post

মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. আল

কুরআনের জীবন্ত রূপ । ড. মুহা: রফিকুল ইসলাম

০৮ নভেম্বর ২০১৯

عَنْ زُرَارَةَ... فَقُلْتُ يَا أُمَّ الْمُؤْمِنِينَ أَنْبِئِينِي عَنْ خُلُقِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏.‏ قَالَتْ أَلَسْتَ تَقْرَأُ الْقُرْآنَ قُلْتُ بَلَى ‏.‏ قَالَتْ فَإِنَّ خُلُقَ نَبِيِّ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ الْقُرْآنَ ‏.‏ - قَالَ - فَهَمَمْتُ أَنْ أَقُومَ وَلاَ أَسْأَلَ أَحَدًا عَنْ شَىْءٍ حَتَّى أَمُوتَ....الى آخر الحديث. ) رواه مسلم ) হাদীসের অনুবাদ (এটি একটি দীর্ঘ হাদীস থেকে সংক্ষেপিত)। যুরারাহ (রা) থেকে বর্ণিত ...এরপর আমি বললাম: হে উম্মুল মু‘মিনিন! রাসূলুল্লাহ সা.-এর আখলাক সম্পর্কে আমাকে কিছু অবহিত করুন। একথা শুনে তিনি আমাকে বললেন, তুমি কি কুরআন পড় না? আমি বললাম হ্যাঁ, পড়ি। তিনি বললেন, আল্লাহর নবী সা.-এর আখলাক তো ছিল আল-কুরআন। সা‘দ ইবনু হিশাম ইবনু আমির বলেছেন, আমি তখন মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম; অতপর: উঠে চলে আসি এবং মৃত্যু পর্যন্ত এ ব্যাপারে আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করি না..। (সহীহ মুসলিম) হাদীসের প্রেক্ষাপট সা‘দ ইবনু হিশাম ইবনু আমির (র) আল্লাহর পথে (আজীবন) লড়াই করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। এরপর মদিনায় যখন এলেন তখন জানতে পারলেন নবী করিম সা. এটা করতে বলেন না। অর্থাৎ পরিবার এবং অন্যান্য কাজকর্ম বাদ দিয়ে শুধু লড়াই করা এটা দ্বীনসম্মত নয়। তখন তিনি আরো কিছু ব্যাপারে অবগত হওয়ার জন্য উম্মুল মু‘মিনিন ‘আয়িশা (রা)-এর কাছে যান এবং রাসূল সা. এর চরিত্র কেমন, বিতর সালাত কিভাবে আদায় করতেন, কিয়ামুল লাইল কিভাবে আদায় করতেন এসব জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।

আলোচনা আলোচ্য হাদীসাংশ মানব জীবনে অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে। যারা মহান আল্লাহ এবং রাসুল সা. কে অনুকরণ অনুসরণ করে মানবজীবনের সকল দিক ও বিভাগ পরিচালনা করতে চায় তাদের জন্য এ হাদীসের এ অংশটি অত্যন্ত কার্যকর ও সফল পথ নির্দেশনা করেছে। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যার আগে চরিত্র সম্পর্কে কিছু আলোচনা দরকার। আরবি خُلُقٌ শব্দের বাংলা অর্থ: চরিত্র, নৈতিকতা, স্বভাব, প্রকৃতি, নীতি ও আচরণ। আভিধানিক অর্থ হচ্ছে: মানুষের এমন জন্মগত স্বভাব ও প্রকৃতি যার ওপর তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। (والخلق اسم لسجية الإنسان و طبيعته التي خلق عليها)

এর পারিভাষিক পরিচয়ে আল জাহিয (মৃ. ২৫৫ হি.) বলেন: চরিত্র হচ্ছে মানব মনের এমন এক অবস্থা, যার দ্বারা মানুষ সতর্কতা বা অগ্রাধিকার ছাড়াই কোন কাজ সম্পাদন করে। কোন কোন মনীষী বলেছেন: চরিত্র হচ্ছে এমন কিছু সুবিন্যস্ত মৌলিক মানবীয় নীতিমালার সমন্বয়, যা মানব জীবনের শৃঙ্খলার জন্য প্রযোজ্য এবং ওয়াহি দ্বারা সীমাবদ্ধ। (مجموعة المبادئ والقواعد المنظمة للسلوك الإنساني، التي يحددها الوحي)

নবী করিম সা.-এর চরিত্র যদি আল কুরআনের মত হয় তাহলে তার চরিত্রের বর্ণনা দেওয়া এই ছোট পরিসরে মহাসাগরের পানিকে হার্মিং বার্ডের ঠোঁটে ঢুকিয়ে দেওয়ার চাইতে অসম্ভব। সুতরাং তার চরিত্রের যে সকল দিক ও বিভাগ মানবতার জন্য, অত্র দুনিয়ার জন্য, আখিরাতের জন্য চূড়ান্ত সফলতা ও মর্যাদা আনয়ন করেছে সে ধরনের কয়েকটি বিষয় উপস্থাপন করবো। আল-কুরআনে আঁকা রাসূল সা. এর চরিত্রের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা: নবী করিম সা. এর সার্বিক চরিত্রের খুব সংক্ষিপ্ত একটি চিত্র কয়েকটি আয়াত ও হাদীসের মাধ্যমে দেখে নেওয়া যায়। মহান আল্লাহ বলেন:

وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ “নিশ্চয়ই আপনি এক মহান চরিত্রের অধিকারী।” (সূরা কালাম: ৪) وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ

“হে মুহাম্মদ! আমি তোমাকে সমগ্র জগতের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।” (সূরা আম্বিয়া: ১০৭)

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِّلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

“আমি তো তোমাকে সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা উপলব্ধি করে না।” (সূরা সাবা: ২৮)

فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ لِنتَ لَهُمْ ۖ وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ ۖ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ ۖ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ

(হে নবী!) এটা আল্লাহর বড়ই অনুগ্রহ যে, তোমার ব্যবহার তাদের প্রতি বড়ই কোমল। নয়তো যদি তুমি রুক্ষ স্বভাবের বা কঠোরচিত্ত হতে, তাহলে তারা সবাই তোমার চার পাশ থেকে সরে যেতো। তাদের ত্রুটি ক্ষমা করে দাও। তাদের জন্য মাগফিরাতে দোয়া করো এবং দীনের ব্যাপারে বিভিন্ন পরামর্শে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করো। তারপর যখন কোন মতের ভিত্তিতে তোমরা স্থির সংকল্প হবে তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করো। আল্লাহ তাদেরকে পছন্দ করেন যারা তাঁর ওপর ভরসা করে কাজ করে। (সূরা আলে ইমরান: ১৫৯)

এ আয়াতগুলো ব্যাখ্যা করলে দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতার বিশাল এক দ্বার উৎঘাটিত হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। এর পাশাপাশি নিঃসন্দেহে নবী করিম সা. এর অনুপম চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যাবে। রাসূল সা.-এর চরিত্রের এ বিশালতাকে ইংরেজ কবি জন মিল্টন এ বর্ণনা করেছেন: Beyond less, boundless and bottom less see হিসেবে। আল কুরআন যেমন তামাম পৃথিবীর আদি-অন্তের সকল কিছু ধারণ করেছে, ঠিক মহানবী সা. এর চরিত্র-মাধুর্যে সকল বর্ণ-গোত্র-জাতির কল্যাণের ও মুক্তির মূলমন্ত্রগুলো সংযুক্ত হয়েছে। এর কিছু নমুনা উপস্থাপন করা হলো-

১. ধৈর্যশীলতা নিজেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সর্বদা আল্লাহ্ তায়ালার আনুগত্যের উপর অটল রাখা, অবাধ্যতার নিকটবর্তী না হওয়া, তার সিদ্ধান্তের কারণে হা হুতাশ না করা এবং তাতে রাগান্বিত না হওয়ার নামই ধৈর্য। রাসূল সা. ইসলামের দাওয়াতকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করতে গিয়ে কুরাইশদের কাছ থেকে অমানুষিকভাবে অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়ে ধৈর্যধারণ করেছেন। তিনি ধৈর্যধারণ করেছেন দুঃখের বছর, যুদ্ধক্ষেত্র, ইহুদিদের ষড়যন্ত্র, ক্ষুধা ও অন্যান্য পরিস্থিতিতে। কোন ষড়যন্ত্রই তাকে দুর্বল করতে পারেনি এবং কোন পক্ষই তাকে টলাতে পারেনি। আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূল সা.কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন-

هَلْ أَتَى عَلَيْكَ يَوْمٌ كَانَ أَشَدَّ مِنْ يَوْمِ أُحُدٍ، قَالَ : ” لَقَدْ لَقِيتُ مِنْ قَوْمِكِ مَا لَقِيتُ، وَكَانَ أَشَدَّ مَا لَقِيتُ مِنْهُمْ يَوْمَ العَقَبَةِ، إِذْ عَرَضْتُ نَفْسِي عَلَى ابْنِ عَبْدِ يَالِيلَ بْنِ عَبْدِ كُلاَلٍ، فَلَمْ يُجِبْنِي إِلَى مَا أَرَدْتُ، فَانْطَلَقْتُ وَأَنَا مَهْمُومٌ عَلَى وَجْهِي، فَلَمْ أَسْتَفِقْ إِلَّا وَأَنَا بِقَرْنِ الثَّعَالِبِ فَرَفَعْتُ رَأْسِي، فَإِذَا أَنَا بِسَحَابَةٍ قَدْ أَظَلَّتْنِي، فَنَظَرْتُ فَإِذَا فِيهَا جِبْرِيلُ، فَنَادَانِي فَقَالَ: إِنَّ اللَّهَ قَدْ سَمِعَ قَوْلَ قَوْمِكَ لَكَ، وَمَا رَدُّوا عَلَيْكَ، وَقَدْ بَعَثَ إِلَيْكَ مَلَكَ الجِبَالِ لِتَأْمُرَهُ بِمَا شِئْتَ فِيهِمْ، فَنَادَانِي مَلَكُ الجِبَالِ فَسَلَّمَ عَلَيَّ، ثُمَّ قَالَ: يَا مُحَمَّدُ، فَقَالَ، ذَلِكَ فِيمَا شِئْتَ، إِنْ شِئْتَ أَنْ أُطْبِقَ عَلَيْهِمُ الأَخْشَبَيْنِ؟ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: بَلْ أَرْجُو أَنْ يُخْرِجَ اللَّهُ مِنْ أَصْلاَبِهِمْ مَنْ يَعْبُدُ اللَّهَ وَحْدَهُ، لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا “

অর্থাৎ, আপনার কাছে কি এমন কোন দিন এসেছে যা উহুদের চেয়েও কঠিন দিন ছিল? রাসূল সা. বলেন: আমি তোমার কওম থেকে এমন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছি যা বর্ণনাতীত। আর আকাবার দিন (তায়েফের ঘটনা) ছিল তাদের পক্ষ থেকে সবচেয়ে কঠিন অবস্থা!! আমি নিজেকে সমর্পণ করলাম ইবনে আবদি ইয়ালিল ইবনে আব্দি কুলাল গোত্রের কাছে; কিন্তু, তারা আমার ইচ্ছায় সাড়া দিল না। অতঃপর আমি চেহারায় দুঃখের ছাপ নিয়ে ফিরে আসছিলাম। আমি যখন সম্বিত ফিরে পেলাম তখন আমি ছিলাম- ‘কারনে সায়ালেব’ নামক স্থানে। আমি মাথা উপরের দিকে তুললাম। দেখলাম একখ- মেঘ আমাকে ছায়া দিয়েছে। সেখানে জিবরাইল (আ)-এর সাক্ষাৎ পেলাম। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, আল্লাহ্ তায়ালা কওমের উদ্দেশে আপনার বক্তব্য ও তাদের জবাব শুনেছেন। তিনি আপনার কাছে পাহাড়ের ফেরেশতাকে পাঠিয়েছেন। তাদের ব্যাপারে আপনার যা খুশি তাকে নির্দেশ দেবেন। পাহাড়ের ফেরেশতা আমাকে ডেকে সালাম দিয়ে বললেন, হে মুহাম্মাদ সা.! আপনি যা চান তাই হবে। যদি আপনি বলেন তাহলে, আমি তাদের উপর পাহাড় দু’টি চাপিয়ে দেবো। রাসূল সা. বললেন: না! বরং, আমি চাই তাদের ঔরসজাত সন্তানদের মধ্য থেকে এমন কেউ বের হোক যে একমাত্র আল্লাহ্ তায়ালার ইবাদাত করবে তার সাথে কাউকে অংশীদার স্থাপন করবে না। (বুখারি ও মুসলিম) ২. সহনশীলতা সহনশীলতা হচ্ছে আত্মনিয়ন্ত্রণ করা। ব্যক্তির কথা কিংবা কাজ থেকে অপছন্দনীয় কোন কিছু যেন পাওয়া না যায় এমন আচরণের নাম সহনশীলতা। রাসূল সা.-এর মাঝে অসাধারণ এ গুণ বিদ্যমান ছিল, যা নিম্নোক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। আনাস (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَاعِدًا فِي الْمَسْجِدِ وَأَصْحَابُهُ مَعَهُ، إِذْ جَاءَ أَعْرَابِيٌّ فَبَالَ فِي الْمَسْجِدِ، فَقَالَ أَصْحَابُهُ: مَهْ مَهْ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” لَا تُزْرِمُوهُ دَعُوهُ “، ثُمَّ دَعَاهُ فَقَالَ لَهُ: ” إِنَّ هَذِهِ الْمَسَاجِدَ لَا تَصْلُحُ لِشَيْءٍ مِنَ الْقَذَرِ وَالْبَوْلِ وَالْخَلَاءِ “، أَوْ كَمَا قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” إِنَّمَا هِيَ لِقِرَاءَةِ الْقُرْآنِ وَذِكْرِ اللهِ وَالصَّلَاةِ “. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِرَجُلٍ مِنَ الْقَوْمِ: ” قُمْ فَأْتِنَا بِدَلْوٍ مِنْ مَاءٍ، فَشُنَّهُ عَلَيْهِ ” فَأَتَاهُ بِدَلْوٍ مِنْ مَاءٍ فَشَنَّهُ عَلَيْهِ- অর্থাৎ, হযরত আনাস বিন মালেক (রা) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সা. একবার সাহাবীদের সাথে মসজিদে বসা ছিলেন। এমন সময় একজন বেদুঈন এসে সেখানে প্রস্রাব করা শুরু করলে সাহাবীরা তাকে ধমক দিয়ে থামতে বললেন। রাসূল সা. বললেন: তাকে ছেড়ে দাও; বাধা স্রষ্টি করো না (প্রস্রাবে বাধা সৃষ্টি করলে বিভিন্ন রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে)। তারপর তিনি তাকে ডেকে বললেন, এগুলো মসজিদ; এ স্থান অপবিত্র কিংবা প্রস্রাব পায়খানার জন্য উপযুক্ত নয়। অথবা তিনি বলেছেন: সেটা কুরআন তেলাওয়াত, আল্লাহর যিকির ও নামাজের স্থান। অতঃপর রাসূল সা. কওমের একজন লোককে বললেন, তুমি পানি ভর্তি একটা বালতি নিয়ে আসো। এরপর এর উপর ঢেলে দাও। তিনি বালতিতে পানি এনে তার উপর ঢেলে দিলেন। (মুসনাদে আহমাদ) ৩. দানশীলতা মুহাম্মাদ সা.-এর দানশীলতা ছিল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী। তিনি নিজের কাছে কিছু থাকলে কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। তিনি একসময় ইয়েমেনি একসেট পোশাক পরেছিলেন। একজন এসে পোশাকটা চাইলে তিনি বাড়িতে গিয়ে সেটা খুলে ফেললেন। এরপর সেটা লোকটির কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তার কাছে কেউ কিছু চাইলেই তিনি তা দিয়ে দিতেন। একবার একজন লোক তার কাছে এসে ছাগল চাইলে তিনি তাকে প্রচুর পরিমাণ ছাগল দিয়েছিলেন, যা দুই পাহাড়ের মধ্যকার স্থান পূর্ণ করে ফেলবে। এরপর লোকটা নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গিয়ে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা ইসলাম গ্রহণ কর। আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ সা. এত বেশি পরিমাণে দান করেন যে কখনও দরিদ্রতার ভয় করেন না। এ ঘটনাটি মুসলিম শরীফে এসেছে এভাবে- عَنْ مُوسَى بْنِ أَنَسٍ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: ” مَا سُئِلَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى الْإِسْلَامِ شَيْئًا إِلَّا أَعْطَاهُ، قَالَ: فَجَاءَهُ رَجُلٌ فَأَعْطَاهُ غَنَمًا بَيْنَ جَبَلَيْنِ، فَرَجَعَ إِلَى قَوْمِهِ، فَقَالَ: يَا قَوْمِ أَسْلِمُوا، فَإِنَّ مُحَمَّدًا يُعْطِي عَطَاءً لَا يَخْشَى الْفَاقَةَ “ নবী করিম সা.-এর জীবনে মানব কল্যাণ, মানুষের মুক্তির চিন্তা, বিবাদ মীমাংসা, সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা, বন্ধু বৎসলতা, উদার মানসিকতা, মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক নিরাপত্তা, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা, অশান্তি বিলোপসাধন, নারীমুক্তি, দাসমুক্তি, মানুষের মাঝে সাম্য-ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠাসহ সকল ধরনের গুণাবলীর সমাবেশ ঘটেছিলো তার জীবনে। এ জন্য মহান আল্লাহ তার চরিত্রের সার্টিফিকেট প্রদান করেছন সূরা আল আহজাবের ২১ নম্বর আয়াতে। মহান আল্লাহ বলেন- لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا আসলে তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে একটি উত্তম আদর্শ, এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহ ও শেষ দিনের আকাঙ্ক্ষী এবং বেশি করে আল্লাহকে স্মরণ করে। রাসূল সা.-এর চরিত্র কিভাবে কুরআনময় তা আরেকটি হাদীস জানা যাবে-  عَنْ يَزِيدَ بْنِ بَابَنُوسَ قَالَ: دَخَلْنَا عَلَى عَائِشَةَ فَقُلْنَا: يَا أُمَّ الْمُؤْمِنِينَ، مَا كَانَ خُلُقُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ قَالَتْ: كَانَ خُلُقُهُ الْقُرْآنَ، تَقْرَؤُونَ سُورَةَ الْمُؤْمِنِينَ؟ قَالَتِ: اقْرَأْ: {قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ} [المؤمنون: ১] ، قَالَ يَزِيدُ: فَقَرَأْتُ: {قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ} [المؤمنون: ১] إِلَى {لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ} [المؤمنون: ৫] ، قَالَتْ: هَكَذَا كَانَ خُلُقُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ইয়াযিদ ইবনে ইয়াবানুস (রহ) থেকে বর্ণিত, আমরা আয়েশা (রা)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললাম, হে মুমিন জননী! রাসূলুল্লাহ সা.-এর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য কী ছিল? তিনি বলেন, কুরআনই ছিল তার চরিত্র। আপনারা সূরা মুমিনুন পড়ে থাকেন। তিনি বলেন, পড়–ন: “কাদ আফলাহাল মুমিনুন”। ইয়াযিদ (রহ) বলেন, আমি পড়লাম, “কাদ আফলাহাল মুমিনুন.... লিফুরুজিহিম হাফিযুন” পর্যন্ত (১-৫)। তিনি বলেন, এটাই ছিল রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর চরিত্র বৈশিষ্ট্য (নাসাঈ, হাকিম)। সুতরাং এ হাদীসের আলোকে যে বিষয়গুলো আমাদের ধারণ করতে হবে তা হচ্ছে- ক. আল-কুরআন অধ্যয়নের সময় মানবকেন্দ্রিক যে সকল সৎ গুণাবলী পাওয়া যাবে, তা অবশ্যই রাসূল সা.-এর মাঝে আছে তা মনে রাখতে হবে। খ. রাসূল সা.-এর চারিত্রিক কোনো বৈশিষ্ট্য সামনে আসলে নিশ্চিতভাবে বুঝতে হবে এটা আল-কুরআনে অবশ্যই আছে। গ. ব্যক্তি মাত্রই রাসূল সা.- এর চরিত্র ও কর্ম অনুকরণ করতে হবে। এবং আল কুরআনের নির্দেশনার আলোকে তা মানতে হবে। ঘ. প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য হচ্ছে, আল কুরআন থেকে থিওরি গ্রহণ করে রাসূল সা. এর জীবনপদ্ধতি অনুযায়ী তা বাস্তবায়ন করা। ঙ. মহান আল্লাহর কাছে দু‘আ করা, তিনি যেন সবসময় আমাদেরকে তাঁর ও রাসূল সা.-এর নির্দেশিত পথে পরিচালনা করেন। আমিন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির