post

তারুণ্যের শক্তি অপচয় ও আমাদের দায়িত্ব

মুহাম্মদ তারেক হোছাঈন

১১ এপ্রিল ২০১৬
বাংলাদেশ অসীম সম্ভাবনা সমৃদ্ধ একটি ভূখন্ড। আয়তনে ছোট হলেও মাটিতে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। মাটির প্রচুর উর্বরতায় কৃষক সহজেই শস্য, ফল-ফলাদি জোগান দেয়। বনজসম্পদের বৃক্ষসহ পর্যাপ্ত পাখির সমাহার। বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি পলিগঠিত সমতল ভূমি। ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে অবস্থিত। কিন্তু সমুদ্র সান্নিধ্যে ও মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এখানে শীত ও গ্রীষ্মের তীব্রতা খুব বেশি নয়। বাংলাদেশের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ২ কোটি ছাত্র। যুবসমাজ প্রায় ৩ কোটি। অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু উৎপাদন আর ব্যবহারের দায়িত্ব যুবসমাজের। যুবকদের এই মহান দায়িত্বে গড়ে উঠবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। আমাদের পাশের দেশ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও চীন। আমাদের তুলনায় তরুণসমাজ খুব কম। প্রাকৃতিক সম্পদ ও মাটির উর্বরতাও সীমাবদ্ধ। এই অল্প সম্পদে যুবকরা তৈরি করেছে বিশাল সম্পদ। জাতির উন্নতি, অগ্রগতিতে প্রয়োজন উপর্যুক্ত তরুণসমাজ। যারা সমাজ ও দেশের কল্যাণে অবদান রাখবে। দেশের যাবতীয় সম্পদকে উর্বর করবে। রাষ্ট্রীয় সংহতি, বিকাশে পাহারাদার হবে। জনগণের কল্যাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। মানবতা রক্ষার্থে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেবে। হাসিমুখে যন্ত্রণা লাঘব করবে। যুগে যুগে ন্যায় ও সত্যের জন্য যারা সংগ্রাম করে, যারা পুরাতনকে ভেঙে নতুন কিছু করতে বা গড়তে চায়, যারা অন্যায়ের কাছে মাথানত করে না। যারা পরাজয় মানতে নারাজ তারাই তরুণ, তারাই জাতির প্রাণশক্তি। তরুণদের এই শক্তি স্থবির নয়। সদা চঞ্চল। সদা সৃষ্টিতে বিশ্বাসী। কিন্তু এই তরুণসমাজ যদি কুপথে পা বাড়ায় জাতির জন্য ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। বাংলাদেশের মত দেশে শতকরা ৪০ শতাংশ দরিদ্র, কিন্তু মাদক সেখানে অনেকাংশে সহজলভ্য। বাংলাদেশে এখন অসংখ্যা কোটিপতি। তাদের জীবনযাত্রা প্রণালী ইউরোপ-আমেরিকার সমান্তরাল। উপভোগ আর অতিভোগে তারা পাশ্চাত্যের সমকক্ষ আসক্তিতে। ব্যবসায়িক স্বার্থে একশ্রেণীর রাজনৈতিক নেতারা মাদকসেবীর প্রশ্রয়ে। দেশের আনাচে-কানাচে নানান মাধ্যমে এই জাল আজ সহজতর। সেই জালে প্রায় আটকা আমাদের সমাজের প্রাণশক্তি যুবসমাজ। মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত ব্যক্তিরাও অধিকাংশ জায়গাতে নেশাতে আক্রান্ত। এদের স্বপ্ন ও প্রাপ্তির মধ্যে পার্থক্য প্রচুর। নেশার বিষক্রিয়ায় শেষ পরিণতি হচ্ছে উর্বরা মেধার অসম্পূর্ণতা এবং উজ্জ্বল পরমায়ুর অবক্ষয়। এভাবে চলতে থাকলে জাতির ভবিষ্যৎ চোখে অন্ধকার দেখবে। জাতিগঠনের মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আদর্শিক দর্শন উপেক্ষিত। তাই তারুণ্যের প্রচুর অভাব দেশের প্রতি ভালোবাসার, দায়িত্ববোধ ও সম্মানবোধের। কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তরুণরা এই শিক্ষা পাচ্ছে না। শিক্ষা, শিক্ষাদান, শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে সার্বিকভাবে নৈতিকতার মোড়কে জ্ঞানচর্চা বিতরণে নিরাপদ রাখতে হবে। তাহলেই শিক্ষিত তরুণরা জীবন ও যৌবনের উত্তাপ দিয়ে গড়ে তুলবে আদর্শিক জাতি। বরং বস্তুবাদ বা জড়বাদী মুখরোচক চেতনার প্রতিফলন হচ্ছে শিক্ষায়। এভাবেই তরুণদের স্বপ্নভরা কৈশোরের ইতিবাচক বিশ্বাসগুলো দিন রাত শুধুই ভেঙেই চলছে। আমাদের ঐতিহ্যে লালিত যা কিছু মহান ও সুন্দর তার অনেক কিছুই অপসংস্কৃতির জোরে অবলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দৃশ্যমান। সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে আর মহৎভাবে বাঁচা। আর যদি শুধু বেঁচে থাকার জন্য বিশ্বাস, চেতনাই অপসংস্কৃতি। অপসংস্কৃতি আমাদের যুবকদের শক্তি, বিশ্বাস ও সমাজের ঐতিহ্যের অপমৃত্যু ঘটাচ্ছে। এই মৃত্যু দৈহিক নয়, আত্মিক ও মানবিক। অসুন্দরের উপাসনা করে অন্যায়ের হাত ধরে বেঁচে থাকাটাই অপসংস্কৃতি। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে অপসংস্কৃতির প্রবল প্রতাপ। ব্যক্তিগত লোভ-লালসা চরিতার্থ করার জন্য ভয়ঙ্কর জোয়ার বইছে তরুণদের দেহ ও মনে। সুন্দর আর মহৎভাবে বেঁচে থাকাটা এখন হাস্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুবকদের খাদ্যাভ্যাস, বিনোদন, হৃদয়াবেগ সব কিছুতেই এই যন্ত্রণার কুপ্রভাব। ফলে মানুষের নৈতিকতার সাথে সম্পর্কশূন্য এক আজগুবি সংস্কৃতির লীলাখেলা চলছে। অপসংস্কৃতির সুদূরপ্রসারী প্রভাব নেশাতে আক্রান্ত সম্ভাবনাময়ী যুবসমাজ। নেশার খপ্পরে পড়ে তারা আজ দিকভ্রান্ত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ধূমপায়ী, সন্তানের সামনে বাবা, চাচারা ধূমপায়ী। এভাবেই অনেকেই মাদকাসক্ত। অনেক যুবকের মাদকের ব্যবহার রুটিন মাফিক। এই নেশার অর্থের জন্য পিতা-মাতার ওপর শারীরিক আক্রমণ। নেশার টাকা জোগাড় করতে সন্ত্রাসের নানা পথে যুবসমাজ। একজন বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী নেশাতে সম্পৃক্ততার বিবরণ দিয়েছেন “একজন তরুণের চোখে ধরা পড়েছে তার আশপাশের অরাজকতা, বৈষম্য আর শোষণ। যথার্থ বিদ্যা অর্জনের জন্য পাচ্ছে না পর্যাপ্ত সুযোগ। শিক্ষা শেষে বেকারত্বের আতঙ্ক। অযোগ্য ব্যক্তিরা অদৃশ্য সুতা ধরে উঠে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় কন্ট্রোল টাওয়ারে। সততার অন্য নাম বোকামি হিসেবে দেখা হচ্ছে। রাজনীতিতে শঠতার ব্যবহারে প্রত্যক্ষ হচ্ছে। এ পরিবেশে শিক্ষিত তারুণ্য আস্থা হারাচ্ছে বারবার। প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় তাদের বিশ্বাস প্রতিনিয়ত ভঙ্গ হচ্ছে। এসব দুঃসহ বর্তমানকে ভুলে থাকতে এবং দুর্বার উত্তেজনাকে তাড়াতে তারা নেশার শরণাপন্ন হচ্ছে।” অনেক তরুণ সঙ্গদোষে নোংরামিতে ডুব দিচ্ছে। সুগন্ধি গোলাপের সঙ্গে থাকলে উপলক্ষও সুগন্ধে ভরপুর হয়। আবার সুগন্ধি গোলাপের যদি ভাগাড়ের গন্ধে ঢেলে দেয়া হয় তথা গোলাপও দুর্গন্ধে ভেসে যায়। এই ভাবে আগ্রাসনে আক্রান্ত আলালের ঘরের দুলালও। পশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণে যুবকরা বিভ্রান্ত। অথচ পাশ্চাত্যের বিত্ত ও বিজ্ঞান যুবসমাজকে শান্তি ও নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। তারপরও একশ্রেণীর যুবক তাদের অন্ধ অনুকরণে বদ্ধপরিকর। তাই যুবক-যুবতীদের বাধা-বন্ধনহীন মেলামেশা প্রকাশ্যে। লোকলজ্জার ভয় নেই। রাষ্ট্রের কোন বাধা নিষেধ নেই। স্বর্গের তালাশে সোনালি সমাজের কবর খননে ব্যস্ত অনুকরণকারীরা। পুঁজিবাদী দুষ্টচক্র মানবতাবিধংসী এক ভয়াল আকৃতিতে আবির্ভূত হয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির খোলসে পুঁজিবাদী সংস্কৃতি মানবতাকে তার উদরে গ্রাস করে চলেছে। যুবসমাজ এটা থেকে রক্ষা পাওয়া পাহাড় টলানোর মত দুঃসাধ্য। এই আগ্রাসনের যাঁতাকলে নিষ্পিষ্ট হচ্ছে জাতির যুবসম্পদ। পুঁজিবাদের রমরমা ছোঁয়ায় উদ্বিগ্ন সচেতন নাগরিক। নানা উপায়ে অধিক অর্থ উপার্জন, অধিক ব্যয়ে সর্বক্ষেত্রে বিচরণ। শহরে ভেসে উঠেছে আকাশচুম্বী অট্টালিকার বাড়ি। নগরে নয়া মডেলের নানা রঙের গাড়ি। আলো ঝলমলে অসংখ্য বিপণিবিতান। নর-নারীর উচ্ছ্বাসের বান। আরো কত দৃশ্যান্তর কার্যকলাপ। তাই বীভৎস চিত্র সবখানে অগণিত। ধনতান্ত্রিক সমাজ ও অর্থনীতিতে ব্যক্তির ভোগের উপকরণ অবাধ ও প্রচুর। ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাসারিতা। আনন্দের পোশাকে ঘুরে বেড়ায় উচ্ছৃঙ্খলতা। সময়ের আবর্তে শাসক বদলিয়েছে। ব্রিটিশ, পাকিস্তানিরা নেই, শোষিতরা বদলায়নি। এইভাবে তরুণদের মেধা-চরিত্র ধ্বংস করাটাও শোষিত। তিলে তিলে আমরা নিজেদের শত্রুতে পরিণতি হয়েছি। আগে পাকিস্তানিদের হত্যার দোষ দিয়েছি। এখন আমরা আমাদের যুবকদের মনোবল কিংবা জাতির কোষগুলি ধ্বংস করে হত্যার উৎসবে মেতেছি। যুবকদের প্রতি দেশ ও জাতির প্রত্যাশা অনেক। তাদের মেধা হবে প্রখর, চরিত্র নির্মলতায় জ্বল জ্বল হবে সমাজ। মানবতা রক্ষার্থে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেবে। হাসিমুখে যন্ত্রণা লালন করবে। দুঃখ কষ্টের তাড়না ব্যথিত করবে না। দেশের জনগণকে যথাযথ মর্যাদায় মূল্যায়ন করবে। সম্পদ ব্যবহার ও সংরক্ষণে স্ব-উদ্যোগে সচেতন থাকবে। ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে জনগণের কল্যাণে উদার হবে। পরস্পর সহযোগী হবে। এই গুণাবলি যুবকদের থাকতে হবে। যুবকরাই এই বিষয়ে কার্যকরী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারবে। সবার এটাই প্রত্যাশা। যুবকদের সৃষ্টিকর্মে কত আয়োজন। তাদের রূপে জৌলুস, আকর্ষণ আছে। আবার আছে হাজারো গরমিল। এই সৌন্দর্যে সুধা নেই। আছে সর্বনাশা ক্ষুধা। তাদের ক্ষমতাও অনেক, কিন্তু নিজেদের নিরাপত্তায় প্রায় অক্ষম। অল্প আয়াসেই অনেক সম্পদ, অনেক আয়াসেই অনেকে যায় হারিয়ে। ভোগবাদী সভ্যতার এখন স্বর্ণযুগ। এই সভ্যতা যুবসমাজকে কী দিয়েছে সচেতন মানুষ তা প্রত্যক্ষদর্শী। বিশ্ব এটাও দেখেছে ইসলাম তার স্বর্ণযুগে কী দিয়েছে এবং যুগে যুগে কী দিয়ে এসেছে। এ দু’টি বিপরীত চিত্র সামনে থাকার পরও যদি আমরা অন্ধের মতো চলি বা অনুকরণ করি, তাহলে আগামী প্রজন্ম থুথু নিক্ষেপ করে বলবে, “এই নির্বোধের দল আমাদের জন্য জাহান্নামের দরজা খুলে দিয়ে গেছে।”

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির