post

স্বাধীনতার একক সুবিধাভোগীদের উম্মাদনা

মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান

১৭ মার্চ ২০২৩

বাংলাদেশ আজ এক ক্ষয়িষ্ণু চিহ্নরেখায় এসে দাড়িয়েছে। জাতি রাষ্ট্রের পরিচয় ধারণ করা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের কোনো চরিত্র বৈশিষ্ট্য এখানে অবশিষ্ট নেই। জীবন এবং জমিনের স্বাধীনতা এখানে একটি গোষ্ঠীর ইচ্ছার কাছে বন্দী। বিশেষ দল বা বিশেষ ব্যক্তির প্রশংসা ব্যতীত রাজনীতিতে কিছু বাকী আছে বলার উপায় নেই। জীবনের নিরপত্তা কিংবা নারী স্বাধীনতা আজ এখানে কতটুকু, তা প্রতিটি নাগরিক বুঝতে পারলেও বলার মতো সাহস রাখে না। অজানা ভয় আর আতঙ্কের মাঝেই তাদের বসবাস। স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনায় প্রধান উপজীব্য বিষয় ছিল সাম্য এবং মানবিক মর্যাদা। এ নীতিবাক্য বক্তৃতা আর কবিতার পঙক্তিমালা হিসেবে শুনতে ভালোই লাগে। নীতিবাক্য আর বাস্তবতার মাঝে যোজন তফাৎ। মানুষের ইচ্ছেগুলো শিকলবন্দী পাখির মতো ডানা ঝাপটায়। গণতন্ত্র এবং নাগরিক অধিকারের সংজ্ঞা এখানে পাল্টে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান রাজনীতির শ্রেণিচরিত্র একনায়কতান্ত্রিক নাকি স্বৈরতান্ত্রিক সে বিষয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই একে গণতান্ত্রিক বলার উপায় নেই। তিপ্পান্ন বছরের অর্জন কতুটুক, তা মোটা দাগের প্রশ্ন। সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনের পরিচয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা যায়। যে কোনো সাধারণ ছাত্রকে মারধর করে বিশ^বিদ্যালয় হতে বের করে দেওয়া যায়। নারী নেত্রী পরিচয়ে সাধারণ ছাত্রীর শ্লীলতাহানি করা যায়। একটি ছাত্র সংগঠনের নেতা হয়ে দুইশ কোটি টাকা বিদেশে পাঁচার করা যায়। সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনের সকল অন্যায়ের সহযোগী যেন প্রতিটি কলেজ এবং বিশ^বিদ্যালয়ের প্রশাসন। ওরা মেরে আনে আর আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। এটাই যেন এখন এ দেশের আইন। শেয়ার বাজার, ব্যাংক, বীমা এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলতে যা কিছু আছে সব লুটপাটের মহোৎসবে ফাঁকা করে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক লুটের হোতারা সর্বোচ্চ পদের পুরস্কার পায়। ডলার সংকটের কথা বলে আমদানী বন্ধ। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশ ছোঁয়া। মানুষের জীবনের নিরাপত্তার সাথে খেয়ে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা তিরোহিত। মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন চায়। যদিও কার্লমার্ক্স বলেছিলেন, ‘মানুষ খাওয়ার জন্য বাঁচে’। তার এ ভুল চিন্তা আর দর্শন কোনোভাবেই মানুষ নামক আশরাফুল মাখলুকাতের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। তবে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা যেন খাওয়া আর লুটপাটের জন্য রাজনীতি চর্চা করে; এটা মূখ ফুটে বলার প্রয়োজন পড়ে না। 

ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের স্বাধীন জনপদ বাংলাদেশ। এ স্বাধীনতা একদিনে আসেনি। সময়ের কাটায় মাঝখানের দু’শ বছরের গোলামীর আগেও আমরা স্বাধীন ছিলাম। আমাদেরকে ইংরেজরা পদানত করে গোলাম বানিয়ে রেখেছিলো দু’শ বছর। এরপর আবার পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামের পর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়। ইতিহাসের খণ্ডিত অংশ নিয়ে চর্বিত চর্বন শুনছি আমরা প্রতিনিয়ত। হাজার নদী, খাল-বিল, পাখ পাখালি, সবুজ ফসলের ক্ষেত আর সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে এখানে এসেছে ওলন্দাজ, মারাঠা, পতুর্গীজ, ইংরেজ আর নানান ভিনদেশীরা। কয়েক হাজার বছরের ঐতিহ্য সমৃদ্ধ বাংলাকে আমরা খণ্ডিত করে ফেলেছি এক ব্রাকেটের মধ্যে। সেমেটিক-দ্রাবির থেকে শুরু করে মোঘল আর নবাবী শাসনামলের গৌরবগাঁথা যে আমাদেরই ইতিহাসের মূল শেকড় তা নতুন প্রজন্মকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাজী শরীয়ত উল্লাহ, মীর নেসার আলী তিতুমীর, মুন্সী মেহের উল্লাহ এবং ফকির বিদ্রোহ যে আমাদের ইতিহাসের গৌরবোজ্জল অতীত, তা নতুন প্রজন্মের মানসপট থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। সমৃদ্ধ বাংলার বর্তমান রূপ আজকের বাংলাদেশ, এটা ভাবতে কষ্ট লাগে। এখানে এক সময় ভিনদেশীরা লুট করে তাদের দেশে নিয়ে যেতো, আজ এ দেশেরই লুটেরারা লুট করে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডায় সম্পদের পাহাড় গড়ে। একজন নারীর জীবন এবং সম্ভ্রম রক্ষার আবেদনে সাড়া দিয়ে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি এদেশের জনগণকে নতুন এক শাসন ব্যবস্থা দিয়েছিলেন। সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সৌভ্রাতৃত্বের অনাবিল শান্তির সমাজ বিনির্মাণ করেছিলেন। বখতিয়ারের শাসনকাল এ জনপদের স্বর্ণালী ইতিহাস। স্বর্ণালী ইতিহাসের হিরোম্ময় যুগ ঈসা খার বিপ্লবী শাসনামল। অথচ সেই সোনার বাংলায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রীর সম্ভ্রমহানী হওয়ার পরও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিবেক জাগ্রত হয় না, এ জন্য হাইকোর্টের রুল জারি করতে হয়। এ কেমন স্বাধীন বাংলাদেশ! যারা রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে স্বাধীনতা এনেছিলো তারা কি এমন বাংলাদেশই চেয়েছিলো?

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেত্রী কর্তৃক প্রথম বর্ষের একজন নবীন ছাত্রীর সাথে যে ঘৃণ্য এবং ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক এবং অনলাইন মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে ফুলপরী নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের এ ছাত্রীকে রাতভর নির্যাতন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তাঁর অনুসারীরা দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। নির্যাতনের সময় তাঁকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, গালাগাল ও এ ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ওই ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর, হলের প্রভোস্ট ও ছাত্র উপদেষ্টার কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন। সানজিদা চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। অপর অভিযুক্ত তাবাসসুম ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। ভুক্তভোগী ছাত্রীও একই বিভাগের। যে তুচ্ছ অভিযোগে নবীন এই ছাত্রীকে নির্যাতন করা হয়েছে তা হচ্ছে, হলের গেষ্টরুমে ওঠার আগে ছাত্রলীগের ঐ নেত্রীকে জানানো হয়নি। কেন জানানো হয়নি এজন্য নির্যাতন।  বিভিন্ন গণমাধ্যমের বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্টারদের কাছে ভুক্তভোগী ছাত্রী যে বর্ণনা তাতে সে বলে, ‘আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিচ্ছিল আর এর ফাঁকে ফাঁকে চালাচ্ছিল শারীরিক নির্যাতন। কিল, ঘুষি, থাপ্পড় কোনোটাই বাদ রাখেনি। কাপড় আটকানোর আলপিন দিয়ে পায়ের ঊরুতে ফুটাচ্ছিল।’ ঐ ছাত্রী আরো বলেন, নির্যাতনের সময় আরেক ছাত্রী মুঠোফোন দিয়ে ভিডিওধারণ করেন। একপর্যায়ে বিবস্ত্র করে ভিডিওধারণ করা হয়। কাঁদতে কাঁদতে তিনি পা ধরে ক্ষমা চাইলেও তাঁরা কোনো কথা শোনেননি। গণরুমে এ সময় উপস্থিত সাধারণ ছাত্রীরাও কোনো কথা বলেননি। এমনকি ‘বিবস্ত্র করে ভিডিওধারণের সময় হুমকি দেওয়া হয়। বলা হয় এই কথা কাউকে জানালে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এমনকি কাউকে এ কথা বললে তাকে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়। 

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কতটুকু খারাপ হলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, তা প্রতিটি চিন্তাশীল মানুষের ভাবনার বিষয়। বিগত দেড় দশকের দুঃশাসন আর একদলীয় শাসনে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারী দলের কর্মী পরিচয়ে একদল ফ্রাঙ্কেইনস্টাইন দানব তৈরি হয়েছে। প্রতিটি ক্যাম্পাসে তাদের দাপটে শুধু সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরাই নয় এমনকি প্রশাসন পর্যন্ত অসহায়, আবার কোথাও কোথাও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের সহায়কের ভূমিকা পালন করে বলে দুস্তর অভিযোগ আছে। ফুলপরির ঘটনায় আমরা এমনটাই দেখতে পাই। ফুলপরির ঘটনা মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে আসার কারণে সবাই তাকে বাহবা দিচ্ছে, কিন্তু এ ঘটনা এমনই যে প্রথম নয় তার প্রমাণ কী? ভুক্তভোগী ছাত্রীকে যখন নির্যাতন করা হচ্ছিল তখন ঐ গণরুমে অবস্থানরত কেউ প্রতিবাদ করেনি, কিংবা সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। এতে বোঝা যায়, সাধারণ ছাত্রীরা ছাত্রলীগের কাছে কতটা অসহায়। তারা এতোসব নোংরা কাজ করার সাহস একদিনে অর্জন করেনি। এক এক দিন এক একটি অপকর্ম করেছে আর পাড় পেয়ে গেছে এভাবে তাদের অপরাধপ্রবণ মানসিকতা সর্বোচ্চ ঘৃণ্য পর্যায়ে পৌঁছেছে। নির্যাতনের শিকার ছাত্রী ফোনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে সাহায্যের আবেদন করলেও তারা তার সাহায্যে যে কোনোরকম সাড়া দেয়নি, তা বোঝাই যাচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রলীগকে সকল ধরণের অপকর্ম করার অবাধ লাইসেন্স দিয়েছে। একইভাবে ল-ইনফোর্সমেন্ট এজেন্সিও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক ছাত্র হিসেবে সুপ্রীম কোর্টের একজন আইনজীবী বিষয়টি আদালতের দৃষ্টিতে আনলে এরপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত শুরু করেছে এবং পুলিশ ঐ ছাত্রীর নিরাপত্তার জন্য ফোর্স নিয়োগ করেছে। অথচ এই পুলিশই কোথাও কোনো ঘটনা ঘটার আগেই সংবাদ পেয়ে যায়, কারা নাশকতার ষড়যন্ত্র করছে। কোথাও চার-পাঁচজন বিরোধী মতের লোক একত্র হলেই তাদের ধরে আনতে পুলিশের সময় লাগে না। এমনকি এখন পর্যন্ত ল-ইনফোর্সমেন্ট এজেন্সীর পক্ষ হতে কোনো মামলা হয়নি কিংবা অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়নি। 

ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা যে এটিই প্রথম নয়, এটা বোঝা গেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর আরো বেশ কয়েকজন ছাত্রী নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছে। ফুলপরী সাহসিকতার পরিচয় দেওয়ার কারণে এ ঘটনা দেশবাসীর জানার সুযোগ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাধারণত যা হয়, একজন নবাগত ছাত্র বা ছাত্রী যে জীবনের প্রথম এক অচেনা পরিবেশে অনেক মানুষের সাথে মিলিত হয়। সেখানে থাকে নানানমূখী রাজনৈতিক পরিস্থিতি। জীবনের নিরাপত্তা, শিক্ষা জীবনের নিরাপত্তা, মান সম্মান এবং নির্যাতনের ভয়ে নতুনভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া ছাত্র ছাত্রীরা এসব বিষয় অনেক কষ্টে হজম করে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগকে যে অপরাধের অবাধ লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে তা বুঝতে কারো বাকী থাকার কথা নয়। এর পূর্বে আমার সিলেট এমসি কলেজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইডেনের ঘটনা আমরা জেনেছি। যতটুকু মিডিয়ায় আসে তার বেশি সাধারণ্যে আলোচনা খুব কমই হয়। বড় বড় কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিক থাকে, বিভিন্ন মিডিয়ার প্রতিনিধি থাকার কারণে কিছু ঘটনা আমাদের জানার সুযোগ হয়। কিন্তু দেশের প্রতিটি ক্যাম্পাসেই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের আধিপত্য। সেগুলো জানার কোনো সুযোগ আদতেই সাধারণের হয় না। যারা কথায় কথায় স্বাধীনতার চেতনার বুলি কপচায়। তাদের দ্বারাই বাক স্বাধীনতা, জীবন ধারণের স্বাধীনতা, শিক্ষা গ্রহণের স্বাধীনতা আজ চরমভাবে লুণ্ঠিত হচ্ছে।  

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগাররা ৯ ফেব্রুয়ারি ’২৩ বৃহস্পতিবার রাতে চারজন ছাত্রকে ধরে নিয়ে সারারাত নির্যাতন করে। যাদের দুইজনকে আইসিইউ-তে নিয়ে চিকিৎসা দিতে হয়। এ বিষয়ে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত ১০ ও ১৬ ফেব্রুয়ারির খবরের কিয়দংশের সামান্য বিশ্লেষণ করতে চাই। দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে ‘‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের ‘নির্যাতনের’ শিকার ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির দুই ছাত্রকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়েছে। ...... আহত দুই ছাত্র হলেন জাহিদ হোসেন ওরফে ওয়াকিল (২২) ও সাকিব হোসেন (২২)। ছাত্রশিবির সন্দেহে বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চমেকের প্রধান ছাত্রাবাসে তাঁদের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নির্যাতন করে। ......একই সময় এস এ রায়হান (২১) ও মোবাশ্বির হোসেন (২২) নামের অপর দুই ছাত্রকে নির্যাতন করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ........নির্যাতনের শিকার ৪ ছাত্রই চমেকের ৬২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।........নির্যাতনে তাঁদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম হয়। গতকাল সন্ধ্যার দিকে তাঁদের বাড়িতে চলে যেতে বলা হয়। রায়হান ও মোবাশ্বির বাড়িতে ফিরে যান। জাহিদ ও সাকিব চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান। তখন ঘটনা জানাজানি হয়।......শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী চমেক ছাত্রলীগের কয়েক নেতা-কর্মী এ ঘটনায় জড়িত বলে চমেক সূত্রে জানা গেছে। তবে ভুক্তভোগী ছাত্ররা কারও নাম বলেননি বলে পুলিশ ও চমেক কর্তৃপক্ষ জানায়। অভিযোগের বিষয়ে চমেক ছাত্রলীগের মহিবুলপন্থী গ্রুপের নেতা অভিজিৎ দাশ সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা (চার ছাত্র) শিবির করেন। গোপনে এই কাজগুলো তাঁরা করে যাচ্ছিলেন। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মারা হয়নি। নগরের চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনজুর কাদের মজুমদার বলেন, ‘আহত ছাত্রদের বিরুদ্ধে ছাত্রশিবিরের কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। তবে কারা তাঁদের মেরেছেন, তা তাঁরা বলেননি। তবু আমরা ঘটনাটি তদন্ত করে দেখছি। ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।’ ...অবশ্য নির্যাতিত ছাত্রদের পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্যাতনের শিকার ছাত্ররা কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন।’’

দেশের প্রথম সারির সকল জাতীয় দৈনিক এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে এ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এ খবরের তিনটি অংশ আমরা পর্যালোচনা করবো। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে এক বছর আগে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে তাদের দলেরই একজনের মাথার খুলি উপড়ে গিয়েছিলো। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ডাক্তার সেই আহত ছাত্রের বেডের মাথার কাছে কাগজে লিখে রেখেছিলেন ‘হাড় নেই চাঁপ দিবেন না’। এরপর থেকে চমেকে ছাত্রলীগের রাজনীতি বন্ধ আছে, কিন্তু বোঝা গেলো, কাগজে কলমে নিষিদ্ধ থাকলেও বাস্তবে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালু আছে। সাধারণত মেডিকেল কলেজে মেধাবী ছাত্ররাই ভর্তির সুযোগ পেয়ে থাকে। যেখানে মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে আদর্শ চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবার জন্য তারা বের হয়ে পড়বে। তারা এখন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের স্থানীয় দু’নেতার লাঠিয়াল হিসেবে মেডিকেল কলেজে আধিপত্য বিস্তারের কাজে লিপ্ত। 

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ঘটনায় প্রথম যে বিষয়টি পর্যালোচনার দাবী রাখে তা হচ্ছে, রাতভর নির্যাতন করা হলো, ভুক্তভোগীদের আইসিইউ-তে নেওয়া হলো। এরপরও কলেজ কর্তৃপক্ষ বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নির্যাতকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। যারা এ নির্মম নির্যাতন করেছে তারা বহাল তবিয়তে কলেজ হোস্টেলে অবস্থান করছে। পুলিশের বক্তব্য আরো রহস্যজনক, তারা বলেছে এখন পর্যন্ত কেউ কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দায়ের করেনি। এতো বড়ো ঘটনা ঘটলো, সকল মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হলো। দুজন ছাত্রকে আইসিইউ-তে নিয়ে চিকিৎসা দিতে হলো। এরপরও কেন অভিযোগ দায়ের করতে হবে? এখানে স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব বর্তায় তার রাষ্ট্রের নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের জন্য ঘটনার বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া। একইভাবে কলেজ কর্তৃপক্ষের ওপর দায়িত্ব বর্তায় অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্তু পুলিশ কিংবা কলেজ কর্তৃপক্ষ কেউ এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। পুলিশ বলেছে কেউ কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়নি। যারা সারারাতভর নির্যাতন চালালো, আবার আইসিইউ-তে গিয়ে হুমকি দিয়ে এসেছে কাউকে কিছু বললে, তাদেরকে প্রাণে মেরে ফেলবে এরপর কার এতটা সাহস আছে, যে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে? চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে ছাত্রলীগের অপরাধকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জাস্টিফাই করা হয়। স্বাধীনতার মাসে আজ প্রশ্ন জাগে এমন স্বাধীনতা আমরা চেয়েছি?

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্র নির্যাতনের ঘটনায় দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি সামনে এসে দাড়ায়। ছাত্রলীগাররা বলেছে, তারা গোপনে শিবির করে এজন্য তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বাংলাদেশের কোন আইনে শিবির করা অপরাধ? সরকার এমন কোনো প্রজ্ঞাপন জারী করেছে কিংবা সরকারী কোনো অর্ডারে কি শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে? পুলিশও একই ভাষায় কথা বলেছে, তাদের বিরুদ্ধে শিবির করার অভিযোগ আছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হিসেবে তারা কি আসলেই এমন কথা বলতে পারে? কোন আইন বা বিধান বলে তারা এমন কথা বলে? এরপরও তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়াও হয় যে, শিবির করা অপরাধ, তবে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অধিকার ছাত্রলীগকে কে দিয়েছে? 

এ বিষয়ে তৃতীয় যে প্রশ্নটি সামনে এসে দাড়ায় নির্যাতিত একজন ছাত্রের চাচাত ভাই সাংবাদিকদের জানিয়েছে তার ভাই ‘কোনো রাজনীতি করে না’।  যার বাবা একজন দরিদ্র ভ্যানচালক। সে মেডিকেল কলেজে পড়ার পাশাপাশি রেটিনায় কোচিং করিয়ে যে টিউশন ফি পায় তা দিয়ে নিজের পড়া-লেখার খরচ নির্বাহের পাশাপাশি বাড়িতে প্রতি মাসে দশ হাজার করে টাকা পাঠায়। যে টাকায় তার ছোট ভাই-বোনের লেখাপড়ার ব্যয় নির্বাহ করা হয়। যেখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিলো এমন অদম্য মেধাবীকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া, সেখানে নিয়তির নির্মম পরিহাস তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এমনকি আগামী দিনে তার শিক্ষা জীবন যে শঙ্কার মধ্যে আছে। আবারো তাকে ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হতে হয় কি না, কিংবা পুলিশ যে বক্তব্য দিয়েছে, যা মূলত আপরাধীদের অপরাধ আড়াল করার প্রবণতা, ‘তাদের বিরুদ্ধে শিবির করার অভিযোগ আছে’। পুলিশ এটা জানতে পারলো যে, তারা গোপনে শিবির করে কিন্তু প্রকাশ্যে সারারাত নির্যাতন করার পরও পুলিশ জানতে পারলো না, কারা নির্যাতন করেছে। মেডিকেল কলেজের প্রাধ্যক্ষ এবং পুলিশ ব্যাখ্যা দিচ্ছে যে, ভুক্তভোগী যদি মামলা না করে তবে কিভাবে মামলা করা যেতে পারে! ভুক্তভোগী ছাত্রদের ওপর যে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে, তাতে তারা যে বেঁচে আছে এটা স্রষ্টার অপার মহিমা। একজন মানুষকে সারারাত নির্যাতন করা হয়েছে, এরপর আইসিইউ-তে গিয়ে তাদেরকে হত্যার হুমকি দিয়ে এসেছে। তারপরও সেই সন্ত্রাসীরা মেডিকেল কলেজের হলে রাজার হালে অবস্থান করছে। পুলিশ আর কলেজ প্রশাসন দেশের জনগণকে বোকা ভেবে আইন শেখাচ্ছে। কলেজের হোস্টেলে এতো বড়ো ঘটনা ঘটলো সেখানে তো কলেজ কর্তৃপক্ষ নির্যাতনের শিকার ছাত্রের পক্ষ হয়ে মামলা করবে। একইভাবে দণ্ডবিধি ও ফৌজদারী কার্যবিধি আইন অনুযায়ী এই ধরনের অফেন্সের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র (পুলিশ) মামলা করতে পারে। কলেজ এবং পুলিশ প্রশাসন উভয়ের বক্তব্য ছাত্রলীগকে আরো বড়ো মাত্রার অপরাধ করার লাইসেন্স দেওয়ার শামিল। 

বড় বিচিত্র এবং আজব ব্যবস্থার মধ্যে আমরা বসবাস করছি। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর পরিবারেও অতি সাধারণ অভিব্যক্তি তাদের সন্তান কোনো রাজনীতি করে না। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে রাজনীতি করা বড় ধরণের অপরাধ(?) কিংবা শুধুমাত্র একটি দলের রাজনীতি করার অধিকার আছে। দেশের অধিকাংশ মানুষের এই মাইন্ড সেটআপ স্থির করে দেওয়া হয়েছে, যে আওয়ামীলীগের বাইরে আর কিছু করা যাবে না। অন্য রাজনীতি করলে তাকে মারা যাবে, হাত পা ভেঙে দেওয়া যাবে, বিশ্ববিদ্যালয় হতে বহিষ্কার করা যাবে, রিমান্ডে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করা যাবে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ না থাকলেও মামলা দেওয়া যাবে, এমনকি তাকে আবরারের মতো পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা যাবে। বিরাজনীতিকরণের এই একদলীয় প্রচেষ্টা বা শুধুমাত্র একটি দল থাকবে, তারা যা চাইবে তাই করতে পারবে, এই যে অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি দাড় করানো হয়েছে, এর বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক প্রতিটি নাগরিক যদি এখনো সোচ্চার না হয় তবে গতকাল আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। পরের দিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ওয়াকিল ও সাকিবকে পিটিয়েছে, ভাগ্য ভালো আল্লাহ তাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন, এভাবে তারা একে একে সবাইকে শেষ করে দেওয়ার দুঃসাহস দেখাবে। বর্তমান বাংলাদেশে যে ফ্যাসিজম কায়েম হয়েছে, তা দেখে কেউ কেউ ভাবেন, আমি তো রাজনীতি করি না, যে রাজনীতি করে তাকে মারতে পারে, ধরে নিয়ে যেতে পারে কিংবা হত্যা করতে পারে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ এমন এক ভয়ঙ্কর দৈত্যের নাম যা কাউকে ছাড় দেয় না। জার্মানীর নাৎসী বিরোধী কবি ও দার্শনিক মার্টিন নেমলারের একটি কবিতার কয়েকটি লাইন দিয়ে আজকের লেখা শেষ করতে চাই। তিনি তার কবিতায় লিখেছিলেন, 

‘‘ওরা প্রথমে যখন কমিউনিস্টদের ধরে নিয়ে যেতে এলো, আমি কোনো কথা বলিনি, কারণ আমি কমিউনিস্ট নই।

তারপর ওরা যখন ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল, আমি নীরব ছিলাম, কারণ আমি শ্রমিক নই।

তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের ধরে নিয়ে যেতে, আমি তখনও চুপ করে ছিলাম, কারণ আমি ইহুদি নই।

ওরা আবারও আসলো ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে, আমি টু শব্দটিও উচ্চারণ করিনি, কারণ আমি ক্যাথলিক নই।

শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে, আমার পক্ষে কেউ কোন কথা বলল না, কারণ, কথা বলার মতো তখন আর কেউ বেঁচে ছিলো না।’’

লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির