post

ঢাকা

জসিম উদ্দীন সিকদার

০৭ জুন ২০২২
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চারলেন প্রকল্পের ৬ বছরের কাজ শেষ হচ্ছে ১১ বছরে। এর মধ্যে চার দফায় ১ হাজার ৬৪৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয় বৃদ্ধি করে বর্তমানে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮১৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের সড়ক অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় বেশি। ইউরোপে চার লেনের নতুন মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ২৮ কোটি টাকা। পাশের দেশ ভারতে এ ব্যয় ১০ কোটি টাকা। আর চীনে তা গড়ে ১৩ কোটি টাকা। অথচ বাংলাদেশের তিনটি মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে ব্যয় হচ্ছে গড়ে ৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়ক চার লেন নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৫ কোটি টাকা। ফলে মহাসড়ক নির্মাণে সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশে পরিণত হওয়ার পথে বাংলাদেশ। অপরিকল্পিতভাবে প্রকল্প গ্রহণ করায় এই অবস্থা তৈরি হচ্ছে। তাই ভবিষ্যতে যাতে অন্য প্রকল্প নির্মাণে এই দীর্ঘসূত্রতা না হয় সে জন্য আগে থেকেই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। তবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নির্মাণে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি ও সওজর মনিটরিংয়ের অভাবে প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতার জন্য দায়ী বলে পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডির এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এ ব্যাপারে বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চারলেন প্রকল্পের এই অবস্থার তৈরি হয়েছে। ৬ বছরের প্রকল্পে শেষ করতে ১১ বছর লেগেছে। এর ফলে সময় ও অর্থের অপচয় হচ্ছে। এ ছাড়া সঠিক সুবিধা পাওয়া থেকেও জনগণ বঞ্চিত হয়েছে। তাই ভবিষ্যতে প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতা যাতে না হয় সে জন্য সঠিক পরিকল্পনার পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করতে হবে। এ ছাড়া দরপত্র যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। তবে বাংলাদেশে বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় জটিলতা হচ্ছে প্রকল্প এলাকায় জমি অধিগ্রহণ। পাশাপাশি প্রকল্পের দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগপ্রক্রিয়াটাও অনেক দীর্ঘ। তাই প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরুর আগেই অনেক সময় ব্যয় হয়ে যায়। এ ছাড়া প্রকল্পে এই দীর্ঘসূত্রতার আরেকটি কারণ হচ্ছে তড়িঘড়ি করা। কোনো প্রকল্প তড়িঘড়ি গ্রহণ করে গ্রাউন্ডে নেমে দেখা যায় আসল কাজ করতে গিয়ে অতিরিক্ত সময় চলে যায়। তাই প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতার কারণগুলো যেমন গ্রাউন্ডে আছে, তেমনি প্রকল্প গ্রহণের সময় তড়িঘড়ির একটি ব্যাপার আছে। তাই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ভূমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য যে বিষয়গুলো প্রকল্প গ্রহণের আগেই সমাধান করার পরামর্শ দেন তিনি। চারলেন মহাসড়ক প্রকল্প ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি অর্থনৈতিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক। এই মহাসড়কটি দুই লেন থেকে চার লেনে উন্নীতের জন্য ২০০৫ সালে একনেকে চারলেন প্রকল্পের কাজ অনুমোদন করে সরকার। এরপর ২০০৬ সালের কুমিল্লার দাউদকান্দি টোল প্লাজা থেকে চট্টগ্রামের সিটি গেট পর্যন্ত ১৯২ দশমিক ৩০ কিলোমিটার মহাসড়ক চারলেনে উন্নীতকরণের কাজ শুরু করা হয়। ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে ২০১২ সালের জুন মাসে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু তা সম্ভব না হওয়ায় পরে তা বাড়িয়ে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। তাতেও শেষ করা সম্ভব না হওয়ায় ২০১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। এতেও ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। এতে সফল না হওয়ায় সর্বশেষ পঞ্চমবারের মতো প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই ছয় বছরের প্রকল্প শেষ করতে হচ্ছে ১১ বছরে। তবে চলতি বছরের মে মাসেই ঢাকা-চট্টগ্রাম চারলেন প্রকল্পটি যান চলাচলের জন্য উদ্বোধন করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ২০০৯ সালে ১১ জুন ঢাকা-চট্টগ্রাম চারলেন প্রকল্পের ১০টি প্যাকেজের জন্য পৃথক দরপত্র আহ্বান করে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ)। সব প্যাকেজে অংশ নিয়ে সাতটিতেই সওজের প্রাক্কলনের চেয়ে কম দর প্রস্তাব করায় কাজ পায় চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। বাকি তিনটি প্যাকেজের মধ্যে দুই ভাগের কাজ করছে দেশীয় রেজা কনস্ট্রাকশন ও এক অংশের কাজ করছে তাহের ব্রাদার্স লিমিটেড। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চারলেনে উন্নতীকরণ ছাড়া এই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ২৮টি ব্রিজ, রেললাইনের ওপর দিয়ে ৩টি ওভারপাস, ২টি আন্ডারপাস, ৩৩টি স্টিল ফুট ওভারব্রিজ, ১৯৫টি বক্স-কালভার্ট, ৫ মিটার মেডিয়ান এবং ৬১টি বাস স্টেশন নির্মাণকাজ একই সাথে চলছে বলে সওজর সূত্রে জানায়। এ ব্যাপারে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন ছিদ্দিক জানান, বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নির্মাণ শেষপর্যায়ে চলে এসেছে। আগামী মে মাসে যান চলাচলের জন্য প্রকল্পটি উদ্বোধন করা হবে বলে ইতোমধ্যে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন। তবে প্রকল্পের কাজের মেনটেইনিংয়ের জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে আরো এক বছর প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করতে হয়। এ জন্য প্রকল্পের মেয়াদ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্পের কাজ মূলত শুরু হয়েছে ২০১২ সালে। এর আগে ফিজিবিলিটি স্টাডি, জমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন পরিকল্পনায় অনেক সময় চলে গেছে। তাই কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে। তবে প্রথম দিকে একটু তৎপর হলে পরিকল্পনায় সময়টা একটু কম যেত বলে জানান তিনি। চারলেনের ব্যয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রকল্পের ব্যয় চতুর্থ দফায় ৬২৭ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৩ হাজার ৮১৬ কোটি ৯৪ লাখ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ তৃতীয় দফা ঢাকা-চট্টগ্রাম চারলেন প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়। সে সময় ৭৮০ কোটি ১২ লাখ টাকা বাড়িয়ে প্রকল্প ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ১৯০ কোটি ২৯ লাখ টাকা। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফায় বিশেষ সংশোধন করলে ঢাকা-চট্টগ্রাম চারলেন প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়ায় ২ হাজার ৪১০ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর আগে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রকল্প ব্যয় প্রথম দফা সংশোধন করা হয়। সে সময় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৩৮২ কোটি ১৭ লাখ টাকা। আর ২০০৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুমোদনের সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম চারলেন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ১৬৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ চার দফায় প্রকল্পটির ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার ৬৪৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বা ৭৬ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অগ্রাধিকারে থাকা এই প্রকল্পের মেয়াদের পাশাপাশি ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এ ব্যাপারে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের জানান, এ প্রকল্পের জন্য নতুন করে জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। কাজ শুরু করার সময় যে ‘রেট শিডিউল’ ধরা হয়েছিল, পরে তা অনেক বেড়ে গেছে। কোথাও কোথাও ‘ডাইভারশন রোড’ করতে হচ্ছে। এসব কারণেই প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে। প্রকল্পটির মূল ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রকল্পের ব্যয় মূল থেকে বাড়ছে ৭৬ শতাংশ। কুমিল্লার দাউদকান্দি টোল প্লাজা থেকে চট্টগ্রামের সিটি গেট পর্যন্ত ১৯২ দশমিক ৩০ কিলোমিটার মহাসড়ক চারলেনে উন্নীতকরণের কাজে চায়না ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের ৭ প্যাকেজের কাজের অগ্রগতি পিছিয়ে রয়েছে। গত জানুয়ারি পর্যন্ত ১৯২ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে প্রায় ১৪৮ কিলোমিটার চারলেন নির্মাণ হয়েছে। আর ২৩টি সেতুর ৯৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। বক্স কালভার্ট নির্মাণ ২টি বাকি রয়েছে। আর রেললাইনের ওপর ৩টি ওভারপাসের মাত্র ৬৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া ৩৩টি ফুটওভার ব্রিজের ৫টি সম্পন্ন হয়েছে। সড়কের দুই পাশ ও সড়ক বিভাজকের মাঝে বৃক্ষ রোপণের বড় অংশ বাকি রয়েছে। কিছু অংশের সড়ক বিভাজক নির্মাণও বাকি রয়েছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাল বাড়ানো হয়েছে পঞ্চমবারের মতো। এ ক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, বিদ্যমান দুই লেনের সড়কটির ঢাল ছিল দুই দিকে। এখন চারলেন করায় এতে সমস্যা হচ্ছে। চারলেনের মাঝে বৃষ্টির পানি জমে যাচ্ছে। তাই পুরনো দুই লেনের পিচ তুলে ফেলে বাম দিকে ঢাল ঠিক করতে হয়েছে। নতুন করে পিচ ঢালাই করতে হয়েছে। এ ছাড়া দুই দফা রাজনৈতিক অস্থিরতায় বেশ কিছু দিন প্রকল্পটির কাজ বন্ধ ছিল। এতে বাস্তবায়ন বিলম্বেও নির্মাণব্যয় কিছুটা বাড়ছে। পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নির্মাণে ব্যয় ও সময় বৃদ্ধির যুক্তির সঙ্গে একমত নয় পরিকল্পনা কমিশন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৩ সালে প্রকল্পটির ব্যয় বড় অংশ বৃদ্ধি করা হয়। সে সময় বিশেষজ্ঞ দল পর্যবেক্ষণ করে বেশকিছু সুপারিশ প্রদান করে। সে অনুপাতে ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছিল। ব্যয়বৃদ্ধির নতুন এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। তাই প্রকল্পের প্রকৃত কাজ পর্যবেক্ষণ ও ব্যয় বিশ্লেষণে সম্প্রতি আইএমইডি প্রতিনিধিদল পাঠানো হয়। আইএমইডি পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো কারণ ছাড়াই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করতে বিলম্ব করছে। এ ক্ষেত্রে বৃষ্টি, সড়ক নির্মাণে প্রয়োজনীয় উপকরণের ঘাটতি, পাথরসঙ্কট, অর্থসঙ্কট, মাটিসঙ্কট ইত্যাদির দোহাই দেয়া হয়েছে। দেখা গেছে, এসব সমস্যা অনেকটাই কেটে গেলেও কাজ না করে বসে ছিল প্রতিষ্ঠানটি। বারবার ব্যয় বাড়ানোর লক্ষ্যেই তারা এমনটি করেছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, চীনা প্রতিষ্ঠানের এ কারসাজির সঙ্গে সওজের সংশ্লিষ্টদেরও সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। ফলে দ্রুত কাজ শেষ করার বিষয়টি নিয়ে সওজের যথেষ্ট অবহেলা ছিল। শুধু তাই নয়, প্রকল্পের মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের জানা থাকলেও এ বিষয়টি নিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো কথা বলা হয়নি। কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। এ জন্য সময় ও ব্যয় বারবার বাড়ানো হচ্ছে। তবে বিষয়টি অস্বীকার করেন সওজের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান। এ ব্যাপারে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নিয়ম মেনেই প্রকল্পের কাজ করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত যেসব কাজ হয়েছে তা সাবলীলভাবেই হয়েছে। তদারকিতে কোনো গাফিলতি বা কারসাজি করা হয়নি। কাগজে-কলমে থাকলেও প্রকল্পটি মূলত শুরু হয়েছে ২০১৩ সালে। এর পর থেকে যে অগ্রগতি হয়েছে তা সন্তোষজনক। এ ছাড়া ব্যয় বৃদ্ধির যে যুক্তি দেয়া হয়েছে তাতে কোনো সমস্যা পায়নি আইএমইডি। এ জন্য একনেকে যাচ্ছে সংশোধন প্রস্তাব। মহাসড়ক নির্মাণে বেশি ব্যয় বাংলাদেশে ইউরোপে চার লেনের নতুন মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ২৮ কোটি টাকা। পাশের দেশ ভারতে এ ব্যয় ১০ কোটি টাকা। আর চীনে তা গড়ে ১৩ কোটি টাকা। অথচ বাংলাদেশের তিনটি মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে ব্যয় হচ্ছে গড়ে ৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়ক চার লেন নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৫ কোটি টাকা। ফলে মহাসড়ক নির্মাণে সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশে পরিণত হওয়ার পথে বাংলাদেশ। যদিও প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর প্রত্যেকটিই বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের অর্থনীতির ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ২০১৪ সালে সেপ্টেম্বরে জেনেভায় ইউএন-ইসিই (ইকোনমিক কমিশন ফর ইউরোপ) আয়োজিত এক সেমিনারে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মহাসড়ক নির্মাণের তুলনামূলক ব্যয়ের চিত্র তুলে ধরেন গ্রিসের ন্যাশনাল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব এথেন্সের অধ্যাপক দিমিত্রিয়স স্যামবুলাস। ‘এস্টিমেটিং অ্যান্ড বেঞ্চমার্কিং ট্রান্সপোর্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার কস্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তিনি বলেন, চার লেনের নতুন মহাসড়ক নির্মাণে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে খরচ হয় গড়ে ৩৫ লাখ ডলার বা ২৮ কোটি টাকা। আর দুই লেন থেকে চার লেনে উন্নীত করতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ২৫ লাখ ডলার বা ২০ কোটি টাকা। চলতি বছর জানুয়ারিতে প্রকাশিত বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সড়ক অবকাঠামোর নির্মাণ ব্যয়-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হবে ২২ লাখ ডলার বা ১৭ কোটি টাকা। আর দুই লেনের মহাসড়ককে চার লেন করতে এ ব্যয়ের পরিমাণ সাড়ে ১৪ লাখ ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় ১১ কোটি টাকা। ৪০টি দেশের নির্মাণ ব্যয়ের ভিত্তিতে ইকোনোমেট্রিক মডেল প্রয়োগ করে গড় ব্যয় নির্ণয় করা হয়। ‘দ্য কস্ট অব রোড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইন লো অ্যান্ড মিডল ইনকাম কান্ট্রিজ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি যৌথভাবে প্রণয়ন করেন অক্সফোর্ড, কলাম্বিয়া ও গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন অধ্যাপক। পাশের দেশ ভারতে গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, চার লেনের নতুন মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় গড়ে ৮-৯ কোটি রুপি; বাংলাদেশের মুদ্রায় যা সাড়ে ৯ থেকে সাড়ে ১০ কোটি টাকা। জমি অধিগ্রহণ ব্যয়ও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। আর জমি অধিগ্রহণ করা না হলে ব্যয় অর্ধেকে নেমে যাবে। তবে দুই লেনের মহাসড়ক চার লেন করতে কিলোমিটারপ্রতি ৫ কোটি রুপি বা ৬ কোটি টাকা ব্যয় হবে। দেশটির ১২তম (২০১২-১৭) পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ রয়েছে। চীনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশটিতে চার লেনের নতুন মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় গড়ে ১৬-১৭ লাখ ডলার; বাংলাদেশের মুদ্রায় যা সাড়ে ১২ থেকে সাড়ে ১৩ কোটি টাকা। তবে দুই লেনের মহাসড়ক চার লেন করতে কিলোমিটারপ্রতি পড়বে ১০ কোটি টাকার কম। দেশটির ১২তম (২০১০-১৫) পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এ তথ্য উল্লেখ আছে। এ দিকে দেশের মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ তিন প্রকল্পের মধ্যে রংপুর-হাটিকুমরুল অংশ আগামী বছর শুরুর কথা রয়েছে। এ মহাসড়কের ১৫৭ কিলোমিটার চার লেনে উন্নীতকরণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা। কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ৫২ কোটি ৭ লাখ টাকা। আর ঢাকা-সিলেট ২২৬ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৬৬৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ৫৬ কোটি ৪ লাখ টাকা। ২০১৭ সালে প্রকল্পটি শুরু করার কথা। দু’টি প্রকল্পই বাস্তবায়ন হবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে। চলতি বছর শুরু হওয়ার কথা ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা চার লেন প্রকল্পের কাজ। সম্প্রতি প্রকল্পটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) চূড়ান্ত করতে সড়ক পরিবহন বিভাগে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দু’টি প্যাকেজে ঢাকার বাবুবাজার লিংক রোড থেকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও মাদারীপুরের পাচ্চর থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত চার লেন করা হবে। ৫৩ কিলোমিটার চার লেন করতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ২৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হবে প্রায় ৯৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে শতভাগ সরকারি অর্থায়নে। যদিও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণে ব্যয় অন্যগুলোর তুলনায় কম হচ্ছে। এ মহাসড়কের ১৯২ দশমিক ৩ কিলোমিটার চার লেনে উন্নীত করায় ব্যয় হচ্ছে ৩ হাজার ৭৯৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ১৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। আর ৮৭ দশমিক ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনে ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ৮১৫ কোটি ১২ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ২০ কোটি ৮২ লাখ টাকা। বাস্তবায়ন বিলম্বে উভয় প্রকল্পে একাধিকবার ব্যয় বাড়ানোও হয়েছে। জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, নতুন চার লেন প্রকল্পগুলোয় ধীরগতির যানবাহনের জন্য পৃথক লেন নির্মাণ করা হবে। রেলক্রসিং ও ইন্টারসেকশনে (মোড়) ওভারপাস, ইউ-লুপ ও ফ্লাইওভার থাকবে। ফলে আন্তর্জাতিক মানের সড়কে কোনো বাধা ছাড়াই যানবাহন চলাচল করবে। বেশ কিছু সেতু ও কালভার্টও রয়েছে প্রকল্পগুলোর আওতায়। এ ছাড়া জমি অধিগ্রহণেও ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এ জন্য খরচ কিছুটা বেশি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানের কারণে সড়কের নির্মাণব্যয় বেশি হবেÑ এ যুক্তির সঙ্গে একমত নন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ২০০৫ সালে নির্মাণ করা বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কটি বাংলাদেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের সড়ক। ধীরগতির যানবাহনের জন্য পৃথক লেনও রয়েছে এতে। এটি নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয়েছে মাত্র ৫ কোটি টাকা। গত ১০ বছরে এ ব্যয় বাড়লেও ১০ কোটি টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। তবে ফ্লাইওভার বা ওভারপাস ও সেতুর কারণে ব্যয় কিছুটা বাড়তে পারে। জানা গেছে, নতুন চার লেন প্রকল্পগুলোয় খুব বেশি জমিরও প্রয়োজন হবে না। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা চার লেন নির্মাণ করতে প্রকল্পটির আওতায় মাত্র ২৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন পড়বে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে মাত্র ৯৭ কোটি টাকা। আর ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পে ৩৮ হেক্টর জমি অধিগ্রহণে ব্যয় হয় ১০৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া রড, সিমেন্টসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর দাম পাঁচ বছরের মধ্যে বর্তমানে সর্বনিম্ন। আর বাংলাদেশের নির্মাণশ্রমিকদের মজুরিও ভারত বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের চেয়ে অনেক কম। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রতি কিলোমিটার মহাসড়ক নির্মাণে গড়ে ব্যয় হয় ৫-৬ কোটি টাকা। ফলে দুই লেনের মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে কিলোমিটারপ্রতি ১০-১২ কোটি টাকা ব্যয় হওয়ার কথা। তবে প্রকল্পের মধ্যে সেতু, ফ্লাইওভার বা ওভারপাস থাকলে ব্যয় কিছুটা বেশি হবে। সে ক্ষেত্রেও চার লেনে উন্নীত করতে কিলোমিটারপ্রতি ২০-২২ কোটি টাকার মধ্যেই থাকবে ব্যয়। উল্লিখিত তিন প্রকল্পের তুলনায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক (জয়দেবপুর-এলেঙ্গা-টাঙ্গাইল) চার লেন নির্মাণেও ব্যয় অনেক কম। এ ক্ষেত্রে ৭০ কিলোমিটারে ব্যয় হচ্ছে ২ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ৪১ কোটি ২০ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে গত মাসে ঠিকাদার নিয়োগ চুক্তি সই হয়। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের বনপাড়া-হাটিকুমরুল অংশটি নির্মাণ করা হয় ২০০৫ সালে। হাওরের ভেতর দিয়ে হওয়ায় সেখানে ৯ মিটার পুরু মাটির স্তর তৈরি করতে হয়। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয়েছিল ৫ কোটি টাকা। সেটাই ছিল বাংলাদেশে মহাসড়ক নির্মাণে সর্বোচ্চ ব্যয়ের উদাহরণ। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে দেশে মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ৫-৬ কোটি টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। নতুন চার লেন প্রকল্পগুলোর বিভিন্ন মোড়ে ফ্লাইওভার, ওভারপাস বা ইউ-লুপ নির্মাণ করা হবে। এতে ব্যয় কিছুটা বেশি হওয়া স্বাভাবিক। তবে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ৯৫ কোটি টাকা এটা অনেক বেশি অস্বাভাবিক। লেখক : সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির