post

পিছিয়ে পড়েছে কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা

আবুল কালাম আজাদ

২৮ মার্চ ২০১৬
কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা উন্নয়নের হাতিয়ার। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই মানুষকে সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য যথার্থ জ্ঞান দক্ষতা দিয়ে একজন যোগ্য কর্মী মানুষ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে ধাপে ধাপে গড়ে তোলা হয়। কারিগরি শিক্ষা যে দেশে যত উন্নত, সে দেশের অর্থনীতি ও মানুষের জীবন তত উন্নত। বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্ব। কারিগরি শিক্ষার বিকাশের মাধ্যমে এবং অত্যাধুুনিক বিষয়ে গবেষণা ও মেধার উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে মানুষ বিশ্বটাকে একটা ডিজিটাল গ্রামে পরিণত করেছে। এসব হয়েছে কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নের মাধ্যমে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও কারিগরি শিক্ষার বহুমুখী শিক্ষার মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে, সুপরিকল্পিতভাবে এগিয়ে চলেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাতীয় অর্থনীতি উন্নয়নের অনুঘটক হিসেবে আরেকটি বিষয় সামনে চলে এসেছে তা হলো- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। অপর পক্ষে শিক্ষা ও দক্ষতার মাধ্যমে জনসম্পদ গড়ে তুলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধশালী করা সম্ভব। বিশ্বব্যাপী আজ কারিগরি শিক্ষা প্রসার লাভ করেছে। সকল উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি শিক্ষার ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাপকতা খুবই লক্ষণীয়। আন্তর্জাতিক তথ্য সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাজ্য, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরে ১৭ থেকে ৫৮ শতাংশ মধ্যমস্তরের দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা হচ্ছে। ফলে এখানে মানুষের জীবনযাত্রার মানও নিচু, আয়ও কম। উন্নতবিশ্বে মধ্যমস্তরেও কারিগরি শিক্ষার শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর হার ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে এই হার ২ থেকে ৩ বা ৪ শতাংশ। এরপরও এই শিক্ষা এখনো অবহেলিত ও উপেক্ষিত। কারিগরি শিক্ষায় সরকারের বহুমুখী ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে এমনটি হচ্ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে সারাদেশের ভোকেশনাল ¯ু‹ল অ্যান্ড কলেজে ২ হাজার ২৭৩টি শিক্ষকের মধ্যে ১ হাজার ৯৪টি পদ শূন্য রয়েছে। আর ২ হাজার ২৭৫টি কর্মচারী পদের মধ্যে ৯৬৮টি পদ শূন্য আছে। দেশে সরকারি পলিটেকনিকের সংখ্যা ৫১ এবং বেসরকারি পলিটেকনিকের সংখ্যা বর্তমানে ৩৫০-এর কিছু বেশি রয়েছে। এ ছাড়া টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ রয়েছে ৬৪ এবং বেসরকারি ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট রয়েছে ২ হাজারের মতো। সংশ্লিষ্টদের মতে কারিগরি শিক্ষার প্রচার-প্রসার ও পাঠ্যক্রমে আধুনিকতার ছোঁয়া নেই। কারিগরি শিক্ষার প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে দূরদর্শিতার অভাব রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বাস্তবভিত্তিক কোন সুযোগ নেই। সরকার কারিগরি শিক্ষার নামে একের পর এক প্রকল্প গ্রহণ করছে। কিন্তু এসব প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণ ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না। নির্দিষ্ট মেয়াদের পর প্রকল্প সমাপ্ত হয় এবং শুধু রয়ে যায় ফাঁকা ভবন, কোন শিক্ষক কর্মচারী থাকেন না। ফলে শিক্ষার্থীরা পড়েন বিপাকে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় (১৩৬ কোটি টাকা) টেকনিকাল অ্যান্ড ভোকেশনাল এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং রিফর্ম নামে একটি প্রকল্প এবং বিশ্বব্যাংক সহায়তায় (৬৩৫ কোটি টাকা) সকল অ্যান্ড ট্রেনিং এনহেন্সমেন্ট নামে মোট তিনটা প্রকল্পের কাজ চলছে। এগুলোর আগে আরো কয়েকটি প্রকল্প শুরু হয়ে শেষ হয়ে গেছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে অধিকাংশই সফলভাবে শেষ হয়নি। বর্তমানে যে তিনটি প্রকল্পের কাজ চলছে, সে প্রকল্পগুলোও সফলভাবে শেষ হবে কি না তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে সরকার ১৯৯৭ সালে ১৮টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন প্রকল্পের কাজ হাতে নেয়। কিন্তু বর্তমানে ১৮টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে কোন শিক্ষক বা কর্মচারীর চাকরি নেই। বাংলাদেশ কারিগরি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম বলেন, শিক্ষাস্বল্পতা কাটিয়ে ওঠার জন্য টেম্পরারি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কারিগরি শিক্ষার মানকে আরো উন্নয়নের জন্য যে তিনটি প্রকল্পের কাজ চলছে, সেগুলোর মেয়াদ শেষ হলে অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে তা বোঝা যাবে। তিনি আরো বলেন, কারিগরি শিক্ষার শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে এ শিক্ষার গুণগত মান তেমন বাড়েনি তবে চেষ্টা চলছে। কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী দেশে মধ্যমস্তরের কারিগরি শিক্ষার মধ্যে রয়েছে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা ইন কৃষি, ডিপ্লোমা ইন মেরিন, ডিপ্লোমা ইন ফিশারিজসহ বিভিন্ন মেয়াদের বৃত্তিমূলক শিক্ষা। দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতায় ৫১টি সরকারি ডিপ্লোমা এবং ১৩ কৃষি প্রশিক্ষণ, ৬টি টেক্সটাইল, ১টি মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ২টি সার্ভে ইনস্টিটিউট রয়েছে। জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর অধীনে রয়েছে ৩৫টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, কারিগরি অধিদফতরের অধীনেও রয়েছে ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত প্রায় ৫৬.৮৬ লক্ষ জনশক্তি বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়েছে। শুধু ২০০৭ সালে আগের রের্কড ভঙ্গ করে ৮.৩৩ লক্ষ বাংলাদেশী নাগরিক কাজের সন্ধানে বিদেশে গিয়েছে, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ১১৮.২৪ ভাগ বেশি। দক্ষতার ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বৈদেশিক কর্মসংস্থানের মধ্যে ৪৮% জনশক্তি অদক্ষ, ১৫% জনশক্তি আধা-দক্ষ, ৩৩% দক্ষ আর ৪% পেশাজীবী। বৈদেশিক কর্মসংস্থান এখন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ক্ষেত্র। ২০১৩ সালে এই খাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে ১৬.১% বিলিয়ন ইউএস ডলার। আমাদের দেশের জনশক্তি মূলত মধ্যপ্রাচ্যÑ  সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত কাতার ওমান, জর্ডান এবং কিছু কিছু ইউরোপের ইতালি, আয়ারল্যান্ড, স্পেন প্রভৃতি দেশে গিয়ে থাকে। এসব দেশে জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো হচ্ছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম। এসব দেশের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আমাদের দেশের জনশক্তিকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় আরো প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ হতে হবে। তাহলে দেখা যাবে যে বৈদেশিক মুদ্রার আয় আরো অনেকগুণ বেড়ে যাবে। এ জন্য দরকার আরো কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারের সদিচ্ছা এবং বাস্তব কর্মপরিকল্পনা। বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনশক্তির পরিমাণ মাত্র শতকরা ৫-৬ ভাগ। মালয়েশিয়া, কোরিয়া, জার্মান ও জাপানে যথাক্রমে ১০, ১৬, ৫৮ ও ৬০ ভাগ। দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্রে বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা দিয়েছে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের প্রকৌশলীসহ প্রায় ২ লক্ষাধিক কারিগরি জনশক্তি পাস করে চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে। যদি কারিগরি জনশক্তির পরিমাণ ২০ ভাগে উন্নীত করা হয়, তবে প্রতি বছর প্রায় চল্লিশ হাজারের মতো মধ্যমস্তরের প্রকৌশলীসহ ৮ লক্ষাধিক কারিগরি জনশক্তি চাকরির বাজারে প্রবেশ করবে। কিন্তু দেশের আনুষ্ঠানিক কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে ২০২০ সালের মধ্যে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন আদৌ সম্ভব হবে কি? মৌলিকভাবে কারিগরি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার পাশাপাশি উপানুষ্ঠানিক পর্যায়ে সকল ক্ষেত্রে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে বিস্তৃত করলে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হতে পারে। এ দেশ এখন ডিজিটাল দেশ হিসেবে উন্নয়নের চরম উৎকর্ষ সাধন করছে। এই মুহূর্তে কারিগরি শিক্ষার যদি বেহাল দশা হয় তাহলে ডিজিটাল দেশ রূপায়ণ করবে কে? বাস্তব প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষাকে আরো ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি জনগণের আশা পূরণের জন্য বাস্তব কিছু কর্ম উদ্যোগ থাকতে হবে। যার মধ্য দিয়ে আগামী দিনে এ ধারার শিক্ষাই হবে সাধারণ মানুষের আশার স্থল। করণীয় দিকগুলো হলোÑ কারিগরি শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন : বর্তমান কারিগরি শিক্ষার গুণগত মান আশানুরূপ নয়। শিক্ষার যথাযথ মানোন্নয়নে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। বোর্ডের জনবলবৃদ্ধি : বর্তমানে বাংলাদেশ কারিগরি বোর্ডের অধীনে প্রায় ৫০০০-এরও বেশি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। সারাদেশে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা সুপারভিশন ও তদারকি করে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। কিন্তু যে পরিমাণ লোকবল বোর্ডে থাকার কথা তার চেয়ে অনেক কম। বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালে মোট প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে ১০২৪ ও ৬৬,৩২৮ এবং ২০০৬ সালে এর সংখ্যা দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩৮৫৯ ও ২,৬৫,০২৪। এতে দেখা যায় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৩.৭৫ গুণ এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৭-০৮ সালে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪১১১ এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩,৩৩৯৭৪ জন। ২০০৯-১০ সালে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪১১১ এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৯৯৭৮৮ জন। মৌলিক উপরোল্লিখিত তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ২০০০ সালের তুলনায় ৯-১০ সেশনে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪ ও ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু জনবল কাঠামো ১০১ জনের স্থলে বৃদ্ধি ঘটেনি, বা নতুন পদও সৃষ্টি হয়নি। ২০০৪ সালে বোর্ডের ১১৫তম সভায় বিভিন্ন ধরনের ৮০টি পদ অনুমোদন করলেও ২০০৯ সালে এসে তা ৩২টি পদ রাজস্ব খাতে অনুমোদন পাওয়া যায়, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। বর্তমানে বোর্ডের কাজ সচল রাখার জন্য চুক্তিভিত্তিক বা দৈনিক হাজিরা ভিত্তিক লোকবল দ্বারা কার্য সম্পাদন করা হচ্ছে। বোর্ডের স্পর্শকাতর ও গোপনীয় কাজ স্থায়ী কর্মকর্তা বা কর্মচারী দ্বারা সম্পাদন করা উচিত। তাতে নতুন পদ সৃষ্টি ও জনবল নিয়োগ করা অত্যন্ত জরুরি। অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের অভাব ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে এসএসসি (ভোকেশনাল) পর্যায়ে ৫০০টি এবং এইচএসসি (বিএম) পর্যায়ে ২০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল সহায়তা প্রদান করা হয়েছিল। পরবর্তীতে আর কোন প্রতিষ্ঠানকে কোনো প্রকার সহায়তা প্রদান করা হয়নি। কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ একটি ব্যয়বহুল কার্যক্রম। বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের জন্য সহায়তা প্রদান করা প্রয়োজন। সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ইইডি ভৌত অবকাঠামো সহায়তা ও মন্ত্রণালয় হতে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি গ্রন্থাগার উন্নয়নের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও অনুরূপভাবে সহায়তা প্রদান করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের যৌথ উদ্যোগ থাকলে সারাদেশের শিক্ষা বোর্ড ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আরো সুন্দর ও সুচারুভাবে পরিচালিত হবে বিশেষ করে ধারণা করছেন। মূলত সারাদেশে ডিজিটাল বাংলাদেশের নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। এ ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অবস্থা যদি এই হয় তাহলে দেশে অন্যান্য কারিগরি ও বৃত্তিমূলক কার্যক্রমের অবস্থা আরো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক প্রশিক্ষণ : বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে আধুনিক প্রশিক্ষণ বিশেষভাবে প্রয়োজন। বিশেষ করে বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগকৃত শিক্ষকদের মানোন্নয়ন ও শিক্ষাদানপদ্ধতির ওপর কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষাদানপদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান আবশ্যক। তা ছাড়া যুগের চাহিদানুসারে সিলেবাস আপডেট করা হলে নতুন বিষয়বস্তু সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হয়। নতুন সিলেবাস অনুযায়ী পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি। মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ : শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের নিমিত্তে যে সকল গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রয়োজন, তার মধ্যে সিলেবাস, বই-পুস্তক যন্ত্রপাতি, ভৌত অবকাঠামো, মূল্যায়নপদ্ধতি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। উপরোক্ত উপাদানগুলোর মধ্যে বই-পুস্তক ও যন্ত্রপাতি পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য উপাদান। ইতঃপূর্বে বোর্ড থেকে বাংলায় বিভিন্ন শিক্ষাক্রমের বই প্রকাশের পদক্ষেপ নেয়া হলেও বর্তমানে তেমন ইতিবাচক কার্যক্রম নেয়া হয় না, উদ্যোগ থাকলেও বাস্তবায়ন হয় না। বাস্তব কারণে সংশ্লিষ্ট অ্যাকাডেমি মানসম্মত পাঠ্য-পুস্তক সরবরাহ হতে বঞ্চিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো পদক্ষেপ ও উদ্যোগ না থাকার দরুন প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমেই পেছন দিকে হাঁটছে। এ ব্যাপারে বাজারে বিভিন্ন লেখক/ প্রকাশক কারিগরি ও বৃত্তিমূলক বিভিন্ন শিক্ষাক্রমের বিষয়ভিত্তিক গাইড/বই প্রণয়ন ও মুদ্রণ করে অবাধে বাজারজাত করছে। কিন্তু গাইড বইগুলো মানসম্পন্ন না হওয়ায় শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখার জন্য মানসম্পন্ন পাঠ্য-পুস্তক ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের জন্য অপরিহার্য। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযথভাবে এগিয়ে আসা দরকার। পরীক্ষা গ্রহণ ও ফলাফল প্রকাশ : বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন পরীক্ষা, নিয়োগপদ্ধতি, সময় বিভাজন, ফল প্রকাশ পদ্ধতিসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বহুবিধ সমস্যা বিরাজমান রয়েছে। একই বোর্ডের অধীনে একাধিক প্রতিষ্ঠানে এখনও পরীক্ষা অব্যাহত রয়েছে। সব জানলেও বিষয়টি ভীষণ খারাপ লাগার কথা। বোর্ডসূত্রে জানা গেছে, গত পর্ব সমাপনী (৮ম পর্ব) পরীক্ষার ১টি প্রশ্নেই মোটা অংকের টাকা গচ্চা দিতে হয়েছে বোর্ডকে। তা ছাড়া বর্তমান পরীক্ষাপদ্ধতিতে জোড়-বেজোড় ও ১ম হতে ৩য় পর্ব পর্যন্ত নিজস্ব ছাত্রদের মেধা বিকাশে প্রতিবন্ধকতা মনে হয়। তা ছাড়া সমাপনীতে ফল প্রকাশে ও জটিলতা সৃষ্টি হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আভিধানিক নীতিমালা থাকা দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মনিটরিং : বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের কোনো ভূমিকা বা সংশ্লিষ্টতা নেই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সুষ্ঠু পরিচালনা ও সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের সংশ্লিষ্টতা প্রয়োজন। কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক অধিদফতর এবং বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ে নিয়মিতভাবে মনিটরিং করা সময়ের একান্ত দাবি। গবেষণা সেল : বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সাথে দেশের লক্ষ লক্ষ মেধার সম্পৃক্ততা রয়েছে। যে মেধাকে লালন করার জন্য এবং আগামী দিনে তাদের দিয়ে দেশ ও জাতির সঠিক নির্দেশনার জন্য কিভাবে কী করবে তার সমাধান দেবে একমাত্র গবেষণা সেল। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আজও কোনো গবেষণা সেল প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। গবেষণা সেল থাকলে বোর্ডকে সামনের দিকে সফলভাবে সহজে নেয়া সম্ভব বলে গবেষক ও শিক্ষাবিদরা মনে করেন। সর্বোপরি বাংলাদেশের এই পরিস্থিতিতে কারিগরি শিক্ষাকে আরো সুন্দর সুচারু ও গোছালোভাবে পরিচালনা করা দরকার। সেটা একান্ত দেশ জাতির স্বার্থেই। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলকে যথাযথভাবে এগিয়ে আসা দরকার। লেখক : কলাম লেখক, গবেষক ও কলেজ অধ্যক্ষ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির