post

স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের আনন্দঘন উৎসব

ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম

১৯ মে ২০২১

ঈদ শব্দের অর্থ আনন্দ বা খুশি। ফিতর বলতে বুঝায় স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন। পবিত্র রমাদানে সিয়াম সাধনা, সংযম পালন, অল্পে তুষ্ট ও শৃঙ্খলাময় জীবনযাপন শেষে মুসলিমদের ঘরে ঈদুল ফিতরের হাস্য¯িœগ্ধ আগমন ঘটে। এক মাস টানা সিয়াম পালনের আনন্দ ও অনাবিল পরিতৃপ্তি নিয়ে মুসলিম উম্মাহ ঈদ পালন করে। অন্য কথায় সুদীর্ঘ এক মাসের সিয়াম, সংযম, সাধনা শেষে ঈদের শুভাগমনে স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম মানস আনন্দ-প্রীতিতে, সৌন্দর্য-মাধুর্যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। চারদিক ভরে যায় আনন্দ-কোলাহলে ভ্রাতৃত্ব ও প্রেমের সৌরভ বিতরণে। এই আনন্দ ইবাদতকেন্দ্রিক ধারণাপ্রসূত এক পবিত্র আমেজ সৃষ্টি করে, যা অন্য কোনো বিনোদন সংস্কৃতি থেকে আশা করা যায় না।

সারা বিশ্বের প্রায় দেড় শ’ কোটি মুসলমানের হৃদয়জুড়ে ঈদ আসে প্রতি বছর। ঈদের আনন্দ অনুভব করে ইসলামী সমাজের প্রতিটি সদস্য। ঈদ ধনী-গরিব বিত্তবান-বিত্তহীন সাদা-কালো সকল মুসলমানের জন্যই সমান। আরব-আজম তথা এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, ওশেনিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দূরপ্রাচ্য যেখানেই আছে মুসলিম সেখানেই আছে ঈদ। ঈদের আনন্দে সকল মুসলিমের সমান অধিকার। ভৌগোলিক সীমানার সাথে নেই এর কোনো সম্পর্ক। মুসলিম একটি আদর্শিক জাতির নাম। তাই সমগ্র বিশ্বের মুসলমান একই বিশ্বাস ও বিধানের অনুসারী। সাংস্কৃতিক একই মূল ধারার অধিকারী তারা। কারণ তাদের সভ্যতা সংস্কৃতি তো আল্লাহ ও রাসূল সা. প্রদর্শিত আদর্শ প্রসূত।

সারা বিশ্বের মুসলিমরা রমাদানে সিয়াম পালন করে। সিয়াম পালন শেষেই আসে তাদের ঈদ। তারপর হজের মওসুমে আসে কুরবানির ঈদ। বিশ্বের সকল মুসলমান ঈদের আনন্দে শরিক হয়। ঈদ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। মুসলমানদের ঈদ মূলত বিশ^ ঈদ। অর্থাৎ ঈদের দিনটি বিশ্বজনীন খুশি ও আনন্দের দিন। পৃথিবীর সব জাতিরই আনন্দ উৎসবের দিন আছে। কিন্তু মুসলমানদের তথা মুসলিমদের ঈদ অন্যসব মানুষের আনন্দ উৎসবের চাইতে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ঈদের এই স্বাতন্ত্র্য তার অন্তর এবং অঙ্গ উভয় দিকেই। এ স্বাতন্ত্র্যের কারণে ইসলামের ঈদ খুশি আর আনন্দই বিলায় না বরং সেই সাথে মানবতাবোধ এবং মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলিও বিতরণ করে।

ঈদ একটি অনন্য সভ্যতার প্রতীক। ঈদ এলে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সঞ্চারিত হয় ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা, সহানুভূতি এবং একজনের দুঃখ, দারিদ্র্য ও আনন্দে আরেকজনের অংশীদার হওয়ার অনুভূতি, আকুতি। শ্রেণি-বৈষম্য বিবর্জিত, পঙ্কিলতা ও অশালীনতামুক্ত সুনির্মল আনন্দ উপভোগ করা যায় ঈদুল ফিতরের পুণ্যময় দিবসে। ঈদ একটি সু¯িœগ্ধ প্রীতিঘন মিলন উৎসব। এ কথা সত্যি যে, আরবী শব্দ ঈদের অর্থই হলো আনন্দ। সাদা-কালো ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ছেলে-মেয়ে সকলেরই জন্য ঈদুল ফিতরের দিনটি হতে পারে একটি মহা মিলনের।

একটি নির্মল আনন্দ উৎসবের দিন। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে ঈদ শব্দের সঙ্গে আরও একটি শব্দ জড়িত রয়েছে। সেটি হলো ফিতর। এই ফিতর শব্দের অর্থ হলো না খেয়ে থাকার পর খাবার গ্রহণ করা। না খেয়ে থাকার অবস্থা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া। ঈদুল ফিতর তাদের জন্য যারা রমাদানের পবিত্র মাসে সিয়াম সাধনায় নিয়োজিত থেকে প্রয়াস নিয়েছিলেন আত্মসংযম করার, লোভ লালসা দমন করার দরিদ্রের দুঃখ কষ্ট লাঘব করার। প্রতিবেশীর ব্যথা বেদনা দূর করার। নিজের না খেয়ে থাকার কষ্ট উপলব্ধি করার। উঁচু-নিচু ভেদাভেদ ভুলে যাওয়ার। দৈহিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অসুস্থাবস্থার ছলনায় কর্মব্যস্ততার অজুহাতে যে ব্যক্তি রমাদানে সিয়াম পালন করে না তার তো অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

এ প্রসঙ্গে একটি কথা মনে রাখতে হয়ে যে, রোজা রাখার অর্থ নিছক উপবাস নয়। রমাদান থেকে এসেছে ‘রমদ্ব’ যার অর্থ হলো- দহন করা, জ্বালানো, পোড়ানো, পুড়িয়ে ফেলা, জ্বালিয়ে দেয়া, দগ্ধীভূত করা, ধ্বংস করা, বিনাশ সাধন করা। রমাদানে সব কিছু তাপদগ্ধ হয় রমাদানের রোজা গুনাহকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়। সিয়াম সাধনায় গুনাহ মাফ হয়। রমাদানের রোজা নফসের খায়েশকে জ্বালিয়ে দিয়ে মানুষকে আল্লাহর খাঁটি বান্দাহ বানায়। যে ব্যক্তি দেয়ার চেষ্টা করেনি, তার নিরন্ন উপবাসের কোনোই মূল্য নেই। শুধু শুধু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে না খেয়ে থাকল। অতঃপর ঈদুল ফিতরের দিন রোজার পরীক্ষার ফলাফল যখন বেরুবে, তখন সে কোনোক্রমেই কৃতকার্য হতে পারবে না। সে নির্বোধ বলেই বুঝতে পারবে না যে, ঈদুল ফিতর তার জন্য আনন্দের দিন নয় এটি তার জন্য দুঃখের দিন, বেদনার দিন, আক্ষেপ করার দিন, কান্নাকাটি করার দিন।

তাই যে ব্যবসায়ী চেষ্টা করেছে রোজার মাসে বেশি মুনাফা লুটে নেয়ার, যে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বিক্রি করেছে। যা মানুষ চেষ্টা করেছে ফ্যাশন মডেলের লোভনীয় বিজ্ঞান দেখে দামি দামি কাপড়-চোপড় কেনার, দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, ইয়াতিম-অসহায় কারও দুঃখ দুর্দশার কথা চিন্তা না করে। যে মানুষ চেষ্টা করেছে অপচয়-অপব্যবহারের মাধ্যমে, অসৎ পন্থার মাধ্যমে, অন্যায় অত্যাচারের মাধ্যমে, কুচিন্তার মাধ্যমে, অহঙ্কারের মাধ্যমে ঈদের সুবিমল আনন্দ উপভোগ করার ঈদ তার জন্য আদৌ কোনো আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে না। বরং ঈদ আনে তার জন্য আজাব আর অভিশাপের প্রতিশ্রুতি। পার্থিব দৃষ্টিতে সে আনন্দ করে সত্যিই কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে সে হারায় সর্বশক্তিমানের কাছ থেকে সরাসরি পুরস্কার লাভের অতি দুর্লভ সুযোগ। রহমানুর রাহিমের সন্তুষ্টি লাভের লোভনীয় সুযোগ। আর সেই প্রসঙ্গে, তার জন্য অপেক্ষা করে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার ভয়ঙ্কর শাস্তি।

এই হচ্ছে ইসলামের আদর্শ। এই হচ্ছে ফিতরের তাৎপর্য। ঈদ বাংলাদেশের জাতীয় উৎসব। আবহমানকাল ধরে এই জনপদে ঈদ উদযাপন হয়ে আসছে। জাতীয় উৎসব হলেও ঈদের সামগ্রিকতা জাতীয় জীবনকে শতভাগে প্রভাবিত করতে পারে না। তেমনি রোজাও ষোলআনা পূত-পবিত্র পরিবেশে পালন করার সুযোগ থাকে না। এর কারণ বাংলাদেশে ইসলাম চর্চা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায় না। সরকারও খণ্ডিত ইসলাম উপস্থাপন করতে আগ্রহী। তারপরও খণ্ডিত অবয়বে ঈদ যে সর্বপ্লাবী রূপমাতায় এসে জাতিকে উজ্জীবিত করে তার কোনো সীমা নেই। ইসলামের সর্বজনীন আবেদন নিয়ে ঈদ সবাইকে নাড়া দেয়ার সুযোগ পেলে জাতি নতুন মাত্রায় রোজা ও ঈদ পালনের সুযোগ পেত। লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির