post

কমছে বিনিয়োগ, কমছে বিদেশী সাহায্য

০৩ মার্চ ২০১৪

Aorthonityকমছে বিনিয়োগ, কমছে বিদেশী সাহায্য। এক দিকে যেমন বড় কোনো বিদেশী বিনিয়োগ দেশে আসেনি, অন্য দিকে দেশী বিনিয়োগের খুব বেশি দেখা মিলছে না। এর মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে নির্বাচনত্তোর পরিস্থিতিতে বাইরের দেশ ও উন্নয়ন সহযোগীরা তাদের দেয়া বাংলাদেশকে সহায়তা ব্যাপক হারে কমিয়ে দিতে পারে। এমনকি কোনো দেশ বা সংস্থা তাদের এখানকার কার্যক্রমও সীমিত করে দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বিদেশী বিনিয়োগ যে কমে গেছে তা মানতে রাজি নন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক কারণে বৈদেশিক বিনিয়োগ অনেক কমে গেছে। বিদেশী উদ্যোক্তারা যারা এসেছিলেন তারা সাবধান হয়ে গেছেন। সেই সাবধানতা এখনো কাটেনি। দেশের ব্যক্তিমালিকানা খাতও আশানুরূপ বিনিয়োগ করেনি। তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, এ অবস্থা বেশি দিন থাকবে না। অচিরেই দেশে বিনিয়োগ ফিরে আসতে থাকবে। বিনিয়োগ বোর্ড একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। তাদের পরিসংখ্যানও বলছে, গত বছর দেশী বিনিয়োগ কমে গেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৩ সালে দেশে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়েছে ৪২ হাজার ৪৮৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকার। নিবন্ধিত শিল্প প্রকল্পের সংখ্যা ছিল এক হাজার ১৯৭টি। আগের বছর ২০১২ সালে এক হাজার ৬৫৫টি শিল্প প্রকল্পের বিপরীতে স্থানীয় বিনিয়োগ নিবন্ধনের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ৭৮ কোটি ছয় লাখ টাকার। অর্থাৎ বিনিয়োগ নিবন্ধন কমেছে ১৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। বিনিয়োগ বোর্ড যে হিসাবটি দিয়েছে তার সবগুলোই প্রস্তাবিত বিনিয়োগ। এটি দিয়ে প্রকৃত বিনিয়োগের কোনো চিত্র পাওয়া যাবে না। এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন হতেও পারে, আবার না-ও হতে পারে। দেখা গেছে, নিবন্ধিত বিনিয়োগ প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত আর আলোর মুখ দেখে না। অনেকে স্রেফ নিবন্ধন দেখিয়ে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকেন। বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্য থেকে দেখা যায়, গত বছরের শেষ প্রান্তিকে বিদেশী বিনিয়োগ নিবন্ধন মারাত্মকভাবে কমে গেছে। এ সময় ছয়টি শতভাগ বিদেশী এবং ১৫টি যৌথ বিনিয়োগ প্রকল্প নিবন্ধিত হয়। নিবন্ধনের পরিমাণ ছিল মাত্র ৭৮৭ কোটি টাকা। অথচ আগের প্রান্তিকে ২১টি শিল্প প্রকল্পের বিদেশী বিনিয়োগ নিবন্ধনের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৭০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এ অবস্থায় চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন ও আগামী অর্থবছরের নতুন বাজেট প্রণয়ন করতে সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিদেশী সহায়তা না পাওয়া গেলে সবচেয়ে বড় হোঁচটটি খেতে হবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি(এডিপি) বাস্তবায়নে। এক দিকে যেমন এর বাস্তবায়ন বাধার সম্মুখীন হবে, অন্য দিকে নতুন অর্থবছরের জন্য এডিপি প্রণয়ন করাও বেশ কষ্টকর হয়ে পড়বে। কারণ এডিবির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অর্থায়ন করা হয়ে থাকে বিদেশী সাহায্যের মাধ্যমে। ইতোমধ্যে এ খাতে বরাদ্দকৃত বিদেশী সহায়তা ছাড় আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ফলে গত পাঁচ বছরের মধ্যে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে সবচেয়ে কম। বাস্তবায়ন হার মাত্র ২৭ শতাংশ। আর এডিপি বাস্তবায়ন করা সম্ভব না হলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটি স্থবিরতা বিরাজ করবে। নতুন করে কোনো কর্মসংস্থান হবে না। বাড়বে বেকারত্ব। গত মাসে ব্রিটিশ সরকার বলেছে, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও একতরফা নির্বাচন করার কারণে তারা বাংলাদেশে চলমান দু’টি প্রকল্পে অর্থায়ন কমিয়ে দেবে। শুধু ব্রিটিশ সরকার নয়, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থতহবিলের (আইএমএফ) মতো বড় উন্নয়ন সহযোগীরা নতুন সরকারের সাথে ‘সংযুক্তি’ কমিয়ে আনতে পারে বলে শঙ্কা ব্যক্ত করেছে ইআরডির সূত্রগুলো। তাদের বক্তব্যে, বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক যদি তাদের সহায়তা কমিয়ে দেয় তবে তা হবে বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু দুর্নীতি বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাথে সরকারের বছরখানেক ধরে সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে। এখন নির্বাচনগত কারণে এটি আরো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ও দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইআরডি থেকে হালনাগাদ যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যায়, ইতোমধ্যে বিদেশী সহায়তাপ্রাপ্তি গতবারের চেয়ে বেশ কমে গেছে। কোনো কোনো জায়াগায় এই অর্থপ্রাপ্তি অর্ধেকে নেমে এসেছে। এর ফলে বাজেটে অর্থায়নে বিদেশী সহায়তাও আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়কালে বাজেট অর্থায়নে বিদেশী সাহায্য ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে ৮৫২ কোটি ৩২ লাখ টাকা। যেখানে গত অর্থবছরে (২০১২-২০১৩) একই সময়ে বাজেটে অর্থায়নে বিদেশী সহায়তা পাওয়া গিয়েছিল চার হাজার ৫৩১ কোটি ২২ লাখ টাকা। এবার তা কমে গেছে ৪৩২ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ তিন হাজার ৬৭৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এখানেই শেষ নয়, চলতি অর্থবছরে বিদেশী সাহায্য ছাড়ও আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জুলাই-অক্টোবর (২০১৩-২০১৪) বিদেশী সাহায্য অবমুক্তি বা ছাড় কমেছে ৩১ শতাংশ। গত অর্থবছরে এই সময়ে বিদেশী সাহায্য ছাড় হয়েছিল যেখানে ৮০ কোটি ৯৬ লাখ মার্কিন ডলার সেখানে এবার ছাড় হয়েছে ৫৫ কোটি ৬৮ লাখ ডলার। আগামী মাসগুলোতে তা আরো কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে।

এডিপি বাস্তবায়নে স্থবিরতা চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে গতি আসেনি। এ সময়ে এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছে মাত্র ২৭ শতাংশ। গত পাঁচ বছরে এবারই এডিপি সবচেয়ে কম বাস্তবায়িত হয়েছে। যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে তবে বছর শেষে এডিপি বাস্তবায়ন ৭০ শতাংশের ওপরে ওঠানোই কষ্টকর হয়ে যাবে। চলতি অর্থবছরে এডিপি বিদেশী সাহায্যপ্রাপ্তির প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৪ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। চার মাসে ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে মাত্র প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এ পরিস্থিতি সরকার ইতোমধ্যে এডিপি কাটছাঁট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এডিপির আকার ১০ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হচ্ছে ৫৫ হাজার দুই কোটি টাকা।

বাজেটও কাটছাঁট হচ্ছে চলতি অর্থবছরে দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার বিশাল বাজেটটি এখন আর বাস্তবায়ন করতে পারছে না সরকার। কারণ বাজেট বাস্তবায়নের জন্য অর্থের সঙ্কুলানের যে প্রাক্কলন করা হয়েছিল, এখন এসে দেখা যাচ্ছে তা সংগ্রহ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। ফলে অর্থবছরের সাত মাসের মাথায় এটি কাটছাঁট করা শুরু হয়েছে। পুরো বাজেট থেকে কেটে ফেলা হচ্ছে ১১ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ফলে সংশোধিত বাজেটের আকার গিয়ে দাঁড়াচ্ছে দুই লাখ ১১ হাজার ২২০ কোটি টাকা, যা মূল বাজেট থেকে ৬ শতাংশ কম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইআরডির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আগামী মাসের মাঝামাঝিতে নতুন অর্থবছরের জন্য এডিপির প্রণয়নের কাজ শুরু করা হবে। এর আগে বিভিন্ন দাতা সংস্থার সাথে আমাদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সাধারণত এসব বৈঠক থেকে আগামী অর্থবছরে কী পরিমাণ বিদেশী সাহায্য পাওয়া যাবে তার একটি আশ্বাস পাওয়া যায়। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম হবে, কারণ এই বৈঠকে সদ্য হয়ে যাওয়া নির্বাচন নিয়ে আমাদের নানামুখী প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। বিশেষ করে একতরফা নির্বাচন এবং সুশাসন নিয়ে আমাদের সত্যিই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে বলা যায় আগামী অর্থবছরে এডিপি অর্থায়ন জোগার করা আমাদের জন্য রীতিমতো কঠিন হয়ে পড়বে। - অন্য দিগন্তের সৌজন্যে

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির