বাংলাদেশ বর্তমানে এক ধূসর পথে অনিশ্চিত যাত্রা শুরু করেছে। মূলত আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখেই এই অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রা। তারও আগে নির্বাচনকালীন দেয়া অন্যান্য ইস্যুগুলোকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র মীমাংসিত যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠিত ও আদর্শবাদী একটি রাজনৈতিক শক্তিকে শুধুমাত্র নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে নির্মূল করার জন্য কথিত বিচার করছে। দেশী-বিদেশী সকল মহলেই সে বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অন্যদিকে অবৈধ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বাতিল, নেতাকর্মীদের মুক্তি ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিরোধী জোট রাজপথে নামলে দলীয় প্রশাসন ও দলীয় ক্যাডারদের দ্বারা তাদের ওপর নগ্ন ও নৃশংস হামলা চালানো হচ্ছে। তাদেরকে গ্রেফতার করে নির্মম নির্যাতন চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকার বিরোধী জোটকে বাদ দিয়ে একটি একদলীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ও করণীয় ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী’র কাছে। ছাত্র সংবাদের পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন মাজহারুল ইসলাম
ছাত্র সংবাদ : কোথাও আলোর আভাস দেখতে পাচ্ছেন কি? ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে দেশ চরম অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে, অরাজকতার দিকে যাচ্ছে। সঙ্ঘাতের দিকে যাচ্ছে। এবং এর অনিবার্য পরিণতি রক্তপাত। কেউ কেউ মনে করেন সামরিক শাসক আসতে পারে। সামরিক শাসন কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। আমি জানি না শেষ পর্যন্ত এটা কী হবে। বিরোধী দল যে আন্দোলন করছে, সে আন্দোলন দমানোর জন্য সরকার সেনাবাহিনী নিয়োগ করবেÑ এরকম একটা গুজব শোনা যাচ্ছে। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? একদিকে জনগণ, অন্যদিকে সরকার। সরকার তার পেশিশক্তি দ্বারা তার জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই যুদ্ধ সম্ভবত ময়দানেই ফয়সালা করতে হবে। অন্য কোনো পথে আমি এর ফয়সালা দেখি না। সুতরাং আলোর আভাসও দেখি না। ছাত্র সংবাদ : বাংলাদেশ কি হঠাৎ করেই অন্ধকার পথে যাত্রা শুরু করেছে নাকি ক্রমান্বয়ে? এর পেছনে কী বা কাকে দায়ী করবেন? ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : হঠাৎ করেই অন্ধকার পথে বাংলাদেশ ধাবিত হয়নি। এই সরকারকে ক্ষমতায় আনার যে প্রক্রিয়া, তার আগে মইন উদ্দিন ফখরুদ্দিনের যে সরকার তাদের ক্ষমতায় আনার যে প্রক্রিয়াÑ এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই বর্তমান বাংলাদেশ এখানে এসে পৌঁছেছে। সাম্রাজ্যবাদী এবং আধিপত্যবাদী শক্তি তথাকথিত সুশীল সমাজ এই বলে বিভ্রান্ত করেছে যে, বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার অর্থ হলো বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটা। তালেবান রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া। তারা বহুলাংশে এতে সফলও হয়েছে। আধিপত্যবাদী দেশটির কথা বাদই দিলাম, সাম্রাজ্যবাদী যে শক্তি তারা সম্ভবত এ কথা বিশ্বাস করেছিল। আজকে সে পরিস্থিতি নেই। যেখানেই এ ধরনের অবস্থা ঘটছে, যেখানেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হচ্ছে তার ভিডিও ফুটেজ, স্টিল ফটো, অন্যন্য রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ঘটনাটা ঘটিয়েছে প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগাররাই। অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াত জোটকে বিদেশীদের চোখে জঙ্গিবাদী হিসেবে প্রমাণ করবার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিল। আসল কথা হচ্ছে, সুশীল সমাজ আওয়ামী লীগের শেল্ফ। ফলে তখন সেই মইন উদ্দিনের সামরিক সরকারের আবির্ভাব ঘটে। যদিও ফখরুদ্দিনের একটা কোট মানে সুপার কোট তার উপরে ছিল। কিন্তু তারা যেটা করেছে সেটা লক্ষণীয়। তারা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এইসব হাবিজাবি অনেক কথা বলেছে। কিন্তু তারা যে মাত্রায় বিএনপির ওপর নির্যাতন করেছে সে তুলনায় আওয়ামী লীগের ওপর তেমন কোনো নির্যাতন হয়নি। তার অর্থ কী? তার অর্থ বিএনপিকে নির্মূল করতে তাদেরকে আনা হয়েছিল। খানিকটা শো করা হয়েছে যে, তারা আওয়ামী লীগকেও ধরছে, শেখ হাসিনাকে ধরছে। কিন্তু ব্যাপারটি সেটি ছিল না। কারণ তারা ক্ষমতায় আসা মাত্রই শেখ হাসিনা তাদেরকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন যে চালিয়ে যান। বিএনপি জামায়াত নির্মূল করে দেন। আমরা সঙ্গে আছি। প্রয়োজনে আমরা ক্ষমতায় গেলে রেক্টিফাই করে সবকিছু অনুমোদন করে দেব। এবং বৈধতা- সে বৈধতা তো সত্যি সত্যি দিয়েছে। মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দিন বাইরে আর একজন জেনারেল মাসুদ উদ্দিন অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূত এখনো নিযুক্ত আছেন। এরাই তো নায়ক। ওই সরকার নাকি শেখ হাসিনাকে আর্সেনিক বিষ প্রয়োগ করেছিল। যেখানে ফুলের টোকা সহ্য হয় না, সেখানে আর্সেনিক বিষ প্রয়োগ করল আর আপনি জামাই আদরে তাদেরকে রাখলেন, এবং সেই সরকারের কারোর গায়ে একটা নখের স্পর্শ করা হয়নি, এর অর্থ হলো প্রথমে তাদেরকে আনা হয়েছিল যদি তাদের রাখা সম্ভব হতো তাহলে তারাই হয়তো এতদিন এই দেশ শাসন করতো। কিন্তু তারা ছিলেন অথর্ব, অকর্মণ্য, দুর্নীতিবাজ, একধরনের পাপিষ্ঠ। ফলে জনগণ খুব শীঘ্রই তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং বহুক্ষেত্রে তাদের রুখে দিতে থাকে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল বলে গেছেন, একধরনের আঁতাতের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসীন করা হয়েছে। ১২০ ভাগ, ১১০ ভাগ ভোট পড়েছে কোনো কোনো কেন্দ্রে। ব্যালটের মুড়ি পাওয়া গেছে। ইসি বলেছে, এই মুড়ি যার কাছে পাওয়া যাবে তাকেই আটক করা হবে। অর্থাৎ মুড়ি অনুসন্ধান করে দেখা হবে না আসল ঘটনা কী। তারমানে মুড়ি যেই পাও জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ফেল, নষ্ট করে ফেল। এটা দেখিও না। এই যে একটা মনোভাব, এই মনোভাবের ফলে দেখা যায় যে আস্তে আস্তে আস্তে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হয়। ক্ষমতায় আসার পর প্রথম থেকেই তারা প্রমাণ করবার চেষ্টা করলো যে তারা জঙ্গিবাদ বিরোধী। কী দিয়ে? আপনি কুরআন শরীফ পড়েন কেন? আপনার বাসায় কুরআন-হাদিস আছে কেন? অতএব, আপনি জঙ্গিবাদী। আপনার বাসায় ইসলামের ব্যাখ্যামূলক বই আছে কেন? আপনি জঙ্গিবাদী। মাদ্রাসার ছাত্রদের ওপর নির্যাতন চলল। শিবিরদের ওপর নির্যাতন চলল। এদের মেসগুলোকে তছনছ করা হলো। হাজারে হাজারে শিবিরকর্মীকে, ইসলামসমর্থক কর্মীকে গ্রেফতার করা হলো, এবং তাদের ওপর অমানবিক অমানসিক নির্যাতন করা হলো। এর মাধ্যমে তাদের (আওয়ামী লীগের) ভাষায় জঙ্গিবাদ দমনের চেষ্টা করা হলো। শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মেধাবী ছাত্রনেতাকে গ্রেফতারের পর অকথ্য নির্যাতন করে তাকে পঙ্গু করে দেয়া হলো। এখনো তিনি কারাগারে বন্দি। এই যে একটা পরিস্থিতি, এটা ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। এখন হয়তো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি টের পেয়েছে যে, আসলে আওয়ামী লীগ গোটাটাই তাদের সাথে প্রতারণা করেছে। প্রকৃতপক্ষে বিএনপি ও জামায়াত সেই ধরনের শক্তি নয়। যখন তারা এই উপলব্ধিতে এসেছে তখন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলে বসলেন যে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বিএনপি’র উপদেষ্টার মতো মনে হয়। কারণ তারা (যুক্তরাষ্ট্র) আর আওয়ামী লীগকে সমর্থন করছেন না। তাদের ভেতরকার যে ভণ্ডামী, সেই ভণ্ডামীগুলো প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশ একদিনেই অন্ধকার পথে যাত্রা শুরু করেনি। ধারাবাহিকভাবে এই অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে। আর ভারত এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করাচ্ছে। ভারতীয় ষড়যন্ত্রের কারণে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে, সেই সঙ্গে সামরিক বাহিনী ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। আরো কীভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করা যায় ভারত সে চেষ্টা করছে। আর ভারত কার্যত বাংলাদেশকে একটি অঙ্গরাজ্য হিসেবে দেখতে চায়। ব্যবসা, বাণিজ্য, পররাষ্ট্রনীতি সবকিছু চলবে ভারতীয় নীতি অনুসারে। যেভাবে ভুটানে চলে। এর পেছনে আমি সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদী শক্তিকে দায়ী করি। আর আওয়ামী লীগকেও দায়ী করি। দেশপ্রেমের ‘প’ পর্যন্ত তাদের ভেতরে নেই। সারা পৃথিবী থেকে এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রটাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। এর পরিণামটা হচ্ছে ঋণ, অনুদান এই সব কিছু বন্ধ হয়ে যাবে। বন্ধ হয়ে গেলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়ে যাবে। ফলে বেকারত্ব বাড়বে। বেকারত্ব বাড়লে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। দেশ আরো গহীন গভীর অন্ধকারের দিকে চলে যাবে। ছাত্র সংবাদ : আওয়ামী লীগ তার প্রয়োজনেই বারবার সংবিধান ব্যবচ্ছেদ ও কাঁটাছেড়া করেছে- আপনিও কি তাই মনে করেন? ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : প্রয়োজন বলে নয়- ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা, প্রশ্নহীন করার জন্য আওয়ামী বারবার সংবিধানের ব্যবচ্ছেদ করেছে। সংবিধান এখন এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, শেখ হাসিনার হাতে সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকবে। আল্লাহ না করুন, তার যদি কিছু একটা ঘটে যায়, তখন কী হবে? ক্ষমতাটা কার হাতে যাবে? অর্থাৎ একজন মন্ত্রীও কিন্তু তার মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মচারীকে বদলী করার ক্ষমতা রাখেন না। সেটা হবে শেখ হাসিনার মাধ্যমে। দুদক কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা করতে পারবে না। অর্থাৎ তাদেরকে হাতে রাখা হয়েছে। কেন? সরকারি কর্মচারি মানুষ, নাগরিক, আমিও মানুষ, নাগরিক- তাহলে আমার বিরুদ্ধে মামলা করবে কোন্ এখতিয়ারে দুদক? সুতরাং এই যে পরিস্থিতিটা সৃষ্টি করা হয়েছে, সংবিধান ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে, বারবার কাঁটাছেড়া করা হয়েছে সম্পূর্ণ আওয়ামী লীগ- আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে- শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্ব পাকাপোক্ত করার জন্য। সংবিধান ব্যবচ্ছেদ করে অন্তর্ভুক্ত করা হলো যে, বিদেশের সাথে কোনো চুক্তি পার্লামেন্টে উপস্থাপন করা যাবে না, প্রেসিডেন্টকে গোপনে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিলেই হবে। প্রশ্ন হলো- পার্লামেন্ট কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমনিই? শেখ মুজিবের সময় ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে যে চুক্তি হয়েছে, সে চুক্তিকে তো আজ পর্যন্ত ভারতকে পার্লামেন্ট রেক্টিফাই করেনি। তাহলে পার্লামেন্ট যদি ওখানে অত শক্তিশালী হয়, এখানে কেন পার্লামেন্টকে এতটা নিষ্ক্রিয় করে তোলা হচ্ছে? সবকিছুই ক্ষমতা কুক্ষিগত করা এবং ভারতের করতলে বাংলাদেশকে নিবেদিত করার জন্য করা হয়েছে। অন্য কোনো কারণ নেই। ছাত্র সংবাদ : বর্তমান সাংবিধানিক সঙ্কট কী এবং কিভাবে এর সূচনা? ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : বর্তমান সাংবিধানিক সঙ্কট একটাই- পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল। যদি এতকিছু না করে পঞ্চদশ সংশোধনী পর্যন্ত আওয়ামী লীগ না যেত, তাহলে কিন্তু কোনো ক্রাইসিসই তৈরি হতো না দেশে। ধরুন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন, তার একটা মীমাংসা করা যেতই। ইয়াজউদ্দিনের কথা এত বলা হয়, কিন্তু তাঁকে তো শেখ হাসিনা প্রথমে মেনেই নিলেন এবং কাজ শুরুও করলেন। বললেন, দেখি না উনি কী করেন। কেমন করেন। কেমন নিরপেক্ষ থাকেন। তারপরে নানান কথা বলেছেন। যখন প্রেসিডেন্ট এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে চাইলেন, তখন কিন্তু তিনি তা মেনে নিলেন। তাই সংবিধানে থাকলেও এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব ছিল। সুতরাং শেখ হাসিনাকে বলবো, কোনো সঙ্কট থাকবে না, আপনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনুন। এবং তার আগ পর্যন্ত সংবিধান যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় সংবিধানকে ফেরত নিয়ে আসুন। তাহলে এই সঙ্কটের সমাধান হয়ে যাবে। এর সূচনা আওয়ামী লীগকেই করতে হবে। এই মুহূর্তে সে কাজটি করার জন্য কোনো গণতান্ত্রিক শক্তি নেই। আমি জানি না সেই শুভবুদ্ধি আওয়ামী লীগের আছে কি না। ছাত্র সংবাদ : এই সঙ্কট কি বাংলাদেশকে অনিশচয়তার দিকেই নিয়ে যাচ্ছে না? ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : হ্যাঁ, বাংলাদেশকে ঘোর অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি উপরে এ ব্যাপারে বলেছি। অনিশ্চয়তা বহুবিধ। একটু পেছনে ফেরা যাক। ভারতে মুসলমানরা আলাদা রাষ্ট্র (পাকিস্তান) চেয়েছিল। এই পাকিস্তান ইস্ট এবং ওয়েস্ট দু’টি অংশ হয়েছিল। ইস্ট পাকিস্তান ওয়েস্ট পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হলো কারণ এরা সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমান ছিল। এবং এটা এমনিই হয়নি, দৌড় দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রে যোগ দিল তা নয়, ভোটাভুটি হয়েছে যে, তোমরা ভারতের সঙ্গে থাকবে না পাকিস্তানে যোগ দেবে। তারা ভোট দিল কারণ তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানকে অস্বীকার এবং রাতারাতি তার ধর্মকে পরিবর্তন করে দেয়া কী করে সম্ভব হতে পারে? মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম হচ্ছে তার ধর্ম, তার আত্মমর্যাদা, তার সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা রক্ষার চেষ্টা করবে। আমি আশা করি ইনশাআল্লাহ সেই লড়াইয়ে মানুষ জয়ীও হবে। অন্ধকার চিরদিন থাকে না। এক সময় আলোর রেখা ফোটেই। ছাত্র সংবাদ : আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী? শেখ হাসিনার অধীনে একদলীয় নাকি নির্দলীয় সরকারের অধীনে সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে? ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : আমার মূল্যায়ন হলো- শেখ হাসিনা যে কোনো প্রকারে পারুক একদলীয় নির্বাচন করবে। এরশাদের কথা না বলাই ভালো। ১৯৮৬ সালে আওয়ামী জোট ও বিএনপি জোট উভয়েই সিদ্ধান্ত নিল যে, কোনো প্রকারেই তারা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাবে না, যে যাবে সে হবে জাতীয় বেঈমান। কিন্তু একরাতের মধ্যেই শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নিজেই জাতীয় বেঈমানে পরিণত হলেন। এরশাদের সাথে নির্বাচনে গেলেন এবং বিরোধী দলের নেতা হিসেবে সংসদেও গেলেন। এখন এরশাদ তার প্রতিদান দিচ্ছেন। হাসিনা যেহেতু বিপদে আছেন, এরশাদ তাই তার (হাসিনার) দুঃসময়ে তার প্রতিদান দিচ্ছেন। এর বাইরে আর কিছু না। সুতরাং, সেভাবে নির্বাচনের চেষ্টা শেখ হাসিনা করবেন। অবশ্য তাতে তিনি কামিয়াব হবেন কিনা তা বলতে পারছি না। ছাত্র সংবাদ : অন্যান্য প্রতিশ্রুতিগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আওয়ামী লীগ কেন শুধু যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকে সামনে নিয়ে এলো? ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : এটা এখন আর বুঝিয়ে বলা লাগে না। এখন আন্তর্জাতিকভাবে সবাই বুঝে গেছে যে, জামায়াত একটি বড় অনড় শক্তি। যে মাত্রায়ই তার আকার হোক, সেই শক্তিকে দমন করার জন্যে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধী ইস্যুটাকে সামনে নিয়ে এসেছে। জামায়াতকে যদি বিএনপি থেকে সরিয়ে দেয়া যায় কিংবা তাকে যদি নেতৃত্বশূন্য করা যায়, তাহলে তাদের পথচলাটা অনেকখানি সহজ হবে। এই কারণেই অন্যান্য প্রতিশ্রুতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসেছে। অন্য কোনো কারণ নেই। এই বিচারে সরকার আইন-কানুন বিচারের ন্যূনতম ধার ধারেনি। সামান্যতম স্বচ্ছতা এখানে পাওয়া যায়নি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টও বলেছে যে, বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষকে ঘায়েলের জন্যই এই মীমাংসিক ইস্যুটিকে সামনে আনা হয়েছে। এটা দিবালোকের মতই সত্য। ছাত্র সংবাদ : আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে? এই বিচার সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : না, প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এই দেশে হচ্ছে না। আজকে যাঁদেরকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, শেখ মুজিবের আমলে যে দালাল আইন করা হয়েছিল, সেই দালাল আইনে এই লোকগুলোর একজনেরও নাম ছিল না। এমনকি রাজাকারও ছিল না। আর এতদিনে কতগুলো বইপুস্তক, পত্রপত্রিকাকে সামনে হাজির করে আপনি প্রমাণ করলেন যে, এঁরা যুদ্ধাপরাধী, এঁদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে শেখ মুজিব নির্ধারণ করেছিলেন, তাদেরকে আপনি ফিরিয়ে আনুন মুরদ থাকলে। পৃথিবীর কোন্ দেশে সাধারণ নাগরিক যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে? কোথাও না। এ এক অদ্ভুত বিচার, জাস্ট জুডিশিয়াল কিলিংÑ আপনাকে হত্যা করার দরকার, হ্যাং করে দিলাম। এর বাইরে আর কিছু নয়। আর তাছাড়া সারা বিশ্ব এখন বলছে এটা রাজনৈতিক ইস্যু, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করবার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। ছাত্র সংবাদ : বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী? ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : আমি আশাবাদী মানুষ। ধরা যাক, আমি এখন এদেশের প্রবীণ নাগরিক। কিন্তু আমার যখন ১৮ বছর বয়স ছিল, তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। আমি কিন্তু বসে ছিলাম না। আমাকে কেউ বলেনি, আমার মা-বাবা কেউ বলেননি- তাদেরকে জানানোরও প্রয়োজন মনে করিনি, আমি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। কারণ, আমি মনে করেছি যে, এই নির্যাতন আর সহ্য করা যায় না। আবার যারা এর বিরোধিতা করেছে, ধরা যাক, অধ্যাপক গোলাম আযমের ব্যাপারে তাঁর আইনজীবী বলেছেন, হ্যাঁ, তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতা চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যুদ্ধাপরাধমূলক কোনো কাজ করেননি। পাকিস্তানের অখণ্ডতা তিনি কেন চেয়েছেন তা তিনি নিজেও বলেছেন। আমিও বলতে চাই। যদি এতটুকু ছোট একটা রাষ্ট্র ভারতের কোলের ভেতর তৈরি হয়, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে না। সুতরাং দুই পাকিস্তান একীভূত থাকা উচিত। আমি পাকিস্তান আন্দোলন দেখিনি। তখন আমার জন্ম হয়নি। পাকিস্তান আন্দোলন যারা দেখেছিলেন, তারা সেই সত্য উপলব্ধি করেছিলেন যে, কী নির্যাতন এবং কী নিপীড়ন হিন্দু জমিদারদের দ্বারা পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা হয়েছেন। সে কথা তাঁদের স্মরণে এসেছে, এবং এটা লজিক্যালি। শেখ মুজিব নিজেও পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন করেছেন, জেল খেটেছেন। তিনি বলেছেন যে, পাকিস্তান ছাড়া মুসলমানের মুক্তি নেই। ছাত্র সংবাদ : বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিজয়ের এই মাসে তরুণ ও যুবসমাজের কী করণীয়? ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : এখনকার জেনারেশন কিন্তু দেখছে, হোয়াটস্ হ্যাপেনিং উইথ ইন্ডিয়া, কিভাবে ইন্ডিয়া বাংলাদেশের প্রভু হয়ে উঠছে। দেশের মানুষ জলের ঐশ্বর্য কেড়ে জীবনের উপাদান আনে। লড়াই-ই আমাদের জীবন। তাই এখনকার প্রজন্ম, পরবর্তী যে প্রজন্ম- এখানে যদি সেই রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়- হাজার বছর যুদ্ধ হবে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য, কোনো দিন সে যুদ্ধ শেষ হবে না। বর্তমান সঙ্কট উত্তরণে তাদেরকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
আপনার মন্তব্য লিখুন