post

খেমার রোজ ও কম্বোডিয়া গণহত্যা

গোলাপ মুনীর

২১ মার্চ ২০২১

দেশটি সরকারিভাবে কখনো কম্বোডিয়া, আবার কখনো কম্পোচিয়া নামে পরিচিত হয়েছে। বর্তমানে এর সরকার স্বীকৃত নাম ‘কিংডম অব কম্বোডিয়া’। দক্ষিণ-পূর্ব এই দেশটির আয়তন ৬৯,৮৯৮ বর্গমাইল। এর উত্তর-পশ্চিমে থাইল্যান্ড, উত্তর-পূর্বে লাওস, পূর্বে ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ-পশ্চিমে থাইল্যান্ড উপসাগর। এর লোকসংখ্যা ১ কোটি ৬৪ লাখ ৮০ হাজার। ৯৭ শতাংশই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। রাষ্ট্রধর্ম বৌদ্ধ। এর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে ভিয়েতনাম ও চীনা বংশোদ্ভূত, চেম মুসলমান ও ৩০টি পাহাড়ি উপজাতি। এখানে কার্যকর রয়েছে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। সেখানে একজন রাজা রয়েছেন। তবে সরকারপ্রধান হচ্ছেন একজন প্রধানমন্ত্রী। তিনি রাজ পরিবারের বাইরের একজন নেতা। ১৯৮৫ সালে সেখানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে হুনসেন কম্বোডিয়া শাসন করে আসছেন। কমিউনিস্ট পার্টি অব কম্পোচিয়া (সিপিকে) সমধিক পরিচিত খেমার রোজ নামে। এরা কম্বোডিয়া শাসন করে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত। ১৯৫১ সালে সিপিকের সূচনা। এটি কার্যকর থাকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত। এর নেতা ছিলেন পলপট। সদর দফতর ছিল কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত এর রাজনৈতিক আদর্শ ছিল কমিউনিজম, পরবর্তী সময়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। ১৯৬০-এর দশকে ‘খেমার রোজ’ নামটির সূচনা করেন নরদম সিহানুক। তিনি তার দেশের ভিন্ন মতাবলম্বী কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বর্ণনা করতে এই নামটি ব্যবহার করেন। তিনি ১৯৭০ সালে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পর এদের সাথে জোট গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৬০-এর দশকে খেমার রোজ সেনাবাহিনী ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে পূর্বাঞ্চলীয় কম্বোডিয়া জঙ্গল এলাকায়। আর এতে সহযোগিতা জোগায় উত্তর ভিয়েতনামের সেনাবাহিনী, ভিয়েতকং, প্যাথেট লাও এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)। ভিয়েতকং আবার পরিচিত ‘ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অব ভিয়েতনাম’ (এনএলএফ) নামেও। এটি দক্ষিণ ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার কমিউনিস্ট রাজনীতির এক সশস্ত্র বিপ্লব। এর সামরিক শাখার নাম ‘লিবারেশন আর্মি অব সাউথ ভিয়েতনাম।’ (এলএএসভি) ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়ে এরা বিজয়ী হয়। এলএএসএভির গেরিলা ইউনিটের পাশাপাশি এর নিয়মিত সামরিক ইউনিটও ছিল। সেই সাথে ছিল একটি দলীয় ক্যাডার নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কের ক্যাডাররা কৃষকদের সংগঠিত করত। অপরদিকে ‘প্যাথেট লাও’ ছিল লাওসের মধ্য-বিংশ শতাব্দীর একটি রাজনৈতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন ও সংগঠন। এর আনুষ্ঠানিক নাম ছিল ‘লাও পিপল’স লিবারেশন আর্মি’। লাওসের গৃহযুদ্ধের পর এই গোষ্ঠী ১৯৭৫ সালে ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হয়। প্যাথেট লাও সব সময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে ভিয়েতনামি কমিউনিস্টদের সাথে। গৃহযুদ্ধের সময় এটি কার্যকরভাবে সংগঠিত, সুসজ্জিত এবং এমনকি পরিচালিত হয় ‘পিপল’স আর্মি অব ভিয়েতনামের মাধ্যমে। এরা লড়াই করেছে ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট-বিরোধীদের বিপরীতে। এ সময় এদের জেনেরিক নাম হয়ে ওঠে লাওশিয়ান কমিউনিস্ট। এই কমিউনিস্ট আন্দোলনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা আসত চীন থেকে। মাও সেতুংয়ের আদেশে ‘পিপল’স লিবারেশন আর্মিকে দেয়া হয় ১১৫,০০০টি বন্দুক, ৯২০,০০০টি গ্রেনেড ও ১৭ কোটি বুলেট। প্রশিক্ষণ দেয়া হয় ৭ শতাধিক সামরিক কর্মকর্তাকে। পলপট ও খেমার রোজ যে বিদেশী সহয়তা পেতো, এর ৯০ শতাংশই আসতো চীন থেকে। এরা শুধু ১৯৭৫ সালেই ১০০ কোটি ডলারের আর্থিক ও সামরিক সহায়তা পায় চীন থেকে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পরামর্শে খেমার রোজ প্রথম দিকে লড়াই করেছে সিহানুক সরকারের বিরুদ্ধ। ১৯৭০ সালে এক অভ্যুত্থানে সিহানুককে ক্ষমতাচ্যুত করে কম্বোডিয়ায় ক্ষমতায় আসেন লন নল। লন নল প্রতিষ্ঠা করেন আমেরিকা-পন্থী খেমার প্রজাতন্ত্র। তখন খেমার রোজের অবস্থান পরিবর্তন করে ক্ষমতাচ্যুত সিহানুককে সমর্থন দেয়। আমেরিকার ব্যাপক বোমাবাজি অভিযানের পরও কম্বোডিয়ার গৃহযুদ্ধে খেমার রোজ বিজয়ী হয়। এরা কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন দখল করে ১৯৭৫ সালে। এর পরপরই পলপটের নেতৃত্বাধীন খেমার রোজ জোর করে দেশটির বড় বড় শহরগুলো থেকে লোকজন বিতাড়িত করে পাঠায় বাধ্যতামূলক শ্রমশিবিরে। ১৯৭৬ সালে দেশটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘গণতান্ত্রিক কম্পোচিয়া’। খেমার রোজ সরকার ছিল অতিমাত্রিক অটোক্র্যাটিক, টোটালিটারিয়ান, জেনোফোবিক, প্যারানয়েড ও রিপ্রেসিভ। অন্য কথায় এরা ছিল স্বৈরতান্ত্রিক, সামগ্রিক কর্তৃত্ববাদী, বিদেশীদের প্রতি প্রবল ঘৃণার মনোভাব পোষণকারী, নির্যাতনে বদ্ধমূল বিশ্বাসী ও ভিন্নমতাবলম্বী নিপীড়ক। খেমার রোজ সরকারের সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পলিসি ও Maha Lout Ploh-এর কারণে কম্বোডিয়ায় প্রচুর লোকক্ষয় ঘটে। Maha Lout Ploh চীনের Great Leap Forward-এর কম্বোডীয় সংস্করণ। এটি ছিল খেমার রোজ সরকারের ইকোনমিক পলিসি। এ নীতি অবলম্বন করে কম্বোডিয়াকে কার্যত পরিণত করা হয় মোবাইল তথা ভাসমান শ্রমিকের দেশে। এ নীতির কারণেই চীনে মহাদুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। খেমার রোজও চীনের মতো একই ধরনের কালেক্টিভিজম বা যৌথবাদের আওতায় যৌথ চাষাবাদের কৃষি-সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। এর ফলে কম্বোডিয়ায়ও ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এ নীতির আওতায় চলে সব ক্ষেত্রে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের ভ্রান্ত প্রয়াস। এ কারণে দেশটিতে চিকিৎসাযোগ্য রোগের অনেক ওষুধের অভাব দেখা দেয়। এর ফলে প্রচুর লোক চিকিৎসা না পেয়েই মারা যায়। তা ছাড়া খেমার রোজ যাদেরকেই তাদের রাজনীতির মতের বিরোধী বলে সন্দেহ করেছে, তাদেরকেই হত্যা করেছে। তাদের ফ্যাসিবাদী আচরণের কারণে দেশটির অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় গণহত্যার শিকার হয়েছে। এর ক্যাডাররা এলোপাতাড়ি সন্দেহভাজন প্রতিপক্ষ নির্যাতনে অংশ নিতো। এমনকি তথাকথিত কমিউনিস্ট শুদ্ধি-অভিযানে তাদের দলের অনেকেই এই সন্দেহের কারণে গণহত্যার শিকার হয়েছে। এই অভিযান চলে ১৯৭৫-৭৮ সাল পর্যন্ত সময়ে। এ সময়ে লাখ লাখ কম্বোডীয় প্রাণ হারায়। এক পরিসংখ্যানের মতে, তখন দেশটির ২৫ শতাংশ লোক খেমার রোজের হাতে প্রাণ হারায়। ১৯৭০-এর দশকে খেমার রোজ ব্যাপক সমর্থন ও অর্থ-সহায়তা পেয়েছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি থেকে। এতে অনুমোদন ছিল মাও সেতুংয়ের। একটি সূত্র মতে, খেমার রোজ যে বিদেশী সাহায্য পেত, তার ৯০ শতাংশই আসত চীন থেকে। ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনাম কম্বোডিয়ায় ঢুকে পড়ে খেমার রোজ বাহিনীর ব্যাপক ধ্বংস সাধন করে। তখনই খেমার রোজ সরকারের পতন ঘটে। খেমার রোজ তখন পালিয়ে যায় থাইল্যান্ডে। থাইল্যান্ডের সরকার খেমার রোজকে দেখে কমিউনিস্ট ভিয়েতনামিদের বিরুদ্ধে এক ‘বাফার বাহিনী’ হিসেবে। খেমার রোজ ভিয়েতনামি ও নয়া গণপ্রজাতন্ত্রী কম্পোচিয়া সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। তাদের এই যুদ্ধ চলে ১৯৮৯ সালে এ যুদ্ধের অবসানের আগ পর্যন্ত। প্রবাসী কম্বোডিয়ান সরকার ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক সমর্থন নিয়ে জাতিসঙ্ঘে এর আসনটি ধরে রাখে। সে সময়টায় কম্বোডিয়া রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছিল কিংডম অব কম্বোডিয়া। এর এক বছর পর হাজার হাজার খেমার রোজ গেরিলা সরকারের সাধারণ ক্ষমার আওতায় সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। আইয়েং স্যারি ছিলেন খেমার রোজের ডেপুটি লিডার। তাকেও সাধারণ ক্ষমা দেয়া হয়। তিনি ১৯৯৬ সালে ‘ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল ইউনিয়ন মুভমেন্ট’ নামের একটি নয়া রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৯৯ সালে সংগঠনটির পুরোপুরি অবসান ঘটে। ২০১৪ সালে জাতিসঙ্ঘ-সমর্থিত একটি আদালত খেমার রোজের দুই নেতা নুওন চিয়া ও খিউ সাম্ফানকে জাতিসংঘ-সমর্থিত একটি আন্তর্জাতিক আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। তাদেরকে খেমার রোজের পরিচালিত গণহত্যায় তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে এই সাজা দেয়া হয়। এবার ফিরে যাওয়া যাক কম্বোডিয়ার খেমার রোজ কমিউনিস্টদের কলঙ্কজনক অধ্যায় ‘কম্বোডিয়া জেনোসাইড’ প্রসঙ্গে। কম্বোডিয়া জেনোসাইড ছিল মূলত খেমার রোজ কমিউনিস্টদের পরিচালিত কমিউনিস্টবিরোধী কম্বোডিয়দের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পিত এক হত্যাযজ্ঞ। আর এর নেতৃত্ব দেন কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি পলপট। তিনি বৈপ্লবিকভাবে কম্বোডিয়াকে ঠেলে দেন কমিউনিজমের দিকে। আগেই জেনেছি, খেমার রোজ কমিউনিস্টরা কম্বোডিয়ায় ক্ষমতায় ছিল ১৯৭৫-১৯৭৯ পর্যন্ত সময়ে। খেমার রোজ সরকারের ৫ বছর সময়ে পরিচালিত গণহত্যার শিকার হয় দেশটির ২৫ শতাংশ মানুষ। তাদের পরিচালিত গণহত্যা ইতিহাসে ঠাঁই নিয়েছে ‘কম্বোডিয়া জেনোসাইড’ নামে। ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ক্ষমতা দখলের পর খেমার রোজ সরকার দেশটিকে একটি সমাজতান্ত্রিক কৃষি-প্রজাতন্ত্রে পরিণত করতে চায়। যার ভিত্তি চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবে অনুপ্রাণিত আল্ট্রা-মাওইজম বা অতি-মাওবাদ। পলপট ও অন্যান্য খেমার রোজ সরকারের কর্মকর্তারা চীন সফরে গিয়ে বেইজিংয়ে মাও সেতুংয়ের সাথে সাক্ষাৎ করে তার পরামর্শ নেন। এর পর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য ঝেং চুংগিয়াও কম্বোডিয়া সফরে গিয়ে সহায়তার প্রস্তাব দেন। খেমার রোজ এর লক্ষ্য পূরণে শহরগুলো থেকে লোকদের জোরজবরদস্তি করে বাধ্যতামূলক শ্রমশিবিরে পাঠানো শুরু করে। যারা তাতে আপত্তি তুলেছে, তাদের কমিউনিস্টবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন চলেছে, অনেককে পেতে হয়েছে মৃত্যুর স্বাদ। শ্রমশিবিরেও লোকজন শারীরিক নির্যাতন, অপুষ্টি ও ব্যাপক রোগশোকের শিকার হয়ে মারা গেছে। ১৯৭৬ সালে এরা দেশটির নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেয় ‘ডেমোক্র্যাটিক কম্পোচিয়া’। অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন জাগে, এ কোন ‘ডেমোক্র্যাটিক নর্ম’ তাদের তথাকথিত ডেমোক্র্যাটিক কম্পোচিয়ায়। এই গণহত্যা প্রক্রিয়ার অবসান ঘটে ১৯৭৯ সালে, যখন ভিয়েতনামের সেনাবাহিনী কম্বোডিয়ায় ঢুকে খেমার রোজ সরকারকে উৎখাত করে। ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে দেখা গেল এরই মধ্যে খেমার রোজের অবলম্বিত নীতির কারণে ১৫ থেকে ২৫ লক্ষ লোক মারা গেছে। এদের মধ্যে রয়েছে ২ লাখ থেকে ৩ লাখ চীনা কম্বোডীয়, ৯০ হাজার মুসলমান ও ২০ ভিয়েতনামি কম্বোডীয়। নমপেনের কাছের একটি মাধ্যমিক স্কুলে গড়ে তোলা ‘সিকিউরিটি প্রিজন ২১’-এ মারা যায় ২০ হাজার লোক, যাদের মধ্যে বেঁচে যায় মাত্র ৭ জন বুড়ো লোক। ‘প্রিজন ২১’ ছিল খেমার রোজ পরিচালিত ১৯৬টি প্রিজনের একটি। এসব প্রিজনে আটক ব্যক্তিদের নিয়ে যাওয়া হতো কিলিং ফিল্ডে, যেখানে তাদের হত্যা করা হতো বুলেট বাঁচানোর জন্য পিকএক্স নামের এক ধরনের কুড়াল দিয়ে আঘাত করে। এরপর তাদের দেয়া হতো গণকবর। তখন শিশু অপহরণ ও মগজধোলাই চলতো ব্যাপক হারে। এদের অনেককে লাগানো হতো নানা ধরনের নৃশংস কাজে। ২০০৯ সালে ‘ডকুমেন্টেশন সেন্টার অব কম্বোডিয়া’ চিহ্নিত করে ২৩,৭৪৫টি গণকবর। এতে কবর দেয়া হয় কমপক্ষে ১৩ লাখ সন্দেহভাজন কমিউনিস্টবিরোধীকে। এই গণহত্যার যারা শিকার হয়েছে, তাদের ৬০ শতাংশই সরাসরি হত্যার শিকার। বাকিরা মারা গেছে না খেতে পেয়ে, রোগেশোকে ভোগে কিংবা চরম পরিশ্রান্তির কারণে। এ গণহত্যার কারণে দ্বিতীয়বারের মতো শুরু হয় শরণার্থীদের দেশান্তরী হওয়া। অনেকে প্রাণে বেঁচে যায় পাশের দেশ ভিয়েনামে গিয়ে। এর চেয়ে কিছুটা কম সংখ্যায় থাইল্যান্ডে পালিয়ে যায়। ১৯৭৯ সালে কম্বোডিয়ায় ঢুকে জানুয়ারির দিকে খেমার রোজ সরকারকে উৎখাত করে। এর ২২ বছর পর ২০০১ সালে ২ জানুয়ারি কম্বোডিয়ার সরকার গঠন করে খেমার রোজ ট্রাইব্যুনাল। উদ্দেশ্য, খেমার রোজ সদস্য ও নেতাদের মধ্যে যারা কম্বোডিয়া গণহত্যার সাথে জড়িত ছিলেন তাদের বিচারের আওতায় আনা। ট্রাইব্যুনাল কাজ শুরু করে ২০০৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। ২০১৪ সালের ৭ আগস্টে নুওন চিয়া এবং খিউ সাম্ফানকে এই গণহত্যার সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। কেন এই গণহত্যা? কোন আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য খেমার রোজের এই নির্বিচার গণহত্যা। আমরা জানি, ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তাদের বিবৃত রাজনৈতিক আদর্শ ছিল কমিউনিজম। এর পরবর্তী সময়ে এরা বলতো, তাদের রাজনৈতিক আদর্শ হচ্ছে: মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। আর যেহেতু কম্বোডিয়ার আলোচ্য গণহত্যা ঘটেছে ১৯৭৫-১৯৭৯ সময়ে, তাই নিশ্চিত ধরে নেয়া যায়, কমিউনিস্ট আইডিওলজি বাস্তবায়নই ছিল এই গণহত্যা পরিচালনার মুখ্য উদ্দেশ্য। যে রাজনৈতিক আদর্শ বাস্তবায়নের উপায় হিসেবে গণহত্যাকে বেছে নেয়া হয়, সে ধরনের কোনো রাজনৈতিক আদর্শ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। পলপট ছিলেন একজন কমিউনিস্ট। তিনি মার্কসবাদ-লেনিনবাদে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন পুরোপুরি আত্মনির্ভরশীল কৃষিসমাজ, যাতে থাকবে না কোনো বিদেশী প্রভাব। স্ট্যালিনের কর্ম বর্ণিত হয়েছে পলপটের চিন্তাধারার ওপর একটি ‘ক্রুসিয়াল ফরমেটিভ ইনফ্লুয়েন্স’ হিসেবে। মাও-এর কর্মও তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, বিশেষ করে ‘অন নিউ ডেমোক্র্যাসি’র প্রভাব। ইতিহাসবেত্তা ড্যাভিড চ্যান্ডলারের মতে, জিন জ্যাক রুশো ছিলেন তার প্রিয় লেখকদের একজন। ১৯৬০-এর দশকে পলপট মার্কসবাদ-লেনিনবাদ সম্পর্কিত তার ধারণার নতুন করে সূত্রায়িত করেন, যাতে তা কম্বোডিয়ার পরিস্থিতি ও তার লক্ষ্যের সাথে খাপ খায়। তার লক্ষ্যগুলো ছিল: কম্বোডিয়াকে অতীত রূপকথার ক্ষমতাধর ‘খেমার সা¤্রাজ্য’ হিসেবে ফিরিয়ে আনা, বিদেশী সাহায্য ও পশ্চিমা সংস্কৃতির দুষ্ট প্রভাব দূর করা, এবং কৃষিনির্ভর সমাজ পুনরুদ্ধার। কৃষিভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার ব্যাপারে পলপটের সুদৃঢ় বিশ্বাস জন্ম নিয়েছিল কম্বোডিয়ার উত্তর-পূর্বে গ্রাম এলাকার এক নৃ-গোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা থেকে। সেখানে যখন খেমার রোজ ক্ষমতায় এলো, তখন সেখানকার বিচ্ছিন্ন স্বয়ংসম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর উপজাতীয়দের সাথে পলপট ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেন। এসব লক্ষ্য পূরণের পদক্ষেপগুলো যখন একটি ছোট্ট গ্রামীণ সমাজ থেকে বৃহত্তর সমাজে নিয়ে যাওয়া হয়, তখনই তা জোরজবরদস্তি আরোপের প্রয়োজন দেখা দেয়, এরই জের কম্বোডিয়ার গণহত্যা। খেমার রোজ নেতারা বলতে থাকেন, এই হত্যার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে পরিশুদ্ধি আনা হবে। খেমার রোজ জোরজবরদস্তি করে কার্যত পুরো দেশটিকেই পরিণত করে একটি মোবাইল শ্রমিক টিমে। মাইকেল হান্ট লিখে জানিয়েছেন: ‘এটি ছিল সোশ্যাল মোভিলাইজেশনের এমন এক পরীক্ষা, যা বিংশ শতাব্দীর কোনো বিপ্লবের সাথে মিলে না।’ খেমার রোজ প্রশাসন চালু করে অমানবিক ‘বাধ্যতামূলক শ্রমের’ শাসনব্যবস্থা। জোর করে লোকজনকে স্থানান্তর ও যৌথ চাষাবাদ চালু করা হয়। এ জন্য সরকার রীতিমতো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নীতি অবলম্বন বরে। খেমার রোজ সরকারের অর্থনৈতিক নীতি অভিহিত থাকে Maha Lout Ploh, যা সরাসরি চীনের এGreat Leap Forward -এরই পরোক্ষ কম্বোডীয় সংস্করণ। চীনে এর ফলে সৃষ্ট মহাদুর্ভিক্ষে মারা যায় লাখ লাখ মানুষ। ড. কেনেথ এম. কুইন র‌্যাডিক্যাল পলপটের ও খেমার রোজের গণহত্যা নীতি সম্পর্কে সর্বপ্রথম তার লিখিত একটি ডক্টরাল ডিসারটেশনে উল্লেখ করেন। তিনি বর্তমানে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট। এর আগে তিনি ১৯৭৩-৭৪ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের ক্যারিয়ার ডিপ্লোমেট হিসেবে ৯ মাস দায়িত্ব পালন করেন ভিয়েতনাম সীমান্ত এলাকায়। সে সময় তিনি অসংখ্য কম্বোডীয় শরণার্থীর সাক্ষাৎকার নেন, যারা খেমার রোজ বাহিনীর অত্যাচারে দেশ ছেড়ে ভিয়েতনামে গিয়ে শরণার্থী হয়। সাক্ষাৎকারগুলো ও যেসব অত্যাচার নিপীড়ন তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তার ওপর ভিত্তি করে ড. কুইন ৪০ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট লিখে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিভিন্ন জায়গায় পাঠান। এই রিপোর্টে তিনি উল্লেখ করেন- খেমার রোজের আচরণ অনেকটা নাৎসি জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অনুরূপ। ড. কুইন খেমার রোজ ১৯৭০-এর দশকে কম্বোডিয়া জুড়ে যে সন্ত্রাস ও ভীতি ছড়িয়ে দিয়েছিল, তার ব্যাখ্যাও তুলে ধরেন। কারা প্রধানত খেমার রোজের এই গণহত্যা আর নির্য়াতন নিপীড়নের শিকারে পরিণত হয়েছিল? খেমার রোজ যখনই কাউকে সন্দেহ করেছে, মনে করেছে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সাবেক কম্বোডিয়া সরকার অথবা বিদেশী কোনো সরকারের সাথে, তখনই তাকে গ্রেফতার করে নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে কিংবা হত্যা করেছে। তাদের টার্গেট ছিল বুদ্ধিজীবী, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, চেম মুসলমান, ভিয়েতনামি নৃ-গোষ্ঠী, থাই-নৃগোষ্ঠী ও অন্যান্য সংখ্যালঘু নৃ-গোষ্ঠী। খেমার রোজ ডিক্রি জারি করে নিষিদ্ধ করে ২০টি সংখ্যালঘু নৃ-গোষ্ঠীর অস্তিত্ব, যারা ছিল দেশটির মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ। খেমার রোজ প্রথম দিকে ভিয়েতনামি নৃ-গেীকে ব্যাপকভাবে বহিষ্কার করে। এরপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় তাদের ওপর, যারা ভিয়েতনামে পালিয়ে যাচ্ছিল। শেষ দিকে ২০ হাজার ভিয়েতনামিকে আর পালিয়ে যেতে দেয়নি। এদের বেশির ভাগকেই হত্যা করা হয়। খেমার রোজ তাদের গণহত্যার লক্ষ্য বাস্তবায়নে গণমাধ্যমকেও ব্যবহার করে। এরা নমপেন রেডিওর মাধ্যমে কম্বোডিয়ানদের প্রতি আহ্বান জানায় ভিয়েতনামিদের কম্বোডিয়ায় নিঃশেষ করে দিতে। এ ছাড়া খেমার রোজ সীমান্ত অতিক্রম করে অনেক হামলা চালায় ভিয়েতনামে। এসব হামলায় হত্যা করা হয় ৩০ হাজার বেসামরিক ভিয়েতনামিকে। সবিশেষ উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে পরিচালিত ‘বা চুক ম্যাসাকারে’র সময় খেমার রোজ সৈন্যরা ভিয়েতনাম সীমান্ত অতিক্রম করে গ্রামে ঢুকে ৩,১৫৭ জন ভিয়েতনামি গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এর জের ধরে বাধে কম্বোডিয়া-ভিয়েতনাম যুদ্ধ, শেষ পর্যন্ত সে যুদ্ধে খেমার রোজ পরাজয় বরণ করে। তখন চীনা বংশোদ্ভূত কম্বোডিয়ানরাও খেমার রোজের হত্যা আর নিপীড়নের শিকার হয়। তবে বেশি হত্যা ও নিপীড়নের শিকার হয় কম্বোডীয় চেম মুসলমান জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা। কারণ, এরা ইসলামকে বিবেচনা করে বিদেশী ধর্ম হিসেবে। সেইসাথে এরা মনে করে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলমানেরা নয়া কমিউনিস্ট-ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির অংশ হতে পারে না। প্রথম দিকে মুসলমানদের জোর করে এক জায়গায় সমবেত করা হয়। পলপট এর পর তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করা শুরু করেন। প্রথম দিকে গ্রামের প্রবীণদের হত্যা করা হয়। এর পরই শুরু হয় ব্যাপক গণহত্যা। আমেরিকান অধ্যাপক স্যামুয়েল টোটেন ও অস্ট্রেলীয় অধ্যাপক পল আর. বার্ট্রপের অভিমত- ১৯৭৯ সালের খেমার রোজ সরকারের পতন না ঘটলে কম্বোডিয়ায় চেম মুসলমানদের একটি প্রাণীও সেখানে অবশিষ্ট থাকতো না। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির