post

আল

০১ জুন ২০১৭
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক দার্শনিকদের অন্যতম একজন হলেন আবু নাসের মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আল-ফারাবি (৮৭২-৯৫০)। অধিবিদ্যা (সবঃধঢ়যুংরপং), জ্ঞানতত্ত্ব অথবা রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা কখনো হারিয়ে যায় না। গ্রিক এবং ইসলামের রাজনৈতিক রীতি ও নীতিশাস্ত্রে ইবনে ফারাবির ‘সুনীতি সম্পন্ন কর্তব্যপরায়ণ নগর’-এর ধারণাটি সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি নগরজীবন, সভ্যতা এবং অধিবিদ্যা (আধ্যাত্মিক-অদৃশ্য জ্ঞানের) মাঝে একটি সংযোগ সৃষ্টি করেছেন। যদিও এই ধারণাগুলোর সঠিক অর্থ আমাদের পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে, কিন্তু মানুষের উপযুক্ত বাসস্থান তৈরির জন্য এই ধারণাগুলোর পারস্পরিক সংযোগ একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ইবনে ফারাবির এই সংযোগকে পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন। ১৭৫৭ সালে, সভ্যতা শব্দটি প্রথম যখন ভিক্টর রিকাটি মিরাবি তার ‘মানুষের সাথে বন্ধুত্ব বা জনগণের সাথে চুক্তি’ (খ'ধসর ফবং যড়সসবং ড়ঁঃৎধরঃল্ক ফব ষধ ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হ) নামক চুক্তিতে ব্যবহার করেছিলেন, তখন থেকে এই শব্দটির একটা খারাপ ইতিহাস ছিল। এই শব্দটির খারাপ পরিচয়টি ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। উপনিবেশবাদীরা তাদের তথাকথিত ‘সাদা মানুষের দায়িত্ব’ এবং ‘সভ্য করার কর্মসূচি’কে ন্যায্যতা প্রদানের জন্য সভ্যতার ধারণাটি ব্যবহার করেছিল। ১৮ শতাব্দীতে এসে, পৃথিবীটা সুস্পষ্টভাবে সভ্য ও অসভ্য দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এটি আশ্চর্যজনক নয় যে, ইউরোপ প্রতিনিধিত্ব করেছিল সভ্যতার এবং পৃথিবীর বাকি অংশটা ছিল আদিম, সেকেলে, বর্বর ও অসভ্য। পশ্চিমা সভ্যতার জাদুকরী এবং কিছুটা প্রখর স্পর্শে অসভ্য জাতিগুলোর প্রয়োজন হয়েছিল সভ্য জাতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়া। প্রায় দুই শতাব্দী পর একবিংশ শতাব্দীতে স্যাময়েল হান্টিংটন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর তার বিখ্যাত একটি তত্ত্ব প্রকাশ করেন। সেখানে সভ্যতার পরিবর্তে সরাসরি ‘সংঘাত’কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল। হান্টিংটন প্রাচীন উপনিবেশবাদীদের মতো ছিলেন না ঠিক, কিন্তু তার সংঘাতের তত্ত্বটি শেষে গিয়ে ক্লাসিক্যাল পশ্চিমা উপনিবেশবাদের-ই কাছাকাছি একটি ধারণাকে সমর্থন দিয়েছে। তার সংঘাত তত্ত্বের ফলে বাজারে (রাজনৈতিক অঙ্গনে) যে প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে, আমরা এখনো তার মোকাবেলা করছি। সভ্যতা শব্দটির আজ যে অপব্যবহার হচ্ছে, সেখানে একজন গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারক হিসেবে আল-ফারাবীকে উপস্থাপন করা যেতে পারে। তাঁর রাজনৈতিক মডেলকে তিনি ‘সুনীতি সম্পন্ন কর্তব্যপরায়ণ নগর’ হিসেবে বিবেচনা করতেন। প্লেটো-এরিস্টটলের মৌলিক প্রস্তাবনা এবং ইসলামের উন্নত জীবন, সুখ ও মেটাফিজিক্স (আধ্যাত্মিক-অদৃশ্য) জগতের ধারণার সমন্বয়ে ইবনে ফারাবির এই মডেলটি তৈরি হয়েছে। তাঁর মৌলিক প্রস্তাবনাটা হলো অধিবিদ্যা এবং নৈতিকতার ভিত্তি ব্যতীত কোনো সভ্যতা ও নগরজীবন হতে পারে না। মানুষের সমষ্টিগত জীবনে সামাজিক পদমর্যাদা উন্নয়নের জন্য একটি পরিপূর্ণ কাঠামো হলো শহর। শহর মানুষের সত্তাগত একটি প্রয়োজন। কারণ কোনো মানুষ একা একা বাস করতে পারে না এবং একা একা তার নিয়তি পূর্ণ করতে পারে না। ‘একজন মানুষ নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং তার সর্বোচ্চ উৎকর্ষ সাধনের জন্য’ তার অন্য মানুষের প্রয়োজন হয়। মানুষের সমষ্টিগত জীবনের উদ্দেশ্য হলো তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং নৈতিক উৎকর্ষ সাধন করা। এ কারণে মানুষের সত্তা ও নৈতিকতা এমন একটি অর্থপূর্ণ শহর গড়ে তোলে, যেখানে কেবল জাগতিক বাসনা পূরণ করা এবং অন্যকে শাসন করা নয়, বরং একটি সুখী জীবনযাপন করা যায়। এরিস্টটলের ভাষায় এটাকে বলা হয় ‘উন্নত জীবন’ যাপন। আর যাই হোক না কেন, সমষ্টিগত জীবন নিজেই উদারতা ও উৎকর্ষতার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। কেননা মানুষের সকল কার্যক্রমই নৈতিক পছন্দ ও অপছন্দের দ্বারা পরিচালিত হয়। শহর ভালোও হতে পারে, খারাপও হতে পারে। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সত্য এবং পারস্পরিক সহানুভূতির উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে যে শহরের নাগরিকরা তাদের বুদ্ধিমত্তা ও ইচ্ছাশক্তির ব্যবহার করতে পারে, সেটাই একটি ভালো শহর। ভালো শহর মানে যেখানে সর্বসাধারণের ভালোর জন্য কাজ করা যায়। মানুষ বসবাস করে এমন কোনো ভালো শহর বা দেশ বা সাম্রাজ্যের স্বভাবতই এটা কাম্য নয় যে, তা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবে, অথবা সামরিক ও তথ্যপ্রযুক্তিতে শ্রেষ্ঠ হবে। বরং নৈতিক সংশোধন ও আধ্যাত্মিক সুখের অঙ্গীকার প্রদান করাই একটি ভালো শহরের বৈশিষ্ট্য। ন্যায়-নীতিপূর্ণ কোনো শহর এবং ভালো কোনো সভ্যতার (মেটাফিজিক্যাল) আধ্যাত্মিক ভিত্তিটি ঠিক থাকে ; সেখানে বস্তুগত বিষয়াদি তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। আল-ফারাবীর সংজ্ঞা অনুসারে, সুখী ও উন্নত জীবন কেবল তখনই লাভ করা যায়, যখন কেউ সত্যের সন্ধান পায়; যখন সে বিমূর্ত বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ঐক্যবদ্ধ হয়। অর্থাৎ বস্তুগত আকাক্সক্ষার বেড়াজালে আবদ্ধ এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর বাইরে এসে যখন কেউ বোধগম্য সত্যের পৃথিবীতে প্রবেশ করে, তখনই কেবল সে একটি সুখী ও উন্নত জীবন লাভ করতে পারে। সত্য ব্যতীত আমরা না পারব প্রকৃতির সাথে সদাচরণ করতে, আর না পারব মানুষের সাথে ন্যায় বিচার করতে। যদিও মানবসমাজ তাদের নগরজীবনের বস্তুগত ভিত্তিকে অগ্রাহ্য করতে পারে না এবং এভাবে পৃথিবীকে বর্জনও করা যায় না, কিন্তু পৃথিবীকে তার উপযুক্ত স্থানে রাখা উচিত এবং পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলা উচিত না। আল ফারাবি শহর জীবন ও সভ্যতার (আধ্যাত্মিক-অদৃশ্য) মেটাফিজিক্যাল ভিত্তির ওপর বলিষ্ঠভাবে গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তার রাজনৈতিক লেখনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তিনি সৃষ্টিতত্ত্ব, বস্তুর প্রকৃতি ও স্বভাব এবং মেটাফিজিক্স বা আধ্যাত্মিক-অদৃশ্য জগতের বিষয়াবলির জন্য উৎসর্গ করেছেন। তিনি তার পাঠকদেরকে বলেছেন, তারা যেন রাজনীতি বুঝার আগে (মৎবধঃ পযধরহ ড়ভ নবরহম) ‘সত্তা ও অস্তিত্বের গুরুত্বপূর্ণ ক্রমধারা’টা বুঝার চেষ্টা করে। ইসলামী বুদ্ধিভিত্তিক ঐতিহ্যের প্রকৃতি অনুসারে এমন একটি পূর্ণভাব প্রকাশ পায় যে ‘আসমানি আদেশের মৌলিক রীতিনীতি অনুধাবন করা ব্যতীত কোনো ধরনের রাজনৈতিক আদেশই টিকে থাকতে পারে না।’ মুক্তজীবন ও বুদ্ধিমত্তার সাথে বেঁচে থাকার জন্য একটি বড়সড় পরিবেশ লাভ করা ব্যতীত সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে সুখ আসে না এবং জীবনের পরিপূর্ণতা পায় না। সত্য, প্রজ্ঞা ও ন্যায়Ñ এই ধারণাগুলোর সাথে বিভিন্ন জাতি একমত না হলে শান্তিপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না। ইবনে সিনা তাঁর বিখ্যাত বই ‘সিফা’-এর মধ্যে এই বিষয়টা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, কিছু ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করা ব্যতীত মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতাগুলো অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে না; আর তা তখনই কেবল সম্ভব হয়, যখন মানুষ সঠিক পথ (সুন্নাহ) এবং ন্যায়নীতি (আদল)-এর দ্বারা পরিচালিত হয়। দেখুন, ইবনে সিনা এখানে সমষ্টিগত জীবন, নগরায়ন এবং সভ্যতাকে উচ্চতর নৈতিক ভিত্তির ওপর স্থাপন করার জন্য ‘সুন্নাহ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এখানে ‘সুন্নাহ’ শব্দটি এবং রাসূল (সা)-এর সুন্নাহ, শব্দ দু’টি একই। রাসূল (সা)-এর সুন্নাহ হলো এমন একটি সঠিক পথ যা বিশ্বাস, বুদ্ধিমত্তা ও সৎকাজের ওপর ভিত্তি করে জীবন পরিচালনার রূপরেখা প্রদান করে। ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা)-ই প্রথম ব্যক্তি যিনি সঠিক পদ্ধতিতে মদিনায় একটি ইসলামী শহর গড়ে তোলেন। মদিনা একটি শহরজীবন ও একটি সভ্যতা ছিল। এখানে মুসলিম সমাজ প্রথম অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের অভিজ্ঞা অর্জন করেন। মদিনার এই অভিজ্ঞতাই ভবিষ্যৎ ইসলামী সভ্যতার ভিত্তি তৈরি করেছিল। আরবি ও পশ্চিমা ভাষাগুলোতে শাব্দিকভাবে ‘শহর’ ও ‘সভ্যতা’ শব্দ দু’টি খুব কাছাকাছি। বিশেষত, ন্যায়নীতিপূর্ণ শহর ও সভ্যতার সম্পর্কটা খুবই উল্লেখযোগ্য। ইবনে সিনা শাব্দিকভাবে এ বিষয়টা খুব ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছেন এবং একটি অর্থপূর্ণ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের জন্য সত্য-ন্যায়ের সঠিক পথের গুরুত্ব কেমন তা উল্লেখ করেছেন। আমরা আজ বৈশ্বিক যে দুর্যোগের মুখে আছি, সেখানে নগরজীবন এবং সভ্যতার এই অর্থগুলো আমাদের পুনরুদ্ধার করা উচিত। সাম্রাজ্যবাদী ও দখলদারি কর্তৃত্বের জন্য সভ্যতাকে যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার না করে আমাদেরকে সত্য, পুণ্য, বোধগম্য ও সহমর্মিতার নীতির ওপরে সভ্যতা গড়ে তুলতে হবে। লেখক : মাস্টার্স শিক্ষার্থী, উলুদাহ বিশ্ববিদ্যালয়, তুরস্ক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির