post

রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবর

২৬ ডিসেম্বর ২০২৩

[caption id="attachment_9" align="alignleft" width="120" caption="ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক"]ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক[/caption]

২৭ অক্টোবর ২০০৬ সালে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী আমীর রফিকুল ইসলাম খান আমাকে পল্টন জনসভার দাওয়াত দেন। সাধারণত সকল জনসভায় আমি যাই না। কিন্তু এই জনসভায় আমি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। পরদিন সকালে মহানগরী অফিসে পৌঁছাই। সেখানে আমীরে জামায়াতসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ অবস্থান করছিলেন।

ঐদিন বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর পাশে চারদলীয় ঐক্যজোটের জনসভা আগেই নির্ধারিত হয়েছিল। এ মর্মে পত্রপত্রিকায় সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিল। বেলা ১১টার দিকে খবর পেলাম অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে জামায়াত-শিবির কর্মীদের ওপর লগি-বৈঠাধারীরা আক্রমণ করছে। দুপুর ১২টার দিকে ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুল আলম খান মিলন আমাকে কয়েকজন আহত ও শাহাদাৎবরণকারীর খবর জানালেন। আর অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্য আমি বাইরে যেতে চাইলাম। কিন্তু জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম আমাকে বাধা দিলে আমি বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকলাম। এই সময় আহতদের মহানগরী অফিসে আনা হচ্ছিল। বায়তুল মোকাররম এলাকা তখন যেন একটি যুদ্ধক্ষেত্র : রক্ত ঝরছে ও আগুন জ্বলছে। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ছাত্র-জনতার ওপরে সন্ত্রাসী হামলা করা হয়েছিল।

[caption id="attachment_12" align="alignright" width="221" caption="নৃশংসতার নজির!"]নৃশংসতার নজির![/caption] অক্টোবরের ঐ কালো দিনটিতে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই সঙ্কটপূর্ণ। সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। বিএনপি’র পক্ষ থেকেও একটি শক্ত অবস্থান নেয়া হয়েছে। তারা রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সংবিধান প্রদত্ত অন্যান্য বিকল্প প্রস্তাগুলোকে বিএনপি সম্পূর্ণরূপে নাকচ করে। এ ব্যাপারে তারা শরিকদলগুলোর সাথে কোন আলোচনা করেনি। আওয়ামী লীগও আরো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বিএনপি হতে সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল হাসানকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব দেয়া সঠিক ছিল না। আমার এই মত আমি শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে জানালাম। কিন্তু কোন ফল হলো না। পরবর্তী ইতিহাস প্রমাণ করেছে আওয়ামী লীগের মত বিএনপি এ হঠকারী সিদ্ধান্ত না নিলে হয়ত দেশকে সঙ্কটমুক্ত করা যেত। তার পরের বিষয়তো সকলের জানা। দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে নেয়া যে কোন ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্তের খেসারত জাতিকে দিতে হয় যুগ যুগ ধরে।

একদিকে বায়তুল মোকাররমে রক্ত ঝরছে, আর অন্যদিকে পর্দার আড়ালে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য চলছিল দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র। অবস্থা সঙ্গিন দেখে প্রস্তাব এলো আমীরে জামায়াতকে বাদ দিয়ে প্রোগ্রাম করা। আমি এর বিরোধিতা করলাম। কী কারণে করলাম ঠিক মনে নেই। ভাবলাম কর্মীরা ময়দানে যখন রক্ত দিচ্ছে শাহাদাৎ বরণ করছে এ সময় আমীরে জামায়াতকে বাদ দিয়ে সভা করা ঠিক হবে না। ১৯৬৩ সালে অক্টোবরে লাহোরে নিখিল পাকিস্তান জামায়াত সম্মেলনে যখন সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করে, তখন পাকিস্তান জামায়াতের আমীর সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী ভাষণ দিচ্ছিলেন। তাঁকে লক্ষ্য করে যখন সন্ত্রাসীরা গুলি বর্ষণ করছিল তখন বারবার বলা হচ্ছিল মাওলানা বসে পড়–ন, বসে পড়–ন। তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে শান্তকণ্ঠে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি যদি বসে পড়ি, তবে দাঁড়িয়ে থাকবে কে?’

[caption id="attachment_13" align="alignleft" width="144" caption="জামায়াতের সমাবেশ লক্ষ্য করে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিবর্ষণ"]জামায়াতের সমাবেশ লক্ষ্য করে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিবর্ষণ[/caption] আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী যখন ২৮ অক্টোবর বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন অনবরত বোমা বর্ষণ করছিল সন্ত্রাসীরা। কিন্তু অত্যন্ত শান্তভাবে তিনি কর্মীদের ধৈর্য ধরার আহবান জানান। বিরাট কোন বিপর্যয় ছাড়াই মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে জনসভার কাজ সমাপ্ত হয়।

এদিন ৬ জন জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী শহীদ হন। আহত হন অসংখ্য মানুষ। হত্যা করে মৃত দেহের ওপর লাফালাফি করেছিল আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। বাংলাদেশে সা¤প্রতিককালের ইতিহাসে এমন নৃশংস ঘটনা আর ঘটেনি। যে দেশ যত সভ্য, তার রাজনীতি তত শান্ত। ২৮ অক্টোবর থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতি ছিল অত্যন্ত উত্তপ্ত। তারপর ১১ জানুয়ারির পর একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। দেশের অবস্থা এখন এক কথায় বলা যায় অনিশ্চিত।

যে কয়েকজন সর্বশেষ অফিস ত্যাগ করলেন আমি তাদের একজন। স্বভাবতই পরিবারের সবাই চিন্তিত ছিল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অফিসে নিরাপদে ছিলাম। কিন্তু আহত ও শাহাদাতবরণকারী ভাইদের ছবি বারবার চোখের সামনে ভেসে আসছিল। শহীদ আবদুল মালেক ভাইয়ের কথা মনে পড়ছিল। ২৮ অক্টোবর যারা শহীদ হলো তারা নিঃসন্দেহে জীবিত এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে রিজিকপ্রাপ্ত। আল কুরআনে বলা হয়েছে

‘‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না, প্রকৃতপক্ষে তাঁরা জীবিত। কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তোমাদের কোন চেতনা হয় না।” ‘‘যারা  আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে মৃত মনে করো না। তাঁরা আসলে জীবিত। তাদের রবের কাছ থেকে জীবিকা লাভ করছে।” (আল ইমরান : ১৬৯) ইসলামী বিপ্লবের সফলতার জন্য শাহাদাত ও রক্ত অপরিহার্য। যুগে যুগে ইসলামের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে তাই দেখতে পাওয়া যায়। আমি সাধারণত সকল প্রোগ্রামে যাই না। কিন্তু ঐদিনের প্রোগ্রামে না থাকলে হয়তো সারা জীবনই আফসোস করতাম। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কোনদিকে মোড় নেবে বলা মুশকিল। লেখক : বিশিষ্ট আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির