগকারী।’
কিয়ামতের পূর্বে মদের ব্যাপকতা : কিয়ামতের পূর্বে মাদকতা এমনভাবে বৃদ্ধি পাবে যে মদ পানকারীরা তা পান করাকে অপরাধ মনে করবে না। হাদিস এসেছে,
আনাস রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি যে, ‘কিয়ামতের আলামতসমূহের মধ্যে রয়েছে, ইলম উঠে যাবে, মূর্খতা, ব্যভিচার ও মদ্যপান বেড়ে যাবে। পুরুষের সংখ্যা হ্রাস পাবে এবং নারীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। এমনকি পঞ্চাশ জন মহিলার পরিচালক হবে একজন পুরুষ। শুধু তাই নয়; শেষ জামানায় মানুষ মদকে বিভিন্ন নামের ছদ্মাবরণে পান করবে বলে রাসূলুল্লাহ সা. আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মদপানের ক্ষতি

যেকোনো প্রকার মাদকদ্রব্য যা নেশা সৃষ্টি করে, সুস্থ মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটায় এবং জ্ঞান ও স্মৃতিশক্তি লোপ করে দেয়, তা হারাম বা নিষিদ্ধ, চাই তা প্রাকৃতিক হোক যেমন- মদ, তাড়ি, আফিম, গাঁজা, চরস, হাশিশ, মারিজুয়ান ইত্যাদি অথবা রাসায়নিক হোক যেমন- হেরোইন, মরফিন, কোকেন, প্যাথেড্রিন ইত্যাদি।
মাদক মানুষের শরীরে বিভিন্ন ক্ষতি সাধন করে থাকে। নেশাদ্রব্য গ্রহণের ফলে ধীরে ধীরে মানুষের হজমশক্তি বিনষ্ট হয়, খাদ্যস্পৃহা কমে যায়, চেহারা বিকৃত হয়ে পড়ে, স্নায়ু দুর্বল হয়ে যায়, শারীরিক ক্ষমতা লোপ পায়।
আবার এমন অনেক মাদকদ্রব্য আছে, যা সম্পূর্ণরূপে কিডনি বিনষ্ট করে দেয়। মস্তিষ্কের লক্ষ লক্ষ সেল ধ্বংস করে ফেলে, যেটা কোন চিকিৎসার মাধ্যমেই সারানো সম্ভব নয়। মাদক সেবনের ফলে লিভারসিরোসিস রোগের সৃষ্টি হয়, যার চিকিৎসা দুরূহ।
১. খাদ্যনালি, পিত্ত ও প্লিহায় ক্যান্সার হয়।
২. হার্টের অসুখ দেখা দেয়।
৩. কিডনি ও প্রস্রাবের বহু রোগের কারণ মদ্যপান
৪. গর্ভবতী নারীদের সন্তানের মৃত্যুঝুঁকি ও শারীরিক-মানসিক বৈকল্যের কারণ হতে পারে।

মদপানে সামাজিক অবক্ষয়

মদ্যপান ও মাদক মারাত্মক সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ। মদ্যপানের কারণে অকালে ঝরে পড়ছে অনেক তরুণ প্রাণ।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল লেকচারার তথা গবেষক অন্য টুপিওয়ালা বলেন, “আমরা জানতাম যে দীর্ঘদিন ধরে মদ্যপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু এখন আর সেটা মনে করা হচ্ছে না। বরং মদ্যপানই ক্ষতিকর।” ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে এই গবেষোণাটির খুঁটিনাটি প্রকাশিত হয়েছে।
টুপিওয়ালা বলেছেন, মস্তিষ্কের ভেতরে অসংখ্য বিদ্যুতের তারের মতো তার আছে। যারা বেশি মদ পান করেন তাদের এই তারগুলোর হাল খুবই খারাপ। তারা শব্দকোষের খেলাতেও অনেক পেছনে থাকেন। আবার অন্য দিকে ‘ওয়ার্ড রিকল’ বা যে কোনো একটি নির্দিষ্ট ধরনের বিভিন্ন শব্দ বলার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখা যায় না।
মধ্যপ্রাচ্যের চেয়ে পাশ্চাত্যে বেশি সহজলভ্য। পাশ্চাত্যের আবহাওয়া, জলবায়ু, পাশ্চাত্যের মানুষের জীবনমান, অর্থনৈতিক অবস্থা, শারীরিক গঠন, চিন্তা এবং ধর্মীয় বিশ্বাস প্রাচ্যের মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলো থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুতরাং, বাংলাদেশে পাশ্চাত্যের দোহায় দিয়ে মদের লাইসেন্স দেয়ার কোনো যুক্তি নেই। মদ শুধু ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকেও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
আমেরিকার সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘জাস্টিন ডিপার্টমেন্ট’ ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে একটি সমীক্ষা প্রকাশ করে। যা থেকে জানা যায়, এই বছর আমেরিকায় প্রতিদিন দুই হাজার ৭১৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে এবং ধর্ষণকারীদের বেশির ভাগ ছিল নেশাগ্রস্ত।

মাদকে বিপর্যস্ত পরিবার

মদপান ও মাদকের কারণে বহু পরিবার বিপর্যস্ত ও সর্বস্বান্ত। সমাজের নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সব ধরনের পরিবারে মাদক এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মাদকের কারণে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার পরিবার। ৩১ জানুয়ারি ২০১৯ দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে ‘কর্নাটকে মদ নিষিদ্ধ করতে চার হাজার নারীর পদযাত্রা’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়। যাতে বলা হয়, মদ নিষিদ্ধের দাবিতে ভারতের কর্নাটক রাজ্যে ১২ দিন ধরে চলা ২০০ কিলোমিটার পদযাত্রা শেষে ব্যাঙ্গালুরুতে সমাবেশ করেছে নারীরা। রাজ্যের প্রায় চার হাজার নারী এই পদযাত্রা ও সমাবেশে অংশ নেন। তারা দাবি করেছেন, রাজ্যে কোনো ধরনের মদ উৎপাদন এবং বিক্রি করা যাবে না। পদযাত্রায় অংশ নেয়া অম্বিকা জানান, স্বামী মদ্যপ অবস্থায় প্রায়ই তাকে মারধর করেন। আমাকে হুমকি দেয়। আমি মরার মতো বেঁচে আছি। এই সংবাদ থেকেও ধারণা পাওয়া যায়, পারিবারিক জীবনে মদ ও মাদকের ভয়াবহতা কোন পর্যায়ে রয়েছে। শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশেও মাদকের কারণে বহু পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। সন্তানদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশে হঠাৎ কেন মাদকের লাইসেন্স

সম্প্রতি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে পৃথকভাবে এ নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও পররাষ্ট্র দফতর। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বিভিন্ন দেশের ১৫ ব্যক্তি ও ১০ প্রতিষ্ঠানের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, যার মধ্যে সাতজনই বাংলাদেশের। এই নিষেধাজ্ঞার পর র‌্যাবের হাতে নিহত হয়নি একজনও। ক্রসফায়ারের ঘটনাও শূন্য। অনেকে মনে করছেন মদের লাইসেন্স দেয়ার মাধ্যমে পশ্চিমা মহলকে খুশি করতে চায় বর্তমান সরকার। এ কারণে নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে বাংলাদেশের জন মানুষের প্রাণের ধর্মের ও তোয়াক্কা করছে না বর্তমান সরকার।
মূলত বর্তমান সরকার নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে গিয়ে দেশকে পশ্চিমা শক্তির কাছে নতজানু ও তাদের সংস্কৃতিকে নিজেদের মধ্যে অনুমোদন দিচ্ছে যার প্রভাবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের ইসলামী ভাবধারা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বাংলাদেশ একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে একে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য খুবই কৌশলে মদের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। মদ সহজলভ্য হওয়ার কারণে তরুণ সমাজ মদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হবে কিন্তু আমাদের দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং জীবনমানের বিষয়টি চিন্তা করতে হবে। অ্যালকোহলিক হওয়ার কারণে অর্থের অপচয় হবে কিন্তু অর্থ স্বাভাবিক উপায়ে উপার্জন করা যাবে না। তাই এই বাড়তি অর্থের জোগান দেয়ার জন্য তরুণসমাজ চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি ও অন্যায় অপকর্মে লিপ্ত হবে। সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়বে, মানুষের জীবনের কোনো নিরাপত্তা থাকবে না।
একটি অরাজক রাষ্ট্রে পরিণত হবে যার চূড়ান্ত পরিণত হবে ব্যর্থ রাষ্ট্র। মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে শারীরিক দুর্বলতাসহ নানান ধরনের শারীরিক জটিল রোগে আক্রান্ত হবে এই তরুণ সমাজ। ফলে তাদেরকে বাড়তি চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে হবে কিন্তু সেই চিকিৎসা ব্যয় এর অর্থ তারা জোগান দিতে পারবে না। মদ সহজলভ্য করে দেয়ার অর্থই হচ্ছে রাষ্ট্রকে চূড়ান্তভাবে একটা বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া এবং অবৈধ রেজিমকে স্থায়ী করার একটি অপচেষ্টা। তরুণসমাজকে যদি অ্যালকোহলে আসক্ত করা যায় তাহলে তারা অবৈধ ক্ষমতা, রাষ্ট্রচিন্তা, বিজ্ঞান এসব বিষয়ে চিন্তা করবে না। তারা শুধু মদের প্রতি আকৃষ্ট থাকবে আর এই সুযোগটা শাসকশ্রেণী কাজে লাগাতে পারবে। সঙ্গত কারণেই তারা এই মদকে খুবই সহজলভ্য করে দিচ্ছে রেভিনিউ ইনকামের নামে। এটা চূড়ান্ত অসভ্যতা এবং নির্লজ্জতা।
মাদক, জুয়া ও ব্যভিচার সর্বধর্মেই নিষিদ্ধ, সব আইনেই গর্হিত ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শুদ্ধ-সিদ্ধ ও পূত-পবিত্র, সফল ও সার্থক জীবনের জন্য মাদক, জুয়া ও ব্যভিচারের কবল ও ছোবল থেকে নিজেদের ও পরিবারকে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হবে। দেশের উন্নয়নে ও জাতির সুরক্ষার জন্য এসব অসামাজিক অপকর্মের সামাজিক সচেতনতা তৈরি প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

লেখক : সহকারী সম্পাদক, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির