post

সৌন্দর্যের টানে সীমানা পেরিয়ে

২৬ নভেম্বর ২০১১
মু. মুজাহিদুল ইসলাম ভ্রমণপিপাসু মানুষের একটি প্রেমদৃষ্টি সব সময় পড়ে সৌন্দর্যের ওপর। সৌন্দর্যসুধা পান করেই পিপাসা মেটে এই তৃষ্ণার্ত হৃদয়গুলোর। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও এই মহৎ উদ্দেশ্যকে উৎসাহিত করতে ভুলে যাননি। সূরা আনকাবুতের ২০ নম্বর আয়াতে মহান রাব্বুল আলামিন বলেছেন, ‘তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ কিভাবে তিনি সৃষ্টিকর্ম শুরু করেছেন। অতঃপর আল্লাহ পুনর্বার সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম।’ বাংলাদেশ নামক মাতৃভূমিটির প্রায় সব সৌন্দর্যকে স্পর্শ করার পর হৃদয়ের চোখ পড়ল পৃথিবীর অন্য সীমানায় বেড়ে ওঠা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কিংবা মানুষ নির্মিত সৌন্দর্যের ওপর। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথমেই খুঁজে নিলাম পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের তাজমহলকে। আমার সঙ্গী ছিলেন সিরাজগঞ্জ জজ কোর্টের একজন চিরসবুজ মানুষ অ্যাডভোকেট মাসুদ। আর একজন সদালাপী মানুষ ইমরান হোসেন, যিনি আত্মার সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সিরাজগঞ্জ শহর শাখার সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করছেন। জন্মস্থান রাজশাহী হলেও যাত্রা শুরু হয়েছিল সিরাজগঞ্জের এম মনসুর স্টেশন থেকে। ২ সেপ্টেম্বর ’১১, সকাল ১০টা। দিনটি ছিল ঈদুল ফিতরের পরের পরের দিন। শব্দের নান্দনিক ছন্দের দ্যোতনায় দর্শনার উদ্দেশে রওনা হলো আমাদের বাংলাদেশী ট্রেন। কী যেন এক অজানা জয়ের নেশায় ছুটে চলছিল স্টেশন থেকে স্টেশন। ঠিক বেলা সাড়ে ৩টায় আমরা স্পর্শ করলাম দর্শনা প্লাটফরম। সেখানে আমাদের সঙ্গী হলো তিন চাকার ভ্যান। ভ্যানের সাহায্যে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম বাংলাদেশের শেষ সীমানায়। যতই এগিয়ে যাচ্ছিলাম মাতৃভূমির শেকড় যেন সামনের পথগুলো রুদ্ধ করে দিচ্ছিল তার মাতৃত্বের বন্ধন দিয়ে। বাংলাদেশ বর্ডারে যাবতীয় অফিসিয়াল কার্যক্রম শেষে আমরা অনুমতি পেলাম ইন্ডিয়ান বর্ডারের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। উৎসুক মন নিয়ে আমরা ধাবিত হচ্ছি ইন্ডিয়ান চেক পোস্টের দিকে। কয়েকজন বিএসএফেএর দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠল অনুভূতি, দৃষ্টি পড়ল ফেলানিসহ হাজারও মানুষের রক্তস্রোতের ওপর। সেখানে অনেকটা ঝামেলাহীনভাবেই আমরা পেলাম ভারত ভ্রমণের সার্টিফিকেট। যেখানে গেদে নামক স্টেশনে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল একটি লোকাল ট্রেন, যার গতি বাংলাদেশের আন্তঃনগর ট্রেনের গতিকেও হার মানাল। প্রতিটি স্টেশনে তার ক্ষণকাল ছিল ১৫ সেকেন্ড। প্লাটর্ফম এবং ট্রেনের ভেতরের মানুষগুলো যেন বিদ্যুৎগতিতে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন করছিল। দিনের আলো রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার ঘণ্টা দুয়েক পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম কলকাতা শিয়ালদহ্ স্টেশনে। স্টেশন নামক ঐ নতুন পৃথিবীটা মুখরিত ছিল লাখ মানুষের শোরগোলে। অপেক্ষমাণ মানুষের ভিড় ঠেলে আমরাও সঙ্গী হলাম ঐ পৃথিবীর। জমকালো পৃথিবীতে বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম হোটেলের সন্ধানে। কলকাতার কেন্দ্রীয় মসজিদ নাখোদা মসজিদের উল্টো পাশে একটি মুসলিম হোটেলে উঠলাম। রাতের খাবার এবং নামাজ সেরেই সারা দিনের ক্লান্তি অবসাদকে বিছানার কাছে সঁপে দিতে আমরা লুটিয়ে পড়লাম রাতের কোলে। প্রশান্তির সে রাতে স্বপ্নও যেন আমাদের পিছু নিতে পারল না। তবে পাশের মসজিদ থেকে ভেসে আসা সুললিত আজানের ধ্বনি নিজ দায়িত্বেই আমাদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। গোসল-নাস্তা সেরে সকাল ১০টার সময় আমাদের পরিচয় হলো পাতাল ট্রেনের সাথে। জমিন থেকে প্রায় ২০ ফুট নিচে, এ যেন পৃথিবীর একটি সুড়ঙ্গপথ। সেখানেও ১০ মিনিট পর পর বিরতিহীনভাবে ছুটে চলছে এক একটি ট্রেন। নিজ দায়িত্বেই যার কপাটগুলো প্রতিটি স্টেশনে খুলছে এবং বন্ধ হচ্ছে। প্রায় আধঘণ্টা পর পাতাল ফুঁড়ে আবার আমরা ফিরে এলাম চেনা লোকালয়ে। সোজা চলে গেলাম কলকাতা ভিক্টোরিয়া মিউজিয়ামে। এর স্থাপত্য শিল্প অন্তত হাজার বছর কড়া নাড়বে মানুষের অন্তরে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের প্রায় সকল হিন্দু মনীষীর নাম এবং তাদের রেখে যাওয়া  গৌরবগাথা উঠে এসেছে এই মিউজিয়ামে। শুধু স্থান পায়নি টিপু সুলতান, নবাব সিরাজউদ্দৌলাসহ বহু নামীদামি মুসলিম সেনানায়কদের ইতিহাস। ১০ বছর আগেও যাদের উপস্থিতিতে সরব ছিল এই মিউজিয়াম। তবে একজন মুসলিম খলনায়কের তরবারিসহ তার কার্যক্রমের বহু বিবরণ এখানে স্থান পেয়েছে যার নাম মীর জাফর। বুঝতেই পারছেন, ঞযরং রং ঃযব ধঢ়ঢ়ৎড়ধপয ড়ভ ওহফরধৃ..!! একটি চাপা কষ্ট নিয়েই বের হয়ে এলাম এই সৌন্দর্যপুরী থেকে। এরপর রাতঅবধি কলকাতা শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা পরখ করছিল আমার নেশাতুর দু’টি চোখ। ঐতিহ্যবাহী এই প্রাচীন শহরটি অন্তত আমাদের ঢাকা শহরের অবকাঠামোগত  সৌন্দর্য কিংবা উন্নয়নকে আজও হারাতে পারেনি। সেই রাতেই কলকাতার হাওড়া স্টেশনে আমাদের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছিল ঈযবহহধর ঊীঢ়ৎবংং ঞৎধরহ. আমার স্বল্পজীবনের দৃষ্টিকল্পে এটাই ছিল দীর্ঘতম দ্রুতগতিসম্পন্ন ইলেকট্রিক ট্রেন। চেন্নাই শহরে পৌঁছানোর জন্য ২০টি বগি সম্পন্ন একটানা ৩০ ঘণ্টার এই বাহনটি আমার হৃদয় আঙিনায় সংযোজন করল একটি নতুন অধ্যায়। ঘুমের বিছানাসহ সংসার ধর্মের প্রায় সব উপকরণগুলোই ছিল আমাদের ট্রেনটিতে। দিনের বেলায় পাহাড় আর রাতের বেলায় আমাদের সঙ্গী ছিল সেই মায়াময় চাঁদ, যে সারা রাত ধরেই সৌন্দর্য বিতরণ করছিল রাত্রিকে। সৌন্দর্যের এই মনোমুগ্ধকর আয়োজন এই শিল্পীমনকে কবিতা লিখতেও  শেখাল। আর এভাবেই আমাকে না জানিয়েই আমার হৃদয় খরচ করে ফেলল ৩০ ঘণ্টার প্রতিটি সেকেন্ড। অপরিচিত ভাষার অচেনা মানুষের সাথে কথা বলার শেষ অবলম্বন হিসেবে রইল ইংলিশ। টেক্সিওয়ালা থেকে শুরু করে এলিট ক্লাস, সবাই যেন ইংরেজিকে তাদের মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে। এ ক্ষেত্রে আমার দেশের মানুষের এই অসহায়ত্বের কথা স্মরণ হয়েছিল, যারা ইংরেজিকে এখনো নিজেদের দাসে পরিণত করতে পারেনি। ইন্ডিয়া সফরের পুরোটা জুড়েই আমার সঙ্গী ছিল ইংলিশ মাসিক পত্রিকা ‘ঢ়বৎংঢ়বপঃরাব.’ মনোরাজ্যের ক্ষুধা মেটানোর এক অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে এই পত্রিকাটির। খুব উন্নতমানের একটি হোটেলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েই ছুটে চললাম চেন্নাই সমুদ্র সৈকতের পাড়ে, যার ঢেউ এবং গর্জন দুটোই ছিল আমাদের দেশে বেড়ে ওঠা পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের চেয়ে কয়েকগুণ কম। তবে এই সৈকতের পুরো স্থানজুড়েই শোভা পাচ্ছিল ভারতের বিখ্যাত মানুষগুলোর ভাস্কর্য, যা মুহূর্তেই আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেবে আধুনিক ভারতের রূপকারদের সাথে। একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছাত্র হিসেবে মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটির বিস্তারিত শাখা প্রশাখা দেখতেও ভুলে যায়নি আমাদের অনুসন্ধানী মন। রাস্তার পাশেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা চেন্নাই ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়াম দেখে মনে পড়ে গেল ক্রিকেট বিশ্বকাপের সফল আয়োজক হিসেবে আমাদের গৌরবময় সফলতার কথা। আবার একটা ছন্দময় ঝাঁকুনির গুঞ্জরণ। বুঝতেই পারছেন তামিল নাড়– এক্সপ্রেস রাতের আঁধার ভেদ করে এগিয়ে চলছে তাজমহল জয়ের  নেশায়। আর একটি ২৮ ঘণ্টার স্বপ্নযাত্রা। ইন্ডিয়ান তাবলিগ জামাতের ১৭ জন বিনয়ী মানুষ এবার সঙ্গী হলেন এ স্বপ্নযাত্রার। যাদের মনজিল ছিল নয়াদিল্লির নেজামে ইসলাম মসজিদ। ট্রেনের  ভেতরের চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে বীরদর্পেই তারা পাঁচবার সিজদাবনত হচ্ছিলেন মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে। ইন্ডিয়ার মাটিতে তাদের এই সাহসিকতা মুসলমানদের জাগরণকেই যেন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল বারবার। সূর্যি মামার আলোকবর্ষণের পূর্বেই আমরা স্পর্শ করলাম তাজমহলের জন্মস্থান আগ্রা। এ যেন বিদেশের মাঝে আরেকটি বিদেশ। শত শত সাদা চামড়ার ফরেনার কিনে নিয়েছে এ শহরটিকে। সকাল থেকেই ট্যুরিজমের বাসগুলো বিরামহীনভাবে ছুটে চলছে এদিক-সেদিক। তাজমহল ছাড়াও আগ্রার প্রায় ২০টি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ভারতকে পৌঁছে দিয়েছে আকাশের চূড়াই। নতুন হোটেলে কোন রকম বিশ্রাম ছাড়াই কড়া নাড়লাম তাজমহলের প্রাচীরে। হাজার মানুষের মিছিল মাড়িয়ে প্রবেশ করলাম এর প্রধান ফটকে। প্রথম দর্শনেই ইতিহাস যেন কথা বলতে শুরু করল। দৃষ্টি পড়ল মোগল আমলের মুসলিম ঐতিহ্য ও রুচিবোধের আয়নায়। আমি নির্বাক জড় পদার্থের মত দাঁড়িয়েই থাকলাম। ভুলে গেলাম সঙ্গীদের সঙ্গ। হৃদয় মানচিত্রের সমস্ত সৌন্দর্যকে ছুড়ে ফেলে প্রথম স্থানের জায়গাটি দখল করল এই সপ্তামাশ্চর্যটি। ক্যামেরার ফ্লাশ মুহূর্তেই নির্মাণ করে যাচ্ছিল শত শত স্মৃতিচিহ্নের। যমুনার কোল ঘেঁষে স্থাপিত এই স্থাপনাটি সূর্যের মাঝেও যেন দ্বিধাহীনভাবে ছড়াচ্ছিল তার আভা। দুঃখিত, আর পারছি না। জানি সৌন্দর্যের এই ভয়াবহতার বিবরণ দিতে অনেকটা ব্যর্থ হয়েই থেমে যাবে এই ক্ষুদ্র মানুষের কলমটি। এক ঝলকেই দেখে নিলাম শাহ্জাহান-মমতাজের ভালোবাসার প্রতিকৃতি। আমিও সাবেক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মতই অবলীলায় পৃথিবীর মানুষকে দুই ভাগে বিভক্ত করলাম, যারা তাজমহল দেখেছেন আর যারা দেখেননি। মনের বিপক্ষেই প্রায় তিন ঘণ্টা পর ফিরলাম অন্যান্য স্থাপনার খোঁজে। প্রথমেই তাজমহল দেখার ভুলটা আমাদের ভোগাচ্ছিল। একে একে শেষ করলাম আগ্রা ফোর্ট, মোগল সম্রাটের বাগান, কারুকার্যখচিত মন্দির। সবগুলোই যেন নতুন আলোর জন্ম দিয়েই নিভে যাচ্ছিল তাজমহলের সৌন্দর্যের কাছে। তাজমহলের পিপাসা মিটতে না মিটতেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিস্ময় আমার স্মৃতিশক্তিকে এলোমেলো করে ফেলল। এ বিস্ময় আর কিছুই নয়, প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা নয়, শতাব্দী এক্সপ্রেস মাত্র ২২ ঘণ্টায় আবার পৌঁছে দিলো বাংলা ভাষাভাষীদের পরিচিত সম্রাজ্য কলকাতায়। বিশ্রামের স্বাদ ছাড়াই চিরচেনা একই যন্ত্র সবেগে ধাবিত হলো বাংলাদেশের সুঘ্রাণের সীমানায়। আবার সেই ফর্মালিটিজ, বিরক্তিকর সময় ক্ষেপণ। বাধাহীনভাবেই আবারও পেলাম চিরচেনা সবুজাভ স্বর্গের অনুমতিপত্র। স্বর্গের নিয়মানুযায়ী, স্বদেশেই অবসান ঘটল সমস্ত চাওয়া পাওয়ার। এখন আপনাদের বলছি, প্রথমেই বাংলাদেশকে চিনতে শিখুন। আপনার পদভারেই মুখরিত হোক নিজ স্বর্গের উঠোন। ঠিক তারপরেই হারিয়ে যান সৃষ্টিকর্তার বিশাল সাম্রাজ্যে। আর হৃদয়ের কাছেই জেনে নিন আপনার প্রাপ্তিটুকু। ধৈর্যের বাঁধ আর ভাঙছি না। আপনাদের জন্যই নির্মিত জীবনের এই প্রথম উপহার। আমিও বিদায় নিচ্ছি। শুধু মিন্তি, আপনার প্রার্থনায় উচ্চারিত হোক এই তরুণের নাম, যেন সৌন্দর্যের তীব্রতায় অবিকৃতভাবেই ঝলসে যেতে থাকে আমার দু’টি চোখ। লেখক : পরিচালক, সঙ্গীত বিভাগ, বিকল্প সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংসদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির