post

নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়: আমাদের করণীয়

ড. মো: হাবিবুর রহমান

০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯

অন্তহীন সমস্যায় জর্জরিত আজকের বিশ্ব, মানবতা আজ বিপর্যস্ত। পৃথিবীর সর্বত্রই বিরাজ করছে অশান্তি, অরাজকতা; জুলুম-শোষণে নিষ্পেষিত হচ্ছে আজ বিশ্বমানবতা। চারিত্রিক চরম বিপর্যয় ও মূল্যবোধের অবক্ষয় আজ মানবজীবনকে কুরে কুরে খাচ্ছে। চতুর্দিকে চলছে ব্যক্তিগত, জাতিগত প্রাধান্যের তীব্র প্রতিযোগিতা। ফলে যুদ্ধ-সংঘর্ষ, প্রতিশোধ স্পৃহা আজ চরম আকার ধারণ করেছে। একদিকে আধুনিক সমাজ ও সভ্যতার কর্তৃত্বশীলগণ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও শক্তিহীনদের উপর অমানবিক অত্যাচার ও নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। অন্যদিকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা মানবিকতা ও আইনকে উপেক্ষা করে বিরোধী মতের অনুসারীদের উপরে চালাচ্ছে অকথ্য নির্যাতন। আইনের শাসন ও ইনসাফপূর্ণ বিচারব্যবস্থার অনুপস্থিতির সুযোগে বর্তমানে কিছু দুষ্টু প্রকৃতির মানুষ গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে পর্যন্ত পিটিয়ে হত্যা করছে। বর্তমানে নারী জাতির অবস্থা আরো করুণ। নারীরা যেন আজ কেবল ভোগের সামগ্রী। অশ্লীলতা আর উলঙ্গপনার ব্যবসায়িক পণ্য তারা। যার কারণে নারী অপহরণ, খুন, ধর্ষণ আজ সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বিশ^মানবতাকে বাঁচানোর একমাত্র পথ হচ্ছে, আল-কুরআনে নির্দেশিত পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা। আল-কুরআনের আলোকে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে গঠনের মাধ্যমে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করা। নৈতিক মূল্যবোধ, প্রজ্ঞা ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মানবতাবোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ, ভালোবাসা ও সহযোগিতার আদর্শ স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসারিত হলে, হিংষা-বিদ্বেষ, লোভ ও সংকীর্ণতা কমে আসবে এবং যুদ্ধের সম্ভাবনা হ্রাস পাবে। মানুষ মানুষকে ভালো বাসবে, মানুষের কল্যাণে মানুষ কাজ করবে। এভাবে সমাজ-রাষ্ট্রে শান্তির সমীরণ প্রবাহিত হবে। নিম্নে বর্তমানে নৈতিক বিপর্যয় ও অবক্ষয় রোধে আমাদের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

সকল অবস্থায় আল্লাহর গোলামি করা আল্লাহ তা‘আলা এই পৃথিবীর মানুষ এবং জিনকে শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন, আল্লাহর বাণী, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ “আমি মানুষ এবং জিনকে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি।” (সূরা যারিয়াত: ৫৬) মানুষ আল্লাহর ইবাদত করলে পৃথিবীতে যেমন শান্তি পাবে এবং পরকালীন জীবনেও মুক্তি পাবে। আল্লাহ তা‘আলা হযরত আদম (আ) কে উদ্দেশ করে বলেন, فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ “অতঃপর যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে কোন হিদায়াত আসবে, তখন যারা আমার হিদায়াত অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।” (সূরা আল বাকারা: ৩৮) যারা তার প্রভুর কথা অনুযায়ী চলে আল্লাহ নিজে তার ক্ষুধা-দারিদ্র্য থেকে মুক্তি ও নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে নেন। আল্লাহ বলেন, فَلْيَعْبُدُوا رَبَّ هَذَا الْبَيْتِ الَّذِي أَطْعَمَهُمْ مِنْ جُوعٍ وَآَمَنَهُمْ مِنْ خَوْفٍ “অতএব তারা যেন এ গৃহের রবের ইবাদত করে, যিনি ক্ষুধায় তাদেরকে আহার দিয়েছেন আর ভয় থেকে তাদেরকে নিরাপদ করেছেন।” (সূরা কুরাইশ: ৩-৪) অমানবিকতা, পাশবিকতা, নৃশংসতাসহ সকল প্রকার অন্যায়-অপকর্মের বিরুদ্ধে এক মহৌষধ হলো আল্লাহর ইবাদত। বলা হয়ে থাকে এটি হলো জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রতিষেধক ও চিকিৎসা। ইবাদত মানুষকে মুত্তাকি ও সংযমী বানায়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ “হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত কর, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১) সংযমী ব্যক্তিরা বিচার-বিবেচনা করে কর্ম সম্পাদন করে। তাই তারা সকল প্রকার অমানবিক ও অনৈতিক কাজ হতে নিজেরা বেঁচে থাকে এবং অন্যদেরকে বাঁচিয়ে রাখে। একজন সংযমী লোক দেশ ও জাতির জন্য বড় সম্পদ। আর এ সংযমী হতে হলে তাকে আল্লাহর ইবাদতের দিকে অগ্রসর হতে হবে। ইসলামের প্রতিটি ইবাদত মানব মনে মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে বিরাট ভূমিকা পালন করে। কাজেই নৈতিক অবক্ষয় রোধ করতে হলে মানব সমাজকে আল্লাহর গোলামির দিকে আনতে হবে। মানুষ যদি শাশ্বত এ জীবনব্যবস্থার দিকে ধাবিত হয় তাহলে সমাজ থেকে অন্যায়-অনাচার, পাপাচার, জুলুম, নির্যাতনসহ অকল্যাণকর সকল কাজ-কর্ম চিরতরে দূর হয়ে যাবে এবং সমাজ হবে শান্তির নীড়। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা সমাজ ও সভ্যতার নৈতিক অবক্ষয় রোধের অন্যতম উপাদান হচ্ছে ধর্মীয় অনুশাসন তথা ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান মেনে চলা। কেননা এটা যে কোন সমাজ ও সভ্যতার ভিত্তি এবং রাষ্ট্রীয় সুদৃঢ় অবকাঠামো বিনির্মাণের অন্যতম সোপান। মূলত ধর্ম বা জীবন-বিধান নৈতিক দর্শন থেকে শুরু করে প্রত্যয়গত ও সুদৃঢ় অধ্যাত্মবাদের প্রতি মানুষকে সচেতন করে তোলে। সুতরাং যারা বলে, ধর্ম সমাজ ও সভ্যতায় অসহনশীলতার জন্ম দেয়, তাদের অভিযোগ ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক। তাদের এ ধারণা প্রতারণাপূর্ণ ও অগ্রহণযোগ্য। আদর্শিক জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ধর্ম হলো সমাজ ও সভ্যতা বিনির্মাণ প্রক্রিয়ার অন্যতম ও অনিবার্যভাবে প্রয়োজনীয় এক অনুষঙ্গ। একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা ও জীবন দর্শন হিসেবে ধর্মীয় বিধানের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা ও সভ্যতাকেন্দ্রিক জটিলতা নিরসন সম্ভব। (ইসলাম সভ্যতার শেষ ঠিকানা, পৃ. ১৪) মানুষের মাঝে ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগরিত হলে তাদের দ্বারা কোন খারাপ কাজ সংঘটিত হতে পারে না। কারণ পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বার বার অপরাধমূলক কাজের প্রতি ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। আর ভালো ও পূর্ণ কাজের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ “সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না।” (সূরা মায়েদা-২) কাজেই মানুষ যদি ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে তাহলে সেখানে কোন অসঙ্গতি থাকবে না, মানুষে মানুষে কোন বিভেদ থাকবে না, একজন আরেকজনের অধিকার হরণ করবে না। সর্বাবস্থায় তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করা তাকওয়া শব্দের অর্থ আল্লাহভীতি, পরহেজগারি, আত্মশুদ্ধি, পরিশুদ্ধি, বিরত থাকা এবং নিজেকে সব রকম বিপদ ও অকল্যাণ থেকে রক্ষা করা। শরিয়াতের পরিভাষায় মহামহীয়ান আল্লাহর ভয়ে সব রকম অন্যায়, অনাচার, পাপাচার ঘৃণাভরে বর্জন করে আল-কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত পূত-পবিত্র জীবন যাপন করাকে তাকওয়া বলা হয়। তাকওয়ার পরিচয় থেকেই অনুধাবন করা যায়, সকল প্রকার অমানবিক ও মূল্যবোধবিরোধী অন্যায় অপকর্ম হতে তাকওয়া নামক ঢাল ও প্রাচীরই মানুষকে আত্মরক্ষা বা বাঁচিয়ে রাখতে পারে। কারণ তাকওয়া মানুষের সঠিক রাস্তার সন্ধান দেয় এবং সকল কাজকে সহজ করে দেয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا “যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরি করে দেন।” (সূরা আত-তালাক: ২) অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مِنْ أَمْرِهِ يُسْرًا “যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দেন।” (সূরা আত-তালাক : ৪) তাই নৈতিক অবক্ষয় থেকে সমাজের মানুষকে বাঁচাবার জন্য আমাদেরকে সর্বাবস্থায় তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করতে হবে এবং তাকওয়া সম্পন্ন মানুষ তৈরি করতে হবে। এভাবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে রক্ষা করা সম্ভব।

চরিত্রের সংশোধন চরিত্র মানুষের অমূল্য সম্পদ, চরিত্রের মাধ্যমেই মানুষের মর্যাদা ফুটে ওঠে অথচ আজকের মানুষ পার্থিব স্বার্থে তাদের চরিত্র বিকিয়ে দিয়েছে। রাসূল (সা) বলেছেন, يَبِيعُ أَقْوَامٌ خَلاَقَهُمْ وَدِينَهُمْ بِعَرَضٍ مِنَ الدُّنْيَا “অনেক জাতি পার্থিব সম্পদের বিনিময়ে তাদের চরিত্র বিক্রি করে দিয়েছে।” (মুসনাদ আহমদ) মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি ও বিকাশে উত্তম চরিত্রের ভূমিকা অপরিসীম। কারণ মানুষের চরিত্র মাধুর্য অন্যের উপরে প্রভাব ফেলতে সহায়তা করে। রাসূল (সা) নৈতিক চরিত্র গঠন সম্পর্কে বলেন, أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا وَخِيَارُكُمْ خِيَارُكُمْ لِنِسَائِهِمْ “মু’মিনদের মধ্যে সর্বাধিক পূর্ণ ঈমানদার সেই ব্যক্তি যার নৈতিক চরিত্র তাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম। আর যে তার স্ত্রীর কাছে ভালো সে তোমাদের মধ্যে উত্তম।” (সূনান আত-তিরমিযি) রাসূল (সা) আরো বলেছেন, الْبِرُّ حُسْنُ الْخُلُقِ وَالإِثْمُ مَا حَاكَ فِى نَفْسِكَ وَكَرِهْتَ أَنْ يَطَّلِعَ عَلَيْهِ النَّاسُ “সদাচারই সচ্চরিত্র। আর পাপ তাই যা তোমাদের অন্তরে উদ্বেগের সৃষ্টি করে এবং তুমি অপছন্দ করো যে, মানুষ তা জেনে ফেলুক।” (সহীহ মুসলিম ) হযরত আলী (রা) তার পুত্রকে উপদেশ দিয়ে বলেন, “ওহে হুসাঈন! আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, তোমাকে আদব শিক্ষা দিচ্ছি; মন দিয়ে শোন! কারণ বুদ্ধিমান সেই যে শিষ্টাচারী হয়। তোমার স্নেহশীল পিতার আদেশ স্মরণে রাখবে, যিনি তোমাকে শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন। যাতে তোমার পদস্খলন না হয়। আমার প্রিয় ছেলে! জেনে রাখ, তোমার রুজি, রিযিক নির্ধারিত আছে। সুতরাং উপার্জন যাই করো সৎভাবে করবে। অর্থ-সম্পদ উপার্জনকে তোমার পেশা বানাবে না। বরং আল্লাহ ভীতিকেই তোমার উপার্জনের লক্ষ্য বানাবে।” (আদাবুল দাওয়াতি আল-ইসলামিয়্যাহ পৃ. ৩২) একজন সচ্চরিত্রবান লোক কোনদিন অনৈতিক কাজ করতে পারে না। আর এ জন্যই সমাজ থেকে অনৈতিক কর্মকা- দূর করতে হলে মানুষকে নৈতিক চরিত্রের গুণে গুণান্বিত হতে হবে। তাহলেই নৈতিক অবক্ষয় রোধ করে একটি সুন্দর সমাজ গঠন করা সম্ভব।

আখিরাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া মানুষের মৃত্যুর পরে আর একটা জীবন আছে যার নাম আখেরাত। মৃত্যুর পরে দুনিয়ার সকল কাজের হিসাব আখেরাতে আল্লাহর কাছে দিতে হবে। তাই দুনিয়াতে পথ চলার সময় আখেরাতের স্মরণ অন্তরে রেখে কাজ করতে হবে। এ জন্যই নৈতিক অবক্ষয় রোধ করতে হলে আখিরাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যারা আখিরাত পরিপন্থী কাজ করবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ সম্পর্কে রাসূল (সা) বলেছেন, مَنْ أَحَبَّ دُنْيَاهُ أَضَرَّ بِآخِرَتِهِ ، وَمَنْ أَحَبَّ آخِرَتَهُ أَضَرَّ بِدُنْيَاهُ “যে ব্যক্তি পার্থিব জগতকে বেশি ভালো বাসবে তার আখিরাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়া হবে। আর যে ব্যক্তি আখিরাতকে ভালো বাসবে তার দুনিয়ার জীবনকে (বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে) দুর্বিষহ করে দেয়া হবে।” (মুসনাদ আহমদ) রাসূল (সা) অন্যত্র বলেছেন, الدُّنْيَا سِجْنُ الْمُؤْمِنِ وَجَنَّةُ الْكَافِرِ “দুনিয়া মু’মিনদের জন্য জেলখানা আর কাফিরদের জন্য হলো বেহেশত খানা।”(সহীহ মুসলিম ) দুনিয়ায় কিভাবে জীবন-যাপন করতে হবে সে সম্পর্কে রাসূল (সা) বলেছেন, كُنْ فِي الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيبٌ ، أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ “তোমরা দুনিয়াতে গরিব এবং পর্যটকের মত থাকো।” (সহীহ আল-বুখারী), তিনি আরো বলেছেন, حُلْوَةُ الدُّنْيَا مُرَّةُ الآخِرَةِ ، وَمُرَّةُ الدُّنْيَا حُلْوَةُ الآخِرَةِ “দুনিয়ার মজা হলো আখিরাতের তিক্ততা আর দুনিয়ার তিক্ততা হলো আখিরাতের মজা।” (মুসনাদ আহমদ) যদি কোন মানুষ আখিরাতকে অগ্রাধিকার দেয় তার পক্ষে কোন অনৈতিক কাজ করা সম্ভব নয়। এজন্য আখিরাতের প্রত্যাশী মানুষ তৈরি করার মাধ্যমে সমাজ থেকে অনৈতিক কাজ দূর হবে এবং নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত হবে। এভাবেই সমাজ থেকে সকল প্রকার অনৈতিক-অসভ্য কাজ-কর্ম দূরীভূত হতে পারে।

রাসূল (সা)এর আদর্শ গ্রহণ করা রাসূল (সা) এর আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে পৃথিবীতে মানবিক মূল্যবোধ পূর্ণমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন, لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ “অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্ল¬াহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।” (সূরা আহযাব: ২১) রাসূল (সা)ই মানুষকে কিভাবে মানবিক হওয়া যায় তা শিখিয়েছেন। তাঁর জীবনের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত মানবতার কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন। আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, وَإِنَّ مُحَمَّدًا صلى الله عليه وسلم عَلَّمَ فَوَاتِحَ الْخَيْرِ وَخَوَاتِمَهُ “নিশ্চিতভাবে মুহাম্মদ (সা) কল্যাণের শুরু এবং শেষ দুটোই শিখিয়েছেন।” (সুনান আন-নাসায়ী ) একটি জাতিকে নৈতিক অবক্ষয় থেকে ফিরিয়ে উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করাতে হলে তার পূর্বশর্ত হিসেবে যে জিনিসটি প্রয়োজন, তা হলো সমাজের তথা ঐ জাতির লোকদের কুরআন ও সুন্নাহ তথা নৈতিক ও আদর্শিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। আল্লাহর ভয় ও আখেরাতে জবাবদিহিতার চেতনায় যার বিশ্বাস অবিচল তার দ্বারা অন্যায় বা অনৈতিক কোন কাজ হতে পারে না। এ জন্যই ইসলাম সর্বপ্রথম তাকওয়া তথা খোদাভীতি এবং নৈতিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেছে। আল্লাহ তা‘আলা মহানবী (সা) এর চারিত্রের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন, وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ “নিশ্চয়ই আপনি (হে রাসূল) মহান চরিত্রের অধিকারী।” (সূরা ক্বলাম: ৪) মহানবী (সা) ঘোষণা করেছেন, إِنَّمَا بُعِثْتُ لأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الأَخْلاَقِ “আমি উত্তম চরিত্র মাধুর্য এর পূর্ণতা সাধনের জন্য প্রেরিত হয়েছি।” (সুনান আল-বায়হাকী আল-কুবরা ) রাসূল (সা) আরো বলেছেন, أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا “মু’মিনগণের মধ্যে তিনিই পূর্ণ মু’মিন, যিনি নৈতিক চরিত্রের দিক থেকে তাদের মধ্যে সর্বোত্তম।” (সুনান আত-তিরমিযি) মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) মু’মিনদের চারিত্রিক উৎকর্ষতার জন্য কিছু বিষয় অর্জন এবং কিছু বিষয় বর্জনের শিক্ষা দিয়ে আদর্শ চরিত্রবান হওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছেন। নৈতিক দিক থেকে উন্নত করার মানসে অর্জনীয় গুণাবলীর মধ্যে রয়েছে- তাকওয়া বা খোদাভীতি, শোকর, সবর, আত্মসংযম, ক্ষমা, উদারতা, সত্যবাদিতা, বদান্যতা, নম্রতা, প্রজ্ঞা, সততা, মিতব্যয়িতা, আমানতদারিতা, অতিথিপরায়ণতা, ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা প্রভৃতি। তিনি নিজেও এ সকল গুণে গুণান্বিত ছিলেন এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সকলকে এ গুণাবলীসমূহ অর্জনে প্রেরণা দিয়েছেন। অপরদিকে বর্জনীয় বিষয় যেমন- গর্ব-অহংকার, কৃপণতা, অশ্লীলতা, কটুভাষায় গালি-গালাজ, গিবত, চোগলখোরি, ছিদ্রাণ্বেষণ, উপহাস, ক্রোধ, স্বার্থপরতা, লোভ, সংকীর্ণতা, আত্মপ্রীতি, আত্মপূজা, মিথ্যাবলা, অপবাদ, কুধারণা, ধোঁকা দেয়া, অপচয় এবং হিংসা-বিদ্বেষ প্রভৃতি। একল বর্জনীয় কাজ তিনি নিজে বর্জন করেছেন এবং সাহাবীদের বর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাই সমাজের মানুষদেরকে এসকল গ্রহণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে নৈতিক অবক্ষয় থেকে জাতিকে বাঁচানো সম্ভব।

শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, একটি সংস্কৃতি ও সভ্যতা। এ সভ্যতা বিকাশের মাধ্যমে সমাজ থেকে সকল প্রকার অন্যায়-অপকর্ম ও পাপাচার দূল করা সম্ভব। ইসলামের এই শিক্ষা ও আদর্শিক জ্ঞান চর্চার অভাবেই মানবতার মান-সম্মান আজ ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। মানবতার এই নৈতিক বিপর্যয় রোধের জন্য প্রয়োজন সমাজ উপযোগী ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণের। আল্লাহ তা‘আলা সকল নবী-রাসূলকেই মানুষকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য পাঠিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, كَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِنْكُمْ يَتْلُو عَلَيْكُمْ آيَاتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُمْ مَا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ “যেভাবে আমি তোমাদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি তোমাদের মধ্য থেকে, যে তোমাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে, তোমাদেরকে পবিত্র করে এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়। আর তোমাদেরকে শিক্ষা দেয় এমন কিছু যা তোমরা জানতে না।” (সূরা আল-বাকারা: ১৫১) শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ হলো নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধের অপরিহার্য উপাদান। কেননা এর মাধ্যমে মূল্যবোধভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে জ্ঞান ও অভিজ্ঞানকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুচারুরূপে সংরক্ষণ নিশ্চিত করা যায়। শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ব্যাপক বিশ্লেষণ, নিরন্তর গবেষণাভিত্তিক এবং জ্ঞান-অভিজ্ঞানের ভিত্তিতে হলে এর মাধ্যমে ব্যক্তির উন্নয়ন এবং নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব। এ সম্পর্কে আল্লাহ নির্দেশ করেছেন, اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ “পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহাদয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না।” (সূরা আলাক: ১-৫) উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে, সেই জ্ঞান চর্চা করো যে জ্ঞান মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে সাহায্য করে, যে জ্ঞান চর্চা আমাদেরকে মানবকল্যাণে উৎসাহিত করে এবং যে জ্ঞান চর্চা আমাদেরকে সৎ পথে চলতে প্রেরণা দিয়ে থাকে। মানবতার মুক্তির দিক নির্দেশনা দিয়ে মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, الر كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِ رَبِّهِمْ إِلَى صِرَاطِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ “আলিফ-লাম-রা; এই কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষকে তাদের রবের অনুমতিক্রমে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আন, পরাক্রমশালী সর্বপ্রশংসিতের পথের দিকে।” (সূরা ইবরাহিম: ১) উপরিউক্ত আয়াতগুলো দ্বারা বোঝা যায়, আল-কুরআনের শিক্ষা দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ পবিত্র কুরআনেই রয়েছে মানবজাতির কাক্সিক্ষত মুক্তির দিকনির্দেশনা। এ শিক্ষার মাধ্যমেই ইসলামী মূল্যবোধ জাগ্রত হবে। যার ফলে সমাজে থাকবে না কোন অশান্তি ও অনাচার। মানবহিতৈষী ও জনকল্যাণমূলক ধ্যান-ধারণার লালন নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে আমাদেরকে জনগণের মাঝে মানবহিতৈষী ও জনকল্যাণমূলক ধ্যান-ধারণার শিক্ষা দিতে হবে। সমাজের মানুষকে মানবতার কল্যাণে কাজ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। এ পৃথিবীতে যত বিপর্যয় হানাহানি, বিপদ-মুসিবত এসেছে এবং যত জাতি ধ্বংস হয়েছে, এর কারণই হচ্ছে মানুষের কর্ম-প্রক্রিয়া। আল্লাহ বলেন, وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ “আর তোমাদের প্রতি যে মুসিবত আপতিত হয়, তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল। আর অনেক কিছুই তিনি ক্ষমা করে দেন।” (সূরা আশ-শূ’রা: ৩০) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُمْ بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ “মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সমুদ্রে ফাসাদ প্রকাশ পায়। যার ফলে আল্লাহ তাদের কতিপয় কৃতকর্মের স্বাদ তাদেরকে আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।” (সূরা আর-রূম: ৪১) একদল মানুষ তার মন-মগজে লালিত চিন্তা-চেতনা, বোধ-বিশ্বাস দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে অপর একদল মানুষকে ধ্বংস করেছে। এটা এ জন্যই সম্ভব হয়েছে যে, তাদের চিন্তা-চেতনা ও দর্শনে উন্নত শিক্ষা ও মানবহিতৈষী ধ্যান-ধারণা ছিল অনুপস্থিত। তারা নিজেদেরকে পারিপার্শি¦ক সমাজ ও সভ্যতার মানুষের চেয়ে উন্নত ও শ্রেষ্ঠ ভেবেছে। আর সমাজ ও মানুষের স্বার্থ ও নিরাপত্তাকে ভেবেছে মূল্যহীন। এ অনৈতিক ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা মানুষের জীবনের সকল সুখ-শান্তি এবং নিরাপত্তাকে ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। পরিণামে তাদের এ অমানবিক আচরণের ফলে অন্য সমাজ ও জাতির অনিবার্য ধ্বংস ডেকে এনেছে। অপরপক্ষে যখন কোন সমাজের মানুষের মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, প্রেম-ভালোবাসা, দয়া, মায়া-মমতা জাগ্রত হয় তখন সে সমাজে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ জন্ম নেয় এবং এক পর্যায়ে সেখানে ক্রমোন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জিত হয়। তাদের মধ্যে পর্যায়ক্রমে কল্যাণকর, উন্নত, মানবতাবাদী চিন্তা-চেতনা, মানবহিতৈষী চেতনা গড়ে ওঠে। এভাবেই মানুষদেরকে সচেতন করার মাধ্যমে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব।

বিবেকসম্পন্ন মানুষ তৈরি করা আল্লাহ তাআলা প্রত্যেকটা মানুষকে বিবেক ও বুদ্ধি দিয়েছেন। যাতে মানুষ সে বিবেককে কাজে লাগিয়ে সমাজ সংস্কারে ভূমিকা রাখে। বিবেকহীন মানুষ পশুর সমতুল্য। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, إِنَّ شَرَّ الدَّوَابِّ عِنْدَ اللَّهِ الصُّمُّ الْبُكْمُ الَّذِينَ لَا يَعْقِلُونَ “নিশ্চয় আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম বিচরণশীল প্রাণী হচ্ছে বধির, বোবা, যারা তাদের বিবেককে কাজে লাগায় না।” (সূরা আনফাল: ২২) তাই বিবেককে কাজে লাগিয়ে সমাজের মানুষকে ‘বাস্তবভিত্তিক জীবনাচার’ শিক্ষা দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ বাস্তব জীবনাচারই মানস ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করতে পারে। ‘বাস্তবভিত্তিক জীবনাচার’ মানবতাকে সমাজ ও সভ্যতার সফলতার উচ্চ শিখরে আরোহণ ও স্থায়িত্ব লাভের অন্যতম উপায়। বিবেকসম্পন্ন মানুষ সব সময় মানুষ ও সমাজের কল্যাণে কাজ করে, তাই মানুষের বিবেক জাগ্রত করার মাধ্যমে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় থেকে মানবতাকে বাচানো সম্ভব।

সার্বজনীন জীবনদর্শন ও বৃহত্তর ঐক্য নৈতিক বিপর্যয় রোধের জন্য প্রয়োজন সে সভ্যতার সার্বজনীন জীবনদর্শন ও উদারতার ভিত্তিতে জাতির বৃহত্তর ঐক্য। আদর্শিক মতবাদের উদারনৈতিক চিন্তাধারা ও সার্বজনীনতার সুদৃঢ় ভিত্তির উপর সমাজ ও সভ্যতার স্থায়িত্ব নির্ভরশীল। আদর্শ উদার হলে সে সমাজ ও সভ্যতায় বিশ্বের প্রতিটি মানুষ ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি, স্থান, কাল, পাত্রভেদে সবাই সমভাবে মূল্যায়িত হবে। শুধু তাই নয়, আদর্শ উদার ও উন্নত হলে মানুষের পার্থিব ও পারলৌকিক সকল প্রয়োজন পূরণ হবে। ইসলামী খেলাফতের সময়কাল ও পরবর্তী সময়ে ইসলামী ভাবধারায় পরিচালিত রাষ্ট্রগুলোর সমাজব্যবস্থা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমাদের এ উপমহাদেশের মধ্যে ভারতবর্ষ মুসলমানরা শাসন করেছিলো ৮০০ বছর। এ সময়ের মধ্যে কোন অমুসলিম লাঞ্ছিত-অপমানিত হয়নি, বরং হিন্দু-মুসলিম এক সাথে বছরের পর বছর বসবাস করতে পেরেছে। এ সময় মুসলমানদের মধ্যে সার্বজনীন জীবনাদর্শ ও বৃহত্তর ঐক্য বিদ্যমান ছিলো। কোন সমাজ ও সভ্যতায় মানব মস্তিষ্কপ্রসূত মতবাদ বা আদর্শ কোনভাবেই মৌলিক দুর্বলতাকে অতিক্রম করতে পারে না। ফলে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে বিশ্বের মানুষের জন্য তা কল্যাণকর ও উপযোগী হতে পারে না। এ মতবাদের বিধি-বিধান ও দর্শন সার্বজনীনও হতে পারে না। বরং সমাজে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে এ মতবাদ ও আদর্শ পরস্পরবিরোধী বিভেদের সূত্রপাত ঘটায়। যেমন বর্তমান বিশে^ ইসরাইল ফিলিস্তিনের মুসলমানদেরকে নির্বিচারে হত্যা করছে, মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যের মুসলমানদেরকে অন্যায়ভাবে নির্যাতন করে হত্যা করছে এবং সে দেশ থেকে বের করে দিচ্ছে, ভারত তাদের বিভিন্ন রাজ্যের মুসলমানদেরকে হত্যা করছে। সম্প্রতি কাশ্মিরের মুসলমানদের অধিকার হরণ করে তাদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করছে। এসকল রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে সার্বজনীন জীবনাদর্শ ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, মানবতাবোধ অনুপস্থিত। তাই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, সমাজের মানুষকে অনৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে সার্বজনীন জীবনদর্শন গ্রহণ ও বৃহত্তর ঐক্য গঠনের চেষ্টা করা। উন্নত মানসিকতা ও নৈতিক মূল্যবোধ গঠনে আল্লাহর বিধান আল্লাহ তা‘আলা এই পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং তার সামগ্রিক কর্মকা- পরিচালনার জন্য জীবন বিধানও তিনিই দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ “হুকুম একমাত্র আল্লাহর।” (সূরা আনআম: ৫৭) আল্লাহ আরো বলেন, أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ “সৃষ্টি ও নির্দেশ তাঁরই।” (সূরা আল-আরাফ: ৫৪) আর ইসলাম হলো আল্লাহর মনোনীত একমাত্র জীবনবিধান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ “ইসলাম আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত জীবন ব্যবস্থা।” (সূরা আল-ইমরান: ১৯) এ পৃথিবীতে ইসলামের আবির্ভাব হয়েছিল মানবজীবনে এক অভিনব বিপ্লব সাধনের জন্য। মানুষকে সকল প্রকার কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে ইসলামী আদর্শ অনুযায়ী জীবন পরিচালনার জন্য। যে জীবনাচারের মাধ্যমে মানুষ প্রকৃত অর্থেই ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বলে দাবি করতে পারে। আর সে কারণেই তাকে উন্নত মানসিকতা ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন হতে হবে। একটি জাতিকে আদর্শ ও নৈতিকতার উন্নতির সুউচ্চ শিখরে আরোহণ করতে হলে যে জিনিসটি প্রয়োজন, তা হলো সমাজের তথা ঐ জাতির লোকদের কুরআন ও সুন্নাহ তথা নৈতিক ও আদর্শিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। আল্লাহর ভয় ও আখেরাতে জবাবদিহির চেতনা যার মধ্যে অবিচল থাকে, তার দ্বারা অন্যায় বা অনৈতিক কোন কাজ করা আদৌ সম্ভব নয়। এজন্যই ইসলাম সর্বপ্রথম নৈতিক শিক্ষা অর্জন করার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। এ দ্বীনের প্রবর্তক মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) তাঁর নিজ সম্পর্কে ঘোষণা করেন, بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ حُسْنَ الْأَخْلَاقِ “আমি উত্তম চরিত্র মাধুর্য এর পূর্ণতা সাধনের জন্য প্রেরিত হয়েছি।” (মুয়াত্তা, ইমাম মালেক)

আল-কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ নৈতিক মূল্যবোধের সংরক্ষণে আল-কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের বিকল্প কোন রাস্তা খোলা নেই। এই আল-কুরআনের অনুসরণের মাধ্যমেই মানবজাতির সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَى لِلْمُسْلِمِينَ “আর আমি তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছি প্রতিটি বিষয়ের স্পষ্ট বর্ণনা, হিদায়াত, রহমত ও মুসলিমদের জন্য সুসংবাদস্বরূপ।” (সূরা আন-নাহল: ৮৯) আল-কুরআন মানুষকে ভালো কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এর মাধ্যমেই সফলকাম হওয়া সম্ভব। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ارْكَعُوا وَاسْجُدُوا وَاعْبُدُوا رَبَّكُمْ وَافْعَلُوا الْخَيْرَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ “হে মু’মিনগণ, তোমরা রুকু কর, সিজদা কর, তোমাদের রবের ইবাদত কর এবং ভালো কাজ কর, আশা করা যায় তোমরা সফল হতে পারবে।” (সূরা হজ: ৭৭) এ আল-কুরআন ভাল কাজের নির্দেশ এবং সকল প্রকার খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিতে বলেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ “তোমরা হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।” (সূরা আলে ইমরান: ১১০) আল-কুরআনের নির্দেশিত আদেশ-নিষেধ যদি কেউ মেনে চলে তার পক্ষে কোন খারাপ কাজ করা সম্ভব নয়। এভাবে আল-কুরআনের সকল বিধি-বিধান, হুকুম-আহকাম মেনে চলার মাধ্যমে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব। উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, ইসলামের মৌলিক শিক্ষার অভাবে মানুষের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন, অর্থনৈতিক জীবন, সাংস্কৃতিক জীবনসহ সকল ক্ষেত্রে অনৈতিকতা, অমানবিকতা, পাশবিকতা, অন্যায়-অবিচারে পরিপূর্ণ। তাই আমাদের দায়িত্ব সমাজের সকল অন্যায়-অপকর্মের কুফল তুলে ধরে সমাজের মানুষদেরকে নৈতিকতার শিক্ষায় শিক্ষিত করার মাধ্যমে একটি সুখী সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলা। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: গবেষক ও বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির