post

তুরস্ক : এরদোগান এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত

১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪

মীযানুল করীম

Antorjatikতুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন সে দেশের বহুল আলোচিত প্রধানমন্ত্রী রিসেপ (রজব) তাইয়েব এরদোগান। তিনি একই দল একেপির আরেক নেতা আবদুল্লাহ গুলের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন। আরো অনেক দেশের মতো তুরস্কেও নিয়ম হলো, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মোট প্রদত্ত ভোটের অর্ধেকের বেশি ভোট কোনো প্রার্থী না পেলে আবার নির্বাচন হবে। তবে এরদোগান পয়লা রাউন্ডেই ৫১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পেয়েছেন বলে পুনর্নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না। এরদোগানকে বেশ শক্তিশালী প্রার্থীর মোকাবেলা করতে হয়েছে। তিনি হচ্ছেন, ইসলামি বা মুসলিম দেশগুলোর বৃহত্তম ফোরাম ওআইসির বিগত মহাসচিব একমেলেদ্দিন এহসানোগলু। তিনি পেয়েছেন ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট। দুই প্রধান বিরোধী দল সিএইচপি এবং এমএইচপি যৌথভাবে তাকে দাঁড় করিয়েছিল। এই দু’টি দল ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। অপর দিকে একেপি ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং ধর্মের শিক্ষাকে দেশ-জাতি-সমাজের উন্নয়ন ও বিকাশে কাজে লাগানোর পক্ষপাতী। বিরোধী দলে যে এরদোগানের সাথে পাল্লা দেয়ার মতো যোগ্য প্রার্থী নেই, তা প্রমাণিত হলো অরাজনৈতিক ব্যক্তি এহসানোগলুকে তারা সমর্থন দেয়ায়। যা হোক, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অপর প্রার্থী, পিডিপি দলের লোক এবং কুর্দি নেতা সালাদিন দেমির্তাস ১০ শতাংশেরও কম ভোট পেয়েছেন। তুরস্কের অভ্যন্তরীণ এবং মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে এরদোগানের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এরদোগান সরকারকে একের পর এক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। তার সরকার কামাল আতাতুর্কের অনুসারী, সেনাকর্মকর্তা গোষ্ঠী কিংবা সাংবিধানিক আদালতের বিচারকদের মতো কট্টর সেকুলার নয়। এ কারণে ধর্মহীন, ধর্মবিদ্বেষী, বামপন্থী কথিত উদার গণতন্ত্রী ও প্রগতিবাদীরা প্রথম থেকেই লাগাতার প্রচারণা এবং উত্তেজনাপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে অস্থিতিশীল এবং ক্ষমতাসীন একেপি দলকে হেয় করার পথ বেছে নেন। প্রসঙ্গক্রমে গত বছর গেজি পার্কে দীর্ঘস্থায়ী প্রচণ্ড বিক্ষোভের উল্লেখ করতে হয়। কৌশলী বিরোধী দল তাদের বিপুল ছাত্রকর্মী, সংস্কৃতিসেবী, বুদ্ধিজীবী বহর আর মিডিয়া মেশিনসহযোগে রাজপথ উত্তপ্ত রাখতে চেষ্টার ত্রুটি করেনি। তারা একবার ক্ষমতাসীন মন্ত্রিসভার কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে মাঠ গরম করার প্রয়াস পান। আরেকবার অভিযোগ আনা হয় যে, এরদোগান সরকার বাকস্বাধীনতা হরণ করছে। দুর্নীতির অভিযোগের যতটা সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে, সরকার সে ব্যাপারে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করেনি। আর প্রশাসনের দমননীতির যতটুকু বাড়াবাড়ি ছিল, তার কারণ বিরোধী দলের সুপরিকল্পিত উসকানির প্রতিক্রিয়া। তাদের অন্যতম কৌশল ছিল ক্ষমতাসীন মহলের কোন্দল বা মতভেদের কল্পিত বা অতিরঞ্জিত খবর প্রচার। প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল এবং প্রধানমন্ত্রী এরদোগানের মধ্যকার কথিত বিরোধের বিষয়ে প্রচারণা এর দৃষ্টান্ত। তুরস্কের নির্বাচনে ভোটার ছিলেন পাঁচ কোটি ৫৭ লাখ। ৭৬ শতাংশের বেশি ভোটার এবার তাদের ভোট দিয়েছেন। এরদোগান সস্ত্রীক ভোট দিলেন নিজ শহর, ঐতিহাসিক ইস্তাম্বুলে। দেশটির ইউরোপীয় অংশের এই প্রাচীন নগরী শত শত বছর ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে তুর্কি রাজশক্তির গৌরবময় প্রতীক। এই নগর থেকে উত্থিত এরদোগানের স্বপ্ন, আবার আন্তর্জাতিক পরিসরে ইতিবাচক তুর্কি প্রভাব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সেই গৌরবের প্রত্যাবর্তন। ভূখণ্ড দখলের মাধ্যমে নয়, সুশাসন ও উন্নয়নের পথে এরদোগান জনগণের মনোভূমির দখল নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে চান। ১০ আগস্ট প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই তিনি ছয় শ’ বছর প্রাচীন ইয়ুপ সুলতান মসজিদে শোকরানা নামাজ আদায় করেছেন। এবারের নির্বাচন তুরস্কের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান এরদোগানই। অবশ্য আগে থেকেই তার একই দলের আবদুল্লাহ গুল সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। লক্ষণীয়, সাম্প্রতিক কালে মিসরের ইতিহাসের প্রথম জননির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি এবং তুরস্কের প্রথম সরাসরি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এরদোগানÑ দু’জনই ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত। মধ্যপ্রাচ্যের বৃহৎ ও প্রভাবশালী দু’টি রাষ্ট্রের এই দৃষ্টান্তে ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিবাদী হওয়ার দাবিদার মহল শুধু বিব্রতই নয়, তারা বিদ্বেষও বোধ করছেন। তুরস্কে সাম্প্রতিক কালে একটি বহুল আলোচিত নাম ছিল ‘গুলেন’। এটি প্রবাসী রহস্যপুরুষ ফতলুল্লাহ গুলেনের পরিচালিত ও প্রেরণাপ্রাপ্ত আদর্শিক আন্দোলন। তিনি ইসলামপন্থী তত্ত্বগুরু হিসেবে পরিচিত। তার অনুসারীরা নিকট অতীতে একেপি দলের অনুকূলে থাকলেও গত কয়েক বছরে সরকারের সাথে গুলেনের অনুসারীদের বিরোধ দেখা দেয়। অনুমিত হয়, বিশেষ কোনো মহল গুলেনপন্থীদের উসকিয়েছে সরকারকে বিব্রত করার জন্য। অন্য দিকে সরকারও কৌশলগত ভুল করেছে ‘গুলেন’ ইস্যু মোকাবেলায়। এরদোগান সরকারের সময়ে তুরস্কে মানবাধিকার পরিস্থিতির অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। অবশ্য এটাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদপ্রাপ্তির প্রধান শর্ত করে পাশ্চাত্যশক্তি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তুরস্ককে চাপে রেখেছে। ইসলামি মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ একেপি এমনিতেই মানবাধিকারকে গুরুত্ব দেয়ার কথা। এরদোগান তুর্কি-কুর্দি বিরোধের মাত্রা অনেকটা কমিয়ে আনতে পেরেছেন। কুর্দিদের চরমপন্থী আন্দোলনের সম্পূর্ণ অবসান না হলেও সরকার তাদের বেশ কিছু দাবি পূরণ করেছে। এর একটি বড় দিক হচ্ছে, শিক্ষাব্যবস্থা ও গণমাধ্যমে কুর্দি ভাষাকে গুরুত্ব দেয়া। আগে যেখানে দেশের কুর্দি অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চলে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন তুর্কিদের প্রতি সাঙ্ঘাতিক বৈরী মনোভাব ছিল, এবার নির্বাচনে সেখানে এরদোগান দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন পাওয়া উল্লেখযোগ্য সাফল্য বৈকি। মধ্যপ্রাচ্যে সঙ্কট যেমন বাড়ছে, তুরস্কের ভূমিকা ও গুরুত্বও বাড়ছে। এর কারণ ঐতিহ্যবাহী সৌদি আরব, এমনকি ওআইসি এই বিরাট অঞ্চলের বিভিন্ন জ্বলন্ত ইস্যুতে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দু’টি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র ইরান ও মিসর। কিন্তু স্বৈরশাসক পরিচালিত মিসর কিংবা শিয়া অধ্যুষিত ইরানের পক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের নানা সঙ্কটে মধ্যস্থতা করা সম্ভব নয়। এ প্রেক্ষাপটে তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যে এক ধরনের অভিভাবকের অবস্থানে আবির্ভূত হয়েছে। এটা সম্ভব করেছে এরদোগানের দূরদর্শী, ভারসাম্যপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি। এই শতাব্দীর সূচনা পর্যন্ত তুরস্ক দীর্ঘ দিন কট্টর সেকুলার শাসনে থাকাকালে দেশটির এমন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ছিল না কূটনীতির ক্ষেত্রে। আরেকটি বিষয় হলো, ইসরাইল ঘনিষ্ঠ দেশ হিসেবে তুরস্ক দীর্ঘকাল ছিল মুসলিম বিশ্বের ব্যতিক্রম। এরদোগান আমলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে তুর্কি সরকার দেখিয়েছে, ফিলিস্তিন, তথা মুসলমানদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ইহুদিদের খুশি রাখা অন্যায়। তাই গাজার অবরুদ্ধ মানুষের জন্য ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাওয়ার সময় তুর্কি জাহাজে ইসরাইলের বর্বরোচিত হামলা ও হত্যাকাণ্ডকে তুরস্ক সহজভাবে নেয়নি।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির