post

জাতীয় বাজেট ২০১১

১৪ জুলাই ২০১১

আজহারুল ইসলাম

৯ জুন বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় অর্থমন্ত্রী ২০১০-১১ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে ৪০তম এবং মহাজোট সরকারের তৃতীয় বাজেট। নির্বাচিত সরকারের জন্য এবারের বাজেট অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জনগণকে যে স্বপ্ন দেখিয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছিল-জনগণ তার বাস্তবায়ন চায়। তাই প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার এবারের বাজেটে থাকতে হবে। আসলে হয়েছেও তাই, বাজেটে বিশাল আয়-ব্যয়ের পরিমাণ সেটাই প্রমাণ করে। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেখা গেছে উচ্চাকাক্সক্ষা। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ শতাংশ। যেখানে দেশের জনগণ মূল্যস্ফীতির চাপে আক্রান্ত সেখানে মূল্যস্ফীতি ৭.৫ শতাংশে কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশাল ঘাটতি বাজেট যেখানে রয়েছে এবং তা পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎসের দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এতে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমবে। অন্য দিকে  বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে অনিশ্চয়তা। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ঘাটতিসহ আরও অনেক ঝুঁকির মাঝে নিমজ্জিত আমাদের অর্থনীতি। এসব ঝুঁকির কথা অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা থেকেই স্পষ্ট। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আগামী ২০১১-১২ অর্থবছর অনিশ্চয়তার বছর। ঝুঁকিপূর্ণ বছর। সব ধরনের ঝুঁকি মোকাবেলা করে বাজেট বাস্তবায়ন করাটাই চ্যালেঞ্জ। জনগণের প্রত্যাশা থাকবে দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মাঝে থাকবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, নিয়মিত গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি পাবে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য সেবা সঠিকভাবে পাবে, দারিদ্র্য বিমোচন করে সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান করা হবে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, যাতে করে কেউ কোন দিক থেকে বঞ্চনার শিকার না হয়। এসব প্রত্যাশা পূরণে সরকারকে সদা সচেষ্ট থাকতে হবে।

২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটের উল্লেখযোগ্য দিকসমূহ

লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, রেমিট্যান্সপ্রবাহে ধীরগতি, বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক গোলযোগ এবং বিনিয়োগ মন্থর হওয়া সত্ত্বেও বাজেটে ব্যয়, প্রবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির ক্ষেত্রে উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এবারের বাজেটে মোট ব্যয় ধরা হয় ১,৬৩,৫৮৯ কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় ২৬ শতাংশ বেশি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৭ শতাংশ, যা ২০১০-১১ অর্থবছরে ৬.৭ শতাংশ অর্জিত হওয়ার কথা বলা হয়। অর্থমন্ত্রীর ভাষায় ‘আমরা যদি সম্ভাব্য অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অভিজাত যথাযথভাবে মোকাবেলা করতে পারি তাহলে আগামী অর্থবছরে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে উন্নীত হবে।’ এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ যে বিষয়গুলো কাজ করেছে তা হলো বিশ্ব বাণিজ্যের গতি ফিরে আসা, রফতানি বাণিজ্যে সুদৃঢ় অবস্থান, রাজস্ব আহরণে সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি, কৃষি খাতে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি এবং মেয়াদি শিল্পঋণের উচ্চ প্রবৃদ্ধি। অর্থমন্ত্রী মনে করেন, এ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে মূলত তিনটি খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে- তা হলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, যোগাযোগ অবকাঠামো এবং কৃষি খাত। মুদ্রাস্ফীতি ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা ৭.৫ এ নামিয়ে আনা। মুদ্রাস্ফীতির ক্ষেত্রে বলা হয়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৩ শতাংশ। চলতি ২০১০-১১ অর্থবছরে এপ্রিল মাসে পয়েন্ট-টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০.৭ শতাংশে এবং চলতি অর্থবছরে ১০ মাসে গড় হিসেবে এর হার ৮.৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অভিঘাত মোকবেলার কথা বলা হয়। মূল্যস্ফীতির যে ঊর্ধ্বগতি তা যদি কমানো না যায় তাহলে নিম্নআয়ের মানুষ, মধ্য-আয়ের মানুষ এবং নির্দিষ্ট আয়ের অধিকারীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, অন্য দিকে কৃষিতে ভর্তুকি কমানোর পরও মূল্যস্ফীতি কমানো কঠিন ব্যাপার।

বাজেটের কাঠামো

বাজেটে আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়। আয়-ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করে সেগুলো কোন কোন খাত থেকে হবে তাও পরিকল্পিত।

আয়-ব্যয় এবং ঘাটতি সব দিক থেকেই এবারের বাজেট বিশাল বাজেট। ব্যয়ের দিক থেকে এবারের বাজেট গত বারের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি। ঘাটতির পরিমাণও ৩০ শতাংশ বেশি। সব মিলিয়ে অর্থনীতিবিদগণ মনে করছেন- বাজেট বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জস্বরূপ।

আয়ের উৎসকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। রাজস্ব প্রাপ্তি এবং ঘাটতি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত কর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডবহির্ভূত এবং কর ব্যতীত প্রাপ্ত আয় ১,১৮,৩৮৫ কোটি টাকা। বাজেটে আয়ের উৎসসমূহের মাঝে রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক প্রাপ্ত আয়কেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ‘সরকারের করনীতি কেবল সর্বোচ্চ পরিমাণে আদায়ের লক্ষ্যাভিমুখী নয় বরং বিনিয়োগ বৃদ্ধি, নতুন নতুন শিল্প কল-কারখনা স্থাপনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান, জনগণের জীবনমান উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।’ অথচ এ কর জিডিপির অনুপাত মাত্র ৯.৩ শতাংশ। তাই রাজস্ব আহরণে গতিশীলতার লক্ষ্যে, আগামী ২০১৬ সালে মাঝে কর জিডিপির অনুপাত শতকরা ১৩ ভাগে উন্নীত করণে রাজস্ব বোর্ডের সংস্কারে মনোযোগ দেয়া হয়েছে। তা ছাড়া অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) এর ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। অন্য দিকে ঘাটতি বাজেটে রয়েছে অভ্যন্তরীণ ঋণ, বৈদেশিক ঋণ এবং বৈদেশিক অনুদান। বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ৪৫,২০৪ কোটি টাকা যা বাজেটের ২৭.৬ শতাংশ এবং জিডিপির ৫ শতাংশ। ঘাটতি বাজেট পূরণ করা হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিয়ে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মাঝে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ (নিট) ১৮,৯৫৭ কোটি টাকা এবং ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ (নিট) ৮,২৫১ কোটি টাকা নেয়া হবে।

সরকারকে বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট বাজেটের ১৬.৬ শতাংশ ঋণ নিতে হবে, যা মোট ঘাটতির ৬০ শতাংশ। অর্থাৎ ঘাটতি বাজেটের একটা বড় অংশ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া হবে। এতে করে ঋণের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ঋণের সুদ বাড়বে এবং ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ কমে যাবে (ঈৎড়ফিরহমড়ঁঃ ঊভভবপঃ)। এতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমবে। অন্য যে দু’টি উৎস থেকে ঘাটতি বাজেট পূরণ করা হবে তাহলো - বৈদেশিক ঋণ এবং অনুদান। আর এটা বাজেটের ৮ শতাংশ। অর্থনৈতিক মন্দার পর উন্নত দেশগুলোর বিলম্বে প্রবৃদ্ধির ধারায় ফেরা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং জাপানে সুনামি ও ভূমিকম্প, এসব ঝুঁকিপূর্ণ অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভর করবে আমাদের বৈদেশিক ঋণ অনুদান পাওয়া। তা ছাড়া এসব ঋণের পেছনে দাতাগোষ্ঠীর লাগামহীন শর্তাবলি ঋণের সঠিক ব্যবহারকে বাধাগ্রস্ত করে। বাজেটের ব্যয়ের আকার অনেক বড় হওয়াতে স্বাভাবিকভাবেই অর্থায়নের জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে রাজস্ব আয় এবং বৈদেশিক ঋণের ওপর। তাই রাজস্ব আয় এবং বৈদেশিক ঋণ পরিমাণ মত না হলে বাজেট বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

ব্যয়ের খাতসমূহ

শিক্ষা ও প্রযুক্তি ১২.৪%, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ৫.১%, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ৭.৫%, পরিবহন ও যোগাযোগ ৬.৯%, সুদ ১১%, স্বাস্থ্য ৫.৪%, কৃষি ৭.৭%, প্রতিরক্ষা ৭.৩%, জনপ্রশাসন ১৪.৬%, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ ৬.৮%, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ৫.২%, গৃহায়ন ০.৯%, বিনোদন সংস্কৃতি ও ধর্ম ১.০%, শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিস ০.৮%, বিবিধ ব্যয় ৭.৪%,।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত

অতি পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের অপর্যাপ্ততা এবং সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা ত্র“টিপূর্ণ এসব সমস্যার কথা সামনে রেখেই বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের মাঝে ব্যবধান কমানোর কথা বলা হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বাতি জনগণের মাঝে বিতরণ ভালো দিক।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে আবার অন্য দিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ঝুঁকির কথা অকপটে স্বীকার করা হয়েছে। যেমন : ‘নতুন কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বিকল্প জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ বেশি পড়বে। এতে অতিরিক্ত যে অর্থের প্রয়োজন হবে তা মেটাতে ভর্তুকি ও বিক্রয়মূল্য পুনর্বিন্যাস করে।’ (ধারা নং : ৪৭)

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিজনিত অভিঘাত মোকাবেলার জন্য আমাদের সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। যেমন - হয়তো বেশ কিছু অপ্রিয় সিদ্ধান্ত আমাদের নিতে হবে পারে।

১. ভর্তুকিসহ কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যয় হ্রাস ২. প্রয়োজনে কৃচ্ছ্রসাধন, ৩. রাজস্ব আয় বাড়ানো, ৪. মুদ্রা সরবরাহ ও ব্যক্তি খাতে ঋণ সরবরাহ কমানো এবং ৫. বিনিময় হারের যথাযথ বিন্যাস করা।’ (৩৮ নং ধারা)

এসব থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি আমাদের জন্য কতটা ভয়াবহ। তা ছাড়া বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট ব্যবহার স্থায়ী সমাধান নয়। স্থায়ীভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা উচিত।

কৃষি খাত

আমাদের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর হওয়ায় বরাবরই এই খাতকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। বিশেষ গুরুত্বের কারণেই এতে পর্যাপ্ত ভর্তুকির ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এবারের বাজেটে এর ব্যতিক্রম ঘটে যার ফলে সার ও অন্যান্য কৃষি উৎপাদন উপকরণের দাম বেড়ে যায়।

অর্থবছর     পরিমাণ (কোটি টাকা)

২০০৯-১০    ৪৮৯২

২০১০-১১    ৫৭০০

২০১১-১২    ৪৫০০

গত তিন বছরের বাজেটে এবারই কৃষিতে কম ভর্তুকির প্রস্তাব করা হয়েছে। কৃষকদের ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, তাদের মাঝে ঋণ বিতরণ, কৃষিনীতি প্রণয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকার সফলতা দেখালেও কৃষকেরা তাদের ফসলের ন্যায্যমূল্য পাননি। কৃষিঋণের লক্ষ্যমাত্রা আগের চেয়ে বাড়িয়ে ১৩,৮০০ কোটি টাকা নির্ধারণ এবং প্রথমবারের মত পরীক্ষামূলক শস্যবীমা চালুকরণ ভালো প্রস্তাব।

শিক্ষা খাত

‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া জাতির স্থিতিশীল উন্নয়নের চিন্তা অসাড়।’ তাই দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে শিক্ষা খাতে গুরুত্ব দেয়া অপরিহার্য। প্রস্তাবিত বাজেটে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক থাকলেও বারদ্দ তুলনামূলক কম। এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ১৯,৮৩৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১২.৪ শতাংশ। তাই এ বরাদ্দ আরো বাড়ানো উচিত।

উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দিক হলো- ষষ্ঠ থেকে স্নাতক শ্রেণী পর্যন্ত গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান এবং বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে ‘প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ফাউন্ডেশন’ শিরোনামে সরকারি বেসরকারি অর্থায়নে তহবিল গঠনের প্রস্তাব।

সৃজনশীল প্রতিভা অন্বেষণের লক্ষ্যে ভাষা ও সাহিত্য, গণিত, বিজ্ঞান ও কম্পিউটার বিষয়ে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায় থেকে প্রতিভা অন্বেষণ করার পরিকল্পনা। শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও ইন্টারনেট মডেম সরবরাহের পরিকল্পনা। আরও কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া উচিত। যেমন- তরুণসমাজকে দুর্নীতি, অনাচার ও অপসংস্কৃতির সয়লাব থেকে দূরে রেখে নৈতিক ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে প্রত্যেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা। উপবৃত্তির পরিমাণ ও ব্যাপ্তি বাড়ানোর পাশাপাশি, শিক্ষকের যথাযথ মূল্যায়নের (অর্থনৈতিক ও পারিবারিক অবস্থার বিচারে) ভিত্তিতে প্রার্থী বাছাই করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগদানের জন্য ইউজিসি-এর অধীনে স্বতন্ত্র কমিশন গঠন এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য পৃথক অ্যাকাডেমি স্থাপন করা উচিত। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে উৎসাহ প্রদানের নিমিত্তে কেন্দ্রীয় পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানের ‘উদ্দীপনা’ পুরস্কারের পরিমাণ ও ব্যাপ্তি বাড়ানো উচিত। (যেমন- ৯০ শতাংশ বা তার ওপর পাসকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করে পুরস্কার প্রদান করা।)

দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক নিরাপত্তা

সুবিধাবঞ্চিত, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন, প্রতিবন্ধী তথা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর (ঝধভবঃু হবঃ) এর অধীনে বাজেটে একটা বড় অংশ বরাদ্দ থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় এবারও এ খাতে ২২,৫৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দের সুপারিশ করা হয়। যা মোট বাজেটের ১৩.৭৮ শতাংশ। এর অধীনে বয়স্কভাতা, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত মহিলাদের দুস্থ ভাতা, প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে অসচ্ছল ভাতা, দরিদ্র মহিলাদের মাতৃত্বকালীন ভাতা, পথশিশু ও এতিম অসহায় শিশুদের ভাতা, ভিক্ষাবৃত্তি অবসানে বরাদ্দ, অতিদরিদ্রের কর্মসংস্থানে বরাদ্দের অঙ্গীকার করা হয়। এসব কর্মসূচি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন খুবই জরুরি। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে জীবন ধারণের নিশ্চয়তা সাংবিধানিক অঙ্গীকার। কিন্তু দেখতে হবে, এতে প্রকৃত ব্যক্তি তার প্রাপ্য সুবিধা পাচ্ছে কি না। যদি সেখানে দুর্নীতির সুযোগ থাকে বা প্রকৃত ব্যক্তি কে না দিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া হয় তাহলে এসব কার্যক্রম কোন সুফল বয়ে আনার পরিবর্তে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

ভিক্ষাবৃত্তি নিরসণ ও বস্তিবাসীদের পুনর্বাসন

‘ভিক্ষাবৃত্তি নিরসন এবং ঘরে ফেরা’ কর্মসূচির আওতায় বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনে সরকার প্রতিশ্র“তিবদ্ধ। তারই ফলশ্র“তিতে বাজেটে এসব কর্মসূচিতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়। এসব কর্মসূচি দক্ষতার সাথে বাস্তবায়ন করতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে। তাই সরকারকে আলাদা প্যাকেজ প্রোগ্রামের আওতায় ভিক্ষুক ও বস্তিবাসীদের বর্তমান অবস্থান থেকে উপযুক্ত স্থানে (কর্মস্থলে) প্রেরণ করতে হবে। ভিক্ষুক ও বস্তিবাসীদের কর্মস্থল বা উপযুক্ত স্থান নিম্নরূপ হতে পারে। যেমন- যারা সমাজ থেকে পরিত্যক্ত অথবা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন বা স্বামী কর্তৃৃক পরিত্যক্ত তাদেরকে সমাজে পাঠিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা (ঘরে ফেরা কর্মসূচি)। বাকিদের মাঝে যারা শিশু, কিশোর-অর্থাৎ পড়াশুনা করার উপযুক্ত তাদেরকে বিদ্যালয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনে আলাদা বিদ্যালয় স্থাপন করা, প্রয়োজনে আলাদা বিদ্যালয় স্থাপন করে সকল প্রকার সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষা নিশ্চিত করা। যারা প্রাপ্ত বয়স্ক এবং কাজ করতে সক্ষম তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। যাদের চিকিৎসার প্রয়োজন তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে শিক্ষা অর্জন বা কর্মসংস্থানে স্থানান্তর করা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা, কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সকল ধরনের সেবা প্রদান করা, এতে অক্ষম হলে জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা।

কর্মসংস্থান

দেশের তরুণসমাজকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শক্তি হিসেবে পেতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। বর্তমানে দেশে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্য ২৫ লক্ষ। কর্মসংস্থানের ব্যাপারে বাজেটে বলা হয় ‘গত দু’টি বাজেটে বক্তৃতায় কৃষি ও গ্রামীণ খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রবাসে শ্রমিক প্রেরণের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ প্রদান, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ ও এর সাথে বৃহৎ শিল্পের পশ্চাৎ সংযোগ শিল্প স্থাপন, ঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে আত্মনিয়োজনের ব্যবস্থা এবং অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টির কথা বলেছিলাম।’ প্রশ্ন হলো গত দুই বছরে এসব কর্মসূচি গ্রহণ করার পরও এত বেকার কেন? তাই আরও দক্ষতার সাথে কর্মসংস্থান বাড়ানো চেষ্টা করা উচিত।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান

বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের উপার্জন আমাদের অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়িয়ে অর্থনীতির মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী করে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দার ফলে আমাদের রেমিট্যান্সপ্রবাহে কিছুটা ভাটা পড়ে। তা ছাড়া বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিও অনেকটা দায়ী। এবারের বাজেটে শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে ‘অভিবাসন ও দক্ষতা উন্নয়ন তহবিল’ গঠন করে ১৪০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়। অন্য দিকে বিদেশে যেতে ইচ্ছুকদের ঋণ প্রদান এবং বিদেশ থেকে টাকা পাঠানোসহ প্রবাসীদের সার্বিক কল্যাণে ‘প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়াতে কিছু বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত। যেমন- বিদেশে শ্রমবাজারের সম্প্রসারণ এবং নতুন বাজার অনুসন্ধানের লক্ষ্যে যেসব দেশ শ্রমিক নেয়া বন্ধ রেখেছে তাদের সাথে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা করা। আদম ব্যাপারীর খপ্পর থেকে শ্রমিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে রিক্রুটিং এজেন্সির জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং প্রয়োজনীয় ব্যাপারে সঠিক তথ্যের অবাধ সরবরাহ নিশ্চিত করা। নারীদের বিদেশে পাঠানোর চাইতে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃৃদ্ধি করা।

সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি)

২০১০-১১ অর্থবছরে সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্বে প্রজেক্ট বাস্তবায়নের খাতা শূন্য- বলতে গেলে দরপত্র আহ্বান, দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া শুরু, পরিকল্পনা গ্রহণ বা কোনটার কাজ শুরু হয়েছে। অবস্থা এই হওয়া সত্ত্বেও অর্থমন্ত্রী এই খাত নিয়ে আশাবাদী। তাই এবার নতুন করে পিপিপি খাতে বরাদ্দ দেয়া হয় ৩ হাজার কোটি টাকা। এতে কারিগরি সহায়তার জন্য ১০০ কোটি টাকা এবং বাণিজ্যিকভাবে অলাভজনক কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনসেবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে ‘ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ড’ হিসেবে ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়। বাজেটে পিপিপি সংক্রান্ত নীতিমালা, দক্ষতা ও দ্রুততার সঙ্গে কাজ করার জন্য অফিস স্থাপন করে প্রয়োজনীয় নির্বাহী ও আর্থিক ক্ষমতা দেয়ার কথা বলা হয়। জনশ্র“তি রয়েছে পিপিপি মানে ‘পাবলিক মানি টু প্রাইভেট পকেট’ যদি এমন সম্ভাবনা থাকে তাহলে এটা নিয়ে আরও ভাবার অবকাশ রয়েছে।

পুঁজিবাজার

২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে পুঁজিবাজারে যে মন্দা অবস্থা চলছে তা এখন পর্যন্ত বিদ্যমান। এই মন্দা অবস্থার মাঝে ঘটে গেছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসে বড় বড় পতনসমূহ। একের পর এক সূচকের অস্বাভাবিক পতন, ট্রেডিং বন্ধ, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাহাকার এসব সহ্যসীমার বাইরে চলে যাওয়ায় তারা রাজপথে মিছিল, মিটিং, ভাঙচুর ও অবরোধসহ নানা কর্মসূচি শুরু করে। যা আমাদের অর্থনীতির জন্য মোটেই ভাল নয়। বাজারে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে নেয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। কিন্তু এসব কোন কাজে আসছে না। এবারের বাজেট প্রস্তাবনা উপস্থাপনের পূর্বে বিনিয়োগকারী এবং পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা ধরে নিয়েছিল এতে পুঁজিবাজারের সমস্যা সমাধানকল্পে গুরুত্ব দেয়া হবে, কারসাজির (পতনের) সাথে জড়িত দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আশ্বাস দেয়া হবে যাতে বাজারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে। কিন্তু বাজেট থেকে এসব কিছুই পাওয়া যায়নি। তাই পুঁজিবাজারে মন্দা ভাব এখনও বিদ্যমান। বাজেটে পুরাতন কিছু আশ্বাস নতুন করে উত্থাপন করা হয়। যেমন- বিনিয়োগকারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং কোম্পানি সমূহের প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের লক্ষ্যে ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেট এর প্রতিষ্ঠা করা। স্টক এক্সেচেঞ্জে মালিকানা, ব্যবস্থাপনা ও ট্রেডিং কার্যক্রম পৃৃথক করার লক্ষ্যে এবং পুঁজিবাজারে কারসাজি রোধকল্পে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ এ মালিকানা, ব্যবসা ও ব্যবস্থাপনা পৃথকীকরণ (ঝঃড়পশ ঊীপযধহমব উবসঁঃঁধষরুধঃরড়হ) কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ ফান্ড নামে ৫ হাজার কোটি টাকার মেয়াদহীন মিউচ্যুয়াল ফান্ড গঠন করা হয়েছে। অন্যদিকে নতুন করে শেয়ার মুনাফার ওপর করারোপ করা হয়নি। আসলে এসব আশ্বাস বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাজারে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে- কারসাজির সাথে জড়িতদের শাস্তি প্রদান এবং এতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়মনীতিকে পাশ কাটিয়ে সুযোগ লাভ করা বন্ধ করতে হবে। ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে উত্থানের সময় যে বিষয়গুলো কাজ করেছিল তা হলো- কালো টাকা বিনিয়োগ, ব্যাংকের সীমাতিরিক্ত বিনিয়োগ, শিল্প ঋণ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ, বুক বিল্ডিং পদ্ধতির অপব্যবহার, বিনিয়োগকারীদের আর্থিক ঋণ প্রদান, নানাভাবে পুঁজিবাজার সম্বন্ধে মানুষের মাঝে আশাবাদ জাগানো। এসব কিছুই পুঁজিবাজারের সূচককে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে (অতিমূল্যায়িত) তোলে, যা প্রকৃত অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে মোটেই খাপ খায় না। আর সূচকের অতি মূল্যায়নের উপাদানগুলোকে বলা যেতে পারে- নমনীয়তা (ঋষবীরনরষরঃু) অর্থাৎ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা প্রদানের স্বার্থে নিয়মনীতির ব্যাপারে নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করা। পুঁজিবাজারের পতন অথবা অনেক সময় ব্যাংকিং খাতের সঙ্কট প্রমাণ করে বাজারের পারফরম্যান্স ভাল করার জন্য যে সব নমনীয় (ঋষবীরনষব) নিয়মনীতি গ্রহণ করা হয় তা বিনিয়োগকারীদের মাঝে ভাল (চড়ংরঃরাব ঝঢ়বপঁষধঃরড়হ) স্পেকুলেশন তৈরি করে। তখন শেয়ারের চাহিদা জোগানের তুলনায় দ্রুত বাড়ে। এভাবে চাহিদা এবং জোগানের মাঝে ভারসাম্যহীন অবস্থা শেয়ারের দাম এবং সূচক বাড়িয়ে দেয়। এই অতিমূল্যায়িত সূচক পতনের (ঈৎধংয) দিকে মোড় নেয়। তাই করণীয় হলো চাহিদা এবং জোগানের উপাদানগুলোর দিকে নজর রেখে এতে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করা।

আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ

অন্যান্য বারের মত এবারও বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে তবে তা ভিন্নভাবে। সরকার অনুমোদিত বন্ড বা অবকাঠামো ফান্ডে ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে। অর্থনীতিবিদগণ একমত যে, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। এতে আয়কর না দেয়ার প্রবণতা বা অবৈধ উপায়ে আয় করার মানসিকতা তৈরি করে। আবার নীতিগতভাবেও এটা ঠিক নয়। যারা বৈধ পথে উপার্জন করে নিয়মত কর প্রদান করে তাদের ওপর এটা একটা অবিচারস্বরূপ। তবে অনেকে ব্যাপারটিকে সাময়িকভাবে সুযোগ দানের পক্ষে। অনেকে গত বছরের মত এবারও কালো টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের পক্ষপাতী। আসলে এটা কখনও উচিত নয়। মূল ব্যাপার হলো-সাময়িক সুযোগ দেয়ার কথা বলে যদি প্রতি বছর সুযোগ দেয়া হয় তা ঠিক নয়। কালো টাকার স্থায়ী সমাধান হওয়া উচিত, কারণ তা অনুৎপাদনশীল খাতে থেকে অর্থনীতির ক্ষতি করে। তাই কালো টাকা যাতে তৈরি হতে না পারে সে ব্যবস্থা করা উচিত।

করমুক্ত আয়সীমা

এবারের বাজেটে করমুক্ত আয় সীমা নতুনভাবে নির্ধারণ করা হয়। ব্যক্তি করদাতাদের করমুক্ত সীমা ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়। তবে মহিলা ও ৬৫ বছর বয়স্ক করদাতাদের করমুক্ত সীমা ২ লক্ষ টাকা এবং প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে এ সীমা ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা করা হয়। ভালো দিক হলো- ‘সারাদেশের সর্বোচ্চ কর প্রদানকারী ১০ জন ব্যক্তি ও ১০টি কোম্পানিকে এ বছর থেকে ঞধী পধৎফ প্রদান করা হবে- যাতে তারা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, জাতীয় সংসদ সদস্যগণ এবং উচ্চ আদালতের বিচারকগণের বেতন-ভাতাদির ক্ষেত্রে করমুক্ত সুবিধা প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়।’ বিভিন্ন পক্ষ থেকে করমুক্ত আয় সীমা আরও বাড়ানো এমনকি ২ লক্ষ টাকা করার দাবি আসতে থাকে। কারণ বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি থেকে সাধারণ করদাতাদের রক্ষা করাটা জরুরি।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)

এডিপি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকারকে সব সময় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। সব সময় দেখা যায় এডিপির ২০ শতাংশের মত অবাস্তবায়িত অবস্থায় থেকে যায়। অর্থবছরের শুরুতে এর বাস্তবায়নে চরম ধীরগতি দেখা যায় কিন্তু শেষের ৩-৪ মাসে অধিকাংশ অর্থ ছাড় করা হয়। এভাবে তাড়াহুড়া করে কাজ করাতে কাজের গুণগত মান ঠিক থাকে না। অথচ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এডিপির সঠিক বাস্তবায়ন জরুরি। এবারের বাজেটে ৪৬,০০০ কোটি টাকা এডিপিতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়। যা গত বছরে সংশোধিত বরাদ্দের চাইতে ১০,১৭০ কোটি টাকা বেশি।

এডিপির বাস্তবায়ন হার আশাব্যঞ্জক নয় বলে অর্থমন্ত্রী মত প্রকাশ করেন। তিনি আরও বলেন, মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর আওতায় পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়া বিকেন্দ্রায়িত হলেও এখনও তা ফলপ্রসূ হয়ে ওঠেনি। তবে পরিবীক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করা হলে বাস্তবায়ন হার আরও বৃদ্ধি পেত। এবার এ খাতে বরাদ্দ আগের চেয়ে ২৮ শতাংশ বেশি হওয়ায় বাস্তবায়নের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। এ ঝুঁকি এড়াতে অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে প্রত্যেক ইউনিয়নে এক কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া এবং প্রকল্পের সংখ্যা কমিয়ে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন।

বাজেটের আকার লক্ষ্যমাত্রা ও খাতওয়ারি বরাদ্দ যাই থাকুক না কেন দেশের সাধারণ মানুষ চায় সরকার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে তাদের ক্রয়ক্ষমতার মাঝে নিয়ে আসবে। সে জন্য বাস্তবতার নিরিখেই বাজেট বাস্তবায়ন জরুরি। এতে সরকারকে সর্বোচ্চ দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। ২০১১-১২ সালের বাজেট পর্যালোচনা করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) রিসার্চ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাজেট বাস্তবায়ন করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী অর্থবছরে বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারকে চারটি ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হবে। সেগুলো হলো- বাজেট অর্থায়ন, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, রাজনৈতিক সমঝোতার অভাব এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক সমস্যা, এসব ঝুঁকি মোকাবেলা করে বাজেট বাস্তবায়ন করাই বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমান মহাজোট সরকার দিনবদলের অঙ্গীকার নিয়ে; মানুষের মৌলিক দাবি পূরণের প্রতিশ্র“তি দিয়ে সুখী সমৃদ্ধ ও সংবেদনশীল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। তাই এ সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশাও অনেক বেশি। মন্দাত্তোর বিশ্বঅর্থনীতিতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি, মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জাপানে ভয়াভহ সুনামি এবং ভূমিকম্প, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমাদের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এসব কারণে- বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের মূল্য আরও বৃদ্ধি, খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি, রেমিট্যান্সপ্রবাহে নেতিবাচক ধারা, বাজেট ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণ পেতে অসুবিধা এবং দেশে দেশীয় এবং বিদেশী বিনিয়োগ কমাসহ আরও অনেক সমস্যার মুখে পড়তে পারে দেশ এবং দেশের মানুষ। এসব ঝুঁকি সফলভাবে মোকাবেলার জন্য সরকারের উচিত, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সমস্যা সমাধানে দেশীয় উৎসের যথোপযুক্ত ব্যবহার, কৃষির বরাদ্দ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে উৎপাদন বাড়ানো, দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা পূরণের স্বার্থে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দুর্র্নীতিমুক্ত ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা। রেমিট্যান্স বাড়াতে বিদেশে শ্রমবাজারের সম্প্রসারণ করে দক্ষ জনশক্তি প্রেরণ, তুলনামূলক কম শর্তের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করা, দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিদ্যুৎ গ্যাসের নিশ্চয়তা এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করে বিনিয়োগ বৃদ্ধির চেষ্টা চালানো। পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে কারসাজির সাথে জড়িতদের শাস্তি প্রদান এবং ভবিষ্যতে যাতে এরূপ ঘটনা না ঘটে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সর্বোপরি, সরকার শুধু মুখে বুলি না আউড়িয়ে বাজেট বাস্তবায়ন করবে এটাই দেশের মানুষের প্রত্যাশা।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির