post

দেশ ভাগের নির্মোহ পাঠ : ইতিহাসের কাঠগড়ায় মহাত্মা গান্ধী

মু. লাবিব আহসান

০৩ আগস্ট ২০২০

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে নিহত হওয়ার ঘটনার পর বিশ^জুড়ে বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দুর্বার গতিবেগ পায়। এ ক্ষেত্রে যে কয়েকটি সংগঠন অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করছে, তাদের মধ্যে একটি হলো ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারস’। তারা ইতিহাসের অনেক বড় বড় বর্ণবৈষম্যের কুশীলবদের মূর্তি অপসারণের জন্যও জোর বিক্ষোভ করছে। যেসব মূর্তি ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারস’ আন্দোলনকারীদের আক্রমণের মুখে পড়েছে, তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় বেশ নিবিড়। তিনি ভারতের জাতির পিতা মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী। ওয়াশিংটনে গান্ধীজির মূর্তি আক্রান্ত হওয়ায় অনেকেই চোখ কপালে তুলেছেন! প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলেন দীর্ঘ একটা সময়। সেখানে তিনি আইন ব্যবসা করতেন। সেখানে থাকার সময় তিনি বর্ণবাদের শিকার হন এবং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী নেতা হিসেবেই ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকার জন্যই তিনি ভারতের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হন, রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে মহাত্মা উপাধি পান। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধী আদৌ বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন করেননি। তার আন্দোলন ছিলো ভারতীয়দের, মূলত ভারতীয় ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে। কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের জুলুম-নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণের তিনি কোনো প্রতিবাদ করেননি। প্রকৃতপক্ষে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি শ্বেতাঙ্গদের অনুরূপ ছিলো। এ তো গেলো গান্ধীর তীব্র বর্ণবাদী মানসিকতার ফিরিস্তি। কিন্তু তিনি যে একই সঙ্গে একজন কট্টর মুসলিমবিদ্বেষী ও পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থবিরোধী নেতা ছিলেন, তা জানতে আমাদের প্রবেশ করতে হবে ইতিহাসের অন্দরমহলে। সাংবিধানিকভাবে ভারত নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করে আসছে। কিন্তু আদতে তাদের কর্মকাণ্ড এ দাবির পক্ষে কথা বলে না। মুসলিমবিদ্বেষ তাদের রক্তের শিরায়-উপশিরায় প্রবেশ করে আছে। দাঙ্গার মোড়কে মুসলিমদের উপরে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানোসহ ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড পরিচালনা তাদের হিং¯্র মনোবৃত্তিরই বহিঃপ্রকাশ। ভারতের মুসলমানদের গরুর মাংস খাওয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা, মসজিদে আজান নিষিদ্ধকরণ থেকে শুরু করে এমন শত শত উদাহরণ পেশ করা সম্ভব, যা প্রমাণ করে ভারত কোনো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়। ৩ জুন পরিকল্পনা তথা মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মূলত এ দু’টি রাষ্ট্রের উদ্ভব হতে পেরেছিলো মুসলমান ও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বাদ দিলে বিংশ শতকে দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ভারত বিভাগ এবং ইংরেজদের ভারত ত্যাগ। উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন শুরু হয়েছিলো আমাদের বঙ্গদেশ থেকেই। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আ¤্রকাননে এ দেশীয় স্বার্থান্ধ মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার স্বাধীনতার রক্তিম রবি অস্তমিত হওয়ার মধ্য দিয়ে পিঠে চেপে বসে ইংরেজ শাসন। ১৯০ বছর শাসনের পর ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা বিদায় নেয়। কিন্তু পশ্চিম ও উত্তর ভারত ইংরেজ শাসনের অধীনে ছিলো মাত্র ১০০ বছর। ব্রিটিশ শাসন সবচেয়ে বেশি স্থায়ী হয় বঙ্গদেশেই। ব্রিটিশ শাসকরা মুসলমানদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলো বলে গোটা মুসলিম জাতিই তাদের শাসনের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালিয়ে গেছে। অন্যদিকে নিজেদের শাসনকে স্থায়ী ও মজবুত করার জন্য ইংরেজরা হিন্দুদের পূর্ণ সহযোগিতা লাভ করে। যার ফলশ্রুতিতে হিন্দুরা চাকরি, ব্যবসা, জমিদারি, শিক্ষা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে ইংরেজ শাসকদের নিকট থেকে সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে থাকে। অন্য দিকে মুসলিমরা পিছিয়ে পড়তে থাকে প্রতিনিয়ত। ব্রিটিশ শাসন শুরু হবার ৫০ বছর পর ইংরেজ প্রশাসক উইলিয়াম হান্টার তার ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ বইয়ে মন্তব্য করেন, ‘৫০ বছর পূর্বে এদেশের কোনো মুসলমান পরিবার গরিব ও অশিক্ষিত ছিলো না। বর্তমানে সচ্ছল ও শিক্ষিত মুসলমান নেই বললেই চলে।’ তার এই মন্তব্যই প্রমাণ করে, মুসলমানরা ব্রিটিশ শাসক এবং হিন্দু জমিদার; উভয় শক্তির গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলো। ব্রিটিশদের রাজনৈতিক গোলামি এবং হিন্দু জমিদারদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক গোলামি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ’৪৭ এর দেশ ভাগ মুসলমানদের ইংরেজদের গোলামি হতে মুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুদের গোলামি হতেও মুক্তি দান করে। সত্যিকারার্থে, ’৪৭ এ দেশ ভাগ না হলে আজকের বাংলাদেশেরও জন্ম হতো না। ’৪৭ এর পর যারা জাতীয় অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হয়েছিলেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারারও হতে পারতেন কি না সন্দেহ। যারা হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছিলেন, তারা জেলা জজও হতে পারতেন না। যারা মন্ত্রী হয়েছিলেন, তাদেরকে সংসদ সদস্য হয়েই হয়তো সন্তুষ্ট থাকতে হতো। ভাষাসৈনিক অধ্যাপক গোলাম আযম দেশ ভাগের অব্যবহিত পরে রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনা করতেন। দেশ ভাগের আগে কারমাইকেলের অধিকাংশ শিক্ষকই ছিলেন হিন্দু। দেশ ভাগের ২-৩ বছরের মধ্যে হিন্দু শিক্ষকগণ রিটায়ার্ড হয়ে যান এবং তাদের স্থলে মুসলিম শিক্ষকগণ নিয়োগ পান। ’৪৭ এর ‘দেশ ভাগ’ পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের জন্য যে সুখের বার্তা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলো, তা উল্লেখ করতে গিয়ে অধ্যাপক সাহেব তাঁর আত্মজীবনীতে স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, “১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের মাধ্যমে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা হিসেবে বর্তমান বাংলাদেশ যদি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত না হতো তাহলে রংপুর কারমাইকেল কলেজের হিন্দু অধ্যাপকগণের অবসর গ্রহণের পর আবার হিন্দুরাই নিয়োগ পেতেন।” (জীবনে যা দেখলাম, ১ম খণ্ড) আবারও মহাত্মা গান্ধী প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের আগে পরে ভারতে অসংখ্য হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। ‘দাঙ্গা’ সাধারণত তাকেই বলা হয়, যেখানে দুটি প্রায় সমান শক্তিশালী পক্ষ জড়িত থাকে। কিন্তু দেশ ভাগের পূর্বে ১৯৪৬ সালে সংঘটিত কথিত দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছিলো প্রধানত মুসলমানরাই। তাদের সংখ্যা নিছক কয়েক হাজার ছিলো না বরং পৌঁছে গিয়েছিলো কয়েক লক্ষে। এ প্রসঙ্গে এই মহান আত্মার অধিকারী(!) ব্যক্তির ভূমিকা উল্লেখ না করেই পারছি না। যখন কলকাতা ও বিহারের মতো রাজ্যগুলোতে মুসলমানদের কচুকাটা করা হচ্ছিলো, গান্ধীজি তখন ছুটে এসেছিলেন তখন অব্দি অখ্যাত নোয়াখালীর ছাগলনাইয়া এলাকায়; যেখানে কয়েকজন হিন্দুকে মেরে ফেলা হয়েছে বলে শোনা গিয়েছিলো মাত্র। তাঁর উপস্থিতির মাধ্যমে মূলত প্রচার করার চেষ্টা করা হয়েছিলো যে- মুসলমানরা বর্বর এক জাতিগোষ্ঠী এবং তাদের দাবি অনুযায়ী পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলে সেখানে হিন্দুরা বেঁচে থাকতে পারবে না। সে সময় বঙ্গবন্ধু তার এক ফটোগ্রাফার বন্ধু ইয়াকুবকে নিয়ে বিহারে গিয়েছিলেন। সেখানে তারা মুসলমানদের উপর হিন্দুদের নৃশংসতার অনেকগুলো ছবি তুলেছিলেন। সেগুলো তারা গান্ধীকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “এই ফটোর মধ্যে ছিলো মুসলমান মেয়েদের স্তন কাটা, ছোট শিশুদের মাথা নাই শুধু শরীরটা আছে, মসজিদে আগুন জ্বলছে, রাস্তায় লাশ পড়ে আছে; এমন আরও অনেক কিছু। মহাত্মাজী দেখুক, কিভাবে তার লোকেরা দাঙ্গা হাঙ্গামা করেছে এবং নিরীহ লোককে হত্যা করেছে।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা: ৮১-৮২) ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগকালে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশকে। ক্ষোভের ব্যাপার হলো, এর পশ্চাতেও কলকাঠি নেড়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ তাঁর সুবিখ্যাত বই “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর”-এ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তাঁর এ বইটি এখনও এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস জানার একটি প্রধানতম অবলম্বন নিঃসন্দেহে। তিনি এ বইয়ের “কলিকাতার দাবি” শিরোনামের এক উপ-অধ্যায়ে জানিয়েছেন, ভারত ভাগ হলে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে কোন কোন এলাকা আসবে সে বিষয়ে ইংরেজ গভর্নর স্যার আর জে ক্যাসির সঙ্গে কথা বলেছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। গভর্নর ক্যাসি তাঁকে জানিয়েছিলেন, কলকাতা ও দার্জিলিং হবে উভয় বাংলার কমন শহর। এ ছাড়া কলকাতাসংলগ্ন চব্বিশ পরগণার ব্যারাকপুর, বারাসত, ভাঙ্গর ও বশিরহাটসহ বেশ কিছু এলাকা পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে পড়ার কথা। অন্য এক সূত্র থেকে জানা গিয়েছিলো, মুর্শিদাবাদ এবং করিমগঞ্জসহ আসামের বিরাট একটি অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানকে দেয়ার কথা ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে মহাত্মা গান্ধীসহ অন্যান্যদের মারপ্যাঁচে এবং গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের বিশ্বাসঘাতকতায় পূর্ব পাকিস্তানকে সর্বাত্মকভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। লেখক : কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির