post

ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে খ্রিস্টান সন্ত্রাসীর হামলা শোকে স্তব্ধ মুসলিমবিশ্ব । মীম মিজান

০১ এপ্রিল ২০১৯

ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে খ্রিস্টান সন্ত্রাসীর হামলা শোকে স্তব্ধ মুসলিমবিশ্ব । মীম মিজানমানবতার এই দুর্দিনে মানবতাকে আরো একবার নৃশংসতার নজিরে কাঁপিয়ে দিল নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ মসজিদ হামলা। আর এই হামলা যদি কোনো মুসলিম ব্যক্তির দ্বারা সংঘটিত হতো তবে সমগ্র বিশ্বে কী যে তোলপাড় শুরু হতো তা ভাবার মতো নয়। বিশ্বের সব নাস্তিক, মুরতাদ, তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থা আর সুশীলসমাজ টেবিল টকশো, সভা-সেমিনার, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিলের মাধ্যমে মুসলিম সমাজের বিপক্ষে যুদ্ধের উসকানি দিয়ে না জানি কত বড় গোলমাল পাকাতো। কিন্তু এখন আমাদের পক্ষে সুস্থির থাকা বেশ সংযমের। আমার প্রিয় ভাই, প্রিয় মানুষ, মুসলিম কওমের অঙ্গ এভাবে নৃশংসভাবে খুন হয়ে আর কত শাহাদাত বরণ করবে? এই হামলা কে করেছে? কেন করেছে? কোন প্রেক্ষাপট হামলাকারীকে প্ররোচিত করলো এ ধরনের জঘন্যতম ঘটনার সূত্রপাত করতে? আর এর থেকে আমাদের শিক্ষাটাই কী? তা আমাদের জানা উচিত এবং আগামীতে আমাদের করণীয় ঠিক করে নেয়া এখন আশু কর্তব্য বলে মনে করি। গত ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দক্ষিণ শহরে দুটো মসজিদে বেন্টন ট্যারান্ট নামক এক উগ্রপন্থী খ্রিস্টান যুবকের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে পবিত্র জুমার দিনে জুমার নামাজরত ও খুতবা শ্রবণরত প্রাণাধিক প্রিয় মুসলিম ভাইবোনেরা শাহাদাত বরণ করেছেন। এই হামলার ফলে আমরা স্তম্ভিত হয়েছি। হয়েছি বাকরুদ্ধ। হামলার ঘটনা জানার জন্য ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যম খুঁজে যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী মুসলিমবিদ্বেষী উগ্রপন্থী ট্যারান্ট পূর্বপরিকল্পিতভাবে হামলা চালায় দু’টো মসজিদে। সে একটি প্রাইভেট কার ব্যবহার করেছিল। তার কারটি বিস্ফোরকে পূর্ণ ছিল। কারের পেছনের বাঙ্কারে তিনটি স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান ছিল। ছিল কয়েকটি জার্কিন ভর্তি বিস্ফোরক। সেনাবাহিনীর পোশাক ছিল তার পরনে। কয়েকটি সেনা জ্যাকেটও তার গাড়ির পেছনে ছিল। সে যখন ড্রাইভিং করে যাচ্ছিল আর লাইভ ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছিল তার সিটের বাঁপাশের খালি জায়গায় ছিল দুটো স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান। যখন সে আন নুর মসজিদের দিকে যাচ্ছিল তখন রেদোভান কারাঞ্জিক নামক এক মুসলিমবিদ্বেষীর আদর্শের গান শুনছিল (যে বসনিয়ার মুসলিদের গণহত্যার দায়ে দণ্ডিত হয়েছিল)। আন নুর মসজিদে স্থানীয় সময় বেলা ১টা ৪৫ মিনিটে হামলা চালায়। অতঃপর সেখান থেকে সুবার্ব মসজিদে। আন নুর মসজিদ থেকে সুবার্ব মসজিদ যেতে প্রায় সাত মিনিট লেগেছিল এই মুসলিম হত্যাকারী সন্ত্রাসী ট্যারান্টের। তার ব্যবহৃত মেশিনগানে লেখা ছিল ‘রেভেঞ্জ ফর এবা অকারল্যান্ড’ আর অন্য অস্ত্রগুলোতে লেখা ছিল ‘হেইল চার্লস টারমেট’। সে গুলি চালাতে চালাতে খানিকদূর গাড়ির দরজা খোলা অবস্থায় যায়। তারপর গাড়ি বন্ধ করে নেমে পড়ে। গাড়ি থেকে নামার আগেই মাথায় হেলমেটের সাথে লাগানো ক্যামেরাকে ফেসবুকের সাথে সংযুক্ত করে নেয়। এরপর তার ভিডিও দেখে মনে হচ্ছিল যে ক্লাশ অব ক্লান বা ক্লাশ অব টাইটান গেইম খেলছে কেউ। আর সেটা ফেসবুক লাইভে সারা বিশ্ববাসী দেখছে। সে গাড়ির পেছনে এসে ব্যাক খুলে একটি মেশিনগান নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করে। হাতের বাঁপাশে অনেকগুলো পার্কিং করা গাড়ি। যেগুলোতে বিভিন্ন স্থান থেকে আল্লাহ ভীরু পুরুষ-মহিলাগণ জুমার নামাজ আদায় করতে এসেছেন। ট্যারান্ট মসজিদের দরজায় প্রবেশ করেই গুলি ছুড়া আরম্ভ করে। আর অমনি নামাজরত অনেকেই শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন। ঠিক গেম স্টাইলে গুলি চলছিল আর কার্তুজের খোলসগুলি টপকিয়ে টপকিয়ে পড়ছিল বন্দুক থেকে। মসজিদে অনবরত গুলি চালিয়ে খুনের নেশায় মত্ত উগ্রবাদী ট্যারান্ট ডানে বামে চলছিল। অনেক মুসল্লিই এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছিল। কক্ষগুলোর কোণে কোণে জড়ো হচ্ছিল আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে আসা প্রশান্ত আত্মাগুলো। আর সেখানেই সে উপর্যুপরি গুলি চালাচ্ছিল। অনেকেই সিজদারত ছিল। কান্নার আওয়াজ আর আর্তনাদ আল্লাহর আরশে মহল্লা পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছিল। শুধু স্পর্শ করতে পারেনি খ্রিস্টান শ্বেতাঙ্গের পাষাণ মনকে। ইমাম খুতবা দিচ্ছিলেন। ছিল মাসুম শিশু। ছিল মা, ভগিনী ও বাবা-দাদা বয়সী সাচ্চা মুমিন। মুমিনদের জান্নাতে প্রবেশের এ ক্ষণে কিয়ৎপরিমাণ বিরতি দিল নরপিশাচ ট্যারান্ট। কারণ তার বন্দুকের গুলি শেষ। নতুন ম্যাগজিন পুরে নিলো গানে। সেই গুলি মুমিনের ঈমানি কলিজাকে ভেদ করতে করতে শেষ হয়ে গেল। আবারো নতুন ম্যাগজিন লোড করে আল্লাহকে সিজদা করার কপাল ফুটো করতে লাগল। গুলি এবারো শেষ। তবুও তার ঈমানি লহু বয়ে দেয়ার খায়েশ মিটল না। সে আবার ফিরে আসে গাড়ির কাছে। সেখান থেকে আরেকটি মেশিনগান নিয়ে আবারও চলে যায় মসজিদের ভেতরে। আবারো গুলি ছুড়া শুরু। যারা পূর্বেকার গুলিতে আহত হয়ে তড়পাচ্ছিল তাদের আবার গুলি করে এই ঘাতক। খুনে রাঙা হলো জায়নামাজ। লহুর ধারাতে লেপ্টে গেল খোদার ঘরের মেঝে। দেয়ালগুলোতে ছিটিয়ে পড়া ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ও মগজের খণ্ডাংশ। আল্লাহর কুরআনের হরফে রক্তিম ছাপ সাক্ষী হলো কেয়ামত দিবসের তরে। পাশাপাশি কক্ষগুলোতে যারা জীবিত এদিক ওদিক লুকোচ্ছিল তাদেরও গুলি করে শহীদ করে দেয় এই ধর্মান্ধ। মসজিদ থেকে বাইরে বের হওয়ার সময় যারা আশপাশে ছিল তাদেরকেও গুলি করে। রেহাই পায়নি কোন পথচারী। বাইরে গুলি খেয়ে পড়ে এক মহিলা ‘প্লিজ হেল্প মি! ‘প্লিজ! ডোন্ট শুট মি!’ বলছিল। তাকে কাছে থেকে গুলি করে গাড়িতে উঠে ফিরে যাওয়া শুরু করে। ফেরার পথে নিজ গাড়ির কাচ ভেঙে বাইরে অনেককেই গুলি করে। আন নুর মসজিদে ৪১ জন। লিনউডের সুবার্বে মসজিদে সাতজন। হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসাধীন একজন। ১৭ মার্চ আরেকজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মোট ৫০ জন। এখনো গুরুতর ও কম আহত বাইশজন চিকিৎসাধীন আছেন হাসপাতালে। সেই বাইশজনের মধ্যে চার বছর বয়সের একটি শিশুও আছে। আমাদের দেশের অহঙ্কার বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের কয়েকজন সদস্যও সেই মসজিদে নামাজ আদায় করতে যাচ্ছিলেন। তিনটি টেস্ট খেলা ছিল নিউজিল্যান্ডের সাথে। দুটো হয়েছিল। পরদিন তৃতীয় ম্যাচ ছিল। মাঠের কাছাকাছি আন নুর মসজিদটি হওয়ায় তারা সেখানে নামাজের জন্য মনোস্থির করে গেটে যেয়ে বাস থেকে নামছিলেন। দেখেন যে, মসজিদের ভেতর থেকে এক মহিলা রক্তাক্ত শরীর নিয়ে দৌড়িয়ে পালাচ্ছেন। আর তিনি বললেন, ‘ডোন্ট গো ইনসাইড! দেয়ার ইজ শুটিং সামওয়ান!’ মুশফিক, তামিম, তাইজুল, মেরাজরা তখন ফিরে এসে বাসে বসে। কিন্তু বাস আর যেতে পারছে না। প্রশাসন ততক্ষণে বাস চলাচল নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। বাসে বসে থেকে দারুণ উদ্বিগ্ন অবস্থা অতিক্রম করছিল। কেননা কোনো প্রটোকল ছিল না তাদের। বাস থেকে নেমে তারা চট জলদি মাঠে ফিরে যায়। গত দু’টেস্ট আর আগামীকালের টেস্ট নিয়ে ব্রিফিং দিচ্ছিলেন মাহমুদুল্লাহ। আর তার ব্রিফিং শেষ হতে দেরি হওয়ায় মুশফিকদের মসজিদে পৌঁছাতে মিনিট পাঁচেক দেরি হয়। আর এই পাঁচ মিনিটই ছিল আল্লাহর অদৃশ্য হাতের মুজেজা; যার ফলে আমরা ফেরত পেয়েছি প্রিয় ক্রিকেটারদের। এই ন্যক্কারজনক হত্যার পূর্বে নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনা ছিল ৩০ বছর আগের। ১৯৯০ সালের ১৩ নভেম্বর ‘ডেভিড গ্রে’ নামে এক ব্যক্তি আরামোয়ানা এলাকায় প্রতিবেশীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডার পরিপ্রেক্ষিতে অতর্কিতে গুলি চালিয়ে ১৩ জনকে হত্যা করেছিল।

ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে খ্রিস্টান সন্ত্রাসীর হামলা শোকে স্তব্ধ মুসলিমবিশ্ব । মীম মিজানকে এই ট্যারান্ট?

১৯৯১ সালে অস্ট্রেলিয়ার গ্রাফটনের নিউ সাউথ ওয়েলসে জন্ম ও বেড়ে ওঠা ট্যারান্টের পুরো নাম ব্রেন্টন হ্যারিসন ট্যারান্ট। এখন তার বয়স ২৮ বছর। তার বাবার নাম রোডনেই। রোডনেই একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ছিল। তবে সে খেলাধুলোর প্রতি ছিল বেশ আগ্রহী। আইরন ম্যান কম্পিটিশনে অংশগ্রহণ করেছিল ও সফলতা অর্জন করেছিল। রোডনেই ২০১০ সালে ৪৯ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তার বাবা মারা যাওয়ার পর ট্যারান্ট টাকা পয়সার উত্তরাধিকারী হয়। বাবা মারা যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সে একটা জিমে ট্রেইনারের চাকরি করত। তার জিমের লোকজনের ভাষ্যমতে সে খুবই মনোযোগী কর্মী ছিল। তার স্বভাব খুবই নম্র ছিল। কেউই বিশ্বাস করতে পারে না এই হামলার ঘটনা। বাবার মৃত্যুতে নগদ অর্থ লাভ করায় ট্যারান্ট জিমের চাকরি ছেড়ে বিশ্বের অনেক দেশ ভ্রমণ করে। দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের আন্দোলনের দেশগুলো ছিল তার প্রিয় জায়গা। সে সেখান থেকেই মুসলিমবিদ্বেষী ও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের পক্ষে দীক্ষা লাভ করে। প্রায় ২০টি দেশ তার ভ্রমণের তালিকায়। ট্যারান্টের মা একজন শিক্ষিকা। রোডনেই এর মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়। ট্যারান্টের মা সন্ত্রাসবাদ বিরোধী। সে শান্তির পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব। ট্যারান্টের এক বোন আছে। ঘাতক ট্যারান্ট গত দু’বছর ধরে ডিউনডিনের দক্ষিণ শহরে বসবাস করছিল যা ক্রাইস্টচার্চ থেকে ৩৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। ২০১৮ সালের প্রারম্ভে ট্যারান্ট ডিউনডিন শহরের ব্রুস রাইফেল ক্লাবে রাইফেল চালনা শেখার জন্য ভর্তি হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্রাইস্টচার্চ বা আশপাশের এলাকায় হামলার কোন পরিকল্পনা ছিল না তার। পরে মিডিয়া কাভারেজ ও শোরগোল ফেলে দেয়ার জন্য সে এই হামলা চালায়।

শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ব আন্দোলন কী?

এটি একটি একপেশে ভুল ধারণার মতবাদ। যাতে কতিপয় শ্বেতাঙ্গ মনে করেছিল যে তারাই শ্রেষ্ঠ। সবদিক থেকে কৃষ্ণাঙ্গরা নিচু মানের। আর এই ভাবধারাটি সতেরো শতকে বীজ বপিত হয়ে বিংশ শতাব্দীতে এসে পূর্ণতা লাভ করেছিল। ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, মার্কিনমুল্লুকে সর্বপ্রথম এই বিষবাষ্পের ধারণার ছয়লাভ হয়। অতঃপর জার্মানি, রোডেশিয়া, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রিটিশ কমনওয়েলথ, ইউক্রেন ইত্যাদিতে ছেয়ে পড়ে। মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলার নাম আমরা শুনেছি এই শ্বেতাঙ্গ আন্দোলনের বিপরীতে কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলন তথা সমঅধিকার আন্দোলনের জন্য। বিশ্ব আজো ভোলেনি বিকৃত মস্তিষ্কজাত শ্বেতাঙ্গ দ্বারা কৃষ্ণাঙ্গ নির্যাতনের দগদগে ক্ষত।

এবা অকারল্যান্ড ও চার্লস মারটেল কে?

এবা অকারল্যান্ডের বাবার নাম স্টিফেন অকারল্যান্ড। তার মায়ের নাম জেনেট অকারল্যান্ড। শিশু মেয়েটির বয়স ছিল এগারো বছর। শ্রবণপ্রতিবন্ধী। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে সুইডেনের স্টকহোমে উজবেকিস্তানি রাখমাত আকিলোভ নামে এক নামমাত্র মুসলিম যে সুইডেনে অভিবাসী হিসেবে ছিল সে চুরি করা একটি লড়ি অনেকগুলো মানুষের ওপর চালিয়ে দিয়েছিল। যাতে হতাহতের মধ্যে সেই ১১ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী শিশুটি ছিল। আর চার্লস মারটেল হলো সেই ব্যক্তি যে ৭৩২ খ্রিস্টাব্দের তুর যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজিত করেছিল এবং ধ্বংসাত্মক আগ্রাসন চালিয়েছিল।

তার ৭৪ পৃষ্ঠার মেনুফেস্টোতে কী আছে?

এই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের ধ্বজাধারী ট্যারান্ট হামলার কিছু সময় পূর্বে ৭৪ পৃষ্ঠার এক মেনুফেস্টো প্রকাশ করেছিল অন্তর্জালে। দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাছে মেইল করেছিল। সেই মেনুফেস্টোতে সে উল্লেখ করেছে যে, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে অভিবাসীরা প্রাধান্য বিস্তার করছে। বিশেষ করে এশিয়ান ও আফ্রিকানরা। আরো বিশেষ করে মুসলিমরা। তারা এই দেশটি দখল করে নিতে চায়। কী আজব এক কথা! সে নিজেই জানে না যে, আজ থেকে প্রায় ৭০০ বছর আগে পলিনেশীয় বিভিন্ন জাতি নিউজিল্যান্ড আবিষ্কার করেছিল। দ্বীপটি ভালো লাগায় তারা এখানে বসতি স্থাপন করে। অতঃপর তাদের দ্বারা ধীরে ধীরে একটি স্বতন্ত্র মাওরি সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। তারা নিজেরাই নানাভাবে জীবন যাপন করছিল। কিন্তু বর্গিদের শকুনি নজর পড়েছিল তাদের ওপর। ১৬৪২ সালে প্রথম ইউরোপীয় অভিযাত্রী, ওলন্দাজ আবেল তাসমান, নিউজিল্যান্ডে নোঙর ফেলেন। তারপর ১৮ শ’ শতকের শেষ দিক থেকে অভিযাত্রী, নাবিক, মিশনারি ও বণিকেরা নিয়মিত এখানে আসতে থাকে। অনেক চড়াই উতরাই শেষে ১৮৪০ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও নিউজিল্যান্ডের মাওরি গোত্রগুলি চুক্তি স্বাক্ষর করে যার ফলে নিউজিল্যান্ড ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত হয়। মাওরিদেরকে ব্রিটিশ নাগরিকদের সমান মর্যাদা দেয়া হয়। অব্যবহিত কাল পরেই ব্রিটিশ বেনিয়ারা তাদের আসল চেহারা প্রকাশ করে। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির মতোই নিউজিল্যান্ডে ব্যাপকভাবে ইউরোপীয় বসতি স্থাপন শুরু করে। ইউরোপীয় অর্থনৈতিক ও বিচারব্যবস্থা জোরারোপের ফলে মাওরিরা তাদের বেশির ভাগ জমিজমা ইউরোপীয়দের কাছে হারিয়ে প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়ে। মাওরিদের নানা আন্দোলনের ফলে ১৯৩০-এর দশকে নিউজিল্যান্ডকে একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে প্রায় বাধ্য হয় বেনিয়ারা। অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ বাড়ানো হয়। একই সময়ে মাওরিদের মধ্যে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব বা রেনেসাঁস ঘটে। মাওরিরা বিরাট সংখ্যায় শহরে বসতি স্থাপন করা শুরু করে এবং নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করে। উপর্যুক্ত ঘটনাবলি ও ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দিনের আলোর মতোই প্রতিভাত হয় যে, এই নিউজিল্যান্ডে আদিবাসী কারা আর অভিবাসী কারা। সাদা চামড়া কি এ দ্বীপরাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক নাকি মাওরিগণ এটার মালিক? নরওয়ের একজন কট্টরপন্থী শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী এন্ড্রেস ব্রেইভিকের দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত বলে এই মেনুফেস্টোতে উল্লেখ করেছে ট্যারান্ট। এন্ড্রেস ব্রেইভিক একজন দাগি সন্ত্রাসী ও সাক্ষাৎ দানব। নরওয়েতে তার মতামত জানান দেয়ার জন্য ২০১১ সালে ৭৭ জন মানুষকে মেরে বিশ্ববিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ট্যারান্ট এই মেনুফেস্টোতে নিজের নব্য ফ্যাসিবাদী চিন্তা ধারার প্রকাশ ঘটিয়েছে। বিশেষত ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কট্টরভাবে ভীতি প্রদর্শন করেছে। এ ছাড়াও নিজেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘অভিবাসীবিরোধী কর্মকাণ্ড দ্বারা অনুপ্রাণিত’ বলে দাবি করেছে। ট্যারান্ট এসব মুসলিমকে রক্তের সঙ্গে প্রতারণাকারী বলে উল্লেখ করেছেন। এসব প্রতারণাকারীর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। সে উল্লেখ করেছে, আমি ডিলান রুফসহ আরও অনেকের বই পড়েছি। তবে এই ৭৪ পৃষ্ঠার ইশতেহারে কট্টরপন্থী এই ট্যারান্ট যে লোগো ব্যবহার করেছে তা কালো গোলাকৃতির। এই লোগো নাৎসিবাদ সন্ত্রাসী সংগঠন ‘ব্লাক সান’র। খুব সম্ভবত ট্যারান্ট এই ব্লাক সানের সদস্য। কেননা নরওয়ের সেই কট্টরপন্থী দুর্ধর্ষ শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী এন্ড্রেস ব্রেইভিকও ব্লাক সানের সদস্য। আর ব্লাক সানের সদস্যরা খুবই ভয়ানক ও দুর্ধর্ষ হয়। এখন আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে এই ব্লাক সান নিয়ে বেশ শোরগোল পরিলক্ষিত হচ্ছে।

ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে খ্রিস্টান সন্ত্রাসীর হামলা শোকে স্তব্ধ মুসলিমবিশ্ব । মীম মিজানআসুন জেনে নেয়া যাক কী এই ব্লাক সান?

বিশ্ব মিডিয়া এই ব্লাক সানকে বলছে শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদী সন্ত্রাসীদের আঁতুড় ঘর। ব্লাক সান সোসাইটির সদস্যরা বিশ্বাস করে যে পশ্চিমের দেশগুলোতে কেবল শ্বেতাঙ্গরা বসবাস করার অধিকার সংরক্ষণ করে। অভিবাসী বা মুসলিমরা সেখানে থাকার যোগ্য নয়। অভিবাসী ও মুসলিমরা এদেশগুলোতে নানা সঙ্কট ও সমস্যার সৃষ্টি করছে। তাই তাদের নির্মূল ও বিতাড়নের জন্য কট্টর শ্বেতাঙ্গদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করে। এই সংগঠন কবে কোথায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা জানা যায়নি। সম্পূর্ণ গোপন এই সংগঠন বিশ্বজুড়ে হিটলারের আদর্শের অনুসারীদের নিয়ে কাজ করে। এর সদস্যরা নিজেদেরকে কট্টর ডানপন্থী শ্বেতাঙ্গ বলে পরিচয় দিয়ে থাকে।

তথাকথিত বিশ্বনেতাদের নির্লজ্জতার রূপ:

হামলার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই রঙ হেডেড ট্রাম্প এ হামলার নিন্দা জানিয়েছে। হামলায় নিহতদের প্রতি শোক জানিয়েছে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। কঠিন এই সময়ে ব্রিটেন নিউজিল্যান্ডের পাশে থাকবে বলে জানিয়েছেন রানী এলিজাবেথ। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যে কোনো পদক্ষেপে পাশে থাকার কথা বলেছে ফ্রান্স ও জার্মানি। অন্যদিকে হামলার ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন পোপ ফ্রান্সিস। আমি কী জন্য এই বক্তব্যগুলোকে নির্লজ্জতা বললাম তার ব্যাখ্যা বা কারণ নিচের অংশেই পরিস্ফুটন হবে।

সব ঘটনার একই সূত্র

ইসলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীবনব্যবস্থা। যখন গোটা বিশ্ব আঁধারে নিমজ্জিত ছিল; খুন, হত্যা, ব্যভিচার, জুয়া ইত্যাদি পাপাচারে দুনিয়া সয়লাভ করেছিল। ঠিক তখনি রাসূলে করিম (সা) আলোকবর্তিকা হাতে এলেন। দূরীভূত করলেন আঁধার। প্রতিষ্ঠা করলেন ন্যায় ইনসাফ। কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ, ধনী-দরিদ্র, আমির-দাস ইত্যাদির ভেদাভেদ তুলে দিলেন। ইসলামে প্রত্যেক মুমিনের মর্যাদা একই তা প্রমাণ করলেন। মানুষে মানুষে স্থাপন করলেন সম্প্রীতি। সবাইকে বাঁধলেন সহমর্মিতা ও অনন্য আচরণের বাহুডোরে। শান্তির সুবাতাস বয়ে চলল চতুর্দিক। তিনি ইন্তেকাল করলেন। তাঁর যোগ্য খলিফাগণ পরিচালনা করলেন খেলাফত। বিশ্বে জয়জয়কার ধ্বনি উচ্চকিত হতে শুরু করল মুসলিমদের। ইহুদি-খ্রিস্টানদের শুরু হলো অন্তর্জ্বালা। মুসলিমদের কিভাবে ঘায়েল করা যায়? তাদেরকে কিভাবে পতনোন্মুখ করা যায়? এ নিয়ে তারা নানা গবেষণা করে যে বিষয়টি পেল তা হচ্ছে, মুসলিমদের পথচলার আলোর খনি কুরআনের শিক্ষা তাদের কাছ থেকে সরিয়ে দিতে হবে। আর তাই তারা (ইহুদি-খ্রিস্টান) শুরু করল ষড়যন্ত্রের জাল বুনা। ক্রমান্বয়ে আমাদের কাছ থেকে কুরআনিক শিক্ষা উঠে গেল। আমরা হয়ে পড়লাম সুবিধাবাদী। শুধু সাওয়াব খুঁজি। যার ফলে কুরআনিক জ্ঞান দূরে গেল। হয়ে পড়লাম অন্তঃসারশূন্য। কতিপয় সাধারণ নামধারী মুসলিম যুবককে মন্ত্র শেখানো হলো তুমি যদি আল্লাহর নাম নিয়ে এরকমভাবে হামলা চালিয়ে অমুসলিমদের হত্যা করো তাহলে তুমি সরাসরি জান্নাতে যাবে। হামলা চালানোর যত কৌশল আনুষঙ্গিক অস্ত্রপাতি সবই তারা সাপ্লাই দেয়। বিশাল বড় পাঞ্জাবি-জুব্বা, পাগড়ি ইত্যাদি থাকে তাদের পরনে। যুবকের যেহেতু মূল ইসলামের জ্ঞান নেই তাই ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রমণ করে অমুসলিমদের। আর সাথে সাথেই ইহুদি-খ্রিস্টান চক্র তকমা দিয়ে দিল মুসলিমরা জঙ্গি। অথচ ইসলামের মূল শিক্ষা আমরা যদি কারো দ্বারা আক্রমণের শিকার হই তখন তার প্রতিহত করার বিধান আছে। নিজে আগ বাড়িয়ে মানুষ হত্যা ইসলামে জায়েজ নেই। এরকমই নানা ষড়যন্ত্র কালে কালে করে আসছে এই ইহুদি-খ্রিস্টান চক্র। তার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ওসামা বিন লাদেন। রাশিয়ার আধিপত্য থেকে আফগানিস্তানকে মুক্ত করার জন্য তাকে তৈরি করা হলো। যত ট্রেনিং, অস্ত্র, আনুষঙ্গিক সবই দিলো আমেরিকা। রাশিয়ার করায়ত্ত মুক্ত হলে টুইন টাওয়ারে হামলা চালিয়ে দায়ভার ওসামার। সুতরাং অপারেশন চালাও। পাকড়াও কর বিশ্বসন্ত্রাসীকে। এভাবে তারাই আইএস প্রতিষ্ঠা করল। আবার আইএসের প্রয়োজন মিটে গেলে নানা প্রকার হামলা চালিয়ে তাদের ধ্বংস করল তারাই। এই যে তালেবান, এই যে আইএস এগুলো তাদেরই সৃষ্টি। এই তালেবান বিভিন্ন জায়গায় মাঝে মাঝে করেছে আত্মঘাতী বোমা হামলা। তাতে মারা গেছে ইহুদি-খ্রিস্টানদেরই অনেকেই। আর তকমা মুসলিমরা সন্ত্রাসী, জঙ্গি। আর যার বাপ-মা, ভাই-বোন হামলায় মারা গেল তারা হয়ে উঠলো প্রতিশোধপরায়ণ। যার ফলে আন নুর মসজিদের মত চালানো হয় হামলা। এ ছাড়াও ১৯৪৭ সালে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা হলো স্বাধীন ফিলিস্তিনের জমিতে অবৈধ ইহুদি রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা ব্রিটেনের। আর এই ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইলকে ফ্রান্সও সমানতালে সহযোগিতা করে। তারাই বাঁচিয়ে রেখেছে এই মুসলিম বিশ্বের ফোঁড়া রাষ্ট্রটিকে। আমাদের এখানেও ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের কালে কাশ্মিরকে দ্বিখণ্ডিত করে এক অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করে রেখেছে ব্রিটিশরা। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, তারাই উদ্বাস্তু করে মুসলিমদেরকে হামলা চালাতে উৎসাহী করছে। তাদের যাবতীয় সহযোগিতা করছে। আর এর ফলে অমুসলিমদের মধ্যে যাদের প্রিয়জন মারা যাচ্ছে তারাও হয়ে উঠছে একেকটা ট্যারান্ট, ব্রেইভিক ইত্যাদি। ইহুদি-খ্রিস্টানদের ক্রীড়নকে আমাদের ভেতর তৈরি হচ্ছে দ্বন্দ্ব। আমরা হচ্ছি প্রিয়জনহারা। আর আবার নির্লজ্জের মতোই তারা (তথাকথিত বিশ্বনেতা) শোক জানাবে। এটা নির্লজ্জতা বৈকি? আর সব সমস্যার গুরু ওই ইহুদি-খ্রিস্টানরা। তবে আমরা কি বসে বসে আমাদের ভাইদের এভাবে চোখের সামনে বিপথগামী হতে দেখব। যার ফলশ্রুতিতে পাবো সন্ত্রাসী তকমা আবার পরবর্তী ফল হিসেবে হারাবো প্রাণাধিক জ্ঞাতি ভ্রাতাদের? আমাদের কথা বলার একটি জায়গা ওআইসি। সেখানেও কী কী এজেন্ডা আলোচনা হবে তা নির্ধারণ করে পশ্চিমা দাদা ভায়েরা। তবে কি আমরা নিস্তার পাবো না এই করুণ অবস্থা থেকে? আসুন কুরআন পড়ি! কুরআনের আলোকে জীবন পরিচালিত করি! কেউ যদি অতি আদর করে কিছু বলে তবে তা কুরআনের আলোকে বিচার বিশ্লেষণ করে গ্রহণীয় হলে পালন করি। আর বর্জনীয় হলে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। সব সমস্যার গোড়া কোথায় তা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন। আর সমাধান কোথায় বা কিভাবে তাও নিশ্চয়ই নির্ধারণ করেছেন। আজ মুসলিমদের এক হওয়া সময়ের বড্ড দাবি।

লেখক : গবেষক, সাহিত্যিক ও অনুবাদক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির