post

শাখার মাসিক পরিকল্পনা গ্রহণ পদ্ধতি

শাহরিয়ার ফয়সাল

০৭ জুলাই ২০২২

একটি প্রবাদ বাক্য রয়েছে “A Good Plan is Half of the Work Done..” অর্থাৎ- একটি সুন্দর পরিকল্পনা একটা কাজের অর্ধেক। এজন্য যেকোনো কাজের পূর্বেই দরকার সুন্দর একটি পরিকল্পনা। কেননা আমাদের সময় হচ্ছে নির্দিষ্ট এবং এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই আমাদের বিভিন্ন ধরনের কাজ শেষ করতে হয়। সেজন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনেক কাজ করতে হলে প্রয়োজন একটি সুন্দর ও কার্যকরী পরিকল্পনার। কারণ অগোছালোভাবে হয়তো অনেক কাজ করা সম্ভব কিন্তু দিন শেষে তা কখনোই ভালো ফল বয়ে আনে না। আর যিনি কাজ করেন তিনি নিজেও জানেন না যে তিনি আসলে কোথায় পৌঁছাতে চান। এলোমেলো কাজগুলোর থাকে না কোনো লক্ষ্য কিন্তু পরিশ্রম ব্যয়িত হয় অনেক বেশি। 

ধরুন, ২ জন ম্যানেজারের অধীনে ১০ জন করে কর্মচারী দেওয়া হলো এবং প্রত্যেককেই আলাদাভাবে বলা হলো যে, এই ১০ জন কর্মচারীকে নিয়ে একটি লাইব্রেরিকে ৫ ঘণ্টার মধ্যে সুন্দরভাবে সাজাতে হবে। 

প্রথম ম্যানেজার চিন্তা করলেন একসাথে বসে সময় নষ্ট না করে প্রতিটি সময়কে আমরা কাজে লাগাবো। তাই তিনি প্রত্যেক কর্মচারীকে বললেন, যে যার মত বইগুলো সাজিয়ে ফেলেন। নির্দেশনা অনুযায়ী সকলেই কাজ শুরু করল কিন্তু সকলের দক্ষতা সমান না হওয়ায় কেউ ভালোভাবে গোছালো আবার কেউ এলোমেলো করে ফেলল। ফলে সময় শেষ হলো কিন্তু কাজ শেষ হলো না। অনেক বই তারা সেল্ফে সাজাতে পারল না। কোন ধরনের বই কোথায় রাখতে হবে তারও কোনো নির্দেশনা না থাকায় অগোছালোভাবে বইগুলো রাখা হচ্ছিল। তাতে সহজে কেউ বই খুঁজে পাবারও অবকাশ আর রইল না। 

দ্বিতীয় ম্যানেজার কাজটি পাবার সাথে সাথে লাইব্রেরির সামগ্রিক অবস্থাটা মাথায় নিলেন এবং টিমের সকলকে নিয়ে বসলেন। এরপর তিনি অন্তত এক ঘণ্টা ধরে কাজের পরিকল্পনা তৈরি এবং কর্মবণ্টন করে নিলেন। তিনি সকলকে বুঝালেন কোন ধরনের বই কোন স্থানে রাখতে হবে এবং কিভাবে রাখলে সর্বোচ্চ সংখ্যক বই গুছিয়ে রাখা যাবে। ১০ জনের প্রত্যেকের কাজও তিনি নির্দিষ্ট করে দিলেন। ফলে দেখা গেল নির্দিষ্ট সময় শেষ হবার অনেক আগেই তারা কাজটি করে ফেলল এবং পুরো কাজটিই খুব সাজানো-গোছানো হলো।

একটু ভেবে দেখুন তো, প্রথম ও দ্বিতীয় ম্যানেজার এবং তাদের টিমের কর্মচারীরা সকলেই কাজ করেছে কিন্তু তাদের উভয়ের কাজের পরিসমাপ্তিটা হয়েছে ভিন্নভাবে। এটার মূল কারণ হলো কাজের পরিকল্পনা গ্রহণ করা বা না করার কারণে।

এ জন্য বলা হয়- A leader is he who knows the way, follows the way and shows the way. একজন দক্ষ নেতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে লক্ষ্য স্থির রেখে কর্মবণ্টনের মাধ্যমে সকল কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা। আমাদের সংগঠনে যেহেতু দায়িত্বশীলদের চিন্তাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং এ চিন্তা ও কর্মের প্রতিফলনই ময়দানে সামগ্রিক কাজের ওপর পড়ে। তাই সংগঠনের পরিকল্পনাগুলো হওয়া চাই খুবই স্মার্ট এবং সুদূরপ্রসারী।

মাসিক পরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে গ্রহণ করলে তা বার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। মাসের শুরুতেই প্রত্যেক শাখাকে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। সকল শাখাতেই মাসের শুরুতে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়ে থাকে কিন্তু উক্ত পরিকল্পনার মধ্যে আমাদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না তা লক্ষ্য করা হয় না। সাধারণত প্রতি মাসে শাখার কিছু নিয়মিত কাজ থাকে (সদস্য বৈঠক, কুরআন ক্লাস, স্টাডি ক্লাস, আলোচনা চক্র ইত্যাদি) এ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি একটি শাখাকে আরো অনেক কাজ করতে হয়। অধিকাংশ শাখার ক্ষেত্রেই যা চিন্তা করার সময় হয় না। ফলে দেখা যায় বার্ষিক রিপোর্ট পর্যালোচনার সময় অনেক কাজই দৃষ্টির অগোচরে থেকে যায়। এ সমস্যা নিরসনের জন্য আমরা কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি। যার ফলে আমরা বার্ষিক পরিকল্পনা খুব বেশি তৎপরতা ছাড়াই বাস্তবায়ন করে ফেলবো ইনশাআল্লাহ।

মাসিক পরিকল্পনা তৈরির পূর্বে এবং পরামর্শসভা/ সেক্রেটারিয়েট মিটিংয়ে মাসিক পরিকল্পনা পেশ বা অনুমোদনের আগে শাখা সভাপতি, সেক্রেটারি এবং সাংগঠনিক সম্পাদক (যদি থাকে) ভাইদের সময় নিয়ে বসতে হবে। আলোচনাটি খুবই উন্মুক্ত এবং পর্যালোচনাধর্মী হতে হবে। যে সকল বিষয়কে সামনে রেখে উক্ত আলোচনা হতে হবে তা নিম্নরূপ:

১. বার্ষিক পরিকল্পনাকে সামনে রাখা

২. গত বছরের চলতি মাসের রেজুলেশন সামনে রাখা

৩. চলতি মাসের কেন্দ্রের টাস্কলিস্ট সামনে রাখা

৪. পূর্বের মাসের কাজের বাস্তবায়ন সংক্রান্ত পর্যালোচনা সামনে রাখা

এই চারটি ডকুমেন্টস সামনে রাখতে হবে এবং একটা একটা করে এজেন্ডা সাজাতে হবে। এজেন্ডা সাজানোর পর নি¤েœাক্ত ছকের প্রতি চোখ বুলানো যেতে পারে। এই ছকটি প্রদানের মূল উদ্দেশ্য হলো কোনো মাস থেকে সম্ভাব্য কোনো কাজ যেন বাদ না পড়ে যায়।

প্রথমত-দাওয়াত

প্রতি মাসের পরিকল্পনায় দাওয়াত সম্পর্কিত প্রোগ্রাম থাকাটা জরুরি। কারণ দাওয়াতের মাধ্যমে এই সংগঠনে নতুন নতুন নেতৃত্বের জন্ম হয়। যে ময়দানে যত বেশি দাওয়াতি কাজ হয় সেই ময়দান তত বেশি আন্দোলনমুখী। দাওয়াতের কাজটি যত সুপরিকল্পিত হবে তত বেশি ইসলামী আন্দোলন মজবুতি অর্জন করবে। তাই প্রতি মাসের পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে কোন স্তরের ছাত্রদের নিয়ে তাদের উপযোগী কী ধরনের দাওয়াতি কাজ রাখা হয়েছে। 

অবশ্যই এ ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত স্তরসমূহে ভিন্ন ভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে:

স্কুল পর্যায়ে (কুইজ প্রতিযোগিতা, সামিট, সামার ক্যাম্প, রচনা প্রতিযোগিতা, সিঙ্গেল ডিজিট সংবর্ধনা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। এছাড়াও স্কুল বিভাগের বার্ষিক রিপোর্টে অনেক প্রতিযোগিতার উল্লেখ রয়েছে)

কলেজ পর্যায়ে (ক্যারিয়ার ফেস্ট, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, এ+ সংবর্ধনা ইত্যাদি। এছাড়াও কলেজ বিভাগের বার্ষিক রিপোর্টে অনেক প্রোগ্রামের উল্লেখ রয়েছে) 

অনুরূপভাবে মাদ্রাসা, পলিটেকনিক স্তরের ভাইদের কথা মাথায় রেখে প্রোগ্রাম রাখতে হবে। সব মাসেই সব ধরনের দাওয়াতি প্রোগ্রাম রাখাটা জরুরি নয়। প্রতি মাসে ময়দানের চাহিদা বিবেচনায় আয়োজন রাখতে হবে। তা ছাড়া অমুসলিম ছাত্র ও মুহাররমাদের মাঝে দাওয়াতি কাজের বিশেষ কর্মসূচিও রাখা দরকার। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, ময়দানে দাওয়াতি কাজের পদ্ধতির ক্ষেত্রে  সৃজনশীলতা বা নতুনত্ব নিয়ে আসার চেষ্টা করা দরকার। এতে করে দাওয়াতি কাজের সৌন্দর্য ও আকর্ষণ বেড়ে যায়।

দ্বিতীয়ত- সংগঠন

এখনো অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানে আমাদের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। সেসকল প্রতিষ্ঠানের তালিকা আমরা বছরের শুরুতেই করে থাকি। কিন্তু প্রতি মাসে সুপরিকল্পিত কোন উদ্যোগ খুব বেশি নেওয়া হয় না। অন্যদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক প্রতিষ্ঠানে আমাদের কাজ দুর্বল হয়ে গেছে এগুলোকে শক্তিশালী করার উদ্যোগও আমাদের নেওয়া উচিত। 

তাই মাসের শুরুতে তালিকা করতে হবে আমরা কোন প্রতিষ্ঠানকে মজবুত এবং কোথায় সংগঠন বৃদ্ধি করতে চাই। উল্লেখ্য এ ক্ষেত্রে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা বছরের শুরুতে থাকা চাই। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানসমূহের তালিকা করে প্রতি মাসে অল্প অল্প কাজ করলে সংগঠন বৃদ্ধি করাটা খুবই সহজ। এক্ষেত্রে প্রতি মাসে পরিকল্পনা নেওয়ার সময় বিগত মাসের প্রতিষ্ঠানে সংগঠন বৃদ্ধির যে কাজগুলো ছিলো তার যথাযথ পর্যালোচনা করা দরকার।

তৃতীয়ত- প্রশিক্ষণ

জনশক্তি এবং দায়িত্বশীলদের অবস্থা মাথায় রেখে প্রতি মাসেই কিছু প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের আয়োজন রাখা। তবে অবশ্যই নিয়মিত প্রোগ্রাম যাতে বাদ না পড়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বর্তমান অপসংস্কৃতি ও নব্য জাহেলিয়াতের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আমাদের জনশক্তিদেরকে হেফাজত ও তাদের নৈতিক বা চারিত্রিক মানকে আরো বেশি শক্তিশালী করতে হলে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের কোনো বিকল্প নেই। 

ময়দানের কিছু জনশক্তি থাকে সক্রিয় আর কিছু থাকে নিষ্ক্রিয়। তবে সকলকে নিয়েই আমাদের পথ চলতে হবে। এজন্য এই দুই স্তরের জনশক্তির কথা চিন্তা করেই প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম সাজাতে হবে যাতে সকলেই প্রশিক্ষণের আওতায় আসে। পরিবেশ পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন সকল জনশক্তিকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে এবং সকলকে নিবিড় তত্ত্বাবধান করতে হবে। বর্তমান একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের প্রত্যেকটি জনশক্তিকে অবশ্যই দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নতুবা আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। এজন্য যেকোনো মূল্যেই হোক প্রশিক্ষণমূলক প্রোগ্রামগুলো হাতে নিতে হবে।

চতুর্থত- আউটপুট

আমাদের জনশক্তিদের আমরা তৈরি করছি আগামী দিনের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার এবং তার নেতৃত্ব প্রদানের জন্য। তাই নৈতিক মোটিভেশনের পাশাপাশি তাদেরকে একাডেমিক মোটিভেশনও দিতে হবে। দক্ষতা এবং যোগ্যতার বিবেচনায় তারা যেন ভালো একটি ক্যারিয়ার তৈরি করতে পারে এ ব্যাপারে সকল জনশক্তিতে ব্যাপক তদারকি করা দরকার। তবে এ জাতীয় প্রোগ্রামসমূহ সুনির্দিষ্ট হওয়া উচিত। যেমন স্কুল স্তরে পড়ুয়া ছাত্রদের মোটিভেশন আর এইচএসসি/আলিম স্তরে পড়ুয়া ছাত্রদের মোটিভেশন একই রকম হবে না। আবার কলেজ বা পলিটেকনিকের ছাত্রদের জন্য যে মোটিভেশন দরকার তা মাদরাসার জন্য প্রযোজ্য নয়। এভাবে জনশক্তিদের চাহিদার আলোকে বছরব্যাপীই আউটপুট পরিকল্পনা রাখা দরকার। একাডেমিক কাউন্সেলিং, ক্যারিয়ার কাউন্সেলিংয়ের মতো প্রোগ্রামসমূহ নিয়মিতভাবে করা দরকার। নিয়মিভাবে এ ধরনের মোটিভেশনমূলক প্রোগ্রাম করতে পারলে জনশক্তিদের দক্ষতা, আত্মনির্ভরশীলতা ও আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি বেড়ে যায়।

পঞ্চমত- বিবিধ

সংগঠনের বেইজ এরিয়া মজবুতীকরণ এবং ইমেজ বৃদ্ধিমূলক অনেক প্রোগ্রামই আমাদের রাখতে হয়। ফলে অনেক ছাত্র এসকল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আকৃষ্ট হয়ে সংগঠনের দিকে ঝুঁকে। যেমন- বৃক্ষরোপণ অভিযান, ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প, ব্লাড গ্রুপিং ও রক্তদান কর্মসূচি, শীতবস্ত্র বিতরণ, সাক্ষরতা অভিযান, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, শিক্ষা সফর ইত্যাদি। 

ছাত্রসংগঠন হওয়ার কারণে নিয়মিতভাবে ছাত্রকল্যাণমূলক অনেক কাজই করতে হয়। এজন্য শাখার ছাত্রকল্যাণ বিভাগকে অর্থনৈতিকভাবে আরো বেশি সমৃদ্ধকরণে বিশেষ পরিকল্পনা থাকা দরকার। এর পাশাপাশি ছাত্রকল্যাণমূলক  কাজের পরিমাণ বৃদ্ধি করার চেষ্টা করা দরকার। ছাত্রকল্যাণমূলক কাজগুলো হলো- ফ্রি কোচিং ক্লাস চালু করা, লজিং জোগাড় করে দেওয়া, লেন্ডিং লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা, স্টাইপেন্ড চালু করা, টিউশনির ব্যবস্থা করা, ভর্তি সহায়তা, দরিদ্র ও মেধাবীদের বই কিনে দেওয়াসহ ইত্যাদি কাজগুলো করা যেতে পারে।

এ ধরনের কার্যক্রমগুলো নিয়মিতভাবেই সকল শাখায় রাখা দরকার। এতে করে সাধারণ ছাত্রদের মাঝে আমাদের দাওয়াতি কাজসহ গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায় এবং আমাদের জনশক্তিদের ও সামাজিক ক্ষেত্রে কাজ করার যোগ্যতা ও দক্ষতা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির