post

কঠিন বাস্তবতার আয়নায় উন্নয়নশীল বাংলাদেশ

হারুন ইবনে শাহাদাত

০৪ মে ২০১৮
স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ (ডিসি) বাংলাদেশের তালিকায় নাম লেখাতে যাচ্ছে। যদিও আরো কয়েক দফা পর্যালোচনার পর ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব করা হবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্থায়ী স্বীকৃতি দেয়ার কিন্তু তার আগেই প্রচারণার ডামাডোলে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের দেয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছে উন্নয়ন দেশের তালিকায় নাম লেখাতে যেসব শর্ত পূরণ করতে হয় তার প্রায় সবগুলোই পূরণ হয়েছে। তবে নাম তালিকাভুক্ত করার সর্বশেষ শর্ত এই ধারাবাহিকতা কম পক্ষে তিন বছর অব্যাহত রাখতে হবে। তারপরই জাতিসংঘের উন্নয়নশীল দেশের তালিকাভুক্ত হবে এবং পর পর ৬ বছর অব্যাহত থাকলেই মিলবে চূড়ান্ত স্বীকৃতি। তলাবিহীন ঝুড়ির বদনাম মুছে এই অর্জন নিঃসন্দেহে খুশির খবর। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্থার তথ্যমতে, একটি দেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে গেলে যে তিন সূচকের যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, বাংলাদেশ সেই তিনটি শর্তই প্রাথমিকভাবে পূরণ করেছে। তবে এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় অন্তত ৬ বছর একই শর্তগুলো পূরণ করে যেতে হবে। জাতিসংঘের শর্তানুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১২৪২ মার্কিন ডলার হতে হয়, যা বাংলাদেশ অনেক আগেই অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশে এখন মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬১০ ডলার। আর মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে ১০০-এর মধ্যে ৬৬ বা তার বেশি অর্জন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দশমিক ৯ ভাগ। আর তৃতীয় শর্তে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর না হওয়ার মাত্রা ৩২ ভাগের নিচে থাকতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই মাত্রা ২৫ ভাগের কিছুটা বেশি। জাতিসংঘের এই নির্ধারক কমিটি প্রতি তিন বছর পরপর বৈঠকে বসে। একটি বিশেষজ্ঞ টেকনিক্যাল কমিটির মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাওয়ার পর যেকোনো দেশের মূল্যায়ন হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ স্বীকৃতি পাওয়ার পর ২০২১ সালে এ বিষয়ে প্রথম মূল্যায়ন হবে। দেখা হবে দেশটি তার অর্জনকে কতটা সুদৃঢ় করেছে। এরপর ২০২৪ সালে আরেকটি মূল্যায়ন হবে। এই দু’টি পর্যালোচনার পর ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব করা হবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্থায়ী স্বীকৃতি দেয়ার। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে তাহলে এত আগেই কেন এত ডামাডোল পেটানো হচ্ছে? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল। তারচেয়ে বড় বিষয় হলো এই রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে গিয়ে আমরা যদি সত্য গোপন করি তাহলে দশা হবে কাকের ময়ূর সাজার মতোই ভয়ঙ্কর। এই সত্য কথাটা অর্থনীতিবিদরা বোঝানোর চেষ্টা করলেও রাজনীতির মারপ্যাঁচে আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক প্রবৃদ্ধি অর্জন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিশ্বব্যাংকের সংশয় গত ৯ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশের অর্থনীতির হালনাগাদ পরিস্থিতি তুলে ধরার সময় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তৈরি করা প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) যেসব প্রতিবেদন দিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘তথ্য-উপাত্ত দেয়ার ক্ষেত্রে আমরা বিবিএসকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকি। আসলে এর সমপর্যায়ে কেউ নেই। তবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে যে তথ্য দিয়েছে তারা, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন ও সংশয় আছে। বিবিএস সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকলেও এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না বিষয়টা এমনটা নয়। বিশ্বের যে কয়টি দেশে প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের বেশি হয়েছে, তাদের জিডিপির তুলনায় বিনিয়োগ অথবা রফতানি বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দু’টিই বেড়েছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কেননা, বাংলাদেশে সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ স্থবির। কমেছে রফতানি আয়। এক্ষেত্রে শুধু ভোগের ওপর ভিত্তি করে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, যা বিশ্বে একেবারেই ব্যতিক্রম।’ প্রসঙ্গত, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) অর্থনীতির বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়াবে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ বলে জানানো হয়। যা চলতি বাজেটে প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধির চেয়েও বেশি। চলতি বাজেটে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। আগের বছর প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলে ড. জাহিদ হোসেন আরো বলেন, ‘প্রশ্নগুলো হলো এত প্রবৃদ্ধি কি অর্থনীতির সক্ষমতার অতি ব্যবহার নাকি কৃত্রিমভাবে তৈরি করা? এত প্রবৃদ্ধির জন্য কাঠামোগত পরিবর্তনের কোনও প্রমাণ নেই নাকি উৎপাদনশীলতা বেড়েছে? আবার আইনি পরিবর্তন হয়নি, তেলের দামও কমেনি, স্বস্তিবোধের কোনও কারণও নেই। জাতীয় আয়ের প্রকৃত হিসাব করার জন্য বড়মাপের প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনীয়তা আছে। বিবিএস জেলা পর্যায় থেকেও তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। অনেক অর্থনীতিবিদ বলেন, বিবিএস হলো সুপ্রিম কোর্টের মতো। যেহেতু এখানে আইনি কোনও বিষয় নেই, তাই প্রশ্ন তুলতেই পারি। এসব বিষয়ে আরও বিশ্লেষণ করা দরকার।’ তিনি বলেন, ‘এটা ব্যতিক্রমী প্রবৃদ্ধি, আগামীতে এই নিয়ে ঝুঁকি দেখা দেবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়লেও সেভাবে কর্মসংস্থান বাড়েনি। এ বছরে শহরগুলোতে তিন লাখ দরিদ্র বেড়েছে। প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচন যেভাবে হওয়ার কথা তা হয়নি। দারিদ্র্য কমছে ঠিকই, কিন্তু সেই দারিদ্র্য কমার গতি কমে গেছে।’ বিশ্বব্যাংকের এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৫ অথবা ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। আমাদের আয়ের প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৭ এবং কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ২ শতাংশ। আয় ও কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধির চিত্র যদি এমন হয়, তবে বছর শেষে সাড়ে ৬ শতাংশের বেশি হবে না।’ বিশ্বব্যাংকের মতে, অর্থনীতিতে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া, বাণিজ্য ঘাটতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা এবং রাজস্ব ঘাটতি। অর্থনৈতিক ঝুঁকির ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে ব্যাংকিং খাতই সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের খাত হিসেবে উল্লেখ করে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এই খাতের দুর্নীতি দমনে, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য ব্যাংক খাতে তদারকি বাড়াতে হবে। আবার ঋণ আদায়ে আইনগত ও আর্থিক কাঠামোর উন্নতি করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকে তারল্য সংকট না থাকলেও খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। আবার বেশ কিছু বেসরকারি ব্যাংকে তারল্য সংকট আছে।’ তার মতে, মুদ্রানীতি এখন সম্প্রসারণমূলক হয়ে গেছে। বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি অনুযায়ী সতর্কতামূলক মুদ্রানীতি হওয়া উচিত। বিশ্বব্যাংক আরও বলেছে, সাম্প্রতিক সময়ে খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। এটি মূলধন ঘাটতির অন্যতম কারণ। কয়েক বছর ধরে এই ঘাটতি নিরসনে বাজেটের মাধ্যমে অর্থ দেয়া হচ্ছে। জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে খেলাপি বৃদ্ধি ও আমানত কমে যাওয়ায় তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এসব উত্তরণে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে তাতে ব্যাংক খাতে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মনিটরিং পলিসি ছয় মাস পর পর দেয়ার কথা, কিন্তু এখন তারা আগেই দিচ্ছে।’ সামগ্রিক পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির জন্য বেশ কয়েকটি পরামর্শও দিয়েছে সংস্থাটি। জাহিদ হোসেন বলেন, অর্থনীতির উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে মুদ্রানীতি প্রণয়নের সুযোগ দিতে হবে। এ ছাড়া অবকাঠামো উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিতে হবে।’ কঠিন বাস্তব উন্নয়ন সূচকগুলো বিশ্বব্যাংক বলেছে উন্নয়নের সূচকগুলো আরও বিশ্লেষণ করা দরকার। ‘উন্নয়নশীল’ হতে হলে যোগ্যতার মাপকাঠি তিনটি: মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ঝুঁকিহ্রাস। অথচ এই সূচকগুলো সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। বিশেষত মাথাপিছু আয়ের হিসাবটা বরাবরই লেজেগোবরে। এই হিসাবে সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ বা হলমার্ক, এমনকি শেয়ারবাজার লুটেরাদের কুক্ষিগত সম্পদকেও সমাজের দশজনের গড় সম্পদ বলে চালিয়ে দেয়া হয়। হকার, রিকশাচালক, গার্মেন্টস মালিক সবাইকে মধ্যবিত্ত দেখায়, আর মাঝখান থেকে লুটেরাদের ফুলে-ফেঁপে ওঠার দৃশ্যটা ঢাকা পড়ে যায়। ভারতে যখন জিডিপিতে ৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে, তখনো বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের তালিকায় ভারত ছিল শীর্ষে। প্রায় ৪০ কোটি ভারতীয় দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে, ১৯ কোটি ভারতীয় অপুষ্টিতে ভুগেছে, আর প্রতিদিন আত্মহত্যা করেছেন ৪১ জন করে ভারতীয় কৃষক। যেমন সিপিডির এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে গত ছয় বছরে জিডিপি বাড়ার দিনগুলোয় সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় বেড়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা, আর সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে ১০৫৮ টাকা (সূত্র : বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০১৭-২০১৮, প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা, সিপিডি)। অর্থাৎ মাথাপিছু আয়ের এই সূচকটি আসলে উন্নয়ন, আইনের শাসন, মানুষের ভালো থাকা, খারাপ থাকা এসবের কিছুই বোঝায় না। অন্য সূচকগুলোও যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর। যেমন সূচক বলছে, মেয়েদের মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তির হার বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০১৭ বলছে, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া ৪১ শতাংশ মেয়েই দশম শ্রেণির আগেই ঝরে পড়ছে। আবার জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, বিশ্বে বাল্যবিবাহের হার কমলেও বাংলাদেশে বাড়ছে (অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ)! (সূত্র : প্রথম আলো, মার্চ ৭, ২০১৮) বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। কিন্তু পাশাপাশি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে খর্বকায় এবং অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা। দেশের ৩৬ শতাংশ শিশু খর্বকায়। ৫১ শতাংশ শিশু অ্যানিমিয়ায় ভুগছে। মারাত্মক অপুষ্টির ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর তালিকাতেও বাংলাদেশ অন্যতম (সূত্র : ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ২০১৬)। অর্থাৎ যে শিশুগুলোকে বাঁচানো যাচ্ছে, তারা ন্যূনতম পুষ্টিকর খাদ্য পাচ্ছে না। বেঁচে থাকা শিশু বড় হচ্ছে ক্ষুধায়, কম খেয়ে, অপুষ্টিতে, খাটো গড়নের হয়ে। তাহলে শিশুদের এমন অমানবিক বেঁচে থাকায় কার উন্নয়ন হলো? অর্থাৎ সূচক খন্ডিত বা আংশিক চিত্র দিচ্ছে মাত্র। ‘সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারে’ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে! সামগ্রিকভাবে ‘আইনের শাসনে’ ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০২। (সূত্র : প্রথম আলো, ৮ মার্চ ২০১৮) খেলাপি ঋণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ‘নম্বর ওয়ান’! ক্ষমতাবানদের যোগসাজশে দেদার অর্থ আত্মসাৎ চলছেই। নয় বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে তিন গুণ! (সূত্র : বণিক বার্তা ১৯ মার্চ ২০১৮) আর বিচার? উন্নয়নের দেশে বিচারের কী হাল, তার সাক্ষ্য দিচ্ছে প্রতিদিনের দুঃসংবাদগুলো। এবার দেখা যাক কেমন আছে উন্নয়নের দেশের মেয়েরা। গত চার বছরে ধর্ষণে শিকার হয়েছে ১৭ হাজার নারী ও শিশু । আন্তর্জাতিক জরিপে ঢাকা পৃথিবীর সপ্তম বিপজ্জনক শহর। যৌন সহিংসতায় ঢাকার অবস্থান চতুর্থ। (সূত্র : থম্পসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন। দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ডেঞ্জারাস মেগাসিটিস ফর উইমেন, ২০১৭)। ২০০২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যাসংশ্লিষ্ট মামলাগুলোর ৯৭ শতাংশেরই কোনো সাজা হয়নি। (সূত্র : প্রথম আলো, ৮ মার্চ ২০১৮) ‘ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রোজেক্ট’ দেখাচ্ছে, ‘সুষ্ঠু তদন্ত’, ‘দ্রুত তদন্ত’, ‘সুষ্ঠু আইনি প্রক্রিয়া’ ইত্যাদি প্রায় সব কয়টি সূচকেই বাংলাদেশের স্কোর লজ্জাজনক। ‘নাগরিক নিরাপত্তা’র বেলাতেও বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩টি দেশের মধ্যে ১০২। প্রতি বছর রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনায় মুড়িমুড়কির মতো মরছে গড়ে প্রায় ২০ হাজার মানুষ। পোশাকশিল্প, নির্মাণশিল্প, পাহাড় কাটা, আর জাহাজ ভাঙা খাতে স্রেফ অবহেলাজনিত দুর্ঘটনায় বেঘোরে প্রাণ দেন শত শত শ্রমিক। (সূত্র : বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশন, ২০১৮) বৈদ্যুতিক শকে, বিষাক্ত গ্যাসে, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ‘ফায়ার এক্সিটে’র অভাবে, পুরনো বয়লার ফেটে, উঁচু থেকে পড়ে হাড়গোড় ভেঙে শ্রমিক মরছে তো মরছেই। বছরে গড়ে ৭০০ শ্রমিক নিহত হচ্ছেন। আহত ১ হাজার ৩০০ জন (সূত্র : বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) সমীক্ষা-২০১৬)। কোথাও কোনো মাথাব্যথা আছে কি? জাতিসংঘের অর্থনৈতিক সূচকগুলোয় পরিবেশ ধ্বংসের গল্পটি নেই। কৃষকের ‘লাইফলাইন’ বাংলাদেশের নদীগুলোর একের পর এক শুকিয়ে যাওয়ার গল্পটি নেই। তবে আলাদা করে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সমীক্ষা হয়েছে। সেখানেও বাংলাদেশের অবস্থান শোচনীয়। পরিবেশ সুরক্ষায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৯ (সূত্র : এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স-২০১৮) ! পানি, বাতাস, পয়োনিষ্কাশন বা জনস্বাস্থ্য সব কয়টি সূচকেই ঢাকার অবস্থান তলানির দিক থেকে শীর্ষে। ভয়াবহ ক্ষতিকর সালফার ডাই-অক্সাইড বা কার্বন মনো-অক্সাইড নির্গমনেও ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষে। (সূত্র : ইউএস এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স, ২৩ মার্চ ২০১৮) ঢাকার চারপাশের নদীগুলোতে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম আর সিসার দূষণ ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। (সূত্র : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ ২০১৮) বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা বলছে, ঢাকায় সীসা দূষণের শিকার ছয় লাখ মানুষ (বেশির ভাগই শিশু) (সূত্র : বাংলাদেশ পরিবেশ সমীক্ষা-২০১৭, বিশ্বব্যাংক ) এবং দেশের ১ কোটি ২৭ লাখ মানুষের দেহে অস্বাভাবিক কোষের বৃদ্ধি ঘটছে। (সূত্র : . ক্যানসার কন্ট্রোল ইন বাংলাদেশ, জাপানিজ জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল অনকোলজি (জেজেসিও), ২০১৫) এ ছাড়া পরপর কয়েক বছর ধরেই ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে বসবাস-অনুপযোগী শহরগুলোর মধ্যেও অন্যতম শীর্ষে। (সূত্র : গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স ২০১৭) অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থেই ভেঙে পড়ছে সবকিছু। তবু রাস্তা আটকিয়ে চলছে উন্নয়নের আনন্দ র‌্যালি! সত্যিই সেলুকাস, এ এক অদ্ভুত উন্নয়নের দেশ! এ বছর বাংলাদেশের সঙ্গে সঙ্গে আফগানিস্তান আর মিয়ানমারও ‘উন্নয়নশীল’ দেশের তালিকায় ওঠার জন্য যোগ্যদের তালিকায় জায়গা করে নিচ্ছে। এই যোগ্যতার পরের পরিমাপ হবে ২০২১ সালে। ২০২১ সালের পরীক্ষায় পাস হলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ বলে ঘোষণা করবে জাতিসংঘ। দুঃখজনক এই যে ভয়াবহ দুর্নীতি, দারিদ্র্য আর আইনের শাসন ভেঙে পড়া এসব দেশের সঙ্গেই আজকাল আমাদের একচেটিয়া প্রতিযোগিতা। আরেকটু ওপরের দিকে তাকানোর মতো হুঁশও আমাদের আর অবশিষ্ট নেই। ‘তারা’ প্রায়ই জানতে চান, ‘এতই যদি দুর্নীতি, তাহলে জিডিপি বাড়ে কেন?’ যেন দুর্নীতি হলে জিডিপি বাড়ার সুযোগ নেই! অথচ অর্থনীতিতে লেনদেন বাড়লেই জিডিপি বাড়ে। সেই অর্থে রাস্তা, কালভার্ট, ব্রিজ বা ফ্লাইওভার নির্মাণে যতই লুটপাট হোক; এমপি, নেতা, ঠিকাদার মিলে যতই ভাগ-বাটোয়ারা করুক, যতই লাফিয়ে লাফিয়ে প্রকল্প ব্যয় বাড়ুক, টাকার লেনদেন তো বাড়ছে, তাই জিডিপিও বাড়বে। যেমন এক রাস্তা অনর্থক দশবার কাটাকাটি, ভাঙাভাঙি করলেও জিডিপি বাড়ে, দেশের অর্ধেক মানুষ পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, বা সীসাদূষণের কারণে ভয়াবহ সব অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও জিডিপি বাড়ে, ঢাকার ‘লাইফলাইন’ খাল এবং নালাগুলো দখল করে প্রভাবশালীদের বহুতল মার্কেট তৈরি হলেও জিডিপি বাড়ে। যেমন গ্লোবাল কম্পেটিটিভ ইনডেক্স বলছে, এশিয়ার মধ্যে নেপালের পরেই সবচেয়ে খারাপ রাস্তা বাংলাদেশে। (সূত্র : বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০১৭-২০১৮, প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা, সিপিডি) অন্যান্য দেশের তুলনায় দ্বিগুণ-তিন গুণ অর্থ ব্যয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হলেও কয়েক বছরের মাথায় ভয়াবহ দুর্গতি হচ্ছে রাস্তাগুলোর। দ্রুত পুননির্মাণ করার প্রয়োজন পড়ছে। অর্থাৎ আবারও নতুন বাজেট, নতুন লেনদেন, নতুন ভাগ-বাটোয়ারা, নতুন চুরি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, প্রকল্প ব্যয় বা চুরির পরিমাণ বাড়লে জিডিপি বাড়াই স্বাভাবিক। কারণ, জিডিপি কেবল ‘ফাইনাল প্রোডাক্টে’র মূল্যমান বোঝে। কে পেল টাকার ভাগ : নেতা, জনগণ না ঠিকাদার, সেই হিসাবের দায় জিডিপির নেই। তবে দুর্নীতির টাকা যতক্ষণ দেশে আছে এবং দেশের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে, ততক্ষণই দুর্নীতি বা লুটপাটের সঙ্গে জিডিপির কোনো বিরোধ নেই। যেমন জেনারেল সুহার্তোর সময়ে ইন্দোনেশিয়া ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ দেশ। আবার একই শাসনামলে ইন্দোনেশিয়ার জিডিপি এবং মাথাপিছু আয় বেড়েছে। অর্থাৎ দুর্নীতির টাকা দেশের ভেতরেই ছিল এবং তা উৎপাদন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখছিল। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্রটি এত সরল নয়। এখানে মহামারীর মতো দুর্নীতি হচ্ছে, ক্ষমতাবানদের যোগসাজশে অবাধে ব্যাংক ‘ডাকাতি’ হচ্ছে, সরকারের কাছের লোকজন বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হচ্ছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত লুটের টাকা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। আমরা জানি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা খুইয়েছিলেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। এর একটা বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। ‘গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি’র রিপোর্ট বলছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা! অর্থাৎ এটা আমাদের জাতীয় বাজেটেরও দ্বিগুণ! এখানে দুটি প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক। প্রথমত, বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যাংক থেকে লুট হয়ে গেলেও সামগ্রিক অর্থনীতিতে তার সরাসরি প্রভাব কতটা? দ্বিতীয় প্রশ্ন, লুটপাট ও দুর্নীতির টাকার একটি বড় অংশ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, তারপরও জাতীয় মাথাপিছু আয়ে তার প্রভাব পড়ছে না কেন? প্রথমত, আন্তর্জাতিক ঝুঁকি যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে আছে (এরপরও একের পর এক নতুন ব্যাংকের অনুমোদন পাচ্ছে ক্ষমতাসীনেরা!)। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রই বলছে, ব্যাংকিং খাতের ‘অব্যবস্থাপনা’ কাটিয়ে উঠতে গত নয় বছরে তাদের প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। (সূত্র : বণিক বার্তা, খেলাপি ঋণের হার: উন্নয়নশীল দেশে শীর্ষে বাংলাদেশ, ১৯ মার্চ ২০১৮) সবচেয়ে খারাপ সংবাদটি হচ্ছে, একে একে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সব অন্যায় আবদার মেনে নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক! সরকারি ব্যাংকের হেফাজতে থাকা জনগণের রক্ত পানি করা আমানতের ৫০ ভাগই এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তহবিলে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে! আর এ বছরের শুরুতেই লুটপাট সামলাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আরও ২০ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে ছয় রাষ্ট্রীয় ব্যাংক। এই বিপুল পরিমাণ ভর্তুকির টাকা আসবে কোত্থেকে? জনগণের ঘাড়ে পাড়া দিয়ে বাড়তি ট্যাক্স, ভ্যাট আদায় করা ছাড়া আর উপায় কী? দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল, এত সব দুর্নীতির পরেও মাথাপিছু আয় বাড়ছে কেমন করে? উত্তরটি করুণ ও বুকভাঙা। একদিকে প্রতি বছরই গড়ে ৬০-৭০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। (সূত্র : . থম্পসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন। দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ডেঞ্জারাস মেগাসিটিস ফর উইমেন, ২০১৭) আরেক দিকে খেয়ে না খেয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে বছরে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিক। (সূত্র : প্রথম আলো, ৮ মার্চ ২০১৮) টাকা পাচার, ব্যাংক লুট, হরিলুট, এত কিছুর পরও তাই মাথাপিছু আয় বাড়ছেই। খেয়াল করুন, শ্রমে- ঘামে বিবর্ণ আধপেটা প্রবাসী শ্রমিকের দিনের পর দিন ‘কম খাওয়া’ মেনুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের প্রাণভোমরা। রক্ত পানি করা এই বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্সের দাপটেই আজ ‘তারা’ বলতে পারেন, ‘চার হাজার কোটি টাকা কিচ্ছু না’! রিজার্ভের ৮০০ কোটি টাকা ‘কে’ বা ‘কারা’ স্রেফ লুটেপুটে খেয়ে ফেললেও আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে বাংলাদেশ সেন্ট্রাল ব্যাংক। তাহলে উন্নয়নের দেশে কেমন আছেন অর্থনীতির চাকা ঘোরানো সেই মানুষগুলো? সত্য এটাই যে তারা ভালো নেই। উন্নয়নের দেশে কৃষক বছরের পর বছর ফসলের ন্যায্য মূল্য পান না। উন্নয়নের দেশে এশিয়ার সবচেয়ে কম মজুরিতে। (সূত্র : বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশন, ২০১৮) এবং সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে কাজ করেন গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকেরা। (সূত্র : বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) সমীক্ষা-২০১৬) উন্নয়নের দেশে টিকতে না পেরে বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে গিয়ে ১৩ বছরে লাশ হয়ে ফেরেন ৩৩ হাজার শ্রমিক। (সূত্র : এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স-২০১৮) জনগণের নিরাপত্তা, পরিবেশ, অর্থনীতি, বা আইনের শাসনÑ এসব ক্ষেত্রেই প্রতিটি দেশি-বিদেশি জরিপ দেখাচ্ছে সবকিছু ভেঙে পড়ার এক ভয়াবহ চিত্র। কানাডীয় গবেষক নাওমি ক্লেইন তার ‘নো-লোগো’ বইতে দেখিয়েছিলেন, পণ্যের ব্র্যান্ডিং আর বিজ্ঞাপনের পেছনে বিরামহীন অর্থ ব্যয় করে কোম্পানিগুলো, পাশাপাশি ভয়াবহ কাটছাঁট চলে শ্রমিকের মজুরিতে। বাংলাদেশের উন্নয়নটা ঠিক এমনই। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, উন্নয়ন সূচকে এত নেতিবাচক চিত্র থাকার পরও ঢাকঢোল পিটিয়ে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতির প্রচারণা জনগণকে বিভ্রান্ত করে রাখার পন্থা মাত্র। কিন্তু ক্রমাগত ঘা খাওয়া, লাথি খাওয়া মানুষের জানতে আর বাকি নেই, এই চোখধাঁধানো উন্নয়নের ব্র্যান্ডিং আসলে একটি ‘গোয়েবলসীয়’ প্রচারণা, একটি ভয়াবহ তামাশা। বাংলাদেশ ও জনগণের কী লাভ-ক্ষতির খতিয়ান উন্নয়নশীল দেশে হিসেবে স্বীকৃতি চূড়ান্ত পাওয়ার পর দেশ ও জনগণের কী লাভ হবে তা এবার একটু জেনে নেয়া যাক। বর্তমানে এলডিসিভুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বাণিজ্য, শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা, উন্নয়ন অর্থায়ন, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও কৌশলগত সহায়তা পেয়ে আসছে। এ ছাড়া ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে স্বল্পোন্নত দেশগুলো পেটেন্ট লাইসেন্স ছাড়াই ওষুধ উৎপাদন করতে পারে। ফলে বাংলাদেশে বর্তমানে এই খাতে যেসব দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী রয়েছে তারা এ সুবিধা পেয়ে আসছে। জলবায়ু তহবিল থেকে স্বল্পোন্নত দেশগুলো সুবিধা পেয়ে আসছে। এ ছাড়া আগামীতে সেবাখাতে বেশকিছু সুবিধা দেয়ার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। ২০২৪ সালের পর থেকে এসব সুবিধা আর পাওয়া যাবে না। প্রথমত, বাংলাদেশ এখন ৪০টি দেশের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা পায়। সিপিডির এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই সুবিধা হারালে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত ৬ দশমিক ৭ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। এতে আমাদের ২৭০ কোটি ডলারের রফতানি হারানোর আশঙ্কা আছে, যদি না বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে। ইইউ বর্তমানে বাংলাদেশের ৯৭ দশমিক ৮ শতাংশ পণ্যকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়। এই সুবিধা হারালে আমাদের রফতানি আয়ে বড় প্রভাব পড়বে। দ্বিতীয়ত, এই উত্তরণের কারণে বাংলাদেশ আর স্বল্প সুদে ঋণ পাবে না। আমাদের অর্থনীতিতে এই আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহযোগিতার (ওডিএ) অবদান এখন মাত্র জিডিপির এক শতাংশ হলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ২০১২-১৫ সালে এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর যত ওডিএ বরাদ্দ ছিল, বাংলাদেশ একাই তার সাত শতাংশ পেয়েছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পাশাপাশি মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে গেলে তখন স্বল্প সুদে (০ দশমিক ৭৫ শতাংশ বার্ষিক সুদ) দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পাওয়া যাবে না, তখন তুলনামূলক বেশি সুদে ও কঠিন শর্তে ঋণ নিতে হবে। তৃতীয়ত, ডব্লিউটিওর কাছ থেকে আর অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা পাওয়া যাবে না। অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা, প্রাযুক্তিক সহযোগিতা, নানা রকম ছাড়, দীর্ঘ বাস্তবায়ন কাল- এসব সুবিধাও তখন আর পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া ডব্লিউটিওর এনহান্সড ইন্টিগ্রেটেড ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে বাংলাদেশ বাণিজ্য ও বাণিজ্য সহজীকরণের জন্য অনুদান পাবে না। এই পরিস্থিতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করাও বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে। বাংলাদেশের কী করণীয়? এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের করণীয় কী এমন প্রশ্নের উত্তরে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই উত্তরণের মধ্য দিয়েই সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এখনো বাংলাদেশের ৩ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। আমাদের অর্থনীতি এখনো পুরোপুরি শিল্পায়িত হয়নি। এই পরিপ্রেক্ষিতে রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণের পাশাপাশি আমাদের পরিস্থিতিনির্ভর অর্থনীতি থেকে উৎপাদনশীলতা নির্ভর অর্থনীতির দিকে যেতে হবে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অর্জনের জন্য আমাদের প্রযুক্তির আধুনিকায়ন, দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সঙ্গে অবকাঠামোসহ ব্যবসায় পরিবেশ সক্ষমতা, বন্দর সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। যাতে শুল্কমুক্ত সুবিধা না পেলেও পণ্যের দাম ঠিক রেখে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বজায় রাখা যায়। এ ছাড়া পরিবর্তিত বাস্তবতায় বিশ্ব বাণিজ্যে অংশগ্রহণের জন্য যুগোপযোগী বাণিজ্যনীতি প্রণয়ন এবং যেসব দেশ এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেছে তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সর্বোপরি, আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির সক্ষমতা বাড়াতে এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে এই উত্তরণ প্রক্রিয়া শুরু হলেও ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের বাণিজ্যসুবিধা পাবে তা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। অর্থনীতিবিদরা কী ভাবছেন? উন্নয়নশীল তকমা ভালো না মন্দ এমন প্রশ্ন চলে আসছে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের সর্বনিম্নস্তরে পদার্পণের পরপরই। এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘ভালো বা মন্দ কিছুই স্পেসিফিকলি (নির্দিষ্টভাবে) বলা যাবে না। এটি একটি অর্জন।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যাওয়াতে আমাদের মর্যাদা বাড়ল। এটা দেশের মানুষের এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক অর্জন। আত্মঅহংকারের বিষয়। বাংলাদেশকে এখন আর কেউ গরিবের দেশ বলতে পারবে না।’ তবে এই অর্জনের পরে কাজ আরও বেড়েছে বলে উল্লেখ করেছেন এই অর্থনীতিবিদ। আতিউর রহমান আরও বলেন, ‘স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটায় বিশ্বের বাণিজ্য সংগঠন ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। কমবে বিনিয়োগের ঝুঁকির হার। ফলে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে।’ বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘উন্নয়নশীল তকমা অর্জনের সঙ্গে বৈশ্বিক ঋণের ক্ষেত্রে কিছু সুযোগ হারাবে বাংলাদেশ। বাণিজ্য ও সাহায্যে প্রভাব পড়বে। ভারত ও চীনের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। কিছু সুবিধা চলে যাবে, তার সমান্তরালে সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। যাতে পরবর্তী ধাপের সুবিধাগুলো পেতে এগিয়ে থাকে বাংলাদেশ।’ অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানী ড. হোসেন জিল্লুর রহমান সারাবাংলাকে জানান, উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়টি গৌরবের। তিনি জানান, এই মুহূর্তেই আগের পাওয়া সুবিধাগুলো শেষ হয়ে যাবে না। বরং আগামী বছরগুলোতে আরও নতুন সুবিধা পাওয়ার পথে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। জিল্লুর রহমান বলেন, ‘এই অন্তর্বর্তী সময়ে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল ও উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। যাতে এই উত্তরণ বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে সম্মানিত করে।’ প্রায় একই কথা জানালেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনও। তিনি বলেন, ‘আগামী বছরগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা গড়তে প্রস্তুতি নেয়ার সময়।’ তিনি জানান, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে এলে স্বাভাবিকভাবেই বিদেশি ঋণ ও বেসরকারি বিনিয়োগ বেশি আসে। এই বিনিয়োগ কাজে লাগানোর প্রক্রিয়াগুলো শুরু করতে হবে এখন থেকেই। তবে আশাবাদের পাশাপাশি সংকটের শঙ্কার কথাও জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘৪৭ বছরের একটি ইকোনমিক্যাল অর্ব (অর্থনৈতিক বৃত্ত) থেকে বেরোনোর কিছু চ্যালেঞ্জ তো থাকছেই। সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট দেখা দিলে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাও বাধাগ্রস্ত হয়। এই ঝুঁকি এড়ানোর চেষ্টা করে যেতে হবে রাষ্ট্রকেই।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় বাড়াতে হবে। সে জন্য দেশের নীতিনির্ধারকদের পরিপক্বতা অর্জন করতে হবে। বিভিন্ন দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে নেগোসিয়েশনের (দরকষাকষি) ক্ষেত্রে দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে আগামী বছরগুলোতে যেন দেশে কোনোভাবেই অর্থনৈতিক অস্থিরতা বা অস্থিতিশীলতা তৈরি না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।’ বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘সংকট তো কিছু আছেই। স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ার কারণে বিভিন্ন ঋণের ক্ষেত্রে যে গ্রেস পিরিয়ড (অতিরিক্ত সময়) পাওয়া যেত তা হয়তো আগের মতো পাওয়া যাবে না। বেড়ে যাবে সুদের হার, ঋণ সংক্রান্ত ব্যয় বাড়বে। ঋণের টাকা ফেরত দেয়ার সময়ও যাবে কমে। মোট কথা ঋণের ক্ষেত্রে বাধা আসবে।’ ড. জাহিদ আরও বলেন, ‘বাণিজ্যে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াবে শুল্ক সুবিধা কমে যাওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর রফতানির বাজারে নতুন শর্ত যোগ হবে। বৈদেশিক রফতানির বাজার বিশেষ করে নতুন পণ্য রফতানির প্রাথমিকভাবে কিছুটা বাধাগ্রস্ত হবে। বৈদেশিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলোর সাহায্য ও বিদেশি ফান্ড আসাও বন্ধ হয়ে যাবে।’ পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এই অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। সেক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে। শিল্পায়ন বাড়াতে হবে। এই খাতে দেশি-বিদেশি আরও বিনিয়োগ আসতে হবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়াতে দিনরাত কাজ করতে হবে।’ অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানী ড. হোসেন জিল্লুর রহমান উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে রাজস্ব সংগ্রহের বিষয়টি যুগোপযোগী করার ওপর বেশি জোর দিতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থনীতি সংস্কারে এখনই কিছু কাজে হাত দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘সমাজের সকল ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সম্পৃক্তি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন বাড়াতে হবে। এ ছাড়া সুশাসন ও সামাজিক বৈষম্য দূর করতে আরও কাজ করার আছে।’ বিশ্ববাজারে টিকে থাকার মতো নীতি সংস্কার করে মানবসম্পদের উন্নয়নে জোর দেয়ার কথাও বলেছেন খ্যাতনামা এই অর্থনীতিবিদ। খ্যাতির বিড়ম্বনা ও হামবড়া ভাব নিতে গিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বর্ণচোরা মানুষদের দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার অনেক উদাহরণ এ দেশে আছে। তাই ভয় হয় সুশাসন, সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত না করে, লুট-পাট, দুর্নীতি বন্ধ না করে জনগণের জীবনযাত্রার মানের সংশয়যুক্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে পাওয়া অর্জন শেষ পর্যন্ত কাকের ময়ূর সাজার ভয়াবহ পরিণতি ডেকে না আনে। তাই পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন, ইতিবাচক অর্জন ও স্বীকৃতির আলোকে সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বিভিন্ন সংস্থার নেতিবাচক জরিপগুলোকে আমলে নেয়া এবং তার যথাযথ পর্যালোচনা করে ক্ষতগুলো দূর করা। তাহলেই জাতি হিসেবে আমরা ইতিবাচক অর্জনগুলোর জন্য গর্ববোধ করতে পারবো। দেশ স্বল্প, থেকে উন্নয়নশীল তারপর উন্নত দেশে পরিণত হাওয়ার সকল ইতিবাচক সূচক নিশ্চিত করলে দেশ ও জনগণের মধ্যেও বইবে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির অমিয় শান্তির ফল্গুধারা। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির