post

রক্তাক্ত রাজনীতি ও মিথ্যার তীর বর্ষণে শুরুর বছর ২০১৭ বিদায়

আবু হামীম হারুন

০৫ জানুয়ারি ২০১৮
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, গুম, খুন আতঙ্ক, মানবাধিকারবঞ্চিত মানবতার আর্তনাদ, প্রশ্নপত্র ফাঁস, দুদকের অভিযান, প্রশাসনে বঞ্চিত আর ওএসডি কর্মকর্তাদের হা-হুতাশন, প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ প্রশ্নে উত্তপ্ত বিচার বিভাগ, লাগামহীন দ্রব্যমূল্য, ব্যাংকে ও সরকারি উন্নয়নের নামে অর্থনৈতিক লুটপাট, গণতান্ত্রিক অধিকারবঞ্চিত বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দুঃসহ সংগ্রামী জীবন আর সংস্কৃতিতে বিজাতীয় আধিপত্যের দাপট দেখিয়ে বিদায় নিলো ঈসায়ী ২০১৭ বর্ষ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে যে অনিশ্চয়তার সূচনা হয়েছে তা কাটেনি ২০১৭ সালেও। যদিও নির্বাচনের আগে সংবিধান রক্ষার কথা বলে সেই নির্বাচন শেষ হওয়ার পর আর একটি নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি বর্তমান ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছিল। বিগত তিন বছরেও সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি। বরং বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা দিনের পর দিন বেড়েছে। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বাইরের ভিন্নমতের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ওপরও চলেছে একই কায়দায় বঞ্চনা আর লাঞ্ছনার স্টিমরোলার। ২০১৭ সালটি শুরু হয়েছিল ঘাতকের বুলেটে রক্তাক্ত একজন আওয়ামী লীগ এমপির জীবনাবসানের নির্মম খবর এবং এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিরীহ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সরকারি দলের উচ্চমহলের মিথ্যা অভিযোগের তীর বর্ষণের মধ্য দিয়ে। রক্তাক্ত রাজনীতি আর ক্ষমতাসীন মিথ্যাচার দিয়ে শুরু হয়েছিল ২০১৭ বিদায়ী ২০১৭ বছর শুরুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে নিজ বাড়িতে ঢুকে গুলি হত্যার ঘটনায় হকচকিয়ে উঠেছিলো দেশবাসী। সর্বানন্দ ইউনিয়নের শাহাবাজ এলাকায় নিজের বাড়িতে হামলার শিকার হয়ে গুলিবিদ্ধ লিটনকে সঙ্গে সঙ্গে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলেও তাকে বাঁচানো যায়নি। লিটনের দল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা কোন প্রকার তথ্য প্রমাণ ছাড়াই হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রথমে জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করে মিডিয়া গরম করা শুরু করেন। সর্বোচ্চ নেতা থেকে নিয়ে সবার অভিযোগের বন্যায় নিরপেক্ষ তদন্ত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, এমন কথা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হলেও মিথ্যাচার চলতেই থাকে। সরকারের অব্যাহত চাপের কারণে পুলিশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, বিএনপি ও ছাত্রদলের নিরীহ কর্মীদের নির্বিচারে গ্রেফতার করে। মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করতে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে। পরে অবশ্য পুলিশি তদন্তে সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টির এমপি প্রার্থী কর্নেল (অব:) ডা. আব্দুল কাদের খানের জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে। তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে কর্নেল (অব:) ডা. আব্দুল কাদের খানকে গ্রেফতার করে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী। পরে তিনি হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করেন। এখন তিনি জেলে আছেন। ৪৮ বছর বয়সী লিটন এবারই প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার (মেরিন) ছিলেন; আনন্দ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালকও ছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য লিটনের শূন্য আসন থেকে উপনির্বাচনে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের মনোনীত সদস্য সদস্য গোলাম মোস্তফা আহমেদ বিদায়ী বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরের ১৯ তারিখে ইন্তেকাল করেছেন। তিনি ২০১৭ সালের ১৮ নভেম্বর টাঙ্গাইলের নাটিয়াপাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর। মিথ্যাচার, মামলা-হামলা, গণতান্ত্রিক অধিকারহরণ, অপহরণ নিখোঁজ, গ্রেফতারের পর জেলহাজতে বিরোধী দলের নেতাদের একাধিক মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। রংপুর জেলহাজতে বদরগঞ্জের জামায়াত নেতা জয়নাল আবেদিনের (৬৫) মৃত্যু হয়েছে ২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর সকালে রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে। ২০১৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হওয়ার ২৪ ঘন্টা পর পুলিশের নির্যাতনে নিহত হন মাওলানা সাঈদুর রহমান (৪৮)। তিনি কলারোয়ার হঠাৎগঞ্জ মাদ্রাসার সুপার, স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং জামায়াত নেতা ছিলেন। ঘটনার মধ্যে ২০১৭ এর সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ৯ অক্টোবর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির মকবুল আহমাদ, সেক্রেটারি জেনারেল ডা: শফিকুর রহমান, নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার সাবেক এমপিসহ কেন্দ্রীয় ৯ নেতাকে গ্রেফতার। তার আগে ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুল, সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমির মঞ্জুরুল ইসলাম ভূঁইয়া, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য আবদুস সবুর ফকিরসহ জামায়াতে ইসলামীর ৮ জন নেতাকে ২৯ সেপ্টেম্বর শুক্রবার গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা এখনো জেলহাজতে আছেন। তাদেরকে একের পর এক মামলায় আটক দেখাচ্ছে পুলিশ। দেশের কোথাও না কোথাও থেকে প্রায় প্রতিদিনটি দলটির নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করছে পুলিশ। মামলা, হামলা, হুলিয়া, খুন-গুমের জালে বন্দী দেশের সত্যিকারে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। দলটির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতিসহ কয়েক হাজার নেতা-কর্মী এখনো জেলহাজতে আছে। সরকার বিরোধীদের গুম, হত্যা নির্যাতন করছে অভিযোগ করে মানবাধিকার লঙ্ঘনে দলীয় পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে বিএনপি। গত বছরের ডিসেম্বরে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক পরিসংখ্যান প্রকাশকালে বলেন, সরকার শুধু শক্তির জোরে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে আছে। যারাই ভিন্নমত পোষণ করছে, তাদের হয় হত্যা, না হয় গুম করছে। আমাদের দলের প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, শুধু বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার সংখ্যা ৭৮ হাজার ৩২৩, আসামির সংখ্যা ৭ লাখ ৮৩ হাজার ২৩৮, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সরাসরি খুনের সংখ্যা ৫২০, অপহরণের সংখ্যা ৬৪৭ এবং এখন পর্যন্ত নিখোঁজ আছেন ১৫৭ জন। নির্যাতনের শিকার ৩৭ লাখ এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের জুয়েল ও ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান এখনো জেলে। ২০ দলীয় জোটনেত্রী বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া জন্য বিগত বছরটি ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক হামলায় আদালতে হাজিরা দেয়ার বছর। তিনি লন্ডন সফরের পর দেশে ফিরলে বিএনপির রাজনীতিতে নতুন মাত্র যোগ হয়, নেতা-কর্মীরা দ্বিগুণ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে কাজ শুরু করে। বিশেষ করে বছরের শেষের দিকে নভেম্বর মাসে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশ শত প্রতিকূলতা আর সরকারের বিরোধিতার পরও মহাসমাবেশে পরিণত হলে নেতা-কর্মীদের মাঝে নবোদ্দীপনার সূচনা হয়। ২০১৭ সালেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বর্তমান কার্যনির্বাহী সংসদের মেয়াদ এক বছর পূর্ণ হয়। ২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে মধ্য দিয়ে টানা অষ্টমবার সভাপতি নির্বাচিত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর প্রথমবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ওবায়দুল কাদের। কার্যনির্বাহী সংসদের প্রবীণের মাঝে স্থান পায় এক ঝাঁক তরুণ মুখ। দলের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন, বর্ধিত সভা, বিভাগীয় প্রতিনিধি সভা, জেলা কর্মিসভা, জেলা কমিটি অনুমোদন, কয়েকটি সহযোগী সংগঠনের কাউন্সিল অধিবেশন, সবগুলো উপ-নির্বাচনে জয়লাভ, জেলা পরিষদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালীকরণে আওয়ামী লীগ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে লক্ষ্য করে সাংগঠনিক গতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে নজর দেয় দলটি। কিন্তু মাঝপথে অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে দেশের বিভিন্ন স্থান প্লাবিত হয়ে যায়। এতে উত্তরবঙ্গ, হাওর এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বন্যা দেখা দেয়। বন্যার ধাক্কা সামলিয়ে উঠতে না উঠতেই মিয়ানমারের একরোখা নীতির কারণে মনুষ্যসৃষ্ট রোহিঙ্গা সংকট নেমে আসে। এরপর সুপ্রিম কোর্টের একটি পর্যবেক্ষণের রায়কে কেন্দ্র্র করে বিচার বিভাগ এবং সরকারের মুখোমুখি অবস্থানের ধাক্কা সামলানোর ঘটনা। সরকারি দল হিসেবে একের পর এক ধাক্কা সামলানোর মাঝেই দলের কয়েকজন নেতাকে হারানোর বেদনাও সইতে হয়েছে ২০১৭ সালে। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম মহানগরীর সভাপতি সাবেক মেয়র মহিউদ্দীনের ইন্তেকাল এবং তার কুলখানিতে পদদলিত হয়ে ৯ জন সংখ্যালঘুসহ ১১ জনের প্রাণহানির ঘটনা সত্যি হৃদয়বিদারক। বছরের শেষে তাদের জন্য আরেকটি দুঃসংবাদ হলো রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাদের মিত্র দল জাতীয় পার্টির কাছে বড় ব্যবধানে পরাজয়। এ বছর নতুন করে গরিব হয়েছে পাঁচ লাখ মানুষ বিগত বছর জুড়েই নিত্যপণ্যের বাজার ছিল সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। বিশেষ করে বছরের শেষে দিকে চাল, পেঁয়াজ, আটা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বাড়ার সাথে সাথে সরকার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে মধ্যবিত্তরা তাদের অবস্থান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং-সানেমের গবেষণা বলছে, চলতি বছর চালের দাম বাড়ায় দারিদ্র্যসীমা থেকে বের হয়ে আসা পাঁচ লাখ ২০ হাজার মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমায় ঢুকেছে। ২৩ ডিসেম্বর শনিবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে এক অনুষ্ঠানে এই গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির ত্রৈমাসিক পর্যালোচনা’ তুলে ধরতেই এই আলোচনার আয়োজন করা হয়। চলতি বছর বন্যায় হাওর এলাকা ছাড়াও দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ধানের উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশ প্রধানত এই মৌসুমের ওপর নির্ভর করে আর এই সময় উৎপাদনে ধস নামায় চালের দাম বেড়ে যায় অস্বাভাবিকভাবে। এক পর্যায়ে মোটা চালের দাম কেজি প্রতি ৫০ টাকা এবং চিকন চাল ৭০ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। কেবল চালের দাম বেড়েছে, এমন নয়, ধান তোলা থেকে শুরু করে চাল বাজারে নানা পর্যন্ত নানা ধাপেই স্বল্প আয়ের মানুষের আয়ের পথ সংকুচিত হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার নিজে চাল আমদানির পাশাপাশি বেসরকারি খাতে আমদানি বাড়াতে শুল্ক তুলে দিয়েছে। এতে চালের দাম কিছুটা কমে এলেও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দাম এখনও ৩০ থেকে শতাংশ বেশি। সানেমের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বড় ধরনের আমদানি সত্ত্বেও চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই বছর চালের মূল্য বৃদ্ধির কারণে দারিদ্র্যের হার দশমিক ৩২ শতাংশ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। অর্থাৎ এই বছর চালের দাম বৃদ্ধির ফলে পাঁচ লক্ষ ২০ হাজার মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে।’ অনুষ্ঠানে জানানো, দেশে দারিদ্র্যমুক্তির কাজ এগিয়ে চললেও এই হার আগের চেয়ে কমেছে। ২০০২ থেকে ২০০৫ সালে বার্ষিক দারিদ্র্য হ্রাসের হার ছিল ১.৮ শতাংশ, যা ২০০৫ থেকে ২০১০ সালে ১.৭ শতাংশে নেমে আসে। ২০১০ থেকে ২০১৬ সালে এটি আরো কমে ১.২ শতাংশে নেমে যায়। সেলিম রায়হান বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাভাবিক জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বজায় থাকলে সামগ্রিক ও চরম দারিদ্র্যে হার ২০৩০ সালের মধ্যে যথাক্রমে ১০ শতাংশ ও চার শতাংশে নেমে আসবে। আর জিডিপির গড় বৃদ্ধির হার আট শতাংশ হলে সামগ্রিক ও চরম দরিদ্রতার হার যথাক্রমে ৬.০৫ এবং ও দুই শতাংশ হবে। এই গবেষকের মতে বাংলাদেশের জন্য এখন দুইটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত. উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার পাশাপাশি দারিদ্র্যের হার হ্রাসের প্রক্রিয়াকে আরও গতিশীল করা। এটা ছাড়া ২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়নে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে। দ্বিতীয়. শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতে বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেয়া। ব্যাংকিং খাতে ঋণ কেলেঙ্কারি ও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি নিয়েও কথা বলেন এই অর্থনীতিবিদ। ব্যাংক আইন সংশোধন করে একই পরিবার থেকে আরও বেশি পরিচালক রাখার সুযোগ সৃষ্টিরও বিরোধিতা করেন তিনি। বলেন, ‘ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের একই পরিবারের চারজন সদস্যকে টানা নয় বছর দায়িত্ব পালনের সুযোগ দিলে তা ব্যাংকিং খাতকে আরো ভঙ্গুর করে দিতে পারে।’ অনুষ্ঠানে জানানো হয়, গত অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। তবে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত রপ্তানি ৬.৮৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। চামড়া শিল্পকে ‘বছরের পণ্য’ হিসেবে ঘোষণা করা সত্ত্বেও এই খাতে দুর্বল ব্যবস্থাপনার জন্য চামড়া খাতের রপ্তানি ২.৯৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ব্যাংকিং খাতের চরম খারাপ অবস্থা ৪৮টি ব্যাংকের মধ্যে ১৩টির আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ। এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অনেক বেড়েছে। সব ব্যাংকেই যেন সুশাসনের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। নামে-বেনামে ইচ্ছামতো অর্থ তুলে নেয়া হয়েছে। ঋণে বেড়েছে অনিয়ম। সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি ব্যবস্থা আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। দেশে সরকারি-বেসরকারি-বিদেশি মিলে মোট ৫৭টি ব্যাংক রয়েছে। আর্থিক অবস্থার অবনতি হওয়া ১৩টি ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও বিশেষায়িত ব্যাংক আটটি। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স, ন্যাশনাল, ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়ালে পরিস্থিতি কয়েক বছর ধরে খারাপ। এছাড়া বেসরকারি খাতের একাধিক ব্যাংকের মালিকানা বদল নিয়েও নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে আমানতকারীদের মধ্যে বড় ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে সেগুলো চালু রাখতে হচ্ছে। অন্যদিকে বিদ্যমান বেসরকারি চালু ব্যাংকগুলো যেখানে ভালো চলছে না, সেখানে নতুন ব্যাংক অনুমোদনের তোড়জোড় চলছে। খেলাপি ঋণে ঘাটতিতে প্রভিশন ও মূলধন: বছরের শুরু থেকে ব্যাংকিং খাতে লাগামহীনভাবে বাড়ে খেলাপি ঋণ। নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) ও মূলধন ঘাটতিতে পড়ে সরকারি-বেসরকারি বেশকিছু ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাত লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা, যা ১৬ ডিসেম্বর শেষে দাঁড়ায় ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। সরকারি ও বেসরকারি খাতের সাতটি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংক। বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক ও নতুন করে যুক্ত হয়েছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। মোট ঘাটতির সিংহভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংকের। সবচেয়ে বেশি তিন হাজার ৪২১ কোটি টাকা ঘাটতিতে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকে। প্রভিশন ঘাটতির পাশাপাশি মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে আটটি ব্যাংক। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে আট ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে তিনটি রাষ্ট্রীয় মালিকানার বাণিজ্যিক ব্যাংক, তিনটি রাষ্ট্রীয় মালিকানার বিশেষায়িত ব্যাংক এবং তিনটি বেসরকারি খাতের ব্যাংক রয়েছে। নতুন করে যোগ হয়েছে চতুর্থ প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংক। ব্যাংকের পর্ষদ বদল: বছরের শুরুতেই বেসরকারি খাতের অন্যতম ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। গত বছরের শুরুতে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইসলামী ব্যাংক এবং অক্টোবরে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়। ব্যাংক তিনটির শেয়ার বিক্রি করে মালিকানায় পরিবর্তন আনা হয়। চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ এখন ব্যাংক তিনটির মালিক। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেলে অনুষ্ঠিত ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় আরমাডা স্পিনিং মিলের পক্ষে পরিচালক হিসেবে আরাস্তু খান যোগ দেন। এরপরই চেয়ারম্যান মুস্তাফা আনোয়ার ও ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আবদুল মান্নান পদত্যাগ করেন। কমার্স ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আরাস্তু খান চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। আবদুল হামিদ মিঞাকে নতুন এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ২ জুন ব্যাংকটির ৩৩তম বার্ষিক সাধারণ সভায় নতুন শেয়ারহোল্ডার পরিচালক ও স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য নতুন নতুন কোম্পানি তৈরি করে ব্যাংকটির পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়। এদিকে পর্ষদ পরিবর্তনের পর থেকে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় ইসলামী ব্যাংকে। এরপর থেকে ব্যাংকটির শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেন বিদেশি উদ্যোক্তারা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকটিতে বিদেশিদের হাতে ছিল মোট শেয়ারের ৭১ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা চলতি বছরের ৩০ নভেম্বর শেষে কমে দাঁড়িয়েছে ৪৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। বর্তমানে ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। কমে গেছে আয় ও আমানতের প্রবৃদ্ধি। চলতি বছরের অক্টোবরে কুয়েত ফাইন্যান্স হাউজ আট কোটি ৪৫ লাখ ৬৩ হাজার ৭৮২টি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করে এস আলম গ্রুপের কাছে। গ্রুপটির হাতে বেসরকারি খাতের আরো বেশ কয়েকটি ব্যাংকের কর্তৃত্ব রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর মধ্যে এক্সিম ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ছাড়া সবকটিই এখন চট্টগ্রামের এ গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। এদিকে চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর ইসলামী ব্যাংকের কায়দায় পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন আনা হয় বেসরকারি খাতের সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল)। এ পরিবর্তনেও জড়িত ছিলেন এস আলম গ্রুপের সংশ্লিষ্টরা। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান রেজাউল হক, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আনিসুল হক, এমডি শহীদ হোসেনকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফ। নতুন এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের অতিরিক্ত এমডি কাজী ওসমান আলীকে। এ ছাড়া নির্বাহী কমিটির নতুন চেয়ারম্যান করা হয় এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান বেলাল আহমেদকে। তিনি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের জামাতা। এসব কারণে বেসরকারি ব্যাংকে পরিবর্তন আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ বিষয়ে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, নদী ও চর দখলের মতোই একের পর এক ব্যাংক দখল হচ্ছে, যার কোনো বিচার নেই। ফলে তৈরি হচ্ছে অসমতা। বাড়ছে বৈষম্য। তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়নের কথা বলা হলেও সেজন্য যে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দরকার তার ঘাটতি রয়েছে। ফলে বিভিন্ন খাতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়বে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ: বছরজুড়ে ব্যাংকগুলোর পর্ষদ পরিবর্তন ও অনিয়মে প্রায় নিশ্চুপ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে নানা অনিয়মের ঘটনায় বেশকিছু কার্যকর পদক্ষেপও নিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক এ সংস্থা। ব্যাংকের পর্ষদ পরিচালনায় ব্যর্থ হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপে চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে বাধ্য হন ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও এনআরবিসির চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসাত আলী। সর্বশেষ ফারমার্স ব্যাংকের এমডি এ কে এম শামীমকেও সরিয়ে দেয়া হয়। এ ছাড়া অনিয়মের অভিযোগে অপসারণ করা হয় এনআরবিসির এমডি দেওয়ান মুজিবুর রহমানকে। সুশাসনের অভাব, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও প্রভিশন ঘাটতিসহ বিভিন্ন কারণে এবার এবি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতামতের তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পাওয়া চতুর্থ প্রজন্মের নতুন নয়টি ব্যাংকের নানা অনিয়ম ও আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ে জড়িয়ে পড়ায় এসব প্রতিষ্ঠানে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। পরিচালকদের ঋণ ভাগাভাগিতে চলছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এসব অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় লাভ তো দূরের কথা মূলধনই খেয়ে ফেলছেন তারা। এরপরও নতুন করে আরো তিনটি ব্যাংক অনুমোদনের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এর আগে যখন নয়টি ব্যাংক দেয়া হয়েছিল তখন আমরা বলেছিলাম বাংলাদেশের অর্থনীতির যে আকার সেখান থেকে আর ব্যাংক দেয়া ঠিক হবে না। তারপরও শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেয়া হয়। ব্যাংকগুলোর এখন নাজুক অবস্থা। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম আর জালিয়াতির যে রীতি চালু হয়েছে নতুন ব্যাংক এলে তার ক্ষেত্র আরো প্রসারিত হবে। তাই এসব প্রতিরোধে সরকারকে বেশি মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। মালিকদের চাপে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন মালিকদের চাপে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ সংশোধনী চূড়ান্ত হলে কয়েকটি পরিবারের কাছে ব্যাংকের মালিকানা চলে যাবে। কারণ আইন সংশোধন করে ব্যাংকের পর্ষদে একই পরিবার থেকে চারজন এবং একটানা নয় বছর দায়িত্ব পালনের সুযোগ রাখা হচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকে এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক থাকলে ব্যাংকে সুশাসনের ঘাটতি দেখা দেবে বলে জানিয়েছেন সংসদ সদস্যরা। জাতীয় সংসদে আলোচনায় সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মিলন বলেন, ব্যাংক খাতে এক লাখ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ। বেশির ভাগ পরিচালক তা ভাগাভাগি করে নিয়ে গেছেন। পুরো ব্যাংক খাত পণবন্দী হয়ে আছে ব্যাংকের মালিক-পরিচালকদের কাছে। স্বতন্ত্র থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া এমপি রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, সরকারি ব্যাংকের পরিচালকরা বিদেশে টাকা পাচার করছেন। এখন বেসরকারি ব্যাংকেও নিয়ম করা হচ্ছে যে, এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক হবেন। জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ সংসদে বলেন, ব্যাংক খাতে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকে এক পরিবার থেকে চার পরিচালক দেয়ার নিয়ম হচ্ছে, ব্যাংকগুলোতে স্বতন্ত্র পরিচালকও নেই। এভাবে চললে ব্যাংকগুলো মুদির দোকান হয়ে যাবে। ব্যাংকিং খাতের নাজুক অবস্থার বিষয়টি স্বীকার করে সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, বলা হচ্ছে এ খাতে অযথা ভর্তুকি দিচ্ছি। ব্যাংকিং খাতে কোনো ধরনের বিপর্যয় হলে তা সারাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। ব্যাংকিং খাতে যখনই কোনো অসুবিধা হয় তখনই পদক্ষেপ নিয়ে থাকি আমরা। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদত্যাগ ২০১৭ সালের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদত্যাগ। প্রধান বিচারপতির ইস্যুকে কেন্দ্র করে আদালতপাড়াসহ সারা দেশে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পরিবেশ তৈরি হয়। দেশ-বিদেশে, রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম হয়ে ওঠে। সরকারের পক্ষ থেকে অসুস্থতার কারণে তিনি ছুটিতে এবং পরে পদত্যাগ করেছেন বলে দাবি করা হয়। তবে বিএনপিসহ দেশের বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়- ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের কারণে জোরপূর্বক বিদেশে পাঠিয়ে পদত্যাগে তাঁকে বাধ্য করা হয়। যেভাবে শুরু হয় সমস্যা : গত ১ আগস্ট উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নিয়ে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণ রায় প্রকাশ করা হয়। রায়ে প্রধান বিচারপতির বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছিলেন মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও সরকারপন্থী আইনজীবীরা। তাঁরা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগেরও দাবি তোলেন। এরই মধ্যে গত ২ অক্টোবর হঠাৎ করেই এক মাসের ছুটিতে যান প্রধান বিচারপতি। তিনি আবেদনে ৩ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত ছুটিতে যাওয়ার কথা জানান রাষ্ট্রপতিকে। পরে ৪ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি অসুস্থ, এটি নিয়ে রাজনীতির কিছু নেই। আসুন আমরা সবাই মিলে প্রধান বিচারপতির সুস্থতায় দোয়া করি। এরপর ১০ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির ছুটির মেয়াদ বৃদ্ধি করতে একটি চিঠি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। চিঠিতে বলা হয়, আগামী ১৩ অক্টোবর অথবা এর নিকটবর্তী তারিখে ঢাকা ত্যাগ করবেন প্রধান বিচারপতি। ১০ নভেম্বর অথবা এর নিকটবর্তী তারিখে বিদেশ থেকে ফিরবেন। পরে এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে ১১ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি ছুটির মেয়াদ ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করে জিও (সরকারি আদেশ) জারি করা হয়। সুপ্রিম কোর্টে কি হয়েছিল সেদিন : প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটিতে ১০ সেপ্টেম্বর থেকে কানাডা-জাপানে সফরে যান। প্রথমে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান বিচারপতিদের সম্মেলনে যোগ দিতে জাপান যান। পরে শারীরিকভাবে অসুস্থ মেয়েকে দেখতে কানাডায় যান। উভয় দেশ সফর শেষে ২৩ সেপ্টেম্বর দেশে ফেরেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। গত ৩ অক্টোবর অবকাশ শেষে সুপ্রিম কোর্ট খোলার দিন ধার্য ছিল। এর আগের দিন ২ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের কার্যতালিকা তৈরির জন্য সুপ্রিম কোর্টে আসেন প্রধান বিচারপতি। কার্যতালিকায় আপিল বিভাগের ১ নম্বর কোর্টে প্রধান বিচারপতির নেত্বত্বে বেঞ্চ গঠন করা হয়। পরের দিন সেই কার্যতালিকা অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে বসার কথা। কিন্তু দুপুরের পরে জানা যায়, প্রধান বিচারপতি ৩ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত ছুটিতে যাওয়ার কথা জানান রাষ্ট্রপতিকে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে আবদুল ওয়াহহাব মিঞাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে সারা দেশে হইচই শুরু হয়। বিশেষ করে আদালতপাড়ায় শুরু হয় কানাঘুষা। এর মধ্যে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সুপ্রিম কোর্টসহ সারা দেশের আদালতে প্রধান বিচারপতিকে ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে দাবি করে প্রতিবাদ সভা পালন করে। এ নিয়ে আদালতপাড়ায় তৈরি হয় গুমট পরিবেশ। এর মধ্যে ৫ অক্টোবর ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে তাকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পরে তিনি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে দেখা করেন। পরে প্রধান বিচারপতি স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজা দিতে যান। তবে কারো সঙ্গে কথা বলেননি। এর মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে, বিদেশ চলে যাচ্ছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। পরে জানা যায়, অস্ট্রেলিয়ান এম্বাসিতে ভিসার আবেদন করেন এবং তিনি ভিসা পেয়েছেন বলেও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। দেশ ছাড়েন প্রধান বিচারপতি : প্রধান বিচারপতি দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন এমন সংবাদ নিয়ে সাংবাদিকরা জড়ো হয় তাঁর বাড়ির সামনে। বিকেল থেকে অপেক্ষারত সাংবাদিকদের সামনে ১৩ অক্টোবর রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন প্রধান বিচারপতি। দেশ ছাড়ার আগে প্রধান বিচারপতি রাজধানীর হেয়ার রোডে তাঁর বাসভবনের সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি অসুস্থ নই। বিচার বিভাগের স্বার্থে আবার ফিরে আসব। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে একটি মহল প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়েছেন।’ তিনি একটি লিখিত বিবৃতিও সাংবাদিকদের দিয়ে যান। সরকারি বাসভবন থেকে বের হয়ে গাড়িতে ওঠার আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। আর একপর্যায়ে কাগজে লেখা একটি বিবৃতি দিয়ে দেন। সেখানে শুরুতেই বলা আছে, ‘আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি।’ ওই বিবৃতিতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে শঙ্কাও প্রকাশ করেন তিনি। সাংবাদিকদের দেয়া বিবৃতিটি লেখা ছিল প্রধান বিচারপতির প্যাডে। নিচে ছিল প্রধান বিচারপতির স্বাক্ষর। বিবৃতিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি, কিন্তু ইদানীং একটি রায় নিয়ে রাজনৈতিক মহল, আইনজীবী ও বিশেষভাবে সরকারের মাননীয় কয়েকজন মন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যেভাবে সমালোচনা করেছেন, এতে আমি সত্যিই বিব্রত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সরকারের একটা মহল আমার রায়কে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে পরিবেশন করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রতি অভিমান করেছেন, যা অচিরেই দূরীভূত হবে বলে আমার বিশ্বাস। সেই সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আমি একটু শঙ্কিতও বটে। কারণ গতকাল প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনরত দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রবীণতম বিচারপতির উদ্ধৃতি দিয়ে মাননীয় আইনমন্ত্রী প্রকাশ করেছেন যে, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অচিরেই সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনে পরিবর্তন আনবেন। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো রেওয়াজ নেই। তিনি শুধুমাত্র রুটিনমাফিক দৈনন্দিন কাজ করবেন। এটিই হয়ে আসছে। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করলে এটি সহজেই অনুমেয় যে, সরকার উচ্চ আদালতে হস্তক্ষেপ করছে এবং এর দ্বারা বিচার বিভাগ ও সরকারের মধ্যে সম্পর্কের আরো অবনতি হবে। এটি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।’ প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বেঞ্চে বসবেন না অন্য বিচারপতিরা পরদিন অর্থাৎ ১৪ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ১১টি দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর তার কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এ কারণে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসতে চাননি আপিল বিভাগের বিচারপতিরা। এতে করে বিপাকে পড়ে যান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। দেশের এই পরিস্থিতিতে প্রধান বিচারপতির দেশে ফেরা অনেকটাই দুরূহ হয়ে পড়ে। কারণ দেশে ফিরলেও আপিল বিভাগের বিচারপতিরা যদি তাঁর সঙ্গে বিচারকাজে বসতে না চান, সেটি হবে প্রধান বিচারপতির জন্য বিব্রতকর। এ অবস্থায় সম্মানজনক সমাধান ছাড়া তিনি দেশে নাও ফিরতে পারেন। এ লক্ষ্যেই সিঙ্গাপুরে একটি সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা চলছে। বৈঠকে সম্মানজনক সমাধানের পথ বের না হলে তিনি পদত্যাগ করবেন। প্রধান বিচারপতির ছুটির মেয়াদের শেষ ১০ নভেম্বর শেষ হওয়ার পর ১১ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান প্রধান বিচারপতি। কানাডা যাওয়ার পথে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনে রাষ্ট্রপতি বরাবর পদত্যাগপত্রটি জমা দিয়েছেন। এটি বঙ্গভবনে এসে পৌঁছেছে বলে সাংবাদিকদের জানান রাষ্ট্রপতির প্রেসসচিব জয়নাল আবেদীন। তাঁর দেশে ফেরা নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। কেউ বলছেন, তিনি দেশে ফিরতে পারেন। আবার কেউ বলছেন তিনি আর ফিরবেন না। এমনই এক পরিস্থিতিতে ওই খবর আসে। এভাবে অবসান হলো দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতির কর্মজীবন!! এর আগে থেকেই অবশ্য রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল বলে আসছেন, প্রধান বিচারপতির দেশে ফেরা ও এজলাসে বসে বিচারকাজ পরিচালনা সুদূরপরাহত। রোহিঙ্গাদের ঢল ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এ বছর দেশের আলোচিত ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো মিয়ানমার সরকারের গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয়। প্রথমে সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশে বাধা দিলেও পরে সীমান্ত এলাকা খুলে দেয়া হয়। প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। এর আগে থেকেই কয়েক লাখ রোহিঙ্গার ভরণপোষণ করে আসছে বাংলাদেশ। বছর শেষে সব মিলে এই সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। এ বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয় ও তাদের ওপর অত্যাচার নিপীড়ন ও গণহত্যার খবর দেরিতে হলেও বিশ্ববিবেককে নাড়া দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের আশ্রয় দেয়ায় মাদার অব হিউমিনিটি উপাধি পান। রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর পর বিশ্ববাসীর প্রশংসা পায় বাংলাদেশ। পরে এটি বিশ্ব ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু এখনও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়। ফরহাদ মজহারের অপহরণ ও উদ্ধার গত ২০১৭ সালের ৩ জুলাই ভোর ৫টা ৫ মিনিটে শ্যামলীর রিং রোডের নিজ বাসা থেকে বের হন ফরহাদ মজহার। পরে সকাল ১০টার দিকে তাঁর স্ত্রী ফরিদা আখতার আদাবর থানাকে অবহিত করেন যে তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে। এর পর থেকেই পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দারা মাঠে নামে। তারা রাতে তাঁকে উদ্ধার করতে সমর্থ হয়। ওই দিন রাতেই তাঁর স্ত্রী ফরিদা আখতার থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন। প্রথমে মামলাটি তদন্ত করে আদাবর থানার পুলিশ। এক দিন পরই মামলাটি সেখান থেকে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছেন ডিবির পরিদর্শক মাহবুবুল হক। তদন্তের পর তিনি অপহৃত হননি বলে পুলিশ অভিযোগপত্র দাখিল করার প্রস্তুতি নিলে নতুন বিতর্কের সূচনা হয়। কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার গত ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের দিন এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, তাঁকে গুম করার উদ্দেশ্যেই অপহরণ করা হয়েছিল। তিনি দাবি করেন, তাঁকে তিনজন লোক জোর করে গাড়িতে তোলে। এরপর অপহরণকারীরা স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা, বিকাশে টাকা পাঠানোসহ যা যা কিছু করতে বলে, তিনি তা-ই করেন। ফরহাদ অভিযোগ করেন, আদালতে ১৬৪ ধারায় তাঁর দেয়া জবানবন্দি পুলিশ লিখে দিয়েছিল। তবে ‘বিচারাধীন বিষয়ের’ কথা বলে সাংবাদিকদের কিছু প্রশ্ন এড়িয়ে যান। তিনি আরো বলেন, মামলা থেকে বাঁচতে নয়, গুমের শিকার ব্যক্তিদের জন্য এ সংবাদ সম্মেলন করেছেন। গত বছর ফরহাদ মজহার ছাড়াও অপহৃত আলোচিত ব্যক্তিদের মধ্যে যারা উদ্ধার হয়েছেন তারা হলেন; নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক মুবাশ্বার হাসান সিজার, সাংবাদিক উৎপল, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায়, কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমান। নিখোঁজ বাকি ব্যক্তিদের স্বজনরা আশায় বুক বেঁধে আছেন। বনানীতে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ধর্ষণ গত বছরের ২৮ মার্চ ঢাকার বনানীতে একটি হোটেলে আয়োজিত জন্মদিনের পার্টিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ করেন দুইজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী। বনানীর রেইনট্রি নামের হোটেলে ধর্ষণের অভিযোগে আপন জুয়েলার্সের একজন মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ ও তার দুই বন্ধুসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন দুই তরুণী। ঘটনার প্রায় দেড় মাস পর পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ শুরুতে মামলাটি নিতে চায়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। মামলার এজাহারে বলা হয়, সাফাত আহমেদ এবং নাঈম আশরাফই সরাসরি ধর্ষণে অংশ নিয়েছিল। বাকি তিনজন সহযোগিতা করেছে। বর্তমানে মামলাটির বিচার চলছে। শিক্ষা খাতে আলোচিত সিদ্দিকুর, প্রশ্নফাঁস বিদায়ী বছরজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমান (২২), প্রশ্নফাঁস। রাজধানীর শাহবাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের পরীক্ষার সময়সূচিসহ সাত দফা দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বিক্ষোভ কর্মসূচি চলাকালে পুলিশের টিয়ার গ্যাস শেলের আঘাতে দৃষ্টিশক্তি হারান সিদ্দিকুর। অন্যদিকে সারা বছর জুড়ে আলোচনায় ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাসহ দেশের সকল পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনা। গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর উঠে আসে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি। বলা হচ্ছে সিদ্দিকুর, প্রশ্নফাঁস, শিক্ষার্থীদের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা- ইত্যাদি কারণে ২০১৭ সালে অনেকটা ম্লান হয়ে যায় শিক্ষা খাতের সব অর্জন। শিক্ষা সফরে অনুমতি লাগবে শিক্ষা সফর ও সব ধরনের বনভোজন আয়োজনে শর্তসাপেক্ষে অনুমোদন দেওয়া হবে। ফলে পাঠদানের বাইরে সংশ্লিষ্ট মাঠ প্রশাসনের অনুমোদন নিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা সফরের আয়োজন করতে হবে বলে চলতি বছর প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অনলাইন গণশুনানির আওতায় ৩৬ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) উদ্যোগে দেশের ৩৬ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অনলাইন গণশুনানির আওতায় আনা হয়েছে। এইচএসসিতে দশ বছরে সর্বনিম্ন ফল: এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গত ১০ বছরের মধ্যে এবার পাসের হার সবচেয়ে কম। ২০০৭ সালে পাসের হার ছিল ৬৫ দশমিক ৬০ শতাংশ। এর পরের নয় বছর পাসের হার বেশি হলেও এ বছর তা কমে হয়েছে ৬৮ দশমিক ৯১। শিক্ষা সফরে অনুমতি নিতে প্রজ্ঞাপন: শিক্ষা সফর ও সব ধরনের বনভোজন আয়োজনে শর্তসাপেক্ষে অনুমোদন দেওয়া হবে। ফলে পাঠদানের বাইরে সংশ্লিষ্ট মাঠ প্রশাসনের অনুমোদন নিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা সফরের আয়োজন করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। কওমি দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর মান: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শক্রমে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন দাওরায়ে হাদিস সনদকে ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। ঢাবিতে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সব বিষয়ে পড়ার সুযোগ: শর্ত পূরণ করায় চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পাবেন মাদরাসা থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা। এর আগে মাধ্যমিক (দাখিল) ও উচ্চমাধ্যমিকে (আলিম) ২০০ নম্বর করে বাংলা ও ইংরেজি না পড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম সারির বেশ কয়েকটি বিষয় পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতেন তারা। রাস্তায় সন্তান প্রসব গত ১৭ অক্টোবর মঙ্গলবার ভোরে স্বামী পরিত্যক্তা অন্তঃসত্ত্বা পারভীন বেগমের প্রসব বেদনা শুরু হলে সোহেল নামের এক তরুণ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু দুইটি হাসপাতাল থেকে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। সর্বশেষ আজিমপুরের মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গিয়েও চিকিৎসা মেলেনি ওই নারীর। মাত্র ১৫ শ টাকার জন্য তাকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনটি হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সামনের রাস্তায় সন্তান প্রসব করেন পারভীন বেগম। পরে হাসপাতালে যখন তার জায়গা হলো, ততক্ষণে সদ্যোজাত সন্তানটি আর বেঁচে নেই। প্রাথমিকভাবে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় মাতৃসদনের এক আয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ঘটনার তদন্তে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল এবং আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান পৃথক তিনটি কমিটি গঠন করেছে। এর মধ্যে মাতৃসদনের তাৎক্ষণিক তদন্তে আয়া শাহেদা আক্তার দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ঘটনায় স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না এবং প্রসূতিকে কেন ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না- তা রুলে জানতে চাওয়া হয়েছে। বিচার না পেয়ে বাবা-মেয়ের আত্মহত্যা গত ২০১৭ সালের ২৯ এপ্রিল গাজীপুরের শ্রীপুরে শিশু মেয়েসহ চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন এক বাবা। শিশু মেয়ে ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরও বিচার না পাওয়ায় নির্যাতনের শিকার হওয়ায় বাবা-মেয়ে আত্মহত্যা করেন। ঘটনায় ৩০ এপ্রিল ঢাকার কমলাপুর জিআরপি থানায় সাতজনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন নিহত হযরত আলীর স্ত্রী হালিমা বেগম। ২৭ মে মামলার প্রধান আসামি মো. ফারুককে (৩০) গ্রেফতার করে র‌্যাব-১। এর আগে গ্রেফতার করা হয় আরও ২ জনকে। চলন্ত বাসে মেধাবী ছাত্রী রূপা ধর্ষণ গত ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে ছোঁয়া পরিবহনের শ্রমিকরা আইন বিভাগের মেধাবী ছাত্রী রূপা খাতুনকে ধর্ষণ করে। পরে রূপার ঘাড় মটকে হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকায় ফেলে রেখে যায়। মধুপুর থানার পুলিশ ওই রাতেই তার লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের পর বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করে। একই সাথে ওই থানার পুলিশ বাদি হয়ে মধুপুর থানায় হত্যা মামলা করে। এরপর ২৮ আগস্ট মধুপুর থানায় গিয়ে লাশের ছবি দেখে রূপাকে শনাক্ত করেন তার ভাই হাফিজুর রহমান। পরে পুলিশ ছোঁয়া পরিবহনের চালক হাবিবুর (৪৫), বাসের তত্ত্বাবধায়ক সফর আলী (৫৫) এবং বাসচালকের সহকারী শামীম (২৬), আকরাম (৩৫) ও জাহাঙ্গীরকে (১৯) গ্রেফতার করে। পুলিশের কাছে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা রূপাকে ধর্ষণ ও হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেয়। এরপর গত ৩১ আগস্ট রূপার লাশ টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় কবরস্থান থেকে উত্তোলন করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে তাকে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার নিজ গ্রাম আসানবাড়িতে বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়। এমন আরো অনেক নির্মম ঘটনাকে কালের ডায়েরিতে বন্দী করে বিদায় নিলো ২০১৭। নতুন আশা আর সম্ভাবনার আলো জ্বেলে এলো ২০১৮ ঈসায়ী সন। এই নতুন বছর হোক গণতন্ত্র মানবাধিকার বঞ্চিত মানবতার বিজয়ের বছর।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির