post

মানুষ গুজবে কান দেয় কেন?

মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত

১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বহুল প্রচারিত শব্দটি হচ্ছে ‘গুজব’। সোস্যাল মিডিয়ায় গত কয়েক দিনে ‘গুজব’ শব্দটি যতবার ব্যবহৃত ও উচ্চারিত হয়েছে, তা আর কোনো শব্দের ক্ষেত্রে হয়েছে কি না সন্দেহ। বহুল প্রচারিত ‘গুজব’ শব্দটির ব্যবহার বাড়ে ৪ আগস্টের পর থেকে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানীর জিগাতলা-সায়েন্সল্যাবে অবস্থানরত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা এবং তৎপরবর্তী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। সেদিন নিরাপদ সড়কের দাবিতে সপ্তম দিনের মতো রাজপথে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। সেদিন দলীয় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীরা একযোগে হামলে পড়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর। সে সময় ঘটনাস্থলে থাকা আহত শিক্ষার্থীরা ফেসবুক লাইভে এসে তাদের ওপর বর্বরোচিত হামলার বিবরণের পাশাপাশি এটিও বলে যে, তাদের চারজন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং চারজন ছাত্রীকে ধরে নিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। আরো বহু ছাত্রকে আটকে রেখেছে তারা। ঘটনাস্থলে থাকা ছাত্রছাত্রীদের অসংখ্য লাইভ ভিডিওতে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে তাদের সহপাঠী ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা প্রচ- বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ প্রশাসনের পক্ষ থেকে এটিকে ‘গুজব’ বলে মিডিয়ার সামনে তুলে ধরেন। আর এর পরপরই সোস্যাল মিডিয়ায় ‘গুজব’ শব্দটি একটি ব্যঙ্গাত্মক ও হাস্যরসাত্মক শব্দে পরিণত হয়। ইদানীং ছাত্রসমাজ ‘গুজব’ শব্দটিকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করছে। সোস্যাল মিডিয়ায় একযোগে প্রচারণার ধরন এমনই যে, শিক্ষার্থীদের কেউ আহত ও রক্তাক্ত কিংবা চোখে ব্যান্ডেজ, গুলিবিদ্ধ অথবা সাংবাদিকদের ওপর হেলমেটধারী আওয়ামী সন্ত্রাসীদের উপর্যুপরি হামলা এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণের ছবি অথবা একেকটি প্রামাণ্য ভিডিওচিত্র পোস্ট করে তার ক্যাপশনে লিখেছেন- ‘গুজবে কান দেবেন না। তবে চোখ দিয়ে দেখুন।’ একজন ছাত্রের চোখ উপড়ে ফেলা, চারজনকে হত্যা করা, চারজন ছাত্রীকে ধর্ষণ করা এবং আরো ছাত্রীকে আটকে রাখার যে খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তার পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের ডেকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ের ভেতরের দৃশ্য দেখানো হয়। এ রকম দু’জন ছাত্রলীগ সমর্থক ছাত্রকে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়- শিক্ষার্র্থীদের পক্ষ হতে যা বলা হচ্ছে তার সবই গুজব! সেদিনই রাতে এক প্রেসনোটে ডিএমপি থেকে জানানো হয় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে প্রচারিত ঘটনার কোনোটা ঘটেনি। এগুলো সবই গুজব। গুজবে কান না দেয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানানো হয়। সেদিনই মোবাইল অপারেটরদের মাধ্যমে একটি মেসেজ দিয়ে সরকার জানায় এটি গুজব মাত্র। আমার মোবাইলেও সে রকম একটি মেসেজ পেয়েছি। এড়াঃ. রহভড় থেকে পাঠানো মেসেজে লেখা ছিল- ‘রাজধানীর জিগাতলায় ছাত্রহত্যা ও ছাত্রীধর্ষণের ঘটনার কোনো সত্যতা নেই। বিষয়টি পুরোপুরি গুজব। এতে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। পুলিশকে গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করুন : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।’ যদিও আজ পর্যন্ত আসলে সত্যিকারার্থে সেদিন আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর কার্যালয়কেন্দ্রিক কী ঘটেছিল তা জাতির সামনে তুলে ধরা হয়নি। তথ্য জানার অধিকার একজন নাগরিকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। সেদিন আসলে কী ঘটেছিল এবং কোন ঘটনা থেকে গুজবের সূত্রপাত হয়েছে, কতজন আহত কিংবা কতজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কতজন শিক্ষার্থী হসপিটালে ভর্তি, কোন পক্ষ কোন পক্ষকে আঘাত করেছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছিলো। আর এই ঘটনার জন্য কোন তদন্ত কমিটি করা হয়েছে কিনা তা আজ পর্যন্ত জাতির সামনে তুলে ধরা হয়নি। যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নাগরিকদের গুজবে কান না দেয়ার আহবান জানিয়ে মেসেজ দেয়া হয় সে ঘটনার প্রকৃত সত্য যদি জাতির সামনে তুলে ধরা না হয় তাহলে নাগরিকরা গুজবে প্রভাবিত হবেন এটাই তো স্বাভাবিক। মূলধারার গণমাধ্যমকে যখন গলাটিপে ধরা হয় তখন গণমাধ্যমের বদলে সোস্যাল মিডিয়াকেই জনগণ খবর জানার মূল মাধ্যম হিসেবে ধরে নেয়। তখন যদি কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কোন খবর প্রচার করে তখন তা সত্য না মিথ্যা, কে তার প্রমাণ দেবে? ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন নিয়ে মূল ধারার গণমাধ্যমের ওপর সরকার খড়গহস্ত হয়েছে তখনই সেখানে সোস্যাল মিডিয়া শক্তিশালী অবস্থানে চলে গিয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রথম কয়েকদিন সকল টেলিভিশন চ্যানেল লাইভ প্রচার করেছিল কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রেসনোটে সে প্রক্রিয়া থেমে যায়। তথ্য মন্ত্রণালয় সকল টিভি চ্যানেলকে সরকারি নির্দেশনা মেনে চলতে বলে। সরকার সমর্থক চ্যানেল একাত্তর ও যমুনা টিভিকে বিশেষভাবে সতর্ক করে দেয়। ফলে সায়েন্সল্যাব ও জিগাতলায় সেদিন কোনো চ্যানেলই তেমন লাইভ প্রচার করেনি। এমনকি তথ্য মন্ত্রণালয়ের সতর্কবার্তার ফলে বেসরকারি সকল টিভি চ্যানেল কেন যেন বিটিভির মতো আচরণ করতে শুরু করে। সেদিন একটি পোস্ট দেখে খুব হাসি পেয়েছিল। কোন একজন স্কুলছাত্র বিটিভির খবর পড়ার একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছিল- ‘দিনাজপুরে বাতাবিলেবুর বাম্পার ফলন হয়েছে।’ এটি দিয়ে পোস্টকারী বুঝাতে চেয়েছেন হাজার হাজার স্কুলশিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে এলেও বিটিভিতে সেই খবর স্থান পায়নি। এটি বিটিভির প্রতি জনগণের এক ধরনের অনাস্থা। যদিও সংসদে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, বাংলাদেশে ৮০% মানুষ বিটিভি দেখে। সেদিন ধানমন্ডি জিগাতলায় যদি অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুযোগ থাকতো সকল মিডিয়াকে স্বাধীনভাবে খবর প্রচারের স্বাধীনতা দেয়া হতো, টিভি চ্যানেলগুলো যদি আগের মতো লাইভ টেলিকাস্ট করার সুযোগ পেত, তাহলে কোনটা সত্য আর কোনটা গুজব তা নাগরিকদের সামনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যেতো। মূলধারার গণমাধ্যমকে প্রেসনোট জারি করে এবং বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকারই তো গুজব সৃষ্টির সুযোগ করে দিয়েছে। গুজব মানুষের এক ধরনের বিশ্বাসের প্রতিফলন। মানুষ যা প্রতিনিয়ত দেখে এবং মানুষের অন্তরে যে বিষয় স্থির হয়ে গেছে, সে ধরনের ঘটনার খবর সামনে এলে- সেটা গুজব হোক বা সত্যি হোক, মানুষ তার বিশ্বাসের জায়গা থেকেই সেটিকে সত্য বলে ধরে নেয়। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা, গুলিবর্ষণ ও ধর্ষণের খবর কেইবা বিশ্বাস করবে না- বলুন দেখি। দেশের নাগরিকদের সামনে তো এমন জলজ্যান্ত উদাহরণ রয়েছেই! ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা এবং সেই লাশের ওপর পৈশাচিক নৃত্য, বিশ্বজিৎকে দিন-দুপুরে কুপিয়ে হত্যা, কুষ্টিয়ায় আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর নির্লজ্জ হামলা, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের ওপর হামলা, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে হাতুড়িপেটা- এসবতো সাধারণ নাগরিকদের স্মৃতি থেকে এখনও মুছে যায়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির নেতাদের ওপর ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্য গুলির ভিডিও এখনো সোস্যাল মিডিয়া ও ইউটিউবে আছে। এরপরও ছাত্রলীগের হামলার খবর জনগণ কিসের ভিত্তিতে গুজব বলে মনে করবে? আর ধর্ষণের ঘটনা- সেটা তো আরো স্পর্শকাতর। কিন্তু যে ছাত্রসংগঠনের নেতা কাজী নাসির উদ্দিন মানিকের ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপনের রেকর্ড আছে, যে সংগঠনের নেতাকর্মীদের ধর্ষণের খবর প্রতিদিন কোনো না কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়- সেই সংগঠনের লোকজন কাউকে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করেছে- এমন গুজবে কান দেয়ার যৌক্তিক উপকরণতো ছাত্রলীগই তৈরি করে রেখেছে! বাংলাদেশের মানুষ গুজবে কেন বিশ্বাস করছে? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর যে কেউ একবাক্যে বলে দিতে পারবে- সেটা হলো, এদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই। বাংলাদেশের মানুষ খবর পাওয়ার জন্য এখন আর টিভি চ্যানেল অন করে না। আর সে কারণেই মানুষ ঘটনা জানার জন্য সবার আগে সোস্যাল-মিডিয়ায় প্রবেশ করে এবং সত্যটা জানার চেষ্টা করে। একটা প্রেসনোট জারি করে কিংবা নাগরিকদের মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে গুজবে কান দেয়া থেকে জনগণকে বিরত রাখা আদৌ সম্ভব কি না- বিষয়টি সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ভেবে দেখবেন বলে আশা করি। প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করুন। গণমাধ্যমকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দেশে অবাধ তথ্যপ্রবাহের ব্যবস্থা করুন- দেখবেন, কোনটা ‘গুজব’ আর কোনটা ধ্রুব সত্য। তা যদি না হয় তাহলে এইসব চাতুর্যপূর্ণ প্রেসনোটই বরং হয়ে উঠবে অতীব নির্মম একেকটি গুজব। লেখক : এমফিল গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির