post

সংখ্যালঘুদের নিয়ে আওয়ামী লীগের নষ্ট রাজনীতি

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪

ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম

ˆMiWcবাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আবহমান কাল ধরে বাংলাদেশে সকল ধর্মের মানুষ এখানে সহাবস্থান করে আসছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ শতকরা নব্বই ভাগের বেশি মুসলিম হলেও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মের অনুসারীরা অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করে আসছেন যুগ যুগ ধরে। Minority মানে সংখ্যালঘু-অর্থ ক্ষুদ্র বা ছোট জাতিগোষ্ঠী। অক্সফোর্ড ডিকশনারি ও অন্যান্য অভিধান অনুযায়ী একটি মানবসংগঠন, সমাজ বা রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র অংশই হচ্ছে সংখ্যালঘু। অর্থাৎ একটি সংগঠন, সমাজ বা রাষ্ট্র যাদেরকে নিয়ে গঠিত তাদের মধ্যে যদি একাধিক দল বা উপদল থাকে তাহলে সংখ্যার দিক থেকে যারা ক্ষুদ্র তারাই হচ্ছে সংখ্যালঘু। Wikipidia-তে বলা হয়েছে, A minority group is a sociological category within a demographic. Rather than a relational "social group", as the term would indicate, the term refers to a category that is differentiated and defined by the social majority, that is, those who hold the majority of positions of social power in a society. The differentiation can be based on one or more observable human characteristics, including, for example, ethnicity, race, gender, wealth, health or sexual orientation. বাংলাদেশে বহুমাত্রিক সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান। বহু ধর্ম, জাতিগোষ্ঠী, ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষেরা দীর্ঘদিন ধরে এখানে বসবাস করে আসছে। সুতরাং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে ধর্ম, জাতীয়তা, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, ভাষা ইত্যাদির ভিত্তিতে এখানে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে : ধর্মীয় সংখ্যালঘু জাতিগত সংখ্যালঘু ভাষাগত সংখ্যালঘু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সুতরাং বিভিন্ন বিচারে এর প্রত্যেকটি গ্রুপকে বলা হয় সম্প্রদায়। সম্প্রদায় শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- ‘পরস্পরাগত ধর্মগত’ বিভাগ বা দল’ ‘গুরু বিশেষের শিষ্যগণ সমাজ বা দল’। ‘ইক্’ (ষ্ণিক) প্রত্যয় যোগে গঠিত সাম্প্রদায়িক শব্দটির অর্থ হচ্ছে, কোনো ‘সম্প্রদায় থেকে আগত সম্প্রদায় বিশেষের মতাবলম্বী’। ঈড়সসঁহধষরংস এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ধর্মীয়, জাতিগত বা আঞ্চলিক সঙ্কীর্ণতাকেই বলে সাম্প্রদায়িকতা। সাম্প্রদায়িকতার অপর বৈশিষ্ট্য হলো অন্য ধর্ম, জাতি বা অঞ্চলের ব্যাপারে অসহিষ্ণুতা-যা প্রায়ই দাঙ্গায়ও রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। সাম্প্রদায়িকতার উদাহরণ হিসাবে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের মুসলিমবিদ্বেষ, দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাপার্ট-হিড, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে উপজাতীয় সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। বস্তুত পৃথিবীর প্রায় দেশেই কোনো-না কোনো রূপে সাম্প্রদায়িকতার কমবেশি অবস্থিতি রয়েছে। সংখ্যালঘু নির্যাতন দেশে দেশে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বসবাস করছে। বিশেষ করে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীর অনেক দেশেই মুসলমানরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে নির্যাতিত হয়ে আসছে। ইউরোপ, আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, মিয়ানমার, চীনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই মুসলমানদের ওপর হত্যা, খুন, দেশান্তরিতসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে অহরহ। অথচ মুসলমানদের এই অমানবিক নির্যাতনের ব্যাপারে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা দু-একটা বিবৃতি ছাড়া কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বর্তমানে মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর অমানবিক নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। মুসলমানদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। অথচ বিভিন্ন মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কল্পকাহিনী ও নাটক তৈরি করে মুসলিম সম্প্রদায়কে ভিন্নভাবে চি?িত্রত করার অপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সোনালি দেশ ইসলাম ধর্ম আগমনের পূর্বে এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল না বললেই চলে। কিন্তু মুসলমানদের আগমনের মধ্য দিয়েই এখানে ইসলামের সৌন্দর্য সহনশীলতা পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় ও মজবুত করেছে। এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায় ইসলাম ধর্মের পতাকাতলে সমবেত হয়। এরই মাধ্যমে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ইসলামের বিস্তৃতি ছড়িয়ে পড়ে সমাজের সর্বত্র এবং শাসন ক্ষমতার দায়িত্বভার গ্রহণ করে মুসলমানরা। বাংলার এই জনপদে তরবারি তথা বল প্রয়োগের মাধ্যমে নয়, বরং একদিকে হিন্দুধর্মের কঠোর জাতিভেদপ্রথা, ধর্মীয় নির্যাতন-নিপীড়ন, অপর দিকে ইসলাম প্রচারকগণের সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবন যাপন এবং ব্যাপক দানশীলতা, উদার ও সহমর্র্র্মী মনোভাবই এতদঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাধিক্যের অন্যতম তথা একমাত্র কারণ। ভারতে ইসলাম ধর্মের আগমনের পূর্বে এখানে বৌদ্ধ, জৈন ও শৈব প্রভৃতি ধর্মমতের অস্তিত্ব ছিল। মুসলমানরা সিন্ধু জয় করে ৭১১ সালে। সেই থেকে ভারতের বুকে মুসলিম শাসকদের শাসন শুরু। ধীরে ধীরে সমগ্র বাংলায় তুর্কি, পরবর্তীতে পাঠান মুঘলদের শাসন কায়েম হলো। ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত বাংলায় মুসলিম শাসকদের শাসন চালু ছিল। ঐতিহাসিক ইলিয়ট লিখেছেন, বিন কাসিম ‘সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, মুখ্য অধিবাসী ও ব্রাহ্মণদের মন্দির নির্মাণ, মুসলিমদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, নির্ভয়ে বসবাস ও আত্মোন্নতির জন্য প্রতিযোগিতা করার নির্দেশ দিলেন। জিয়াদ আলী লিখেছেন, ‘হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের ¯েœহ প্রীতির সম্পর্ক... মধুর ছিল... পারস্পরিক সৌহার্দ্য স্থাপনের নজির সৃষ্টি হয় নবম শতাব্দী থেকেই। ব্রিটিশরাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করেছে ১৭৫৭ সালে বাংলা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির করতলগত হয়। শাসন ও শোষণের জন্য তারা যে পলিসি গ্রহণ করে তা হচ্ছে ফরারফব বঃ রসঢ়বৎধ অর্থাৎ ‘ভাগ করো ও শাসন করো’। লর্ড এলফিনস্টোন ১৮৫৮ সালে তিনি ‘ভারতের রাষ্ট্রসচিব চার্লস উড ১৮৬২-তে ভাইসরয়কে লিখেছিলেন যে ভারতের ‘জাতিগুলির’ অন্তর্দ্বন্দ্বই ভারতে ব্রিটিশদের শক্তি জোগাবে। তাই ‘এই বিভেদকারী শক্তিকে’ জিইয়ে রাখতে হবে, কারণ সমগ্র ভারত আমাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হলে আর কতদিন আমরা টিকে থাকতে পারব? ভারতে হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক মনোভাব বাংলাদেশের গত একশ বছরের ইতিহাসে চারটি সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটেছে। এক. ১৯০৫ সালে ঢাকাকে রাজধানী করে ‘পূর্ববাংলা ও আসাম’ প্রদেশ গঠন, দুই. ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব, তিন. ১৯৪৭ সালে জাতিস্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিতে পাকিস্তান অর্জন এবং চার. ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ। বিশেষ করে ১৯০৫ সালের ঢাকাকেন্দ্রিক নতুন প্রদেশ গঠন ভারতীয় রাজনীতিতে সৃষ্টি করে এক বড় ধরনের অভিঘাত। কলকাতার নিয়ন্ত্রণমুক্ত এই নতুন প্রদেশ গঠন ছিল ইংরেজ আমলের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর। কলকাতার বর্ণহিন্দুরা দেড় শ’ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো তাদের ভাগ্যবিধাতা ইংরেজদের ‘বয়কট’-এর কর্মসূচি নেয়। তাদের সন্ত্রাস ও সহিংসতার আগুনে পুড়ে ছাই হয় গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জনের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। এই সৃষ্ট ঘটনা-প্রবাহের অভিঘাতে নিদারুণ মর্মযাতনা নিয়ে অকালে ইন্তেকাল করেন ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ব বাংলার জাগরণের অন্যতম নায়ক নওয়াব সলিমুল্লাহ। বিষয়টি হচ্ছে পূর্ব বাংলার ভাগ্যবঞ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানগণ ঢাকাকেন্দ্রিক নতুন প্রদেশ গঠনকে দেখেছে তাদের ‘ভাগ্যোদয়ের প্রথম প্রভাত’ রূপে। অন্য দিকে ইংরেজদের সম্পূরক শক্তিরূপে বেড়ে ওঠা কলকাতাকেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু জমিদার, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকগণ, এ ঘটনাকে মূল্যায়ন করেছেন, তাদের দেড় শ’ বছরে গড়ে তোলা আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তিভূমির ওপর একটি কঠিন আঘাতরূপে। তাদের ভাষায় এ ঘটনা ছিল এক গুরুতর জাতীয় বিপর্যয়। সুতরাং শিক্ষা-দীক্ষায় এই জনপদকে পিছিয়ে তোলার ষড়যন্ত্র কম হয়নি। স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করতে লজ্জাবোধ করেননি। এই অপকীর্তি ঢাকার জন্য ইংরেজরা হিন্দুদের বন্ধু সেজে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক প্রচারযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসির নতুন রূপায়ণ ঘটিয়ে তারা হিন্দুদের ‘মুক্তিদাতা’রূপে আবির্ভূত হয়। মুসলিম শাসনামলে হিন্দুরা নানাভাবে অত্যাচারিত হয়েছিল বলে তারা নানা প্রকার মিথ্যা ও অলীক কাহিনী প্রচারে লিপ্ত হয়। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের বিভিন্ন নাটক তৈরি করছে। এখন সেই ভারতেই আবার সারা বিশ্বে ফেরি করে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ভোটবিহীন হলেও আওয়ামী লীগের কেন থাকা প্রয়োজন তা বিশ্বকে জ্ঞান দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। ভারতে সাম্প্রদায়িক মনোভাব বজায় রাখার জন্য কংগ্রেস থেকে শুরু করে বিজেপি পর্যন্ত সকলেরই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ একটি চেষ্টা সব সময়ই লক্ষ্য করা যায়। এর উদ্দেশ্য শোষণ ও নির্যাতন বজায় রাখা। জনগণের সাধারণ ধর্মানুভূতি ব্যবহার করার জন্য গান্ধী-নেহরু থেকে শুরু করে হেগড়ে-বাজপেয়ি পর্যন্ত সকলেই নিরন্তর চেষ্টা চালিয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতাকে ইন্ধন জুগিয়ে উসকে দিতে কংগ্রেস সরকার ভারতে এক ঘন সাম্প্রদায়িকতার বার্তাবরণের সৃষ্টি করেছে। এই রাজনৈতিক দর্শন সম্পূর্ণ নিজ দলের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। ক্ষমতার রাজনীতি এখানে প্রাধান্য পেয়েছে।... ভোটের প্রয়োজনে কখনো হিন্দু কখনো মুসলিম মৌলবাদকে যেমন রাজীব ব্যবহার করেছেন তেমনি খ্রিস্টান ধর্মকেও তিনি বাদ দেননি।... ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও গণহত্যা ভারতীয়দের সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও মতবাদ এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ ও দাঙ্গা ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় অধ্যায়। যখন ইংরেজ শাসকশ্রেণীর পক্ষ থেকে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলিছিল তখন দক্ষিণ ভারতে মারাঠা শক্তির পুনর্গঠনকল্পে বালগঙ্গাধর তিলক ১৮৯৫ সালে রায়গড়ে এক বক্তৃতায় বলেন, ‘আমাদিগকেও শিবাজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হইতে হইবে। ঢাল-তলোয়ার লইয়া অসংখ্য মুসলমান বহিরাগতকে হত্যা করিতে হইবে। যদিও এরূপ যুদ্ধে আমাদেরও কিছু ক্ষতি হইবে, তাহা হইলেও এরূপ স্বার্থত্যাগের প্রয়োজন আছে।’ ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ১৯৪৭ সালে ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা হাতে পাওয়ার পর বলেই ফেললেন, ‘মুসলিমদের এক হাজার বছরের প্রতিশোধ নিলাম।’ আর প্রতিশোধ নেয়ার ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে ১৯৪৮ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর রাতের অন্ধকারে মুসলিম ঐতিহ্যের লীলাভূমিখ্যাত স্বাধীন-সার্বভৌম হায়দারাবাদ আক্রমণের মাধ্যমে লাখ লাখ মুসলিম হত্যা, হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রমহানি, শত শত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভারত তার প্রথম রক্তপান উদ্বোধন করে। শত শত হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার আড়ালে মুসলিম নিধন করতেও ভারত একটুও পিছপা হয়নি। ১৯৪৯ সালের দাঙ্গায় বাংলায় পাঁচ থেকে দশ হাজার, ১৯৫৭ সালের ১৩ আগস্ট রাঁচিতে দুই শ’, ১৯৬৭ সালে আহমেদাবাদে ১৯৭৯ সালের ১৪ এপ্রিল জামশেদপুরে এক শ’ পঁচিশ, ১৯৮০ সালের ৬ আগস্ট মুরাদাবাদে দুই হাজার, ১৯৮৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আসামে দুই হাজার সাত শ’ তেত্রিশ, ১৯৯০ সালের ১২ ডিসেম্বর হায়দারাবাদে এক শ’ বত্রিশ এবং ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে দুই হাজার মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নৃত্যখেলায় প্রাণ হারায়। এছাড়া ছোট-বড় আরও অসংখ্য দাঙ্গা সংঘটিত হয়। প্রায় ত্রিশ কোটি মুসলিম অধিবাসীর ভারতে একত্রিশ মিলিয়ন (তিন কোটি দশ লাখ) লোকই বাস করে উত্তর প্রদেশে, যা মুসলিম ঐতিহ্যসমৃদ্ধ একটি রাজ্য। এই একত্রিশ মিলিয়ন মুসলিম বসতির রাজ্যে ফায়েজাবাদ স্থাপত্যশিল্পে পরিপূর্ণ একটি জেলা, যেখানে মুসলিমদের অন্যতম নিদর্শন ‘বাবরি মসজিদ’ অবস্থিত। ১৫২৭ সালে প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরের নির্দেশে মীর বাকী মসজিদটি নির্মাণ করেন, যা পরবর্তী সময়ে সম্রাটের নামানুসারে ‘বাবরি মসজিদ’ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। ১৯৪০ সালের পর একে ‘মসজিদে জন্মস্থান’ (অর্থাৎ জন্মস্থানের মসজিদ, হিন্দুরা প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে, এখানে রাম জন্মগ্রহণ করেছেন। আর এটা ছিল বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রথম হাস্যকর ষড়যন্ত্র)। স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার পর এখানে কোন সাম্প্রদায়িক অশান্তি ও দাঙ্গা হয়নি বা দেখা যায়নি। কিন্তু ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে এ পর্যন্ত সারা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় সাড়ে তের হাজার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটিয়াছে। সংখ্যালঘু নির্যাতনের নষ্ট রাজনীতি বাংলাদেশের (১৯৭১-২০০০) সব সরকারই কম বা বেশি, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে ও দিচ্ছে। তা তারা দিয়েছে ও দিচ্ছে ‘ভোটের জন্য’, ‘ক্ষমতায় থাকার জন্য’ বা ‘ক্ষমতা পাওয়ার জন্য’। অর্থাৎ শাসকশ্রেণী ও গোষ্ঠী না চাইলে সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি হবে না বরং তার বিলোপ ঘটবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই বাঙালি-অবাঙালির বিভেদ তৈরি করে জাতিকে বিভক্ত ও বিভ্রান্ত করে চলছে। তাদের উদ্দেশ্য লুটপাট, হিন্দুদের জমি দখল। হিন্দুদের তাড়াতে পারলে অর্থসম্পদ সম্পত্তির দখল আর দেশে থাকলে জোর জবরবস্তি করে ভোট নেয়াই তাদের মুদ্রা দোষে পরিণত হয়েছে। এদেশে সাম্প্রদায়িক বিভেদের পেছনে কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস কাজ করেনি। সবই মূলত ঘটেছে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পারস্পরিক হিংসাবিদ্বেষ থেকে। (লুট, সম্পত্তি প্রাপ্তি, সহজে ক্ষমতাশালী হওয়া ইত্যাদি) এবার সংখ্যালঘু নির্যাতন পূর্ব পরিকল্পিত ‘২ জানুয়ারি ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় অগ্নি রায়ের রিপোর্টটিতে তেমন আভাসই মিলেছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হবে, কোনো কারণে এই সরকার পড়ে গিয়ে যদি জামায়াত সমর্থিত বিএনপি সরকার আসে, তাহলে বিপুলসংখ্যক অনুপ্রবেশকারী মোকাবেলার জন্য ভারতকে প্রস্তুত থাকতে হবে।’ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, তাদের অনুসারী দেশীয় মহলও ইনিয়ে বিনিয়ে ঘটনার একই পূর্বাভাস জানিয়েছিল। সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের অনেকে আগে থেকেই বলে আসছিলেন, নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হবে। বিপুলসংখ্যক সংখ্যালঘু দেশ ত্যাগ করবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কিভাবে নিশ্চিত হলেন? গত ৫ নভেম্বর ২০১৩ ‘হুঁশিয়ার বাংলাদেশ’ শিরোনামে বিশিষ্ট কলামিস্ট, কবি, বিশ্লেষক জনাব ফরহাদ মজহার লিখেছেন-‘এটা পরিষ্কার যে কোনো-না- কোনো অশুভ শক্তি বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে চায়। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তা খুবই বিপজ্জনক। ইতোমধ্যে অনেকে ঘরে বসে না থেকে রাস্তায় প্রতিবাদ করেছেন, জনগণকে অশুভ বিপদ সম্পর্কে সচেতন করছেন।’ সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, বিরোধী দল ক্ষমতায় এলে এ দেশে একটি হিন্দুও থাকবে না। সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ করার সংকল্প ও সাফল্যের ওপর বিরোধী জোটের রাজনৈতিক সাফল্য নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি হুঁশিয়ার হতে হবে ইসলামপন্থীদের। ঘটনা যারাই ঘটাক পুরা দোষ তাদের ওপর চাপানোর চেষ্টা চলবেই। ইতোমধ্যে তা শুরুও হয়ে গিয়েছে। জামায়াত-শিবিরের ওপর দোষ চাপানো সাধারণ ফর্মুলা। (সূত্র : নয়া দিগন্ত ০৫-১১-২০১৩) অপারেশন মাইনোরিটি- সংখ্যালঘু নির্যাতনে কার কী অবদান শিরোনামে : বিশিষ্ট কলামিস্ট মিনা ফারাহ লিখেছেন, একটি দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ধরে রাখার জন্য সংখ্যালঘু কার্ডটি লাইফ সাপোর্টের মতো জরুরি কেন, বোঝার জন্য আইনস্টাইন হওয়ার দরকার নেই। সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে প্রমাণ হয়, হিন্দুদের কোনো শত্রু লাগে না, কারণ এরা এদের তিন শত্রু অর্থাৎ ‘ভারতপ্রীতি, আওয়ামী নির্ভরতা, মেরুদ-ের অভাব’, একটিও বুঝতে অক্ষম।’ সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় কিছু মিডিয়া বারবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো মন্ত্রী, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ‘কেষ্ট বেটা’Ñ একটাও গ্রেফতার হলো? সুতরাং যা আছে ৯৯ শতাংশ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। জামায়াত-শিবিরকে সন্ত্রাসী দেখিয়ে নিজেদের সন্ত্রাস অব্যাহত রাখার মূলে, একদলীয় শাসন ভুলিয়ে দেয়া। সংখ্যালঘু বিষয়টি বহুমাত্রিক, দায় একা জামায়াত-শিবিরের ওপর চাপিয়ে ভুল করছে সরকার।’ (নয়া দিগন্ত ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪) ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর হঠাৎ সংখ্যালঘু নির্যাতন কেন? ৫ জানুয়ারি একদলীয় নির্বাচনে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের পরিবারের ওপর হামলা চালিয়ে দেশের জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এই চক্রান্ত চালায়। ফেনীর মালো পাড়ায় সহিংস ঘটনার জন্য তারা নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী শেখ আবদুল ওহাবের সমর্থকদের দায়ী করছেন। জানা যায়, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে এই আসনে বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন তিনি। নির্বাচনের আগেই প্রকাশ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের তাকে ভোট না দেয়ার পরিণতি ‘ভয়াবহ হবে’ বলে শাসিয়ে দিয়েছিলেন। মালোপাড়া মন্দিরের সামনে নির্বাচনী সভায় স্থানীয় হিন্দুদের অধিকাংশই অনুপস্থিত থাকে। তারা রণজিত রায়কে সমর্থন দিয়েছিলেন। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার পর আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থী রণজিত কুমার রায় বলেছেন, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালিয়েছে তার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ নেতা ও হুইপ শেখ আবদুল ওহাবের ক্যাডারেরা। অভয়নগর উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেক সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের ইন্ধনে এ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনের পর ওই দিন রাতে দিনাজপুর সদর উপজেলার কর্নাই গ্রামে হিন্দুদের কয়েকটি বাড়ি ও দোকানে ভাঙচুর হয়। আক্রান্ত হয় কয়েকটি মুসলিম পরিবারও। ঘটনাস্থল থেকে শামীম ও কামরুল নামে সরকার সমর্থক দু’জন হামলাকারী যৌথবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। দিনাজপুর সদর আসনের সংসদ সদস্য এবং উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেত্রী জেসমিন আরা জোস্নার অনুরোধে ওদের ছেড়ে দেয়া হয়। এর পরপরই তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা কর্নাই গ্রামে তা-ব চালায়। তারা কর্নাই বাজারের হিন্দু ও মুসলমানদের ১০-১২টি দোকানে ভাঙচুর, লুটপাট এবং গ্রামের বেশ কিছু সংখ্যালঘুর বাড়িতে হামলা চালায়। নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলায় কালীমন্দিরে আগুন দিয়েছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল খালেকের ভাষ্য মতে, দলের প্রার্থী নির্বাচিত এমপি ছবি বিশ্বাসকে ভোট দেয়ায় নিজ দলের প্রতিপক্ষ গ্রুপের লোকেরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার হিন্দু অধ্যুষিত ফলদা ইউনিয়নে মন্দির পোড়ানোর ঘটনার প্রধান আসামি আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতাকে গ্রেফতার না করায় এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে নির্বাচন বর্জন করেছে সহস্রাধিক হিন্দু ভোটার। নোয়াখালীর কৃষ্ণপুরে হিন্দুদের ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলার ঘটনায় স্থানীয় পূজা কমিটি আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। পটুয়াখালীর শহরতলী লাউকাঠি বাজারে ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি বাহাদুর শেখের দাবিকৃত এক প্যাকেট সিগারেট ও ৫০০ টাকা না দেয়ায় তিনজন হিন্দু ব্যবসায়ীকে মারধর, দোকানপাটে হামলা ও ভাঙচুর করে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে সে ও তার ক্যাডার বাহিনী। (সূত্র : আমার দেশ) ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর যখন পশ্চিমা বিশ্ব নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে, তখন সংখ্যালঘু নির্যাতনের একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে এসবের সাথে বিএনপি-জামায়াতকে জড়িত দেখিয়ে এক দিকে পশ্চিমা বিশ্বের সহানুভূতি, অন্য দিকে ভারতে যারা আসন্ন নির্বাচনে ব্যাপক বিজয় লাভ করতে পারে সেই ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সমর্থন লাভের প্রয়াস চালানো হয়েছে। ভারতের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সমর্থনের পেছনে ভারতের রয়েছে এজেন্ডা। রয়েছে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত ভারত লজ্জিত হয়ে মোহভঙ্গ হয়েছে। বিশ্বের নজর ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। সংখ্যালঘুদের সম্পদ দখলের যত অভিযোগ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে পরিস্থিতির শিকার হয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে তাদের সহায় সম্পত্তি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলে স্বাধীনতা-পরবরতী সময়ে এর মূল কারণ ছিল আওয়ামী জুলুম, নির্যাতন, লুটপাট আর দখল আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীরাই যে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে এসব সহায় সম্পত্তি দখল করে নেয়। অথচ কোনো সংখ্যালঘুর বাড়িঘর জামায়াতের নেতাকর্মীরা দখল করেছে এমন কোনো প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবে না। ইসলাম ধর্মেও অন্যের সম্পদ দখল নিষিদ্ধ তথা হারাম করেছে । এই নির্দেশনা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা পালন করেন অক্ষরে অক্ষরে। রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সব সময় সংখ্যালঘুদের তাদের নিজস্ব ভোট ব্যাংক হিসেবে মনে করে থাকে। আর তাই অত্যন্ত কৌশলে সংখ্যালঘুদের নিজেদের পক্ষে রাখতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে এর ফায়দা নিতে চায় বিভিন্ন সময়ে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিটি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ রয়েছে। বিগত ২০০৯-২০১৩ সালের আওয়ামী লীগ শাসনামলের দিকে তাকালেই এর প্রমাণ মিলবে অতি সহজে। রামু আওয়ামী লীগের পাঁচ বছরের শাসনে সবচেয়ে বড় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। কক্সবাজারের রামু ও উখিয়ার বিভিন্ন বৌদ্ধ মন্দিরে ন্যক্কারজনক এই হামলার ঘটনা ঘটে। এই হামলায় ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার বর্তমান আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতার প্রত্যক্ষ প্রমান পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ছবির মাধ্যমে আজ দেশের মানুষের কাছে পরিষ্কার। ২৯ সেপ্টেম্বর রাত দশটায় প্রথম মিছিলটি বের হয় রামু উপজেলা আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি আনছারুল হক ভুট্টোর নেতৃতে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে- মিছিলটির শুরুতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেন। তার বা পাশে যুবলীগ নেতার ভাই হাফেজ মোহাম্মদ। এ ছাড়াও হামলায় আরো নেতৃত্ব দেয় উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর পুরান ঢাকায় ১৮ দলের ডাকা অবরোধে সরকারের নির্দেশে প্রতিরোধ করার নামে হিন্দু ধর্মের অনুসারী বিশ্বজিৎ নামের এক যুবককে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। দিবালোকে টিভি ক্যামেরার সামনে উপর্যুপরি চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় এই হতভাগ্য যুবকে। হিন্দু পরিচয় দিয়েও বর্বর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পায়নি দর্জিকর্মী বিশ্বজিৎ! এই ঘটনায় আদালত দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির আদেশ প্রদান করে ছাত্রলীগের ঐ সকল নেতা কর্মীদের। বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি সংগঠনের এতসংখ্যক কর্মীর এক সাথে আদালত কর্তৃক ফাঁসির আদেশ এই প্রথম। ২০০৯-২০১৩ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কর্তৃক সংখ্যালঘু নির্যাতনের কয়েকটি চিত্র এখানে তুলে ধরা হলোÑ ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার বড়মাছুয়া ইউনিয়নের খেজুরবাড়িয়া গ্রামের চার সংখ্যালঘু পরিবারের পানের বরজ ও খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় সরকার সমর্থকরা। ৫ মার্চ ২০০৯, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার যুগিপোতা গ্রামের রবিন ম-লের ১২ বিঘা জমির চিংড়িঘের দখল করে নেয় আওয়ামী লীগ কর্মীরা। ১৯ এপ্রিল ২০০৯, দিনাজপুর সদর উপজেলার পাড়বড়ইল গ্রামের ১১৩টি ভূমিহীন পরিবারকে উচ্ছেদ করে জোতদারকে জমি দখল করিয়ে দেয় পুলিশ। এ সময় পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে ওইসব পরিবারের ঘরবাড়ি। ২০ এপ্রিল ২০০৯, কেরানীগঞ্জে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সম্পত্তি দখল করতে গিয়ে অজিত করাতি ওরফে ক্ষীরমোহনকে পিটিয়ে হত্যা করে। এ সময় চারটি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করে তারা। ২০০৯ সালের মে মাসে সাতক্ষীরার আবাদের হাটের ঘোষাল পরিবারের ৩৮ বিঘা জমি দখল করে নেয় যুবলীগের এক ক্যাডার ও তার সহযোগীরা। ১৪ মে ২০০৯, কালিগঞ্জের উজয়মারিতে ২২টি সংখ্যালঘু পরিবারের জমি দখল করে নেয় আওয়ামী লীগের কর্মীরা। ১১ জুলাই ২০০৯, দোহারের নারিশা পূর্বচর গ্রামে সংখ্যালঘু নৃপেন মালাকারের জমিতে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দখল করে নেয় সরকার দলীয় ক্যাডারা। ২০১২ সাল ৫ মার্চ ২০১২। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামের তিনটি সংখ্যালঘু পরিবারের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। ১৫ মে ২০১২, রাতের আঁধারে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তার সহযোগীরা উপজেলার পানপুঞ্জির খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কবরস্থান দখল করে ক্রুশ গুঁড়িয়ে দেয়। ২৮ মে ২০১২, সিলেটে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েরে ৩৩ বছরের বন্দোবস্তীয় দোকান দখল করে নেয় সরকারদলীয় সন্ত্রাসীরা। ২৫ জুলাই ২০১২ নরসিংদীর পলাশের চরসিন্দুর গ্রামে শ্মশানের জায়গা দখলকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘুদের চারটি বাড়িঘর ও মূর্তি ভাঙচুর এবং তাদের বাড়িতে লুটপাট করা হয়। ২২ আগস্ট ২০১২, রাজধানীর সূত্রাপুরের ৯৫ ঋষিকেশ দাস লেনে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীরা এক হিন্দু পরিবারের বাড়ি দখল করতে তাদের নয় জনকে মারধর, লুটপাট এমনকি পরে তাদের অপহরণ করে। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১২, পিরোজপুরের নাজিরপুরে রুহিতলাবুনিয়া গ্রামে মন্দিরের জমি দখল করার জন্য আওয়ামী লীগ নেতা আলাউদ্দিন মাঝি ও অপর আওয়ামী লীগ নেতা মনোরঞ্জন গোলদার গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১২, মাদারীপুরের রাজৈরের খালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম সাতপাড় গ্রামে রামমোহন মন্ডলের পূজাম-পে পুলিশ এক তরুণীকে উত্ত্যক্ত করে। পূজারীরা এর প্রতিবাদ করায় মধ্যরাতে এসআই কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে পুলিশের সদস্যরা প্রতিমা ভাঙচুর করে। ২০ ডিসেম্বর ২০১২, সাতক্ষীরার দেবহাটার ঢেবুখালিতে ৩০০ বিঘার একটি ঘের দখল করে নেয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। ২০১৩ সাল ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, আওয়ামী লীগ নেতারা চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে সংখ্যালঘুদের ওপর চরম নির্যাতন চালায়। ২৭ মার্চ ২০১৩, আওয়ামী লীগের দলীয় মিছিলে যোগ না দেয়ায় কুষ্টিয়া কুমারখালী উপজেলার দয়ারামপুর ঘোষপাড়ায় তিনটি হিন্দু পরিবারের ওপর হামলা করে এবং ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। ৩১ মার্চ ২০১৩, বগুড়ার সোনাতলার গড়চৈতন্যপুর গ্রামে পূজাম-পের ৪টি প্রতিমা ভাঙচুর করে যুবলীগ। (১ এপ্রিল ২০১৩, দৈনিক আমার দেশ)। ১০ এপ্রিল ২০১৩, কলাপাড়ায় রাখাইন সম্প্রদায়ের শ্মশান দখল করে নেয় সরকারদলীয় ক্যাডাররা। ২২ অক্টোবর ২০১৩, আওয়ামী লীগের একদল সন্ত্রাসী বন্দুক উঁচিয়ে কাফরুল থানার পুলিশের সামনেই ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী রীতা গমেজের বাড়ির একাংশ দখল করে নেয়। ২ নভেম্বর ২০১৩ পাবনার সাঁথিয়ার বনগ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। ৪ ডিসেম্বর ২০১৩, বগুড়ায় যুব লীগ নেতৃবৃন্দ অত্যাচারের মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কয়েকটি পরিবারকে এলাকা ছাড়া করে। অধিকারের রিপোর্ট মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর ২০১১ সালের জানুয়ারি-মার্চ মাসের রিপোর্টে বলা হয়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের প্রথম সোয়া দুই বছরে ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর অমানবিকভাবে নির্যাতন হয়েছে। সংখ্যালঘু নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৮১৩ ব্যক্তি ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এ নির্যাতনের কারণে ৩ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৭৬৬ জন এবং ৫১টি মন্দিরে হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে। ১২ জনের জমি দখল করা হয়েছে, ৪ জনের ঘর ভেঙে ফেলা হয়েছে। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ পরবর্তী ৫ জানুয়ারির     একদলীয় ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য আবারো হামলা চালানো হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর। কিন্তু এবারো প্রমাণ হয় আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা। মালোপাড়া, ঠাকুর গাঁসহ বেশ কয়েকটি স্থানে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া পাবনার সাঁথিয়ায় মন্দিরে আগুন দেয় আওয়ামী লীগ কর্মীরা। জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীর নির্বাচনী এলাকা হিসেবে এর সাথে জামায়াতকে প্রথমে অভিযুক্ত করা হয়; কিন্তু অল্প সময়েই বেরিয়ে আসে প্রকৃত সত্য। এর পরও একটি স্বার্থান্বেষী মহল সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে কোনো ঘটনায় রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য আদর্শবাদী দল জামায়াতকে জড়ানোর অপচেষ্টা করে আসছে সবসময়। অথচ বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে (জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামী এবং জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ) প্রায় প্রতিটি আসনে অন্যান্য ধর্মের লোকেরাও বিপুল পরিমাণে ভোট প্রদান করে জামায়াত মনোনীত প্রার্থীদের বিজয়ী করেছিলেন । কিছু দিন আগে পাবনার বনগ্রামে হিন্দু বাড়িতে হামলা হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান পরিদর্শনে গিয়ে পুলিশ অফিসারকে বলেন, ‘মন্ত্রী হয়ে যদি সন্ত্রাসীদের পক্ষ নেয়, তা হলে সেই মন্ত্রীকে আপনারা প্রশ্রয় দেন কেন? আপনারা মূল আসামিদের বাদ দিয়ে রেখেছেন।’ একটি পত্রিকা দেখিয়ে তিনি বলেন, মন্ত্রীর পাশে সন্ত্রাসীরা ঘুরে বেড়ায়। সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ড. অধ্যাপক আবু সাইয়িদ চৌধুরী বলেন, সদ্য বিগত স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিলে এবং সন্ত্রাসীরা তার সাথে ঘুরে বেড়ালে পুলিশ কী করবে? ১৩ জানুয়ারি হিন্দু-বৌদ্ধ কল্যাণ ফ্রন্ট সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন-পরবর্তীকালে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য হামলার অভিযোগ করেছে। এসব কথার অর্থ হলো, হিন্দু বাড়ি ও মন্দিরে হামলা তারাই করে, যারা ধরা পড়লেও ক্ষমতাবানদের আশীর্বাদে ছাড়া পেয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। সেনবাগে সংখ্যালঘুর জমি দখল করেছে আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা : থানায় জিডি করেও রক্ষা করতে পারেনি বাবার রেখে যাওয়া শেষ সম্বল ১৪ শতাংশ জমি। স্থানীয় আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা জমিটুকু জোরপূর্বক দখল করে সেখানে ইরি ধানের চারা রোপণ করেছে। ঘটনাটি ঘটেছে নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের মতি মিয়ারহাট সংখ্যালঘু দাইয়া বাড়ির এলাকায়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই এলাকার নিরীহ সংখ্যালঘুর লোকজন আতঙ্কে দিন অতিবাহিত করছে। থানায় দেয়া অভিযোগে জানা গেছে, উপজেলার কাদরা ইউনিয়নের হিরাপুর গ্রামের সংখ্যালঘু মৃত রসরাজ চন্দ্র দাসের আহম্মদপুর মৌজার ২১৯৩ নং খতিয়ানভুক্ত ও ৫০৩১ দাগের ১৪ শতাংশ জমি তার পাঁচ ছেলে টকন চন্দ্র দাস, স্বপন চন্দ্র দাস, তপন চন্দ্র দাস, শুপন চন্দ্র ও নিমাই চন্দ্র দাসের নামে ওয়ারিশ সূত্রের মালিক খতিয়ানভুক্ত হয়। “মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রীর বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের জায়গা দখলের অভিযোগ” চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী বেগম হাসিনা মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক পরিবারকে বসতভিটা থেকে উচ্ছেদের অভিযোগ উঠেছে। বুধবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন নগরীর কে সি দে রোড এলাকার বাসিন্দা ঝিনু রানী বড়ওয়া। (শীর্ষ নিউজ ডটকম ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪) আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের মিথ্যাচার জনাব আবুল বারাকাত আওয়ামী ঘরানার একজন অন্যতম বুদ্ধিজীবী হিসেবে খ্যাত। তিনি মৌলবাদী অর্থনীতির গবেষক হিসেবেও পরিচিত। অর্থাৎ সরলীকরণে জামায়াতের অর্থ সম্পদেও খোঁজখবরই বেশ রাখেন তিনি। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি উদ্ভট তথ্য দিয়ে চমক সৃষ্টিতেও কম পটু নন। তার রচিত বই ‘অর্পিত সম্পত্তির সাথে বসবাস’ সারণি-১৯ এ দেখানো হয়েছে, অর্পিত সম্পত্তি দখলের সময় সর্বোচ্চ সংখ্যক (৩৭%) সুবিধাভোগী মুসলিম লীগের সাথে জড়িত ছিল। আর বর্তমানে (২০০৬) ক্ষমতাসীন বিএনপির সাথে ৪৫%, আওয়ামী লীগের সাথে ৩১%, জামায়াতের সাথে ৮% ও জাতীয় পার্টির সাথে ৬% সুবিধাভোগী সংশ্লিষ্ট। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে আওয়ামী লীগের অন্যতম বুদ্ধিজীবী হিসেবে খ্যাত জনাব আবুল বারাকাত তার গবেষণায় ৩১% সম্পত্তি আওয়ামী লীগ কর্তৃক দখল করার হিসাব দেখিয়েছেন। তাহলে সত্যিকার হিসেব করলে দেখা যাবে হিন্দুদের সম্পদ দখলের খতিয়ান তার থেকে কয়েকগুণ বেশি হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। সংখ্যালঘু হামলার ৮৩ ভাগে আ’লীগ জড়িত : প্রবীর মিত্র ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সারাদেশে যেসব সহিংসতা ঘটেছে সেগুলোর শতকরা প্রায় ৮৩ ভাগেই আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা ছিল বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মাইনরিটি পার্টি। শনিবার বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের হলরুমে ‘সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন এবং তাদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ও হামলাকারীদের বিচার দাবি’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক প্রবীর মিত্র এ অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে সংখ্যালঘুদের ওপর যেসব হামলা হয়েছে তার একটারও বিচার হয়নি। সব রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালিয়ে শুধু ফায়দা লুটেছে। কোনো সরকারের কাছেই সংখ্যালঘুরা নিরাপদ নয়। বড় বড় রাজনৈতিক দলে যেসব হিন্দু নেতা রয়েছেন তারা শুধু নিজের জন্য সুবিধা ভোগ করছেন। সাধারণ হিন্দুদের জন্য কিছুই করেননি। (সূত্র : ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ জাস্ট নিউজ) হিন্দুদের ওপর হামলায় আওয়ামী লীগও জড়িত : হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের বাড়িঘর হামলার জন্য সরকারের দিক থেকে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে এসব ঘটনার সাথে সরকারদলীয় সমর্থকরাই জড়িত। বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের একজন নেতা সুব্রত চৌধুরী বলেন, সংখ্যলঘুদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটলে সেটা এখন রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের ওপর দোষ চাপানোর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হামলাকারীদের বিচারের আওতায় না আনার একটি সংস্কৃতি চালু হয়ে গেছে। এখন যেমন বলা হচ্ছে জামায়াত-শিবির এটা করেছে। এটা একটা শ্লোগান হয়ে গেছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সব জায়গায় জামায়াত-শিবির করেছে বিষয়টি এ রকম না। অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের লোকজনও জড়িত হয়েছে সেটা আমরা দেখতে পেয়েছি।’ (উৎস : ১০ জানুয়ারি, ২০১৪ বিবিসি বাংলা) সংখ্যালঘু নির্যাতনে ডিসিদের চিঠি পেয়ে হতবাক সরকার দেশের বিভিন্ন জেলায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের অবস্থা জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠাচ্ছেন বিভিন্ন জেলা প্রশাসক (ডিসি)। এসব চিঠি পেয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো রীতিমতো হতবাক। ওইসব চিঠিতে, সংখ্যালঘু নির্যাতনে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের পরোক্ষভাবে দায়ী করা হচ্ছে। এ ছাড়া সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় নিরাপত্তা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, যশোর ও বাগেরহাট জেলার ডিসিরা সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। (উৎস : ১০ জানু, ২০১৪ মানবজমিন) নাগরিক তদন্ত কমিটির সাতক্ষীরার ক্ষতিগ্রস্ত ২৩টি স্থান পরিদর্শন যশোর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর জেলার ঘটনা তদন্তে গঠিত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী এবং সদস্যসচিব ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের যুগ্ম-সম্পাদক কাদের গণি চৌধুরীর নেতৃত্বে কমিটির অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। প্রথম দিনের তদন্তকাজ পরিদর্শন শেষে কমিটির আহবায়ক রুহুল আমিন গাজী বলেন, ‘সাতক্ষীরার যে করুণ দৃশ্য আমরা স্বচক্ষে দেখেছি তা বর্ণনা করার মতো নয়। নিরস্ত্র মানুষের ওপর সরকারের বৈধ অস্ত্র দিয়ে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, তার বিচার একদিন আল্লাহ করবেন।’ (সূত্র : ৩১-০১-২০১৪, দৈনিক আমার দেশ) ইসলামে সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ একটি জাতীয় রাষ্ট্র স্বীয় রাষ্ট্র কাঠামোতে বিজাতীয় লোকদের উপস্থিতি জনিত জটিলতার সমাধান তিন উপায়ে করে। প্রথমত, তাদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তাকে ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত করে নিজেদের জাতিসত্তার বিলীন করে নেয়। দ্বিতীয়ত, তাদের জাতিসত্তাকে নির্মূল করার জন্য হত্যা, লুটতরাজ ও দেশান্তরিতকরণের নিপীড়নমূলক কর্মপন্থা অবলম্বন করে। তৃতীয়ত, তাদেরকে নিজেদের ভেতরে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানিয়ে রেখে দেয়। দুনিয়ার জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে এই তিনটি কর্মপন্থা ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে এবং এখনও গৃহীত হয়ে চলছে। আজকের ভারতে খোদ মুসলমানদেরকে এসব নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদেরকে যে অধিকারই দেয়া হয় তা সংখ্যাগুরুর দেয়া অধিকার। সংখ্যাগুরুরা ওসব অধিকার যেমন দিতে পারে তেমনি তাতে কমবেশি করা বা একেবারে ছিনিয়ে নেয়ারও অধিকার রাখে। কিন্তু মৌলিকভাবে যে সমস্ত অধিকার সংখ্যালঘুদের ইসলামী রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। প্রাণের নিরাপত্তা : অমুসলিম নাগরিকের রক্তের মূল্য মুসলমানদের রক্তের মূল্যের সমান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলে জনৈক মুসলমান অমুসলিমকে হত্যা করলে তিনি খুনিকে মৃত্যুদ- দেন। তিনি বলেন, “যে নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়া হয়েছে, তার রক্তের বদলা নেয়ার দায়িত্ব আমারই।” (ইনায়া শরহে হিদায়া, ৮ম খ-) হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর আমলে বকর বিন ওয়ায়েল গোত্রের এক ব্যক্তি জনৈক হীরাবাসী অমুসলিম যিম্মিকে হত্যা করে। তিনি খুনিকে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের হাতে সমর্পণের আদেশ দেন। অতঃপর তাকে উত্তরাধিকারীদের হাতে সমর্পণ করা হলে তারা তাকে হত্যা করে। (বুরহান শরহে মাওয়াহিবুর রহমান, ৩য় খ-, পৃষ্ঠা ২৮৭) “যে অমুসলিম নাগরিককে কষ্ট দিল আমি তার বিরুদ্ধে বাদি হবো। আর আমি যার বিরুদ্ধে বাদি হবো আমি কিয়ামতের দিন জয়ী হবো।” (তারিখে বাগদাদ) ‘যে সংখ্যালঘুকে কষ্ট দিল সে আমাকে কষ্ট দিল আর যে আমাকে কষ্ট দিল সে স্বয়ং আল্লাহকে কষ্ট দিল।’ (তাবরানি আওসাত) হযরত আলী (রা)-এর আদালতে সংখ্যালঘু নাগরিক হত্যাকারী এক মুসলিমকে উপস্থিত করা হলো এবং সাক্ষী-প্রমাণের মাধ্যমে তার অপরাধ প্রমাণিত হলো। হযরত আলী (রা) হত্যাকারী মুসলিমকে মৃত্যুদ- দিলেন। তাঁর রায় কার্যকর করার মুহূর্তে নিহত সংখ্যালঘুর ভাই এসে বলল, আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। হযরত আলী (রা)-এর প্রশ্ন ছিল লোকটির প্রতি-হয়তো তারা তোমাকে শাসিয়েছে, চোখ রাঙিয়েছে, হুমকি দিয়েছে তাই তুমি একান্ত বাধ্য হয়ে ক্ষমা করতে এসেছো? জবাবে সে জানাল, না, এ হত্যা ছিল অনিচ্ছাবশত। তারা রক্তপণ (দিয়াত) দিয়েছে। এতে আমি রাজি। হযরত আলী (রা) তখন তার উদ্দেশে বললেন, নিশ্চয়ই তুমি জান, যারা আমাদের নিরাপত্তায় থাকবে তাদের জানের মূল্য আমাদের জানের মতোই। তাদের রক্তপণ আমাদের রক্তপণের মত। (সুনানে কোবরা)। এ ছাড়াও ফৌজদারি দ-বিধি, সম্মানের হিফাজত, পারিবারিক বিষয়াদি, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, উপসনালয়, জিযিয়া ও কর আদায়ে সুবিধা দান, অমুসলিমের চিরস্থায়ী নিরাপত্তা, বাকস্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা, শিক্ষা, অর্থনৈতিক কর্মকা- ও পেশা, চাকরি, অমুসলিমদের নিরাপত্তার একমাত্র উপায়, সামরিক চাকরি থেকে অব্যাহতি ইত্যাদি অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের একান্ত দায়িত্ব। একটি ইসলামী রাষ্ট্র তার অমুসলিম নাগরিকদের যে অধিকারই দিবে, তা পাশের কোন অমুসলিম রাষ্ট্র তার মুসলিম নাগরিকদেরকে কী কী অধিকার দিয়ে থাকে, বা আদৌ দেয় না, তার পরোয়া না করেই দেবে। এ কথা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা যায় যে, ইসলামের চেয়ে অধিক ইনসাফ, সহিষ্ণুতা, উদারতা ও বদান্যতার সাথে অন্য কোনো ব্যবস্থা সে জটিলতার সমাধান করেনি। বাংলাদেশে হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ জৈন বহু ধর্মাবলম্বী মানুষ আছেন, তারা স্বাধীনভাবে রুজি-রোজগার করেন, পূজা-পার্বণ করেন এবং স্বাধীনভাবে তাদের সকল অধিকার নির্বিঘেœ ভোগ করে আসছেন। ইসলাম সকল প্রকার সম্প্রদায়িক শ্রেণীভেদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছে। লঘিষ্ঠ আর গরিষ্ঠকে মুক্ত করতেই এই জীবনব্যবস্থার আগমন। শাশ্বত বিধান আল ইসলামের লক্ষ্যই হচ্ছে সকল প্রকার ভেদাভেদ উঁচু-নিচু, হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে অন্য সকল মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের পতাকাতলে সমবেত করা। সুতরাং যারা এতুটু চেতনা বিশ্বাস ও আল্লাহর কাছের জবাবদিহির মানসিকতাকে লালন করে তারা কখনোই অন্যের অধিকার হরণ সামাজিক অনাচার সৃষ্টি ও সম্পদ লুণ্ঠনের মতো গর্হিত কাজ করতে পারে? বরং তারা সকল ত্যাগের বিনিময়ে হলেও তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা বিশ্বাস করি ইসলামের সৌন্দর্য খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে গোটা পৃথিবীর মানুষকে যেভাবে আকৃষ্ট করেছে, আজও যদি তার প্রতিনিধিরা সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেন, তাহলে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে ইসলামের আলোয় উদ্ভাসিত হবে সারা পৃথিবী। একশ্রেণী স্বার্থান্বেষী মহল সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, নির্যাতন, তাদের সম্পদ লুটপাট করে লাভবান হচ্ছে। আবার আর এক শ্রেণী শুধুমাত্র রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য মিডিয়ার মাধ্যমে এর কল্পকাহিনী তৈরি করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও ইসলামকে বিপন্ন করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। আজ আমাদেরকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সুদৃঢ় করতে হবে এ দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য সম্প্রীতির বন্ধনকে। লেখক : সহকারী সম্পাদক, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির