post

মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নীলনকশা কেন?

১৭ আগস্ট ২০১৪

মুহাম্মদ আবদুল জব্বার

Madrasahমাদরাসা শিক্ষা এ অঞ্চলের প্রাচীনতম শিক্ষাব্যবস্থা। মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষার মূল কেন্দ্র হিসেবে মাদরাসার কদর বরাবরই ছিল। বর্তমানেও বাংলাদেশের মানুষ ভালোবেসে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার ঐতিহ্য ধরে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অপপ্রচার, বৈষম্য তৈরি করে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে রাখার অপচেষ্টা ও মাদরাসা ছাত্রদের নির্যাতিত হতে দেখে ধর্মপ্রাণ মুসলিম সমাজ হৃদয়ে আঘাত পেয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সচেতন দেশবাসীর মনে প্রশ্ন জেগেছে, মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কেন এত ষড়যন্ত্র। নীলনকশার মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা কেন? মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে চলমান ষড়যন্ত্রের কারণ অনুসন্ধানে এই শিক্ষাব্যবস্থার গোড়ার দিকের কথা আলোচনা জরুরি মনে করছি। পূর্বে এই উপমহাদেশের সরলপ্রাণ মুসলমানরা আরবি, উর্দু, ফার্সি ও নিজেদের ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা শিক্ষার প্রতি তেমন আগ্রহী ছিলেন না। ব্রিটিশ শাসনামলে যখন ইংরেজি ভাষার কদর বেড়ে গিয়েছিল, তখন মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষাকে না-জায়েজ মনে করতেন। এই সুবাদে হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সরকারি সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করতে লাগল। সেই সময় মুসলমানদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হিসেবে সৈয়দ আমীর আলী ও স্যার সলিমুল্লাহ মুসলমানদের সুখ-দুঃখের কথা ভাবতেন। তারাই প্রথম মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পদায়নের লক্ষ্যে দ্বীনি শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজন অনুভব করেন। তাই ইংরেজদের সাথে কথা বলে মুসলমানদের জন্য কলকাতা আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও সে সময় মুসলমানদের প্রত্যাশা অনুযায়ী এ মাদরাসায় পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়নি। মাদরাসা পরিচালক হিসেবেও ব্রিটিশ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া হয়। যারা শুরু থেকেই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া দ্বীনি শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা করে আসছিলেন, তারা মুসলমানদের জন্য আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন। এখান থেকেই মূলত মাদরাসা শিক্ষার দু’টি ধারার প্রবর্তন ঘটে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা ‘আলিয়া’ নামে পরিচিতি পায়। আর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত শিক্ষাব্যবস্থা ‘কওমি’ নামে পরিচিতি লাভ করে। সময়ের পরিক্রমায় কওমি মাদরাসা দেওবন্দি শিক্ষাব্যবস্থার অনুকরণে পরিচালিত হতে শুরু করে। আমাদের দেশেও কওমি ও আলিয়া ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়। অবশ্য আলিয়া ধারার শিক্ষাব্যবস্থার অনেক আগেই কওমি ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছিল, যা এ অঞ্চলের প্রাচীনতম শিক্ষাব্যবস্থা। স্বাধীন বাংলাদেশে সময়ের সাথে সাথে আলিয়া ধারার শিক্ষাব্যবস্থাকে সাধারণ শিক্ষার সমপর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে। দাখিলকে এসএসসি, আলিমকে এইচএসসি ও পরবর্তীতে ফাজিলকে ডিগ্রি ও কামিলকে মাস্টার্সের মান দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারিভাবে সমমানের স্বীকৃতি সত্ত্বেও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষার শিকার হতে হয়। উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত মাদরাসা শিক্ষার্থীদের কিছুটা মূল্যায়ন করা হলেও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা রয়েই গেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই প্রতিবন্ধকতাকে বর্তমান সরকার বাড়িয়েই চলছে। বিগত কয়েক বছর ধরে আলিয়া ধারার শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি সুনির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতর আটকানোর অপপ্রয়াস ছিল লক্ষণীয়। সব ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন করে এই ধারার শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে ধারাবাহিক চেষ্টা চলছে। অন্য দিকে কওমি ধারার শিক্ষাব্যবস্থাকেও অন্তঃসারশূন্য করার জন্য চেষ্টা চলছে পুরোদমে। যার মূল উদ্দেশ্য হলো ইসলামের সঠিক আদর্শ থেকে মুসলমানদেরকে দূরে রাখা। দেশকে নিরেট একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে মাদরাসা শিক্ষাবিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা তেমনভাবে সমন্বিত রূপ পায়নি। এর কারণ হলো কুরআন-হাদিসের জ্ঞানের আলোকে সমন্বিত কল্যাণমূলক শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন মানুষের কাছে পরিষ্কার না থাকা। মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে কিছু মানুষের নেতিবাচক বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে, তা-ও আমাদের দূর করতে হবে। সময়োপযোগী পরিকল্পনার আলোকে এগোতে হবে। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা মাদরাসা ছাত্রদের অবজ্ঞা করেই চলছে। মাদরাসা ছাত্রদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত না করে সরকার মূলত রাষ্ট্রের হৃদপিণ্ডেই আঘাত করেছে। যারা দ্বীনের ছায়াতলে বুঝে শুনে একবার আশ্রয় গ্রহণ করে, তারা কখনো সমাজের জন্য কলাণ বৈ অকল্যাণ কামনা করতে পারেন না। কুরআন-হাদিসের ন্যূনতম জ্ঞানের আলো যার ভেতরে থাকে ও যার হৃদয়ে আল্লাহভীতি রয়েছে, দেশ ও জাতির কাছে সে অন্য আর দশজনের চেয়ে বেশি নিরাপদ। তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সে যথাযথ পালন করতে সামান্যতম অবহেলা করে না। সাধারণ শিক্ষায় যারা শিক্ষিত, তাদের অনেকেই নৈতিকতার মানদণ্ডে দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিতদের ধারে কাছেও নেই। নৈতিকতাবর্জিত বলেই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক ব্যক্তি আজ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে দেশের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে। সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন, তুলনামূলক বিচারে মাদরাসা শিক্ষিতরা নৈতিকতার মানদণ্ডে অনেক এগিয়ে আছে। যুগ যুগ ধরে আলেমসমাজ দেশ ও সমাজের কাঠামো রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। নীলনকশার অংশ হিসেবেই সরকার অধুনিকায়নের নামে অনেক ক্ষেত্রে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষতিও করে চলছে। সিলেবাস কাটছাঁট করে দ্বীনি শিক্ষাকে সঙ্কুচিত করেছে, অপর দিকে আধুনিক জ্ঞান শিক্ষার কথা বলা হলেও এর শিক্ষাদানের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষক, প্রশিক্ষণাগার ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ব্যবস্থা করা হয়নি। যার ফলে মাদরাসা ছাত্রদের অনেকে না হচ্ছে ভালো আলেম, না হচ্ছে কর্মদক্ষ। মাঝখানে তৈরি করা হচ্ছে কিছু কেরানি পর্যায়ের লোক। এটা মাদরাসা শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের সাথে চরম বৈষম্য ছাড়া কিছু নয়। এভাবে এই শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি পরিকল্পিতভাবে ছাত্র ও অভিভাবকদেরও নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। চরম বৈষম্য উপেক্ষা করেও মাদরাসার কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী যখন নিজেদের প্রচেষ্টায় সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করে তখন তাদের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয়ার প্রয়াসও বর্তমান সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মাদরাসা ছাত্ররা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে ভূমিকা পালন করুক, এটা অনেকেই চাইছে না। আলিয়া মাদরাসা থেকে যারা আলেম হন, তাদের অনেকে দ্বীনের পক্ষে মজবুত ভূমিকা পালন করছেন। আবার কওমি ধারার শিক্ষাব্যবস্থা থেকেও অনেক প্রতিভাধর ইসলামিক স্কলার তৈরি হচ্ছে, যারা ইসলামের প্রচার ও প্রসারে অবদান রাখছেন। এর ফলে যারা আল্লাহদ্রোহী তাদের মাঝে গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। তারা মনে করে, কুরআন-হাদিসের শিক্ষা চালু থাকলে তাদের সকল পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। তাই সিলেবাস কাটছাঁট করে ও বিভিন্ন সময় মাদরাসা শিক্ষার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযৌক্তিক সরকারি হস্তক্ষেপ করে মাদরাসা শিক্ষার অগ্রযাত্রাকে রুখে দেয়ার চেষ্টা চলছে। যেহেতু সরকারের যেকোনো ইসলামবিদ্বেষী ও নৈতিকতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ প্রথম মাদরাসা থেকেই শুরু হয়, সেহেতু সরকার তাদের চাহিদার আলোকে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে সাজাতে চাইছে। এর মাধ্যমে তারা তাদের শোষণকাজে বিরোধিতার পরিবর্তে সহায়ক হিসেবে মাদরাসা ছাত্রদের গড়ে তুলতে চাইছে। মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের অন্তরায়। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রবক্তারা এর ব্যাখ্যায় বলেন- ধর্ম ব্যক্তিগত পর্যায়ে থাকবে ও রাষ্ট্রের কাজে এর কোনো প্রভাব থাকবে না। কিন্তু এটাই সত্য যে, ধর্মনিরপেক্ষতার অন্তরালে লুকিয়ে আছে ধর্মহীনতা। মানুষকে ধর্মহীন হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াসেই ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আওড়ানো হচ্ছে। এটা তো পরিষ্কার যে, ধর্মহীন মানুষের কোনো নৈতিক সত্তা থাকে না, থাকে পাশবিক সত্তা। পাশবিক সত্তা থেকে ধর্মহীন ব্যক্তি কোনো ধরনের নীচ ও হীন কাজ করতে পারে। কারণ তার কোনো জবাবদিহিতার জায়গা নেই। উল্টো দিকে ধর্ম মানুষকে অপরাধপ্রবণতা থেকে আগলে রাখে। মানুষের মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করে। তাই যারা মনে করে রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের প্রভাব থাকা উচিত নয়, তারা মূলত প্রতারক। আল্লাহভীরু ব্যক্তিরা যেন ক্ষমতায় আসতে না পারে সে জন্য এই প্রতারকরা কাজ করে যাচ্ছে। ধর্মীয় শিক্ষাবিরোধী এসব লোক ভালো করেই জানে, যদি সমাজে ধর্মীয় শিক্ষার বিস্তার লাভ করতে থাকে, তাহলে তাদের নেতৃত্ব খতম হয়ে যাবে। মাদরাসা শিক্ষাবিরোধী ষড়যন্ত্রের একটি চলমান দিক হচ্ছে এই শিক্ষাব্যবস্থার ঘাড়ে জঙ্গিবাদের দায় চাপানোর অপচেষ্টা। মাদরাসাগুলোকে জঙ্গি আস্তানা ও জঙ্গি প্রজননকেন্দ্র হিসেবে প্রমাণ করার জন্য সরকার ও তার সমর্থকগোষ্ঠী মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। জঙ্গি ধারার নাম করে মাদরাসাগুলোতে অন্যায় পুলিশি অভিযান চালানো হচ্ছে। নিরপরাধ ব্যক্তিদের আটক করে নাটক সাজিয়ে জঙ্গি বানানোর চেষ্টা চলছে প্রতিনিয়ত। সরকার সমর্থক গণমাধ্যমগুলো এ ক্ষেত্রে ঘৃণ্য অপপ্রচারে মেতে উঠেছে। দৃশ্যত তাদের ভূমিকায় মনে হয় মাদরাসা বন্ধ করতে পারলে দেশ সন্ত্রাসমুক্ত হয়ে যাবে। তারা কি বলতে পারবে শতকরা কতজন মাদরাসা ছাত্র সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ইভটিজিংসহ অন্যান্য অপরাধের সাথে জড়িত? যখন দেশের অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়কে ডাকাতদের গ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তখন একটি মাদরাসাও কি পাওয়া যাবে যেটাকে মানুষ খুনি অথবা ডাকাতদের গ্রাম বলেছে? ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালনকারী বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া মানিকের মতো কোনো ছাত্র কি মাদরাসা তৈরি করেছে? এরপরও যখন মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে অপপ্রচার চলে, তখন বোঝাই যায় নন-ইস্যুকে ইস্যু করা হচ্ছে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে। উচ্চশিক্ষায় মাদরাসা ছাত্ররা কিভাবে বঞ্চিত হচ্ছে সে বিষয়ে আলোকপাত করা জরুরি। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দিন দিন সঙ্কুচিত করা হচ্ছে। শর্তের বেড়াজাল তৈরি করে বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মাদরাসা ছাত্রদের ভর্তি হওয়ার সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদরাসা ছাত্রদের ভর্তির সুযোগ সীমিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে উচ্চশিক্ষা নেয়ার অধিকার সবার জন্য সমান থাকলেও মাদরাসা ছাত্ররা তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমনকি সরকারের সদিচ্ছা না থাকায় মাদরাসা ছাত্ররা উচ্চ আদালতে গিয়েও তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ প্রতিটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলোতে মাদরাসার ছাত্ররা ভালো রেজাল্ট করছে। মেধাবী ছাত্রদের যদি সরকার মূল্যায়ন না করে তাহলে কী করে দেশে প্রত্যাশিত আগামীর নির্মাতা তৈরি হবে? বিসিএসসহ সরকারি উচ্চপদে মাদরাসার ছাত্রদের চাকরি পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফাজিল ও কামিলকে ডিগ্রি ও মাস্টার্সের সমমান দেয়া হলেও এর সুফল এখনো দৃশ্যমান নয়। সমমানের হওয়া সত্ত্বেও মাদরাসা ছাত্ররা অনেক ক্ষেত্রে চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত। সরকারের সদিচ্ছার অভাবে দেশের সম্পদ হওয়ার পরিবর্তে আজ অনেক ছাত্র দেশের বোঝা হিসেবে থেকে যাচ্ছে। বিগত কয়েক বছর সেনাবাহিনীতেও মাদরাসা ছাত্রদের সুযোগ মিলছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় একবার বলে বসলেন যে, সেনাবাহিনীতে বড় একটি অংশ মাদরাসার ছাত্র। তারা আশঙ্কা করছেন যে তাদের সাথে জঙ্গি কানেকশন থাকতে পারে। আওয়ামী সরকারের এমন আচরণে দেশের মানুষ আজ আশাহত। যেখানে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের একটা বড় অংশই মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত, তাদের ব্যাপারে নেতিবাচক বক্তব্য প্রদান ও পদক্ষেপ গ্রহণ কোনোভাবেই সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সরকার মাদরাসা শিক্ষাকে ঢেলে সাজানোর নাম করে ‘কাঠ মোল্লা’ তৈরির ব্যবস্থা জারি করতে চাইছে। যারা সরকারের আজ্ঞাধীন হবে। যাদের দৃষ্টি মসজিদ-মাদরাসায়ই সীমিত থাকবে। সমাজে কী হচ্ছে তা নিয়ে যারা মাথা ঘামাবে না। যাদের কাজই হবে মৃত ব্যক্তির নামাজে জানাজা পড়ানো, কবর জিয়ারত করা, খতমে কুরআন পড়া, ঝাড়-ফুঁ দেয়া ও ক্ষমতাধরদের জন্য কল্যাণ কামনা করা। যারা সত্য জেনেও না জানার ভান করবে। শাসকবর্গের কোন অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে ধরিয়ে দেয়ার বা প্রতিবাদ করার সাহস যাদের থাকবে না। এক কথায় যারা হবে সরকারের হাতের পুতুল। স্বৈরাচারী চিন্তা থেকে নেয়া সরকারের এসব পদক্ষেপ রুখে না দিলে ভবিষ্যতে তা দেশের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সদ্য রাজনীতিতে পা দেয়া প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের মাদরাসা শিক্ষাবিরোধী অবস্থানও দেশবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। তিনি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে আঁটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি যখন মাদরাসা ছাত্র বেড়ে যাওয়ার বিষয়কে দেশের জন্য আশঙ্কাজনক হিসেবে চিত্রিত করেন, তখন তার মিশন বুঝতে কারোর বাকি থাকে না। তিনি এ দেশের মুসলমানদের আবেগ-অনুভূতি না বুঝে অকপটে মাদরাসা ছাত্র কমানোর মিশনের কথা বলেও ফেলেছেন। জয়ের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রাষ্ট্রীয় শক্তিকে ব্যবহার করে কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে ও হচ্ছে। প্রথমত, এই শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে বাধগ্রস্ত করে আধুনিক বিশ্বে একে পশ্চাৎপদ হিসেবে তুলে ধরার অপচেষ্টা চলছে। দ্বিতীয়ত, আলেম-ওলামদের নারীবিদ্বেষী হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। তৃতীয়ত, ‘মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার সাথে জড়িতদের সমাজের আপদ’, জনগণের মাথায় এই বক্তব্য ঢুকিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে আলেমদের জঙ্গি হিসেবে প্রমাণের ধারাবাহিক চেষ্টা চলছে। চতুর্থত, সরকারের সুযোগ-সুবিধাপুষ্ট, আজ্ঞাবহ পথভ্রষ্ট কিছু আলেমদের দিয়ে প্রতিনিয়ত হক্কানী আলেমদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। পঞ্চমত, ইসলামের মৌলিক নীতিমালার সাথে জাহেলিয়াতের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তথাকথিত উদারপন্থী মানুষ গড়ার অব্যাহত পাঁয়তারা চলছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি ইসলামের কল্যাণমূলক ফর্মুলা, যেমন, হালাল-হারাম, পর্দা ও অর্থনীতির বিধি-বিধান, এসবের পরিবর্তে সরকার ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়কেই গ্রহণ করে নিচ্ছে। জয়ের বক্তব্যকে আলেমসমাজ মেনে নিতে পারেনি, নেয়ার কারণও নেই। আলেমসমাজ তার বিবেচনাহীন, বিদ্বেষপ্রসূত বক্তব্য ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা জয়কে এ ধরনের বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থেকে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বলাবাহুল্য, জয় জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া প্রয়োজন বোধ করেননি। উল্টো তার মিশনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে কাজ করে চলছেন। নানামুখী ষড়যন্ত্রের কারণে আলেমসমাজ আজ মাদরাসা শিক্ষার ভবিষ্যৎ শঙ্কিত। সরকার যেভাবে আলিয়া ধারার মাদরাসাগুলোকে শর্তের ফ্রেমে বেঁধে সুযোগ সুবিধা না দিয়ে পরিচালিত করছে, তার ফলে সময়ের ব্যবধানে এ শিক্ষাব্যবস্থা একদিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নামেমাত্র চালু থাকলেও এখানে ছাত্ররা ভর্তি হতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। অপর দিকে কওমি মাদরাসার শিক্ষাকার্যক্রমে পরিবর্তন আনার চত্রুান্তও শুরু হয়েছে। সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে কওমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে একীভূত করার জন্য তথাকথিত আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে সরকার মরিয়া হয়ে উঠেছে। যেকোনো সময় কওমি মাদরাসার ওপর সরকারি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হতে পারে। যার সুদূরপ্রসারী ফল হবে ভয়াবহ। এতে দেশ প্রকৃত আলেমশূন্য হবে অদক্ষ আলেমদের পাঁয়তারা বেড়ে যাবে। একদিকে দ্বীনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইজতেহাদ করার লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না, অন্য দিকে অদক্ষ আলেমরা সুবিধামতো কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা করতে শুরু করবে। এতে করে চক্রান্তকারীদের স্বপ্ন ষোলকলায় পূর্ণ হবে। এই যখন অবস্থা, তখন আমাদের বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। ইসলামবিদ্বেষীদের চক্তান্ত রুখে দিতে সর্বশক্তি প্রয়োগই এখন সময়ের দাবি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে ইসলামী শিক্ষাবিরোধী কার্যক্রম চরম ধৃষ্টতাই বটে। সরকারের এই ধৃষ্টতার জবাব দিতে হবে। চলমান আধুনিক শিক্ষা যখন নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ তৈরির চাহিদা পূরণ করতে পারছে না, তখন নৈতিক বোধসম্পন্ন মানুষ তৈরির কারিগর মাদরাসা শিক্ষাকে ধ্বংসের চক্রান্ত সচেতনভাবে রুখে দিতে হবে। আমি মনে করি, আলেমসমাজের আজ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। ইসলামী শিক্ষা যে পশ্চাৎপদ শিক্ষা নয়, তা কথা ও কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করার ক্ষেত্র আলেমসমাজকেই তৈরি করতে হবে। এই শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা দেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছে যৌক্তিকভাবে তুলে ধরতে হবে। মিথ্যাচারের তাৎক্ষণিক ও যৌক্তিক জবাব দিতে হবে। নিজেদের কৌশলগত ভুল-ত্রুটি শুধরানোর পদক্ষেপও নিতে হবে। মাদরাসার জন্য ইসলাম ও আধুনিক প্রযুক্তিগত শিক্ষার সমন্বয় সাধন করে সিলেবাস প্রণয়ন করতে সচেষ্ট হতে হবে। মাদরাসা ছাত্রদের উচ্চশিক্ষা ও সরকারি উচ্চপদে পদায়নের সুযোগ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে আন্দোলন করতে হবে। পাশাপাশি আলেম নামধারী সরকারের ভাড়াটে গোলামদের মুখোশ জাতির সামনে উন্মোচন করতে হবে। পাহাড়সম বাধার প্রাচীর মাড়িয়ে যাওয়ার দৃঢ়তা ও নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে মহান আল্লাহর রহমতে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা তার ঐতিহ্য ধরে রেখে অবশ্যই সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। [email protected] ১৫ নভেম্বর ২০১৩, ঢাকা http://www.dailysangram.com/news_details.php?news_id=133411

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির