post

মিসরে ইসলামী আন্দোলন ও ইখওয়ানুল মুসলিমুন

১৪ নভেম্বর ২০১২

ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম

(গত সংখ্যার পর) ১৯৮১ সালে হোসনি মোবারক মিসরের প্রেসিডেন্ট হন এবং আরব বসন্ত শুরু হওয়ার পর ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘ ৩০ বছর পর ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন। স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতনের পর সেনাপ্রধান তানতাবির নেতৃত্বে সেনাপরিষদ মিসরের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়। তিউনিসিয়াড গণ-আন্দোলনের মাসখানেক চললেও মিসরে স্বৈরশাসককে হঠাতে এত দিন লাগেনি। মিসরে গণ-আন্দোলনের সূচনা হয় ২৫ জানুয়ারি ২০১১ মঙ্গলবার। তিউনিসিয়ার গণবিস্ফোরণ এবং এর ফলে স্বৈরশাসনের পতনে উদ্বুদ্ধ হয়ে এক দফার আন্দোলনের আহ্বান জানান হয় মিসরে। এখানে উল্লেখ্য যে, মিসরে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অন্যতম সংগঠক ছিলেন ওয়াসেল গোনিম। ৩০ বছর বয়সী গুগলের এক তরুণ কর্মকর্তা ফেসবুকের মাধ্যমে মিসরে গণ-আন্দোলনের আহ্বান জানান। পরে মুসলিম ব্রাদারহুডসহ মিসরের স্বৈরতন্ত্রবিরোধী শক্তিগুলো আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওয়াসেল গোনিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টাইম ম্যাগাজিনের জরিপে বিশ্বের সেরা ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় ২০১১ সালের জন্য শীর্ষে স্থান পেয়েছেন। ২১ এপ্রিল ২০১১ এ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি ফেসবুকের মাধ্যমে জানানো আহবানে সাড়া দিয়ে মিসরের রাজধানী কায়রোর বুকে লাখো মানুষের বিশাল মিছিল ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এনডিপি) বিভিন্ন কার্যালয়ের দিকে অগ্রসর হয়। একপর্যায়ে হোসনি মোবারকের পুলিশ বাহিনী গণতন্ত্রকামী মানুষের ওপর বেপরোয়া লাঠি চার্জ করলে সংঘর্ষ বেধে যায়। বিক্ষুব্ধ মিসরীয়রা ‘মোবারকের পতন চাই’ বজ্রধ্বনিতে রাজধানী প্রকম্পিত করে তোলে। এ জনতা সমবেত হয় তাহরির (স্বাধীনতা) স্কোয়ারে। চত্বরটি এর নামের অর্থের সাথে সামঞ্জস্য রেখে জনগণের প্রকৃত স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে ওঠে। বিক্ষোভের বহ্নিশিখা বিস্তৃত হয় অলেকজান্দ্রিয়া, পোর্ট সৈয়দ, মানসুরা, আসওয়ান, অ্যাসিউত, তানতা দোহা, গিজা, সুয়েজ প্রভৃতি শহরেও। গণ-আন্দোলনের নেপথ্য চালিকাশক্তি মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করা হয়। অবশ্য বহু বছর ধরেই এই বৃহৎ দলটি জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও নিজ নামে প্রকাশ্যে তৎপরতা চালাতে পারেনি। এদিকে আন্দোলনের প্রথম থেকেই ফেসবুক ও টুইটারে স্বৈরশাসক উৎখাতের আহ্বান দ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ২৫ জানুয়ারি সংঘর্ষে চারজন বিক্ষোভকারী ও একজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। ২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারি আগের দিনের জের ধরে পুলিশ-জনতা সংঘর্ষ বেঁধে যায়। পেটোয়া পুলিশ পানি-কামানের সাথে কাঁদানে গ্যাস ও লাঠি ব্যবহার করে নির্বিচারে। ফলে এ দিন ইখওয়ানের দু’জন কর্মী শহীদ হন। বশংবদ হোসনি মোবারকের জনসমর্থন নেই দেখে চতুর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিসরীয় জনগণের দাবিকে দৃশ্যত সমর্থন জানায়। মিসরের জনগণ চায় পূর্ণ গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সুশাসন। ক্ষমতার অপব্যবহারমুক্ত সরকার, দর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, বৈষম্যমুক্ত সমাজ আর সন্ত্রাসমুক্ত মিসর প্রতিষ্ঠার জন্যই জনগণ গণ-আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি দূর না হওয়ায় ব্যাপক মিসরীয়দের হতাশা ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের রূপ ধারণ করে হোসনি মোবারক সরকারের স্বেচ্ছাচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ক্রোধে রূপান্তরিত হয়। এভাবেই এক পর্যায়ে ধৈর্যের বাঁধ টুটে রাজপথে নেমে আসে জনগণ। গণবিস্ফোরণে টালমাটাল করে তোলে গোটা মিসর। ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি আইএইএ’র সাবেক প্রধান মোহাম্মদ এল বারাদি গণতন্ত্রের সংগ্রামে একাত্ম হতে মিসরে ফিরে আসেন। বিক্ষোভ প্রচণ্ড আকার ধারণ করে পোর্ট সুয়েজ, সিনাই, ইসমাইলিয়া প্রভৃতি শহরে। এসব শহরে পুলিশের সাথে জনতার সংঘর্ষ ঘটে। আতঙ্কিত সরকার আন্দোলনের আগুন চাপা দেয়ার ব্যর্থ প্রয়াসে ফেসবুক, টুইটার, সেই সাথে ব্লাকারির ম্যাসেঞ্জার সমেত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো বন্ধ করে দেয়। ২০১১ সালের ২৮ জানুয়ারি টলটলায়মান মসনদে আসীন হোসনি মোবারকের প্রশাসন দিশেহারা হয়ে ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের সংযোগ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন করার পদক্ষেপ নেয়। ক্রমবর্ধমান আন্দোলন দমনে এলিট ফোর্স নামানো হয়। এ দিন গ্রেফতার হন ইখওয়ানুল মুসলিমুনের ২০ জন নেতা। এই একদিনেই দেশজুড়ে সংঘর্ষে শহীদ হন ১১ জন আর আহতের সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। টিকে থাকার প্রয়াসে হোসনি মোবারক মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত করেন। পরদিন সালের ২৯ জানুয়ারিও পুলিশ-জনতা সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। পরিস্থিতি শান্ত করতে প্রেসিডেন্ট ৩০ বছরের শাসনকালে সর্বপ্রথম নিয়োগ দেন একজন ভাইস প্রেসিডেন্টকে। সাবেক গোয়েন্দা প্রধান ও ঘনিষ্ঠজন ওমর সোলেইমানকে এ পদে নিযুক্ত করা হয়। এদিকে অবনতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নামানো হয় সেনাবাহিনীকে। ৩০ জানুয়ারি গণ-বিক্ষোভের ঢেউ হয়ে ওঠে আরো উত্তাল। স্বৈরাচারী সরকার আরো একটা ব্যর্থ প্রয়াস হিসেবে জারি করে সান্ধ্য আইন। ওই দিকে, এত বছর যারা গদিতে হোসনি মোবারককে রেখেছিলেন ঠেস দিয়ে, সে পাশ্চাত্য শক্তিই তাকে বলল অবলিম্বে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে। ৩১ জানুয়ারি সান্ধ্য আইনের তোয়াক্কা না করে জনতা তাহরির চত্বরেই অবস্থান নেয়। তাদের সংখ্যা ছিল আড়াই লাখ। সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে শহীদ হন কয়েকজন। গণতন্ত্রকামী জনগণ পরদিন মিলিয়ন মার্চ-এর ডাক দেয়। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার মতলবে হোসনি মোবারকের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী আহমদ সফিককে বলেন বিরোধী দলের সাথে সংলাপ শুরু করতে। কিন্তু বিরোধী আন্দোলনকারীরা বিলম্ব না করে তা প্রত্যাখ্যান করে। মাহমুদ ওয়াগদিকে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ করা হয় গণ-আন্দোলন দমনে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। চরম অশান্ত অবস্থার মাঝে নিরাপত্তার অভাবে বিদেশীরা মিসর ছাড়তে শুরু করেন। ২০১১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি হোসনি মোবারক জাতির উদ্দেশে এক বেতার ও টেলিভিশন ভাষণ দেন। প্রেসিডেন্ট পদ ধরে রাখার কৌশল হিসেবে সংবিধান সংশোধনের কথা জানান। ঘোষণা করেন ২০১১ সালে সেপ্টেম্বরে মেয়াদ পুরো হলেই ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন আর প্রার্থী হবেন না। গণ-আন্দোলনের মূল শক্তি ইখওয়ানুল মুসলিমুন হোসনি মোবারকের এসব বক্তব্যকে ‘চাতুর্য’ আখ্যা দেন। এ দিনের সবচেয়ে বড় আলোচিত বিষয় ছিল তাহরির স্কোয়ারে বিশ লাখ লোকের সমাবেশ। সেনাবাহিনী এর আগে কঠোর ভূমিকা নিলেও এ দিন বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায়নি। সৈন্যরা বিক্ষোভকারীদের যেমন বাধা দেয়নি, তেমনি মোবারকপন্থী সন্ত্রাসীদের হামলাও অবলোকন করেছে নীরবে। পরদিন ২ ফেব্রুয়ারি হোসনি মোবারকের পেটোয়া সন্ত্রাসীদের হামলা, বোমাবাজি ও সংঘর্ষে নিহত হয় আটজন, আহত দেড় হাজারের বেশি। এদিন শহীদ হন ইখওয়ানুল মুসলিমুনের নেতা নূর আলী নূর। ১৫ কিলোমিটার দূরবর্তী গিজার পিরামিড এলাকা থেকে ঘোড়া ও উটের পিঠে চড়ে এসে সমবেত জনতার ওপর আচমকা হামলা করে মোবারকের সন্ত্রাসী বাহিনী। সাধারণ জনগণকে তাদের হামলা থেকে রক্ষা করতে গিয়ে নূর আলী নূর শাহাদাত বরণ করেন। (চলবে) লেখক : বিশিষ্ট ব্যাংকার ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির