post

যুগোপযোগী পরিকল্পনা : বাস্তবায়নই মূল কাজ

০৪ মে ২০১৫

মুহাম্মদ আব্দুল বাছেত#

Carear‘আমি কোনো কিছু করার সিদ্ধান্ত নিলে, জীবন দিয়ে তা করার চেষ্টা করি। সারা দুনিয়া তার বিরুদ্ধে গেলেও আমি তা করে ছাড়ি। যদি আমার কাছে তা সঠিক মনে হয়। আমি মনে করি, এটাই নেতার কাজ।’ এরূপ উক্তি করা তারই সাজে, যিনি এর বাস্তবতাও দেখিয়েছেন, তিনি হচ্ছেন সম্প্রতি মৃত্যুবরণকারী আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক ‘লি কুয়ান ইউ’। দুর্নীতি ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত মাত্র ৭১৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রাকৃতিক সম্পদহীন এই দ্বীপটি এখন এশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র। তার নেতৃত্বেই ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটি থেকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ মাথাপিছু আয়ের দেশে রূপান্তর হয়েছে রাষ্ট্রটি। শুধুমাত্র এতটুকুতেই ক্ষান্ত নয়। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বলবৎ রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাও প্রতিষ্ঠা করেছেন সেখানে। যুগোপযোগী পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত ড. মাহাথির মোহাম্মদকে সহযোগিতা করেছে বন জঙ্গলে ঘেরা মালয়েশিয়াকে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছাতে। যেকোনো লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে চাই যুগোপযোগী ও কার্যকর পরিকল্পনা। যেটি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদিও হতে পারে। সকল পরিকল্পনার একক হবে দিন। একেকটা দিন পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে পরিকল্পনা কতটুকু সফল হচ্ছে বা হওয়ার পথে। এবং পরিকল্পনাটি কতটুকু বাস্তবসম্মত। পরিকল্পনা গ্রহণে শুরুতেই ঠিক করা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। বর্তমানে কোন পর্যায়ে আছি, কোথায় যেতে চাই, কিভাবে যেতে চাই এবং সিদ্ধি অর্জনে কোন পথটি সঠিক ও যুগোপযোগী। লক্ষ্য ঠিক করতে গিয়েই যদি বাস্তবায়নের সময়টুকুই হারিয়ে ফেলি, সেটি হবে নিবুর্দ্ধিতার প্রমাণ, যার জন্য এখনই সময় লক্ষ্য ঠিক করার ও বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের। আজকের পরিবেশ, আবহাওয়া, পরিকল্পনা গ্র্রহণকারীদের মন-মগজ, চিন্তাধারা পরবর্তী প্রজন্মের সাথে কখনও সামঞ্জস্য হবে না। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণে বিষয়টি বিবেচনীয়। স্বাভাবিকভাবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের গুরুভার বর্তায় পরবর্তী প্রজন্মের ওপর। পরিকল্পনা গ্রহণে পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আবার এটি সহজ একটি কাজ। সে জন্য পরিকল্পনা গ্রহণে এমন কোনো পরামর্শ কাম্য নয়, যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষেও করাটা অসম্ভব। অথবা ওই পরিকল্পনার বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পিত হলে নানা অজুহাতে ঘিরে রাখবে তাকে। যা না বললেই নয়, এমন অনেক পরিকল্পনাও দেখেছি, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্তই ছিল যেটি স্থির; এক প্রজন্মের পরে অন্য প্রজন্ম পর্যন্ত পৌঁছায়নি তার গন্তব্য। কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল তার দৌড়। পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে যতো আবেগ-অনুপ্রেরণা, ত্যাগ ও বেগ পোহাতে হয়; বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তার অনেকটাই হারিয়ে যায়। অনেকেই আবার নেতিবাচক কথা শুনতে খুব বেশি অভ্যস্ত নয়। অথচ পরিকল্পনা গ্রহণে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়ই বিবেচনীয়। শুধুমাত্র সমালোচনার জন্যই এই আলোচনা নয়, বরং অতীত ও বাস্তবতা থেকে শিক্ষা অর্জনই মুখ্য। লক্ষ্য বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা- সঙ্কীর্ণ মানসিকতা। যে নিজেকে গুটিয়ে রেখে স্বপ্নরাজ্যে শুধুমাত্র স্বীয় কল্যাণেই মগ্ন, বৃহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণে অংশীদার হওয়া তার জন্য অশোভনীয়। গতানুগতিক চিন্তা-ভাবনা ও কাজ সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে একটু একটু অগ্রসরের মাধ্যমে সফলতার পরিধি বৃদ্ধি পেতে পারে। কিন্তু বৃহৎ লক্ষ্য বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব নয়। চিন্তার জগৎ যত গভীর ও প্রসার হবে, পরিকল্পনা হবে তত স্বচ্ছ ও ফলপ্রসূ। যেমনটি ঘটেছিল তেইশ বছর বয়সী চিন্তামগ্ন আইজ্যাক নিউটনের মাথায় আপেল ছিঁড়ে পড়ার মধ্য দিয়ে, যা নিউটনকে সহায়তা করেছে ‘অভিকর্ষ তত্ত্ব’সহ বিজ্ঞানের জগতে নব নব আবিষ্কারের পরিকল্পনা গ্রহণের। সে কারণে যে তার মনকে যত মহৎ করতে পারবে, পরিকল্পনা গ্রহণ ও আবিষ্কারে তিনি তত আন্তরিক হবেন। স্বার্থপরতা, এককেন্দ্রিকতা ও অন্ধতা যাকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারে না। পরিকল্পনা গ্রহণে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বাস্তবায়নের মানসিকতা ও কর্মপন্থা তৈরি করা। আমিত্ব স্বভাব বাদ দেয়া। ‘আমি’ শব্দের যথাসম্ভব প্রয়োগ কমিয়ে আনা। শব্দটির অধিক ব্যবহার ধীরে ধীরে অন্যদের থেকে নিজেকে আড়াল করে দেয়। এতে ¯্রষ্টার করুণা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। কথায় আছে ‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’। বৃহৎ লক্ষ্য এককভাবে নয়, বরং সামগ্রিক ভাবেই বাস্তবায়ন হওয়া সম্ভব। কারণ মতামতে সর্বসম্মতি বা ঐকমত্যে শয়তান প্ররোচনা প্রদানেরও সুযোগ পায় কম। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য একটি শক্ত খুঁটির প্রয়োজন, শত প্রতিকূল পরিবেশে লক্ষ্য বাস্তবায়নে যাকে বিন্দুমাত্র নড়াতে পারবে না। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এ খুঁটি প্রস্তুত রাখতে হবে বাস্তবায়নের সময়কাল। পরিকল্পনাকে বার্ষিক, মাসিক, দৈনিক ইত্যাদি আকারে ভাগ করে প্রতিদিনের কর্মবিন্যাস থাকবে টেবিলে, যা ব্যক্তির মনকে কর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে বাস্তবায়ন পর্যন্ত। নির্দিষ্ট সময়ে কোনো কাজ শেষ না হলে পরবর্তী পরিকল্পিত সময় থেকে কিছু সময় গ্রহণ করে ভারসাম্যতা নিয়ে আসা যায়। যেমনি ঘটে পরীক্ষার হলে। কোনো প্রশ্নের উত্তর শেষ করতে অনেক ক্ষেত্রে অন্য প্রশ্নের বরাদ্দকৃত সময় থেকে কিছু সময় নিতে হয়। সংশ্লিষ্ট কাজে অভিমত ও পরিপক্ব ব্যক্তি দিয়েই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। যেমনটি হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয়েছিলেন বৈজ্ঞানিক আইজ্যাক নিউটনের মা। চাষাবাদ ও খামারের কাজ দিয়ে তার মা কখনই তার থেকে যথার্থভাবে কাজ আদায় করে নিতে পারেননি। নিউটনের মা বুঝতে পেরেছিলেন, এ কর্মে তার ছেলে নির্বোধ-অকর্মণ্য। অলসতা ও অবহেলায় দৈনন্দিন যে সময়টুকু নষ্ট হয়, পরিকল্পনায় সে সময়টুকু আওতাভুক্ত করে নেয়া। লক্ষ্য বাস্তবায়নে সময়ের গুরুত্ব বুঝতে গিয়ে ¯্রষ্টাও নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর উপাসনা করার পর বসে না থেকে জমিনে কর্মে মনোনিবেশ হতে। সিদ্ধি অর্জনের জন্য প্রয়োজনে শারীরিক ও মানসিক ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। বড় ধরনের পরীক্ষা বা আপদের সম্মুখীন হওয়ার মানসিকতা যারা তৈরি করতে না পারবে; বৃহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে হাত না জাগানোই তাদের ভালো। অনড় মনোবল ও দৃঢ়তা দীর্ঘ কারাবাস নেলসন ম্যান্ডেলাকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ উচ্ছেদের যুগোপযোগী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের পথ থেকে বিন্দুমাত্র নড়াতে পারেনি। সুদীর্ঘ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জেলজীবনেও ছিলেন না স্থির, লিখেছেন ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’। বইটির শেষ অংশে তিনি লিখেছেন ‘স্বাধীনতার জন্য আমাকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে’। অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আমি স্বাধীনতার সুউচ্চ পাহাড়ে আরোহণ করেছি। পাহাড়ে উঠে দেখতে পেলাম, আশপাশে অনেক পাহাড় আছে। সেগুলোতেও উঠতে হবে আমাকে। আমি এখন যে পাহাড়ে আছি সেটা একটু বিশ্রাম নেয়ার জায়গা মাত্র। আমাকে ছুটতে হবে আরও অনেক দূর। এ পথে আসবে অনেক বাধা-বিপত্তি, তবুও আমাকে ছুটতে হবে। নেই কোনো সুযোগ বিশ্রাম নেয়ার। স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিছু দায়িত্ব, সে দায়িত্ব পালন করে আমাকে আরও অনেক দূর যেতে হবে। আমার পথ এখনও হয়নি শেষ। সাময়িক ব্যর্থতা, হতাশা আর গ্লানি যেন চেপে ধরতে না পারে। লক্ষ্য বাস্তবায়নে লেগে থাকা। ধীরে ধীরে সময়ের পরিক্রমায় সফলতা ঠিকই ধরা দেবে। দরিদ্রতা, দুঃখ কষ্ট ছাড়া কালোরাও পিছিয়ে থাকেনি গন্তব্যে পৌঁছাতে। অপরাহ উইনফ্রে হয়েছেন বিশ্বখ্যাত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, লেখিকা ও স্বীকৃতি পেয়েছিলেন ২০১৩ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী হিসেবে। ব্রত বাস্তবায়নের অবিরাম সাধনা কালো চামড়ার টনি মরিসনকে করেছে নোবেল বিজয়ী বিখ্যাত লেখিকা। লেখক : সেক্রেটারি, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির